লেপার্ডের ডেরায়
অরিন্দম দেবনাথ
ভরা গ্রীষ্মে প্রায় পাতাঝরা ঘন জঙ্গলের
মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মোহিনী নদীর শুকিয়ে যাওয়া ধারাপথ সংক্রান্ত একটা সমীক্ষা সেরে টিকারি
এস্টেটের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে যখন পাকা রাস্তার কাছে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধে ছ’টা। পিঠে
ভারী বোঝা। বৃষ্টিহীন এপ্রিল মাসের শেষ। চারদিন ধরে ভরা গ্রীষ্মের দুপুরে নদীর
শুকনো বালুচড়া ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে গায়ের চামড়ায় বড়ো বড়ো লাল চাকা চাকা
ঠোসা পড়ে গেছে। একটু ঘষা লাগলেই প্রচণ্ড জ্বালা হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
সঙ্গে নিয়ে আসা চার বাক্স ভর্তি
জলের বোতলের আর একটাতেও জল অবশিষ্ট নেই। এ ক’দিন জলের অভাবে স্নান করিনি কেউ। তাঁবুর
ভেতরে প্রচণ্ড গরমে রাতে ঘুম হয়নি। মশার উৎপাত আর সাপের ভয়ে অসহ্য গরমেও বিশেষ নকশায় তৈরি চারদিক
মশারির নেট দিয়ে ঘেরা তাঁবুর ভেতর থাকতে হয়েছে। টিনবন্দী খাবার খেয়ে খেয়ে পেটের
অবস্থা খারাপ।
জলহীন নদীর বুকে বিশাল বিশাল
পাথরের টুকরো জেগে। নদীর দু’পাশে মূলত শাল-মহুয়ার জঙ্গল। বর্ষাকালে এই নদীই জলে
ভরে ভয়ংকর হয়ে যায়। জঙ্গল তখন হয়ে ওঠে সবুজ।
আমাদের বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছনোর
কথা ছিল পাকা রাস্তার ধারে। সেইমতো আগে থেকেই গাড়িকে আসতে বলে দেওয়া হয়েছিল আমাদের
নিতে। পুরো অঞ্চলটাই মোবাইল পরিষেবার বাইরে। সব কাজ শেষ করে জঙ্গল থেকে তাঁবু
গুটিয়ে রওয়ানা হতে হতেই বিকেল পাঁচটা। রওনা হবার আগে শেষ জলের বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক
জল ভাগ করে গলাটা একটু করে ভিজিয়ে নিয়েছিলাম সকলে। জলের অভাবে জিভ খড়খড়ে হয়ে
রয়েছে। আগে বেহিসেবির মতো জল খেয়ে এখন ফলটা হাতে হাতে টের পাচ্ছি। আমাদের তাঁবু
থেকে খানিক দূরে একটা বড়ো পাথরের তলায় খানিক বালি ভিজে দেখে সেখানে একটা ফুট দুয়েক
গভীর গর্ত খুঁড়েছিলাম আমরা। সারাদিনে বেশ কয়েক লিটার জল জমছিল ওই গর্তে। কোনওরকমে চারজনের
হাতমুখ ধোয়ার কাজ হয়ে যাচ্ছিল ওই জলে।
যে অঞ্চলে আমরা সমীক্ষা
চালাচ্ছিলাম, সেখান থেকে কাছাকাছি গ্রামের দূরত্ব প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। আশেপাশের
জঙ্গলে অনেক বুনো জন্তু ঘোরাফেরা করে। এই জঙ্গলের একশো কিলোমিটার দূরে রয়েছে একটা
অভয়ারণ্য। সেখানে হাতি, ভালুক, লেপার্ড, হরিণসহ অনেক প্রাণীর বাস। আমরা শুকনো নদীর
বুকে যেখানে তাঁবু গেড়েছিলাম সেখানে কাছাকাছি জলের কোনও উৎস না থাকায় জন্তুজানোয়ার
আসার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না। তবুও পালা করে রাত জেগে পাহারা দিতাম আমরা।
জঙ্গলের ভেতরকার ঝরা পাতায় ঢাকা কাঠুরেদের
পায়ে চলা লাল মাটির পথ ধরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে জাতীয় সড়কের ধারে পৌঁছে বুকটা ধক করে
উঠল। আরে! গাড়ি কই? জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাকা সড়কের দু’পাশের ঘন গাছের ডালে
ডালে ফিকে অন্ধকার ক্রমেই মিশকালো হচ্ছে। এই রাস্তায় দিনের বেলাই গাড়ি চলে খুব কম।
রাতে খুব প্রয়োজন না হলে কেউ এই রাস্তা মাড়ায় না হাতি আর ডাকাতের ভয়ে। জঙ্গলটা
ভয়ংকর রকমের নিশ্চুপ। একটা পাখিরও সাড়া নেই। এমনকি গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।
মোবাইলটা অন করে দেখি সিগন্যাল নেই। মানে ফোনও অচল। গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে
যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই!
হঠাৎ কানে এল গাড়ির দরজা বন্ধ করার
শব্দ। নজরে এল, অনেকটা দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে শুকনো পাতায় শব্দ তুলে আধো অন্ধকারে
টর্চ জ্বালিয়ে একটা লোক এগিয়ে আসছে। লোকটা সামনে আসতে দেখি, আরে, এ তো আমাদের
গাড়ির ড্রাইভার শশী কূর্মু! শশীর হাতে একটা জলভর্তি বড়ো বোতল।
ঈশ্বরকে দেখলেও বোধহয় এত খুশি হতাম
না। কোনও কথা না বলে জলভর্তি বোতলটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে শেষ করলাম আমরা চারজন।
“বাঁচালে, শশী,” ফাঁকা জলের বোতলটা দেখিয়ে বললাম।
শশী মুচকি হাসি হেসে বলল, “আপনাদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে গাড়িটা
জঙ্গলের ভেতরে ঢুকিয়ে বসেছিলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে মোবাইলের আলো দেখে বুঝলাম
আপনারা এসে গেছেন। আপনারা না এলে সারারাত আমি গাড়িতেই বসে থাকতাম। তারপর সকালে খুঁজতে
বেরোতাম। জঙ্গলে কখন কী ঘটে কিছুই বলা যায় না। আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি গাড়িটা
নিয়ে আসি।”
চার বছর আগে আমি শশীর খোঁজ পাই।
তারপর যতবার এই অঞ্চলে এসেছি, শশীই আমার সাথী হয়েছে। শশী যেমন সাহসী তেমনি
পরোপকারী। জঙ্গলের মানুষ শশী আমাকে প্রথমবারই সাপের কামড় থেকে বাঁচিয়েছিল। সেবার
আমার সঙ্গে পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঘুরছিল শশী। হঠাৎ বলল, “সাহেব, এগোবেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন।”
আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে গেলাম।
শশী আমার থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে মাটির ওপর লাফাতে লাগল। সামনে শুকনো পাতার ওপর
সড়সড় শব্দ শুনে দেখি মিটারখানেক লম্বা কালোর ওপর হলুদ সাদা শিকলের মতো দাগওয়ালা তিরের
মতো সরু মুখের একটা সাপ দ্রুত চলে যাচ্ছে।
শশী বলল, “চন্দ্রবোড়া। এই জঙ্গলে প্রচুর আছে। খুব সাবধানে চলাফেরা
করবেন। কামড়ালেই মৃত্যু।”
একটু আগে ভাবছিলাম গাড়ি না থাকলে
কী করব। এখন আবার অন্য চিন্তা শুরু হল। রাতে থাকার জন্যে মোহিনী অভয়ারণ্যের ফরেস্ট
গেস্ট হাউস বুক করা আছে। কিন্তু অভয়ারণ্যের মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায় সন্ধে ছ’টায়।
অভয়ারণ্যের মূল ফটকটা পাকা রাস্তার ওপরে হলেও গেস্ট হাউসটা রাস্তা থেকে চোদ্দ
কিলোমিটার ভেতরে। আগে এই অঞ্চলে এলেও কখনও মোহিনী অভয়ারণ্যে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই
প্রথম যাব। সঙ্গের তিন সাথীর প্রথম এই অঞ্চলে আসা। জানতাম, অভয়ারণ্যের গেস্ট হাউসে
রান্নার লোক থাকলেও খাবারের সব উপকরণ সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। পুরনো
পরিচিত ড্রাইভার শশীকে আগেই বলে দিয়েছিলাম খাবারদাবার সব কিনে নিয়ে আসতে। কী করেছে
এখনও জানি না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি নিয়ে এল
শশী। এক এক সেকেন্ড এক এক ঘণ্টার মতো লম্বা মনে হচ্ছে। গাড়িতে উঠে দেখি থলে বোঝাই
আনাজপাতি, চাল-ডাল সব কিনে এনেছে শশী। এমনকি এক পেটি বোতলবন্দি খাবার জলও।
ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছে শশী। পাকা
সড়কের দু’পাশের ঘন অন্ধকারে লম্বা পাতাহীন গাছগুলোকে হেড লাইটের আলোয় অজস্র হাত
বাড়ানো কঙ্কালের মতো লাগছে।
সাড়ে সাতটা বাজে। প্রচণ্ড খিদে
পেয়েছে। শুকনো বিস্কুট আর খেতে ইচ্ছে করছে না। শশীকে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কতক্ষণ লাগবে?”
শশী বলল, “আরও আধঘণ্টা।”
“জঙ্গলে ঢোকার গেট
তো বন্ধ হয়ে গেছে, শশী?”
“কিছু ভাববেন না, একটা
ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
আমি আর কিছু বললাম না। শশীর ওপর ভরসা
আছে।
আটটা নাগাদ অভয়ারণ্যের গেটের সামনে
পৌঁছে দেখি বিশাল লোহার গেট বন্ধ। গাড়ির হেড লাইটের আলো লোহার দরজা ভেদ করে লাল মাটির
পথ বেয়ে হাতি, ভাল্লুক, সাপ, হরিণ, পাখি আর লেপার্ডের ছবি দেওয়া একটা সাইনবোর্ডের ওপর
পড়েছে। গেটের মাথায় সিসি টিভির ক্যামেরার পাশের লাল আলো অন্ধকারের
মাঝে জ্বলজ্বল করছে। গেটের পাশে অফিসের দরজা বন্ধ।
হেড লাইট বন্ধ করে গাড়ির দরজা খুলে
শশী নামল। বলল, “আপনারা
গাড়িতেই বসুন, আমি আসছি।”
টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল
শশী। সামনের আসনে চুপ করে বসে আছি। সঙ্গী তিনজন পেছনের আসনে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। গাড়ির
ইন্ডিকেটরের হলুদ আলো নিভছে আর জ্বলছে। পাশের গাছগুলো দেখা দিয়েই আবার হারিয়ে
যাচ্ছে আলোর তালে তালে। ক্লান্ত শরীরে দু’চোখে ঘুম নেমে আসছে। থেকে থেকে একটা
রাতজাগা পাখি ডেকে উঠছে। অদ্ভুত ডাকটা। গুব গুব গুব...
মহুয়াফুলে জঙ্গল ভর্তি। সামনের মাটিতে পড়ে আছে
অজস্র হলুদরঙা মহুয়াফুল। মহুয়ার গন্ধে মাতোয়ারা পুরো জঙ্গল।
মিনিট পনেরো কেটে গেছে। গাড়ি থেকে
নামব কিনা ভাবছি। শশী বারণ করে গেছে গাড়ি থেকে নামতে। গ্রীষ্মকাল। বিষধর সাপেদের সাম্রাজ্যে
আছি। গাড়ির আয়নায় দুটো ছোটো ছোটো আলো ঝলক দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রাস্তার ওপারে
জঙ্গলের গাছপালার ফাঁক দিয়ে জোরালো টর্চের আলো শুকনো ঝরাপাতার ওপর দিয়ে আসছে।
“সরি সাহেব, গার্ডকে
ওর কোয়ার্টার থেকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে নিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।” শশী বলল।
ফরেস্ট গার্ড গেট-সংলগ্ন অফিসের
তালা খুলে আলো জ্বেলে আমাকে অফিসে ডাকল। খাতাপত্রে নামঠিকানা লেখা হলে বিশাল লোহার
গেটটা খুলে দিল ফরেস্ট গার্ড। দু’পাশের মিশকালো অন্ধকারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা
অসংখ্য গাছপালার খানিকটা আলোকিত করে উঁচু নিচু লাল মাটির পথ বেয়ে আমাদের গাড়ি কড়মড়
আওয়াজ তুলে জমাট নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দ্রুত চলল ফরেস্ট রেস্ট হাউসের দিকে।
আচমকা ব্রেকে চাপ পড়াতে গাড়িটা হালকা
ঝাঁকুনি খেল। একটা বেশ বড়ো আকারের খরগোশ রাস্তার পাশের গাছের ফাঁক থেকে এক লাফে
রাস্তায় উঠে গাড়ির আগে আগে ছুটতে লাগল। গাড়ির জোরালো আলোর তালে তালে খরগোশটা ছুটে ছুটে আমাদের সঙ্গ
দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে যেন। খানিক পর রাস্তা ছেড়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল
খরগোশটা।
খরগোশটা চলে যাবার খানিক পর জঙ্গল
থেকে বেরিয়ে এল একটা হগ ডিয়ার। সেটাও খানিক গাড়ির আগে আগে ছুটে এক লাফে রাস্তার
পাশের এক ছোটো নালা পেরিয়ে চলে গেল গাছপালার আড়ালে।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ গেস্ট হাউসে
পৌঁছে কুককে খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে গেস্ট হাউসের সামনের
বিশাল ঝিলটার সামনে গিয়ে সবে হাত পা ছড়িয়ে বসেছি, ওমনি পেছনে লাঠি ঠকঠকিয়ে এক
ফরেস্ট গার্ড উপস্থিত। কোমর বেঁকিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফরেস্ট গার্ডটি বলল, “আপনারা প্লিজ বাংলোর গ্রিল ঘেরা বারান্দায়
গিয়ে বসুন। লেপার্ডটার একটু অসুবিধা হচ্ছে।”
গার্ডের হাতের জোরালো ফ্লাশ লাইটের
আলো ঝিলের জল পার করে একটা ঝোপকে আলোয় ভরিয়ে দিল। জল খাওয়া থামিয়ে হালকা হলুদের
ওপর কালো দাগের মসৃণ লোমশ প্রাণীটা মুখ তুলে আলোর দিকে তাকিয়ে।
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment