গল্পের ম্যাজিক:: সূর্যগ্রহণের গল্প - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


সূর্যগ্রহণের গল্প
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

কা-নাম ভারি দুষ্টু মেয়ে ছিল। মায়ের কথা মোটে শুনত না। মা বলেছিল, “দুপুরবেলা একা একা বনের ভেতর যাস না।”
কিন্তু সে কথা শুনতে দুষ্টু মেয়ের ভারি বয়েই গেছে! দুপুরবেলা মাও কাজ-টাজ সেরে একটু চোখ বুজেছে, আর কা-নামও অমনি ঘর ছেড়ে একদৌড়ে সো—জা জঙ্গলে।
খানিক ভেতরে ঢুকতেই ঠা ঠা দিনের আলো নরম হয়ে এল। ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে একটা ছোট্টো নদী বয়ে যাচ্ছে। এই নদীটার খোঁজ সে ছাড়া আর কেউ জানে না। তার জলে পা ডুবিয়ে কা-নাম আরাম করে বসল। মাথার ওপর সবুজ ছাদ। সে ছাদের এখান ওখান দিয়ে ফোকর গলে তিরের ফলার মতন রোদ এসে নদীর জলের সঙ্গে খেলা জুড়েছে। মন দিয়ে তাই দেখছিল কা-নাম।
ঠিক সেই সময় ঝোপের আড়াল থেকে তার দিকে দেখছিল একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। মানুষের মাংস খেতে ভারি ভালোবাসত বাঘরাজা উ-খ্‌লা। সামনে এমন একটা মানুষকে একা একা বসে থাকতে দেখে তাই তার জিভে জল আসছিল। তবে কিনা মানুষটা একেবারে একরত্তি। তবে তাতে তার আপত্তি নেই। কদ্দিন আটকে রেখে খানিক খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে নিলেই হল।
এই ভেবে, ভয়ানক একটা হাঁকার ছেড়ে হলুদ বিদ্যুতের মতো উ-খ্‌লা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কা-নামের ওপর। তারপর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে একছুটে গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেল।

* * *

চোখ খুলে চারপাশে তাকিয়ে কা-নাম টের পেল, একটা গুহার ভেতর সে বন্দি। বাইরে উঁকি মেরে দেখে, সে এক গহিন জঙ্গল। সে বনের কূলকিনারা নেই। একা একা কোথায় যাবে সে, সেই গভীর অরণ্যে! একটা পাথরের ওপর জড়োসড়ো হয়ে তাই ভাবছে কা-নাম এমন সময় কোত্থেকে একটা বিরাট বাঘ লাফ দিয়ে গুহায় ঢুকে এসে একরাশ ফলমূল আর একটা লাউয়ের খোলায় করে খানিক জল সেখানে নামিয়ে রেখে ফের জঙ্গলে উধাও হয়ে গেল।
এতক্ষণে কা-নামের খেয়াল হল, তাই তো! খুব খিদে পেয়েছে যে তার! সেই কখন সকালবেলা দু’মুঠো ভাত খেয়েছিল; তারপর আর দাঁতে কুটোটি কাটেনি সে। ফলমূল খেয়ে পেট ভরিয়ে খানিক জল খেয়ে সে শুয়ে পড়ল গুহার মেঝেতে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে কথা তার নিজেরও খেয়াল নেই।
তারপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা বাঘ এসে কা-নামকে খাবার দিয়ে যায়; মেপেজুপে দেখে যায় কতটা মোটাসোটা হল মেয়েটা। গুহায় বসে কা-নাম সেই ফলমূল খায় আর মায়ের কথা ভেবে হাপুস হয়ে কাঁদে।
গুহায় কিন্তু আরও একজন থাকত। কে বল তো? সে এক ছোট্টো ইঁদুর। অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকত বলে কা-নাম তাকে কোনওদিন চোখে দেখেনি। সে কিন্তু কা-নামের সব খবর রাখত। একদিন সন্ধেবেলা ইঁদুর গুহার বাইরে ঝোপের ভেতর খাবার খুঁজছে এমন সময় দেখে বাঘ কা-নামকে খাবার দিয়ে গুহা ছেড়ে বের হচ্ছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে যাচ্ছে। অমনি ইঁদুর কান খাড়া করল। শোনে, বাঘ আপনমনেই বলছে, “মেয়েটা বেশ গোলগাল হয়ে উঠেছে। আজ রাত্রে এটাকে খাব। যাই, বন্ধুবান্ধবকে নেমন্তন্ন করে আসি।”
কা-নামের ওপরে ইঁদুরের মায়া পড়ে গিয়েছিল। বাঘের কথা শুনে সে ঠিক করে নিল, যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে। তাড়াতাড়ি গুহার ভেতর ফিরে এল সে। এসে দেখে খাওয়াদাওয়া সেরে কা-নাম ঘুমিয়ে কাদা। তার কানের কাছে গিয়ে কিঁচকিঁচ করে ইঁদুর বলল, “ওঠো গো মেয়ে। আজ যে তোমার ভারি বিপদ!”
ঘুম ভেঙে চমকে উঠে কা-নাম দেখল, তার কানের কাছে একটা ছোট্ট ইঁদুর দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে।
“কী বিপদ গো?”
ইঁদুর তখন তাকে সবকথা বলে শেষে বলল, “এবারে তুমি পালাও গো মেয়ে।”
কা-নামের চোখে জল এল। বলল, “এ জঙ্গলের কিচ্ছুটি যে চিনি না আমি! কোথায় যাব একা একা?”
তাই শুনে ইঁদুর খানিক ভেবেচিন্তে নিয়ে বলল, “এস তাহলে আমার সঙ্গে। আমি তোমায় বাঁচাব।”
ইঁদুরকে কাঁধের ওপর বসিয়ে মাঠঘাট, বন, উপবন পেরিয়ে কা-নাম ছোটে—ছোটে—ছোটেরাত পেরিয়ে দিন হল, তারপর দিন পেরিয়ে ফের যখন রাত নামছে তখন সেই বনের ভেতর একটা বিরাট পুকুরের সামনে এসে দাঁড়াল তারা। কা-নামকে চুপটি করে দাঁড়াতে বলে তার কাঁধ থেকে জলের বুকে ঝাঁপ দিল ইঁদুর। তারপর টুপ করে তলিয়ে গেল পুকুরের গহিন জলে।
খানিক বাদে জল তোলপাড় করে ভেসে উঠল পাহাড়ের মতো একটা ব্যাঙতার কাঁধের ওপর ইঁদুর বসে। পুকুরধারে পৌঁছে জলের ভেতর থেকেই সে গোল্লা গোল্লা চোখ মেলে কা-নামকে দেখল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, “আমি উ-হিনরো। দুনিয়ার সেরা জাদুকর। বল, তোমার কী বিপদ হয়েছে।”
তারপর কা-নামের সবকথা শুনে উ-হিনরো বলল, “তুমি বরং আমার বাড়িতে এসে থাক। সেখানে থাকলে উ-খ্‌লা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তবে কিনা, আমার বাড়িতে থাকতে হলে তোমাকে ব্যাঙ সেজে থাকতে হবে। অমন বিচ্ছিরি মানুষের চেহারা দেখলে আমার সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েগুলো ভয় পাবে তো! কী? রাজি?”
কা-নাম মাথা নাড়ল।
তারপর তো কোলাব্যাঙের চামড়া মুড়ি দিয়ে কা-নাম উ-হিনরোর বাড়িতে থাকে। তার বউ-ছেলেমেয়ের ফাইফরমাশ খেটে, চড়চাপড় খেয়ে দিন চলে তার। বাড়ির বাইরে পা দেয়াও মানা।

কয়েকমাস পরে একদিন উ-হিনরোর বাড়িতে বেড়াতে এসে কা-নামের দশা দেখে ইঁদুরের চোখে জল এল। অত সুন্দর রাজকন্যার মতো মেয়ে ব্যাঙ সেজে ব্যাঙের বাড়ির চাকরানি হয়ে থাকছে! এ কিছুতেই হতে পারে না।
সুযোগ খুঁজতে লাগল ইঁদুর। তারপর একদিন যখন উ-হিনরো বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে দূরের কোন পুকুরে নেমন্তন্ন খেতে গেছে, সেই ফাঁকে কা-নামকে নিয়ে ফের বের হয়ে পড়ল পথে। পুকুর ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে তারা এসে পৌঁছোল এক জাদুবনের মাঝখানে। সেখানে একটা ছোট্টো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ভারি অদ্ভুত চেহারা তার। দেখে কা-নাম জিজ্ঞাসা করল, “কী গাছ এটা?”
ইঁদুর বলল, “এ হল জাদুগাছ। তোমায় একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। গাছের মাথায় চড়ে বসে মন্ত্রটা বল। তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে।”
খানিক বাদে গাছের মাথায় চেপে বসে ইঁদুরের শেখানো মন্ত্রটা বলল কা-নাম,
গাছদেবতা, গাছদেবতা
শুনছ নাকি ভাই,
তোমায় বলি একটা কথা
উঁচোও তোমার ঝাঁকড়া মাথা
তোমায় চেপে আকাশদেশে যাই—”

অমনি কা-নামকে মাথায় নিয়ে সড়সড় করে মাথা উঁচলো জাদুগাছ। দেখতে দেখতে জঙ্গলের সবুজ চাঁদোয়া ছাড়িয়ে, মেঘেদেরও ছাড়িয়ে গেল সে। পায়ের নিচে পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল। কা-নাম এসে পৌঁছোল আকাশের দেশে। সে দেশে কারও কোনও দুঃখকষ্ট নেই।
কিন্তু সেই সুখের দেশে এসেও দুঃখিনী কা-নামের দুঃখ ঘুচল না। এ দেশে সবাই সুন্দর। একটা বিচ্ছিরি দেখতে ব্যাঙকে কে আর ভালোবাসবে এখানে? পথে পথে অনেক ঘুরে শেষমেশ সূর্যদেবী কা স্‌ন্‌গীর বাড়িতে তার ঠাঁই মিলল অনেক কষ্টে।
বিরাট সেই প্রাসাদের এক কোণে দুঃখিনী ব্যাঙের বাসা। কেউ তার দিকে ফিরেও দেখে না। কিন্তু তারপর একদিন রাতে সূর্যদেবীর ছোটোছেলে এসে কী মনে হতে উঁকি মেরেছিল কা-নামের ঘরেদেখে, কোথায় ব্যাঙ! মাটিতে কোলাব্যাঙের চামড়া খুলে রেখে পালঙ্কে শুয়ে একটা ভারি মিষ্টি মেয়ে ঘুমোচ্ছে। ছোটোছেলে তখন চুপিচুপি ঘরে ঢুকে ব্যাঙের চামড়াটা তুলে নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলে দিল আগুনের ভেতর। তারপর সুন্দরী কা-নামের হাত ধরে নিয়ে চলল সূর্যমায়ের ঘরে।
তারপর পূর্ণিমার রাতে সূর্যমায়ের ছোটোছেলের সঙ্গে বেজায় ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল কা-নামের। সে বিয়ের দিন দুপুরবেলা আকাশ-মাটি-পাতালের সব্বার নেমন্তন্ন হয়েছিল বিয়ের ভোজে। উ-হিনরোও নেমন্তন্ন পেয়েছিল। দাসী পালিয়ে যাবার পর থেকেই তো সে রেগে দশখানা হয়ে দুনিয়াজোড়া খুঁজে চলেছে তাকে। বিয়ের কনেকে দেখে সূর্যদেবীর ওপর তার রাগ দেখে কে! খাবার ফেলে রেখে আকাশপাতাল হাঁ করে সে ধেয়ে গেল তাঁর দিকে। বেধে গেল তুমুল যুদ্ধ। উ-হিনরোর ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেল সূর্যদেবীর আলোর মুখ। পৃথিবীতে ভরদুপুরে অন্ধকার নেমে এল। পৃথিবীর মানুষরা তো সূর্যদেবীর দলে! তারা উ-হিনরোকে ভয় দেখাবার জন্য এমন ঢাক-ঢোল বাজানো শুরু করল যে তাইতে ভয় পেয়ে উ-হিনরো সূর্যকে ছেড়ে একছুটে পালিয়ে গেল তার জাদুপুকুরের মাঝখানে। আকাশ আবার আলোয় ঢেকে গেল।

কত যুগ কেটে গেছে তারপর। উ-হিনরোর কিন্তু সূর্যের ওপর রাগ আজও যায়নি। মাঝেমাঝেই পুরনো কথা মনে পড়লে সে রেগে দশখানা হয়ে সূর্যদেবীকে গিয়ে আক্রমণ করে। তখন ভরদুপুরে পৃথিবীতে ছায়া নেমে আসে। মানুষরা তখন ফের ঢাক-ঢোল বাজাতে শুরু করলে খানিক বাদে ভয় পেয়ে সূর্যদেবীকে ছেড়ে পালিয়ে যায় উ-হিনরো। আর এমনি করেই আকাশের বুকে সূর্যগ্রহণ হয়।
_____
খাসিয়া পাহাড়ের রূপকথা
অলঙ্করণঃ শুভ্রা ভট্টাচার্য

1 comment:

  1. দারুন সুন্দর রুপকথা শুনলাম, পড়লাম নয় । এই রকম সুন্দর কথা পড়তে গিয়ে আসলে আমরা শুনি আর সেই কাজটাই দেবজ্যোতি বাবুর কলমে বাঁ কীবোর্ডে এসেছে ।

    ReplyDelete