অন্য সময়ে
তরঙ্গ ব্যানার্জী
সমস্বরে সকলের উল্লাসের
অভিব্যক্তির ফলে গমগম করে ওঠে আয়তনে প্রকাণ্ড হলঘরটা।
শোনা যায় হাততালির শব্দ। ইংরাজিতে বিভিন্নরকম স্বস্তিমূলক মন্তব্য কানে আসে।
রিসার্চ রুমের একশো বাইশজন এইমুহূর্তে বেজায় আনন্দিত। আজ, ২০৩০ সালের ৭ই জুন সার্থক
হয়েছে বৈজ্ঞানিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। আবিষ্কার হয়েছে টাইম ট্রাভেলিং মেশিনের। সৃষ্টি
হয়েছে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের।
শন ওয়াইল্ডকে দেখা যায় সায়েন্টিস্টদের
সঙ্গে হাই-ফাইভ করতে। নাসার টাইম
ট্রাভেলিং রিসার্চ সেন্টারের লিড সাইন্টিস্ট সে। সুস্ময়ও আনন্দিত এইসময়। তবে তার
আনন্দের পরিমাণ কয়েকশো গুণ বেশি হতেই পারত। এক বিশেষ ঘটনার ফলে তা আর হয়নি।
মুহূর্তেই একের পর এক নিউজ
চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিকরা মেশিন এবং টাইম ট্রাভেল নিয়ে
আলোচনা করতে থাকেন সানন্দে। সুস্ময়কে ইন্ডিয়ান অরিজিনের দেখে এক বাংলা নিউজ চ্যানেলের
রিপোর্টার চলে আসে ওর কাছে। এই সাফল্য নিয়ে ডিটেলে কিছু বলতে অনুরোধ করে। অনেকদিন
পর বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করে না সুস্ময়। সে বলতে থাকে, “ইট ইজ মাই
অনার বিয়িং ইনভলভড অ্যাজ আ প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট ইন দিস গ্রেট ভিক্টরি ইভেন্ট।
আমরা সবাই জানি স্পেস ট্র্যাভেল, ইন্টারস্টেলার ট্র্যাভেল, ইন্টারপ্ল্যানেটরি
ট্র্যাভেলের পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে টাইম ট্র্যাভেলের উপর কাজ শুরু করে নাসা।
অফকোর্স আমাদের কাজের ফাউন্ডেশান ছিল আইনস্টাইনের ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’। ওয়ার্ম হোল
কনসেপ্ট সেখান থেকেই। উই নো, ওয়ার্ম হোলের কাজ স্পেস-টাইমে দুটো আলাদা সময়কে লিঙ্ক
করা। সো আমাদের টার্গেট ছিল এমন একটা মেশিন তৈরি করবার যেটা রিঙ্কেলস আইডেন্টিফাই
করতে পারে। কারণ, ছিদ্র অথবা রিঙ্কেলস রয়েছে সব জায়গায়, এমনকি টাইমেও। কোয়ান্টাম
ফোমের অন্তর্ভুক্ত এই রিঙ্কেলসগুলোই হল একেকটা ওয়ার্ম হোল। বাট দ্য প্রবলেম ওয়াজ...”
সুস্ময় থেমে যায় হঠাৎ। তার
চোখ স্থির হয়ে যায় এক দৃশ্যে। মিডিয়া, সায়েন্টিস্ট, স্টাফদের ভিড়ের মাঝে একটা উঁচু
জায়গায় হাতে মাইক নিয়ে শন ওয়াইল্ড কথা বলে চলেছে উচ্চস্বরে, “আই, আই মেড দিস
হ্যাপেন। ইট ইজ মি, গাইস!”
পাশেই রাখা শ্যাম্পেনের বোতল
খুলে সেলিব্রেট করতে দেখা যায় তাকে। কথাগুলো বিষাক্ত তিরের ফলার মতো বিঁধছিল
সুস্ময়ের বুকে। বাকিরা হাততালি দিয়ে চিয়ার করে চলেছে। সমস্ত
ক্যামেরার লেন্সে এখন শনের ক্লোজ-আপ। নিজের অবদান
সম্পর্কে নাগাড়ে বলে চলেছে শন। নির্বিকারভাবে সুস্ময় শুনে চলে সবকথা। মাথার
ভেতরে ওর অনেককিছু চললেও মুখে কিছু বলে না।
একসময় থামে শন। হাসতে হাসতে ড্রিঙ্কস
নিয়ে কিছু বন্ধুবান্ধব সমেত ভিড়ে হারিয়ে যায়। বাঙালি
নিউজ রিপোর্টার আবার সুস্ময়ের দিকে মন দেয়, “ইয়েস মিঃ রায়চৌধুরী, প্লিজ কন্টিনিউ।”
সুস্ময় কী নিয়ে কথা বলছিল
ভেবে নিয়ে আবার শুরু করে, “হ্যাঁ, তো ওয়ার্ম হোল খুঁজে পাওয়া গেলেও আওয়ার প্রবলেম
ওয়াজ দ্য সাইজ। মলিকিউলসের থেকেও ছোটো ওয়ার্ম হোল দিয়ে মানুষ টাইম ট্র্যাভেল করতে
পারবে না কখনওই। সো উই হ্যাড টু এনলার্জ ইট। তারপর
আমরা মেশিনের স্পিড নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করি। ‘অ্যাপোলো ১০’ – যা মানুষচালিত
সর্বাধিক গতিবেগসম্পন্ন যন্ত্র, স্পীড ২৫০০০ মাইলস পার আওয়ার। ফর টাইম ট্র্যাভেল
উই নিডেড অ্যাট লিস্ট টু থাউজেন্ড টাইমস অফ দ্যাট স্পীড। ইনিশিয়ালি উই মেড ইট
হ্যাপেন। অ্যান্ড টুডে, উই আর উইটনেসিং হিস্ট্রি। থ্যাঙ্ক
ইউ সো মাচ!”
আর কথা বলতে ভালো লাগছিল না
সুস্ময়ের। রিপোর্টার ওকে মেশিন সম্পর্কে আরও কিছু বলতে অনুরোধ করে। একজন ইয়াং আফ্রিকান-আমেরিকান
স্টাফকে দেখিয়ে সুস্ময় বলে বাকি সমস্ত ইনফর্মেশন সে পেয়ে যাবে তার থেকে। রিপোর্টার
তাই করে। এগিয়ে যায় ছেলেটার দিকে। সুস্ময় নিজের কাজে রওনা দেয়।
স্টাফ ছেলেটির ঠিক পিছনেই রাখা রয়েছে টাইম মেশিন। চারপাশে গিজগিজ করছে লোকজন। প্রত্যেকে মেশিনের লাইভ ফটো নিতে চাইছে। শুনতে চাইছে কীভাবে কাজ করে এই যন্ত্র। ছেলেটাও বলে চলেছে অনর্গল, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, দিস ইজ ‘ভালানিস্কা ১২২’, ওয়ার্ল্ড’স ফার্স্ট ইনভেন্টেড টাইম মেশিন। অ্যাজ ইউ ক্যান সি...”
স্টাফ ছেলেটির ঠিক পিছনেই রাখা রয়েছে টাইম মেশিন। চারপাশে গিজগিজ করছে লোকজন। প্রত্যেকে মেশিনের লাইভ ফটো নিতে চাইছে। শুনতে চাইছে কীভাবে কাজ করে এই যন্ত্র। ছেলেটাও বলে চলেছে অনর্গল, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, দিস ইজ ‘ভালানিস্কা ১২২’, ওয়ার্ল্ড’স ফার্স্ট ইনভেন্টেড টাইম মেশিন। অ্যাজ ইউ ক্যান সি...”
যন্ত্রটি আকারে একটি বৃত্তের
মতন। উপরে ও নিচে টেকনিক্যাল কারিকুরিতে ভরপুর চোঙের আকারের দুই আচ্ছাদন।
যন্ত্রটির পিছনদিকে প্রবেশদ্বার। একটিমাত্র বসার জায়গা এবং সেটাই চালকের আসন।
চেয়ারের দু’পাশে দুই হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলে মেশিনের কন্ট্রোলস। যাত্রীর সামনে
ডাইমেনশনাল টাচ স্ক্রিন অপারেটিং সিস্টেম।
‘ভালানিস্কা ১২২’ এমন একটি
টাইম মেশিন যার দ্বারা সশরীরেই অন্য সময়ে পাড়ি দেওয়া সম্ভব। বৈজ্ঞানিকরা বেশ
কয়েকবার বিনা কোনও ঝঞ্ঝাটে ভবিষ্যতে ভ্রমণ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা
দিচ্ছে অতীত ভ্রমণে। কারণ, বৈজ্ঞানিকদের মতে নির্ভুলভাবে অতীত-ভ্রমণ বাস্তবায়িত
করা অনেকাংশে কষ্টকর। তাই গড়বড় হয়ে যাচ্ছে সময়ে। গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে মেশিনে। এইজন্য
প্রজেক্টের সকলের মতে আপাতত বন্ধ রাখা উচিত পাস্ট ট্র্যাভেল। কিন্তু সুস্ময় এই
ভাবনার ব্যতিক্রম। তার দৃঢ় বিশ্বাস, কিছুটা সময় পেলেই সে এই সমস্যার জট ছাড়াতে
সক্ষম হবে। কিন্তু তার পথের কাঁটা শন ওয়াইল্ড। যেহেতু প্রজেক্ট ইনচার্জ শন, তাই এই
প্রজেক্টে তার মত না নিয়ে কিছু করা অসম্ভব। কুতকুতে চোখওলা লাল চামড়ার লোকটা যে
একসময় তার বন্ধু ছিল, মাঝে মাঝে বিশ্বাসই করতে পারে না সুস্ময়। পরক্ষণেই ভাবে ওর
সঙ্গে যা হয়েছে, আমেরিকার মতন শহরে এইরকম ঘটনা তো নিতান্তই স্বাভাবিক।
পাঁচ বছর আগের সেই বৃষ্টিভেজা
রাত ছিল সুস্ময়ের জীবনে এক অভিশাপ, যার প্রায়শ্চিত্ত সে করে চলেছে প্রতিদিন। ওয়ালস্ট্রীটের
নিকটবর্তী নিজের টাউন হাউসে টাইম ট্র্যাভেলের থিসিসটা নিয়ে সেদিন ব্যস্ত ছিল
সুস্ময়। হাত আর মাথা চলছিল তার ঝড়ের বেগে। সব কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে, এইসময়
নোটিফিকেশন রিংটোন বেজে ওঠে সারা ঘরে। দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো স্ক্রিনে লক্ষ করে,
বাইরে দাঁড়িয়ে শন ওয়াইল্ড। সুস্ময়ের বন্ধু শন। শনকে ভিতরে নিয়ে এসে বসায় সুস্ময়।
কফি অফার করে। নিজের থিসিস নিয়ে আলোচনা করে। শনের মতামত চায়। শনও নিজের সাধ্যমত
সাহায্য করতে থাকে। কী এক কারণে সুস্ময়কে পাশের ঘরে যেতে হয় কিছুক্ষণের জন্য। শন তৈরিই
ছিল। হয়তো অনেকদিন ধরে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে। ইন্ডিয়ানটা যে ঘরের সিসিটিভি
ক্যামেরাগুলো সর্বক্ষণ অন রাখতে এখনও অভ্যস্ত হয়নি, খুব ভালো করেই জানত শন। সুতরাং
কোনও ভয় নেই ওর। সামনেই টেবিলে ছড়ানো রয়েছে জ্যাকপট। পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে
চটপট কাজ সারতে থাকে সে।
সুস্ময় ফিরে এলে শন ভদ্রভাবে
ওকে জানায় তার খুব জরুরি এক কাজ মনে পড়ে যাওয়ায় এখন উঠতে হচ্ছে। সুস্ময়কে কিছু
বলার সুযোগ না দিয়েই শন প্রস্থান করে। সে চলে গেলে, থিসিসের কাজ সম্পূর্ণ করে
নিশ্চিন্তে নিজের ফ্যামিলির সঙ্গে সময় কাটাতে থাকে সুস্ময়। পরের দিন নাসার কনফারেন্স
রুমে সুস্ময় যখন নিজের থিসিস নিয়ে শনকে প্রেজেন্টেশন দিতে দেখে তখন সত্যিই যেন
আকাশ ভেঙে পড়ে ওর মাথায়। ধাক্কা সামলাতে বেশ কিছুক্ষণ লাগে। কোনওরকমে কপিরাইট
ক্লেইম করবার বৃথা চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে রাতারাতি ক্রিয়েটরের নাম বদলে গেছে
অফিশিয়ালি। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে কোনও লাভ ছিল না।
ব্রিটিশ, আমেরিকান, সুইস লোকজনদের ভিড়ে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় সুস্ময়ের। বিদেশ
কি এতই নিষ্ঠুর? অন্যের পরিশ্রম নিজের নামে চালানোর এত খিদে এদের? ভেঙে পড়ে
সুস্ময়।
এরপর যা হওয়ার তাই হয়। শন
ওয়াইল্ডকে টাইম ট্র্যাভেলের প্রোজেক্ট ইনচার্জ ডিক্লেয়ার করা হয়। আর সুস্ময়কে
জুনিয়র সায়েন্টিস্ট। কাজ চলতে থাকে শনের তদারকিতে। একবছরের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে
নেয় সুস্ময়। এই শহরে প্রাপ্য সম্মান কেউ দেয় না। তা
ছিনিয়ে নিতে হয়। না হলে বশ্যতা স্বীকার করে চলতে হয়। এই
কথাগুলোই উঠতে বসতে জপ করেছে সে। পাঁচ বছরে নিজেই নিজেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
বুঝিয়েছে নিজেকে, এভরি ডগ হ্যাজ ইটস ডে। অপেক্ষা শুধু সঠিক সুযোগের।
“ওয়ানা লিফট, রায়চৌধুরী?”
পার্সোনাল কারে কিছু সমস্য
দেখা দেওয়ায় সুস্ময় আজ সুপার-মেট্রোতে কাজে এসেছে। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় এই
আহ্বানে সে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে শন ওয়াইল্ড নিজের ব্ল্যাক ম্যাকলারেনের ব্যাক
সিট থেকে কাচ নামিয়ে গলা বের করে চেয়ে আছে ওর দিকে। ঠোঁটে তার অবহেলাময় হাসি।
সম্ভবত বাবলগাম চিবোচ্ছে লোকটা। সুস্ময় আলতো করে ‘নো থ্যাঙ্কস’ বলে কাটিয়ে দিতে
চায়। কিন্তু শন গাড়ি নিয়ে ওর সঙ্গে তাল
মিলিয়ে চলতে থাকে।
“কাম অন রায়চৌধুরী, বি আ
স্পোর্ট!”
“ম্যান, লিভ মি অ্যালোন।”
“ইজ ইট অ্যাবাউট দ্যাট নাইট,
মাই ফ্রেন্ড? ওহ! প্লিজ...”
“জাস্ট গো আওয়ে।”
শেষের কথাটা বেশ জোর গলায়ই
বলে ওঠে সুস্ময়। সেটা হয়তো অপছন্দ হয় শনের। ড্রাইভারকে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিয়ে
নেমে আসে সে। পলকেই চলে আসে সুস্ময়ের কাছে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সুস্ময়। ওর
দু’কাঁধে ভদ্রভাবে হাত রাখে শন। তার চোখের দৃষ্টি হিমশীতল। কথা বলতে থাকে কেটে
কেটে, “দিস ইজ মাই কান্ট্রি। মাই রুলস। ইউ হ্যাভ টু প্লে দিস গেম বাই মাই রুলস। গট
ইট?”
সুস্ময় কিছু বলে না। অথবা
বলতে পারে না। শনের চোখের দিকে তাকাতেও পারে না। সুস্ময়ের টাইয়ের নট ঠিক করে
দেওয়ার ভঙ্গি করে শন নিজের গাড়িতে উঠে বসে। আবার কী মনে হতে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়,
“দিস ইজ মাই টাইম, রায়চৌধুরী। নট ইয়োরস। নট এনিওয়ান এলস। মাই
টাইম।”
বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলির মতো
নিজের ম্যাকলারেন নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় শন ওয়াইল্ড। জড়বস্তুর মতো খনিকক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকে সুস্ময়। চোখ খোলা থাকা সত্ত্বেও চিন্তার প্রতিবন্ধকে সে দেখতে পায় না
কিছু। ওর মাথায় আছড়ে পড়তে থাকে এক বিশেষ সম্ভাবনার এলোপাথাড়ি ঢেউ। শনের
শেষ কথাগুলোতে কিছু পেয়েছে সে। মারাত্মক কিছু। এমন এক বজ্রসমাহার নিয়ে সে
নাড়াঘাঁটা করতে চলেছে যা ঐ লাল চামড়ার শয়তানটাকে পথে বসিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু
প্রয়োজন সতর্কতা। খুব ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করে সুস্ময়। হালকা
হাসি দেখা যায় ওর ঠোঁটে। সেই হাসিতে খেলা করে বুদ্ধিমত্তা।
অবশেষে টাইম মেশিনের
চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়ায় সুস্ময়। সময় এখন রাত
সাড়ে আটটা। এতক্ষণে বিভিন্নপ্রকার সিকিউরিটি ইস্যু, যেমন আইডেন্টিটি প্রুফ,
ফিঙ্গার প্রিন্ট ভেরিফিকেশন, রেটিনা স্ক্যান ইত্যাদি পেরিয়ে এখানে আসতে পেরেছে সে।
এতবছর কাজ করায় নাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত সুস্ময়। কোটের বাঁ
পকেট থেকে এক আঠা জাতীয় বস্তু বের করে সে। নিজের বুড়ো আঙ্গুলে লাগিয়ে নেয় সেটা।
চাপ দেয় সামনের ছোটো স্ক্রিনে। প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট শন ওয়াইল্ডের থাম্ব ইমপ্রেশন
পেয়ে আনলক হয়ে যায় হাইটেক ওয়াল। এই এক সপ্তাহে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শনের ফিঙ্গার
প্রিন্ট যোগাড় করেছে সে। যা ছাড়া এই চেম্বারে প্রবেশের কোনও
দ্বিতীয় পথ নেই। বুদ্ধির দৌড়ে সে যে শনের চেয়ে বরাবরই এগিয়ে তা আবার নিজের কাছে
প্রমাণ করে সুস্ময়।
চেম্বারে প্রবেশ করে সে। বন্ধ
করে দেয় প্রবেশপথ। অন্তত আধঘণ্টার জন্য সুরক্ষিত এই
চেম্বার। একমাত্র শন ছাড়া আর কেউ আসতে পারবে না এখানে। আর শন তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই
প্লেজার বারে ফুর্তি করতে ব্যস্ত। কোনও গণ্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবদিক বিবেচনা
করেই মাঠে নেমেছে সুস্ময়। সামনেই তার ‘ভালানিস্কা-১২২’।
টাইম মেশিনের পাওয়ার বাটন অন
করে সুস্ময় প্রাইম সুইচগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রয়োজনীয় সবক’টা সুইচ চটপট অন করে
দেয় সে। টাইম মনিটরে জরুরি কম্যান্ডগুলো দিতে থাকে একে একে। ফাইবার প্যানেল আনলক
হয়ে যায় মেশিনের। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে সুস্ময়। শেষবার ঝালিয়ে নেয় সে
ঠিক কী কী করতে চলেছে। পাস্ট ট্র্যাভেল করবে সুস্ময়। পাঁচ বছর আগের সেই রাতে। গন্তব্য
তার নিজের টাউন হাউস। উদ্দেশ্য তার, এই পাঁচ বছরের টাইমলাইন চেঞ্জ করা। সুস্ময়ের
ক্যালকুলেশন অনুযায়ী তাদের টাইম মেশিন ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’ মানে।
অর্থাৎ, অতীতের কোনও ঘটনার হেরফের ঘটালে বর্তমান সময়ে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুতরাং
শন ওয়াইল্ডকে নিজের রিসার্চ ওয়ার্ক চুরি করা থেকে আটকাতে পারলে ফিরে এসে সুস্ময়
নিজের যোগ্য সম্মান পাবে। নাসায় তার পদের অবস্থান হবে সম্পূর্ণ আলাদা।
টাইম মেশিনে টাইম সেট করে
আধঘণ্টা। টাইপ করে নিজের বাড়ির ঠিকানা। ঠিক কোন স্থানে মেশিন গিয়ে পৌঁছবে তাও
নির্দিষ্ট করে সুস্ময়। নিজের বাঁ হাতে পরে নেয় টাইম ওয়াচ। দুটো ভিন্ন সময়ে
সামঞ্জস্য রাখবার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিক নারীকন্ঠ বলে ওঠে, ‘ইউ আর রেডি
ফর ইয়োর ডেস্টিনেশন।’
চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে
‘লঞ্চ’ বাটনে চাপ দেয় সুস্ময়। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে শুরু করে মেশিন। আলোককণায় সজ্জিত
এক ছিদ্র প্রকট হয় সামনে। দেখতে দেখতে সেটা আকারে বড়ো হতে থাকে। টাইম মেশিন প্রবেশ
করে সেই ওয়ার্ম হোলে। ফোর্থ ডাইমেনশনের অলিপথ দিয়ে প্রবল ঝাঁকুনি সমেত সুস্ময়
এগোতে থাকে নিজের গন্তব্যের দিকে।
যথাযথ জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হয়
টাইম মেশিন। সুস্ময়ের বাড়ির বাগান। মেশিন থেকে নামে সুস্ময়। হালকা মাথা ঘুরছে ওর।
চারপাশে গাছগাছালির ঝোপ। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। না, কোনও ভুলভ্রান্তি হয়নি। এই
সেই রাত। সুস্ময়ের জীবনের সেই কলঙ্কিত রাত। সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে এসে পৌঁছেছে
সে। নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে হয় ওর। টাইম ওয়াচের একটা নির্দিষ্ট আইকন টাচ করে
সুস্ময়। অদৃশ্য হয়ে যায় ‘ভালানিস্কা-১২২’। যন্ত্রটা
এখন নিজের চারপাশে এক ইনভিজিবল লুপ তৈরি করে নিয়েছে যাতে এই সময়ের কেউ সেটার
উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে না পারে। সুস্ময় হাঁটতে শুরু করে। হাতে সময় তার মাত্র
ঊনত্রিশ মিনিট।
নিজের বাড়ির পিছনদিকে এসে
দাঁড়ায় সুস্ময়। হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলেছে ওর। সামনে বড়ো কাচের জানালা। ঘরের ভিতরে আলো
থাকায় সেখানকার দৃশ্য দেখতে কোনও অসুবিধা হয় না। লবিতে সোফায় বসা নিজেকে ও শনকে
কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে সুস্ময়। এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে ওর। এইরকম
অভিজ্ঞতা হবে কোনওদিনও ভাবেনি সে। আর কিছুক্ষণ পরই অতীতের সুস্ময়ের ভিতরের ঘরে উঠে
যাওয়ার কথা। ভবিষ্যতের সুস্ময় অপেক্ষা করে চলে। নজর রাখে ঘড়ির কাঁটায়।
ঠিক পাঁচ মিনিট পর যা হওয়ার
তাই হয়। সুস্ময় উঠে গেলেই শন দ্রুত হাতে ওর রিসার্চ ওয়ার্কের ছবি তুলতে শুরু করে।
অন্যের পরিশ্রম চুরি করতে থাকে নির্দ্বিধায়। ঘটনাটা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে
সুস্ময়ের অসহ্য লাগে। মাথা ঠিক রাখতে পারে না সে। নিজের সৃষ্টি এতদিন অন্যের নামে
বিকিয়েছে এবং তা চুপচাপ মেনেও নিয়েছিল সে। কিন্তু আর না। এইবার ঘুরে দাঁড়ানোর
পালা।
সুস্ময় ভেবে চলে, শয়তানের
বাচ্চাটা বাইরে বেরোলেই ওর স্মার্টফোনটা ছিনিয়ে নেবে সে। টুকরো টুকরো করে ফেলবে
যন্ত্রটা। কিন্তু যদি সংঘর্ষ হয়? শনের গায়ের জোরের সঙ্গে পেরে উঠবে তো সে? এই
কথাটা বেমালুম ভুলে গেছিল। কী করা উচিত
তার এখন? হঠাৎ প্যান্টের ডানপকেটে হাত পড়তেই নিজের সর্বক্ষণের সঙ্গী পেনসিল নাইফটা
অনুভব করে সুস্ময়। সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার শিরদাঁড়া বেয়ে
এক কেউটে সাপ নেমে যায়। পাষণ্ডটাকে যদি এই বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে রাতে খুন করে
ফেলে রেখে সুস্ময় চলে যায়, তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়। তাহলেই তো পরম নিস্তার।
যেরকম ডাকাবুকো শয়তানি বুদ্ধির মালিক লোকটা তাতে সুস্ময়ের পথে যে সে পরে বাধা হয়ে
দাঁড়াবে না, তার কী গ্যারান্টি? তাছাড়া সুস্ময় এইখানে তাকে খুন করলেও কোনও বিপদের
আশঙ্কা তো নেই। এইসময়ের সুস্ময় থাকবে নিজের বাড়িতে।
সাক্ষী থাকবে তার ফ্যামিলি। নিঃসন্দেহে স্ট্রং অ্যালিবাই। আর ভবিষ্যতের সুস্ময় তো
ফিরে যাবে নিজের সময়ে এবং মার্ডার ওয়েপন পেনসিল নাইফটাও সুস্ময় নিজের সঙ্গে রাখা
শুরু করেছে বছর তিনেক হল। সুতরাং আমেরিকান পুলিশ পরেরদিন এখানে সেটার কোনও হদিশ
পাবে না। পারফেক্ট মার্ডার করবার নেশা পেয়ে বসে ওকে।
সিন্ধান্ত নিতে দেরি করে না
সুস্ময়। পেনসিল নাইফটা পকেট থেকে বাইরে বের করে নেয়। শয়তানের সঙ্গে মোকাবিলায়
শয়তান হওয়াই উচিত। ভদ্রমানুষের মুখোশটা অনেক দূরে সরিয়ে
রাখাই ভালো। হঠাৎ সে লক্ষ করে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে শন। দ্রুত পা চালাচ্ছে লোকটা।
ঘড়ি দেখে সুস্ময়। আর মাত্র বারো মিনিট। এর মধ্যে কার্যসিদ্ধি না হলে অনর্থ হয়ে
যাবে। ছুরিটা বাগিয়ে ধরে সন্তর্পণে শন ওয়াইল্ডের পিছু নেয় অন্য সময়ের আগন্তুক। জোরালো
শব্দে গর্জে ওঠে আকাশ।
শনকে কোনওরকম প্রতিরক্ষার
সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না সুস্ময়ের। সুতরাং চুপচাপ পিছন থেকে শনের কাঁধে আলতো করে
বাঁ হাত রাখে সে। চমকে ঘুরে তাকায় শন। তার গলার পাতলা চামড়াটা আড়াআড়িভাবে ছিঁড়ে
দিতে ছুরিটা চালিয়ে দেয় সুস্ময়। কিন্তু নিজের শরীরেই একটা ঝটকা অনুভব করে সে।
শূন্যের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে না পেরে কয়েক হাত সামনে এগিয়ে যায়। শনকে দেখতে পায় না।
এক সেকেন্ডে যে কী হল বুঝে উঠতে পারে না সুস্ময়। পরক্ষণেই দেখে, শন তার পিছনে। সময়
নষ্ট না করে শনের গলা লক্ষ করে আবার ছুরি চালায়। ছুরি আড়পার হয়ে যায়। আবার একই
চেষ্টা করে সুস্ময়। আবার একই ফলাফল। যেন শূন্যে ছুরি চালিয়ে বাতাসকে চিরতে চাইছে
সে। শন ততক্ষণে ব্যাপারটা হ্যালুসিনেশন
মনে করে হাঁটা দিয়েছে নিজের গাড়ির দিকে। হাতের টাইম ওয়াচের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা
ছ্যাঁত করে ওঠে সুস্ময়ের। যন্ত্রটা আর কাজ করছে না। শিহরিত
হয়ে ওঠে সে। দৌড়তে থাকে সেই জায়গায় যেখানে টাইম মেশিন রেখে এসেছিল। অকুস্থল
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ‘ভালানিস্কা-১২২’-র স্পর্শ পায় না সুস্ময়। আর বুঝতে বাকি
থাকে না তার, ঠিক কী হয়েছে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে সুস্ময়। পিছনে ফিরে তাকায়।
দেখে, কাদায় তার এতক্ষণের দৌড়াদৌড়ির কোনও পায়ের ছাপ নেই।
টাইম মেশিনের গায়ে হাত বুলোতে
দেখা যায় শন ওয়াইল্ডকে। পাঁচ মিনিট হল সেটা ফিরে এসেছে।
সিস্টেম অনুযায়ীই কাজ হয়েছে। হতেই হয়। উত্তেজনায় ডান হাত মুঠো করে বাঁ হাতের চেটোয়
ঘুষি মারে শন, ‘হেল ইয়ে!’ শব্দ করে এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। তারপর পাগলের মতো
হাসতে থাকে।
কয়েকদিন ধরে ইন্ডিয়ানটার
হাবভাবে কিছু গোলমাল লক্ষ করেছিল শন। আজ তাই হইহুল্লোড় বাদ দিয়ে রায়চৌধুরীর পিছু
নিয়েছিল সে। দেখেছে লোকটা খুব সাবধানে একের পর এক সিকিউরিটি ইস্যু পেরিয়ে টাইম
মেশিন চেম্বারে ঢুকেছে। কীভাবে যেন ওর থাম্ব ইমপ্রেশনও যোগাড় করেছে। বেশ অবাক
হয়েছিল শন। ভয়ও পেয়েছিল যথেষ্ট। করতে কী চায়
ইন্ডিয়ানটা? কিন্তু যখনই টাইম মনিটরে সে দেখে সুস্ময় রায়চৌধুরী পাস্টে ট্র্যাভেল
করেছে, ওর মতলব ঠাহর করতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র লেগেছিল শনের। হন্যে হয়ে খুঁজেছিল
কোনও উপায়। কিছু মুহূর্ত পর এক অতি সাধারণ নিয়ম মনে পড়ে যায় তার। তার নিজেরই
ইম্প্রোভাইজ করা একটা রুল। পলকেই সমস্ত দুশ্চিন্তার বাষ্প উবে যায় শনের মাথা থেকে।
চলে যায় সোজা মেইন মনিটরের কাছে। ডিজিটাল স্ক্রিনে অনেকক’টা অপশন থেকে শেষেরটা
সিলেক্ট করে শন। ‘এমারজেন্সি কামব্যাক’। অপারেটিং
সিস্টেম কনফার্মেশন চায়। নির্দ্বিধায় কনফার্ম করে শন।
‘এমারজেন্সি কামব্যাক’ এমনই
এক অপশন যার ফলে ট্রাভেলারকে ফেলে রেখে মেশিন চলে আসবে বর্তমান সময়ে। হঠাৎ
কোনও বিপদে টাইম মেশিনের সেফটির জন্যই এই রুল। প্যাসেঞ্জারকে স্যাক্রিফাইস করে
যাতে মেশিন সম্পূর্ণ সুরক্ষিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে যথাসময়।
নিয়মানুযায়ীই কাজ হয়। মেশিন
ফেরত চলে আসে নাসার চেম্বারে। বন্ধ হয়ে যায় ওয়ার্ম হোল। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অতীত আর
বর্তমানের যোগসূত্র। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনের পাওয়ার সুইচ অফ করে দেয় শন। ভাবতে থাকে
সুস্ময় রায়চৌধুরীর কথা, যে এখন টাইম গ্যাপে ফেঁসে যাওয়া এক এনার্জি ছাড়া আর কিছুই
না। যার অস্তিত্ব না আছে অতীতে, না আছে বর্তমানে, না ভবিষ্যতে। একই সময়ে দুই একই
মানুষের থাকা সম্ভব নয়। কসমস তার অনুমতি দেয় না।
চেম্বার ক্লোজ করে দেয় শন।
নাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণের টেনশনে গলাটা বেশ শুকিয়ে এসেছে তার। পছন্দের নাইট ক্লাবের
দিকে পা বাড়ায় সে। পিছনে ফিরেও তাকায় না। আপন মনে
বিড়বিড় করে চলে, “সায়োনারা, রায়চৌধুরী। টোল্ড ইয়ু, দিস ইজ মাই টাইম।”
-----
অলঙ্করণঃ
সূর্যোদয় দে
No comments:
Post a Comment