গল্পের ম্যাজিক:: কুকুর কীভাবে মানুষের বন্ধু হল - রাখি পুরকায়স্থ


কুকুর কীভাবে মানুষের বন্ধু হল
রাখি পুরকায়স্থ

আহা! সেসব দিনগুলি ছিল সত্যি বড়ো সুখের। পশুরা তখন মিলেমিশে শান্তিতে বাস করত এক ঘন সবুজ বনে সেই বনে হরেকরকমের জিনিস বিকিকিনি করবার জন্য ঠিক মানুষের মতোই মেলার আয়োজন করত পশুরাভয় (বন) অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মেলার আয়োজন করা হতমেলাগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মেলাটি ছিল ‘কা লেও লুরি লুরা’ (লুরি লুরা মেলা)সেই মেলায় সামিল হত বনের সকল পশু। মেলায় বিক্রি করবার জন্য পশুগুলি তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসত রকমারি পণ্যআসলে সেই জঙ্গলের ফরমান অনুযায়ী, মেলায় উপস্থিত থাকতে চাইলে প্রতিটি পশুকেই বাধ্যতামূলকভাবে সঙ্গে আনতে হবে এমন এক জিনিস যা মেলাতে বিক্রি করবার যোগ্য বৃ্দ্ধ হোক কি যুবা, ধনী হোক বা দরিদ্র – কেউ যেন খালি হাতে মেলায় না আসে, এটাই ছিল সেই জঙ্গলের আইন। সেই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে মেলা পরিচালনার জন্য একটি মেলা পরিচালন সমিতি গঠন করে ইউ খ্‌লা নামে এক বাঘকে সেই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল আসলে মেলার জনপ্রিয়তা বাড়াবার উদ্দেশ্যে পশুরা সবাই মিলে এমন সাধু উদ্যোগ নিয়েছিল।
মানুষদের চিরকালই চরম শত্রু বলে মনে করে বনের সকল পশু। আর শত্রু মনে করবে নাই বা কেন? মানুষেরা তো তীরধনুক দিয়ে নির্বিচারে পশুশিকার করে বেড়ায় আর সে কারণেই মানুষদের সঙ্গে পশুদের বন্ধুত্বপূর্ণ মেলামেশার পরিবেশ কখনওই গড়ে ওঠেনি। মানুষদের তাই এই মেলাগুলি থেকে জেনেশুনেই দূরে রাখে পশুর দল কিন্তু একদিন জঙ্গলের সব নিয়মকে পালটে দিল এক কুকুরসে তার জ্ঞাতিভাইদের চমকে দিয়ে জঙ্গল ছেড়ে চলে গেল চিরশত্রু মানুষের কাছে। চিরকালের জন্য সে হয়ে গেল মানুষের পরম বন্ধু! এমন আশ্চর্য ঘটনা কী করে ঘটল তা জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এই মজাদার গল্পখানা

একদিন উ সেও নামে একটি কুকুর মেলায় বিক্রি করবার মতন পছন্দসই জিনিসের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিল। অন্যান্য পশুরা খুব সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী তারা নিজেরাই তাদের পণ্যদ্রব্য তৈরী করে কিন্তু কুকুরটি খুবই কুঁড়ে প্রকৃতির। তার কাজকর্ম করতে মোটেই ভালো লাগে না। এদিকে মেলায় যাবার ইচ্ছেও তার প্রবল কিন্তু শূন্য হাতে মেলায় গেলে জুটবে শুধু প্রতিবেশী পশুদের তিরস্কার আর মেলার সভাপতির কঠিন শাস্তি। এসব বিপদের হাত থেকে বাঁচতে সে এক নতুন উপায় আবিষ্কার করলজঙ্গল ছেড়ে সে রওনা দিল নতুন দেশেসেখানে সে খুঁজবে এমন একখানা তৈরি-জিনিস যা কিনা বিনা পরিশ্রমেই যোগাড় করে মেলায় বিক্রি করা যায় সারাদিন সে তাই বিদেশ-বিভুঁইয়ে ক্লান্ত শরীরে হেঁটে ঘুরতে লাগলপথে পড়ল অনেক গ্রাম। প্রতিটি গ্রামে সে অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে খুঁজতে লাগল মেলায় বিক্রি করবার মতন বস্তু ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে এল সন্ধে সূর্য পাটে যেতেই কুকুরটি মহা চিন্তায় পড়ে গেল সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে সে একটিও উপযুক্ত জিনিস কিনতে সক্ষম হয়নি। ক্রমশ তার মনে একটি আশঙ্কা দানা বাঁধতে লাগল - তাকে হয়তো শেষমেশ মেলায় যাবার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হবে।
সূর্য যখন সবে অস্ত গিয়েছে, কুকুরটি তখন শিলং পাহাড়ের ঢালে সাদ্দেও গ্রামের উপকন্ঠে এসে পৌঁছোল। তার নাকে ভেসে এল এক আজব জোরালো গন্ধ। তার মনে হল, এমন গন্ধ রান্না করা খাবার থেকেই আসা সম্ভবদীর্ঘ পথশ্রমের পর সে তখন ভীষণ ক্ষুধার্ত। গন্ধ অনুসরণ করে সে এসে পৌঁছোল গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে একটি কাঠের বাড়ির সামনে। বাড়ির বাসিন্দারা তখন রাতের আহার করতে ব্যস্ত ছিলেন। সেই পরিবারের সদস্যদের হাবভাব দেখে কুকুরটির মনে হল, তাঁরা খুব সুস্বাদু একটি ব্যঞ্জন দিয়ে আহার করছেনআসলে মাটির পাত্রে খাসি বরবটিকে গেঁজিয়ে প্রস্তুত করা হয় এক বিশেষ খাবার ‘তুং রিমবাই’, আর তা দিয়েই পরিবারটির সকলে তৃপ্তি সহকারে আহার করছিলেন সেই বিশেষ রান্নার পদ থেকেই তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল।
খাসি জনজাতির মানুষেরা প্রকৃতিগতভাবেই খুব আন্তরিক ও অতিথিপরায়ণ। তাই সেই পরিবারের গৃহকর্ত্রী যখন দেখতে পেলেন বাইরে থেকে একটি কুকুর সতৃষ্ণ নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তিনি বুঝতে পারলেন সে বড়ো ক্ষুধার্ত। ঘরের সকলের খাওয়ার পর একটি মাটির পাত্রে রাখা ছিল অবশিষ্ট খাবার। কুকুরটিকে ঘরের ভেতর আহ্বান করে গৃহকর্ত্রী সেই সামান্য খাদ্যটুকু তুলে দিলেন কুকুরের সামনে। অশেষ কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল উ সেওপ্রচন্ড ক্ষুধায় কাহিল উ সেও একটুও সময় নষ্ট না করে গোগ্রাসে সবটুকু খাবার গিলতে লাগল খাবারের কটু গন্ধ বা স্বাদ সে খেয়াল করতে পারল না মোটেই। একপেট খিদের মাঝে খাবারটি খুব সুস্বাদু বলেই মনে হল তার
পেট পুরে খাওয়া শেষ হতেই কুকুরটির মাথায় খেলে গেল এক নতুন বুদ্ধি। যার খোঁজে বিদেশ-বিভূঁইয়ে এত কষ্ট সহ্য করে ঘুরে বেড়ানো, আকস্মিকভাবে সে খুঁজে পেয়েছে সেই বস্তু – মেলায় বিক্রি করবার যোগ্য এক অভিনব খাদ্যএবার তাকে লুরি লুরা মেলায় অংশ নেওয়া থেকে আটকাবার সাধ্য নেই কারও! সৌভাগ্যবশত সেই দয়ালু পরিবারটির কাছে বিক্রির জন্য প্রস্তুত তুং রিমবাই বেশ বেশি পরিমাণে ছিল। তাঁরা এক বিশেষ আকৃতির মাটির পাত্রে খাদ্যটি রেখে পাত্রের মুখ মাটি দিয়ে আটকে খাদ্যটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন এতে নাকি খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকে। সামান্য দর কষাকষির পর উ সেও একটি বেশ বড়সড় আকৃতির তুং রিমবাইভরা পাত্রের মালিক বনে গেল। খুশি মনে সেই পাত্রখানা ঘাড়ে ফেলে সে ফিরে চলল জঙ্গলেপাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে সে যেতে লাগল লুরি লুরা মেলা প্রাঙ্গণের দিকে। তখন তার প্রাণে যেন আর আনন্দ ধরে না। এবারকার মেলায় নিশ্চিতভাবে সেই হবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কিংবা মেলায় এই নতুন খাবারটি বিক্রি করে নিশ্চয়ই প্রচুর লাভ হবে কিংবা এত উদ্যমী হবার কারণে কতই না প্রশংসা কুড়োবে সে – এসব সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে আপন মনে হাসতে লাগল উ সেও
পথে আরও অনেক পশুর সঙ্গে উ সেওয়ের দেখা হলসকলেই যাচ্ছে লুরি লুরা মেলায় সওদা করতে। তাদের সকলের পিঠেই রকমারি পণ্যসামগ্রী। পথচলতি সকল পশুদের কাছে উ সেও তার পিঠে চাপানো মাটির পাত্রে ভরা চমৎকার খাবারটির গল্প বড়াই করে শোনাতে লাগলগলা চড়িয়ে সে সবাইকে বলতে লাগল, আশ্চর্য এ খাবার আবিষ্কারের কৃতিত্ব কেবল তার একারউ সেও এ ব্যাপারে এত বেশি কথা বলছিল যে সেই মাটির পাত্রে ভরা বিশেষ খাদ্যের খবর চারদিকে দাবানলের মতো হু হু করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং খুব তাড়াতাড়ি তা সকল প্রাণীদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল এতে অবশ্য অবাক হবার কিছুই নেই এমনটা তো হবারই কথা লুরি লুরা মেলায় এমন অদ্ভুত খাদ্যবস্তুর কথা কেউ কোনও কালে শুনেছে বলে তো মনে পড়ে না!
লুরি লুরা মেলায় পৌঁছে গর্বিত উ সেও মেলার ঠিক মাঝখানে মাটির পাত্রখানা নামিয়ে বেশ ঘটা করে জমিয়ে বসে পড়লসেখানে বসেই সে উচ্চৈঃস্বরে হাঁকতে লাগল, “আসুন, আসু্ন, কিনে নিয়ে যান আমার আশ্চর্য খাবার
এমনিতেই মেলায় আসবার পথে অনেকে জেনে গিয়েছিল সেই আজব খাবারের কথা। তারপর যখন মেলার মধ্যিখানে চিলচিৎকার দিয়ে হেঁকে উ সেও তুমুল হইচই বাঁধিয়ে ফেলল, তখন আস্তে আস্তে অন্যান্য পশুরা চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ভিড় জমাতে লাগল বহু আলোচিত সেই আশ্চর্য খাদ্যবস্তু দেখবার কৌতূহলে তখন ফেটে পড়ছে চারপাশ প্রবল ভিড়ের ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে প্রত্যেকেই তখন গলা বাড়িয়ে সেই অদ্ভুত আকৃতির মাটির পাত্রটি একঝলক দেখবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল
মুখে ভীষণ গাম্ভীর্য এঁটে উ সেও এবার মাটির পাত্রের ঢাকা খুলতে উদ্যত হল। কিন্তু যেমনি সে পাত্রের মুখে আটকানো মাটির প্রলেপ ভেঙেছে, অমনি সকলকে হতবাক করে দিয়ে পাত্র থেকে বেরিয়ে এল এক অসহ্য বিকট দুর্গন্ধ। আচমকা সেই উৎকট গন্ধে ভরা বাতাসের ধাক্কায় পশুর পাল যেন একপ্রকার উড়ে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে জড়ো হল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য সব চুপচাপ। তবে সে তো ক্ষণিকের বিহ্বলতা! শীঘ্রই সেই বিস্ময় কাটিয়ে পশুরা উল্লাসে ফেটে পড়লতারা উ সেওকে যাচ্ছেতাইভাবে টিটকারি দিতে লাগলতাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলসাথে চলতে থাকল বিষম ব্যঙ্গবিদ্রূপ। লজ্জায় উ সেওয়ের মাথা কাটা গেলনিরুপায় উ সেও কী করে! সে মাথা নামিয়ে চুপচাপ সব অপমান সহ্য করতে লাগল
এবার সকলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে এগিয়ে এল হরিণ। তার সব রোষ গিয়ে পড়ল মাটির পাত্রটির ওপর। পাত্রটি সম্পূর্ণভাবে না ভাঙা পর্যন্ত সে তীব্র ঘৃণাভরে মাটির পাত্রটিতে লাথি মারতে লাগলশেষমেশ পাত্র ভেঙে তুং রিমবাই ছড়িয়ে পড়ল ধূলায়। বাকি পশুরা এসব দেখে খুব মজা পেলতাদের হাসাহাসি-ব্যঙ্গবিদ্রূপের পরিমাণ এতে যেন আরও বেড়ে গেল। অসহায় উ সেও গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করতে লাগলকিন্তু কে তার কথা শোনে? সবাই তখন আনন্দে মশগুলআস্তে আস্তে বাকি পশুরাও এগিয়ে এল। ধূলায় ছড়িয়ে পড়া তুং রিমবাই তুমুল হট্টগোল করে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিতে লাগল সকলে মিলে, যেন এতেই উ সেওকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। শেষমেশ উ সেওয়ের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এমন অন্যায় ব্যবহার সে আর মেনে নিতে পারছিল না। উপায়ান্তর না দেখে মেলা পরিচালন সমিতির সভাপতি উ খ্‌লা নামে বাঘের দরবারে হাজির হল সে ন্যায় বিচারের আশায়। কিন্তু হায়! উপহাস ও অপমান এখানেও তার পিছু ছাড়ল না মোটেই। উ খ্‌লা বেশ কড়াভাবে বুঝিয়ে দিল, উ সেওয়ের সাথে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তা সবই তার প্রাপ্য ছিল। মেলা প্রাঙ্গণে এমন আজব বস্তু বয়ে এনে চারপাশ দুর্গন্ধে ভরিয়ে তোলা খুবই অন্যায় কাজ, আর উ সেও স্পষ্টতই সেই মহাদোষে দুষ্ট!
রাগে, দুঃখে, অপমানে বেচারা উ সেও তক্ষুনি মেলা ছেড়ে চলে গেল। না, কেবলমাত্র মেলা ছেড়ে গিয়েই সে শান্তি পেল না। সে ঠিক করল, এমন নিষ্ঠুর জ্ঞাতিভাইদের থেকে সে বহুদূরে চলে যাবে। লুরি লুরা মেলায় সে আর আসবে না কখনও। তাই জঙ্গলকে চিরতরে ত্যাগ করে সে বেড়িয়ে পড়ল একটি সুখী আশ্রয়ের আশায়। ঘুরতে ঘুরতে সে আবার এসে হাজির হল সাদ্দেও গ্রামের সেই দয়ালু পরিবারের বাড়িটির সামনে, যাদের কাছ থেকে সে তুং রিমবাই কিনেছিল। উ সেওয়ের দুর্ভোগের কাহিনি শুনে বাড়ির মালিকের মনে বড়ো করুণা হল তার প্রতি। তিনি নিজের হাতে বহু যত্নে তুং রিমবাই প্রস্তুত করেছিলেনতাই তাঁর মনে হল, উ সেওয়ের অপমান যেন তাঁর নিজেরই অপমান। উ সেওয়ের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সে যেন সাদ্দেও গ্রামে তাঁর পরিবারের সাথেই থেকে যায়, আর কোথাও যাবার দরকার নেই তার। সেই সঙ্গে তিনি উ সেওকে আশ্বস্ত করলেন, যে কোনও অবস্থায় তিনি তাকে রক্ষা করবেন এবং তার ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করবেন
কুকুর পাকাপাকিভাবে লোকসমাজে আশ্রয় নেবার পর মানুষ খুব সফল শিকারি হয়ে উঠলসেই যে লুরি লুরা মেলায় অন্যান্য পশুগুলি পা দিয়ে তুং রিমবাই মাড়িয়ে খুব আনন্দ লুটেছিল, তাদের পা থেকে কিন্তু তুং রিমবাইয়ের উৎকট গন্ধ একটুও ছাড়েনি। এখন মানুষ যখন শিকারে যায় তখন কুকুর সবসময় তাঁদের সঙ্গে থাকে আর অন্য সকল পশুদের পায়ে লেগে থাকা তুং রিমবাইয়ের গন্ধ শুঁকে বহুদূর থেকে অতি সহজেই পশুদের অনুসরণ করতে সক্ষম হয় এভাবেই কুকুর এখন মানুষকে পশু শিকারে সাহায্য করে। স্বাভাবিকভাবেই বনের অন্যান্য পশুদের দিন কাটে অনুতাপ করে। কী কুক্ষণেই যে তারা লুরি লুরা মেলায় উ সেওকে নিয়ে নির্বোধের মতো ঠাট্টা-তামাশা করেছিল! এখন কীভাবে পায়ের সেই দুর্গন্ধ ছাড়াবে তা ভেবে ভেবে তারা কুলকিনারা পায় না
মানুষ স্বভাবতই নানান কাজে ব্যস্ত থাকে। সবসময় তার পক্ষে বিদেশ-বিভূঁইয়ে শিকারে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু মাংসের যোগান আসবে কোথা থেকে? সেই সমস্যা মেটাতে মানুষ গ্রামে শূকরপালন করা শুরু করে, যাতে সারাবছরই মাংসের যোগানে বিঘ্ন না ঘটে। কুকুর মানুষের সঙ্গে থাকতে আসার অনেক আগে থেকেই শূকর মনুষ্যসমাজে স্থান পেয়েছিল। তাই গ্রামে আসার পর উ সেও নামে কুকুরটি উ স্নিয়াং নামে একটি শূকরের সঙ্গে বাসস্থান ও খাবার ভাগ করে নিতে লাগল মালিকের আশ্রয়ে গৃহপালিত প্রাণীদুটির জীবন ছিল আগাগোড়া আলস্যে ভরাএভাবেই মানুষের অনুগ্রহে তাদের দু’জনের নিস্তরঙ্গ জীবন হু হু করে কেটে যাচ্ছিল।
সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একদিন সন্ধেবেলা চাষের ক্ষেত থেকে ফেরবার পথে বাড়ির মালিকের নজর পড়ল গৃহপালিত প্রাণীদুটির ওপরএক অভিনব ভাবনা ঘিরে ধরল তাঁকে। তিনি মনে মনে বললেন, ‘ইস! আমি কী ভীষণ মূর্খ। এমন দুটি হৃষ্টপুষ্ট প্রাণী বাড়িতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, আর আমি কিনা দিনরাত এক করে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছি! পেট পুরে খেতে দেবার বিনিময়ে এদের উচিত আমাকে চাষের কাজে সাহায্য করা
যেমন ভাবনা ঠিক তেমন কাজ। পরদিন সকালে বাড়ির মালিক কুকুর ও শূকরকে জমিতে গিয়ে চাষ করতে হুকুম দিলেন। জমিতে এসে উ স্নিয়াং মালিকের আদেশ মেনে তার তুন্ড দিয়ে গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। দিনশেষে দেখা গেল জমির বেশ খানিকটা অংশ সে চাষযোগ্য করে তুলতে পেরেছে। উ সেও অত্যন্ত কুঁড়ে। কায়িক শ্রম দিতে সে মোটেই আগ্রহী নয়। যথারীতি সে সারাদিন কোনও কাজ করল না। আয়েশ করে গাছের ছায়ায় গড়িয়ে আর মাছি তাড়িয়ে তার সারাটা দিন দিব্যি কেটে গেল। সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার সময় হলে কুকুরটি হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এক আশ্চর্য কান্ড শুরু করলচাষের জন্য প্রস্তুত জমির অংশটিতে এদিক সেদিক দৌড়তে শুরু করল সে। কুকুরের এসব কান্ড দেখে শূকর তো রেগে আগুন
এভাবেই দিনের পর দিন চলতে লাগলতবে একদিন শূকরের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এক সন্ধ্যায় জমি থেকে ফিরে মালিকের কাছে কুকুরের অন্যায় আচরণের কথা নালিশ করল সে। কুকুর কীভাবে কুঁড়েমি করে দিন কাটাচ্ছে এবং সমস্ত কাজ যে সে একাই করতে বাধ্য হচ্ছে – সবই মালিককে জানাল শূকর।
মালিক কিন্তু উ সেওয়ের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বিশ্বাস করতে পারলেন না। শিকারের সময় তিনি উ সেওয়ের মধ্যে এক সক্রিয় সাহায্যকারীকে খুঁজে পেয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা বিচার করতে তিনি তাই জমিতে এসে হাজির হলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন জমির মাটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে উ সেওয়ের পায়ের ছাপ। উ স্নিয়াংয়ের পায়ের ছাপ প্রায় নেই বললেই চলে! উ স্নিয়াংয়ের ওপর তিনি যথারীতি প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হলেন এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তে নিলেন, উ স্নিয়াং তার বন্ধু উ সেওয়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।
বাড়িতে ফিরে মালিক দুটি পশুকে ডেকে পাঠালেনভীষণ রেগেমেগে তিনি হুকুম জারি করলেন, বন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনবার শাস্তি স্বরূপ উ স্নিয়াং এখন থেকে একটি ছোটো খোঁয়াড়ে একা একা থাকবে আর বাড়ির সকল সদস্য খাবার পর থালায় পড়ে থাকা খাবার দিয়ে আহার করবেকিন্তু উ সেওকে মালিকের পরিবারে বিশেষ স্থান দেওয়া হবে সে মালিকের বাড়িতেই পরিবারের সকল সদস্যদের সঙ্গে একত্রে বাস করবে এবং মালিকের পরিবারের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাবে
এভাবেই বনের কুকুর লোকসমাজে এসে মানুষের পরম বন্ধু হয়ে উঠলআজও মানুষ ও কুকুর পরস্পরের পাশে থেকে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে
_____
খাসি জনজাতিদের লোককথার পুনর্কথন; গল্পের উৎসঃ ‘How the Dog Came to live with Man’ from ‘Folk-Tales of the Khasis’ by Mrs. K. U. Rafy.

অলঙ্করণঃ শ্রীময় দাশ

1 comment:

  1. দারুণ। এমন ভিনরাজ্যের বা ভিনদেশের লোককথার অনুবাদ আরও পড়ার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete