ছোটোবেলার পুজো
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
অত ভয় জীবনে পাইনি!
দশমীর সন্ধে। পাড়ার দুর্গাঠাকুর ভাসান যাবে। বরণ শেষ, ঠাকুরের হাত থেকে অস্ত্র খুলে নেওয়াও হয়ে গেছে।
ভারিরা বিরাট বিরাট বাঁশ আর মোটা কাছি নিয়ে বাঁধাছাঁদার তাল করছে। আমরা, তখন সবাই নেহাতই বালক, দাঁড়িয়ে আছি ঠাকুরের সামনে।
মনখারাপ লাগছে। ঠাকুর চলে যাওয়া মানেই তো পুজো শেষ, মজা শেষ।
তাই যতক্ষণ থাকা যায় দুর্গাপ্রতিমার কাছাকাছি।
আমাদের এক বন্ধু ছিল চিরকালই
একটু ছিটগ্রস্থ। অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস মাথায় আসত তার। ঠিক খ্যাপামি নয়, বরং এখন বুঝতে পারি, ইচ্ছে
করেই অমন খাপছাড়া চালচলন আর বেপট কান্ডকারখানা ছিল তার। হঠাৎ সে তড়াক করে লাফিয়ে
উঠে বলল, “মা দুগ্গার হাতে অস্তর নেই, অথচ
অসুরের বুকে রক্ত! আইব্বাপ!” বলে হাত-পা ছুঁড়ে এসে পড়ল
আমার ঘাড়ে। আমি সেই ধাক্কায় কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই পা গিয়ে পড়ল হলুদ জলভরা মাটির
সরাখানায়, যার ওপর আয়না রেখে একটু আগেই মা দুর্গার মুখ
দেখেছে সবাই। পায়ের চাপে সরা ভেঙে খান খান। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কালীদা, পাড়ার পুজোর পুরোহিত। ভয়ংকর বিরক্ত হয়ে বলল, “কী যে
করিস তোরা! এতে ঘোর অকল্যাণ হয়! স্কুল খুলেই না পরীক্ষা তোদের!”
রইল পড়ে ভাসান দেখা। দুরু দুরু বুকে বাড়ি
ফিরে এলাম। সত্যিই পুজোর ছুটির পর স্কুল খুলেই সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা। আর আমিই কিনা
ঠাকুরের সরা ভেঙে ফেললাম! রীতিমতো কাতর হয়ে পড়লাম পরীক্ষায় ফেল, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, না খেয়ে খেয়ে একদিন মরে যাওয়ার
সম্ভাবনায়!
আমাদের পাড়ার ঠাকুর আসত
সেই চন্দননগর থেকে। যদিও আমরা আহিরীটোলা–কুমোরটুলির খুব কাছেই, তাও ‘চন্নননগরের
পীতিমে’ উত্তর কলকাতার ওই পুরনো পাড়ার লোকেদের খুব পছন্দের
ছিল। পুজোমণ্ডপের কোনও বাহার ছিল না। বিরাট এক একচালা মন্দিরের মতো বাঁশের কাঠামোয়
ত্রিপল ঢাকা সেই মণ্ডপ হত একেবারেই নিরাভরণ। ভেতরে হয়তো কুঁচি দেওয়া রঙিন কাপড়ের
একখানা সাদামাটা ছাদ, আর চালচিত্রের পিছনের কাপড় টকটকে লাল।
কিন্তু ওটুকু রঙও দরকার হত না। কারণ, আগাগোড়া শোলার সাজে অপরূপা সেই
দুর্গামূর্তির সামনে দাঁড়ালে আর কোনওদিকে নজর যেত না। ষষ্ঠীর বোধনের সন্ধ্যায়, অষ্টমীর সকালের পুষ্পাঞ্জলিতে, দশমীর বরণে সবাই অপলক চেয়ে থাকত উষ্ণ গোলাপি আভার সেই জগদ্ধাত্রী মুখের
দিকে।
মহালয়ার পর পরই চন্দননগর
থেকে ট্রাকে চড়ে ন্যাড়া-বোঁচা মাটির ঠাকুর মাঝরাতে এসে পৌঁছত পাড়ার মণ্ডপে। বরণ
করে সেই মূর্তিকে তোলা হত। ছোটোবেলায় ঘুমের মধ্যে কেউ কেউ শুনতে পেতাম অস্পষ্ট
শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনি।
পরদিন ভোরবেলায় তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যেত। কোনওমতে মুখচোখ ধুয়েই দৌড় দৌড়। পুজোর মাঠে
গিয়ে দেখতাম চারদিক আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন সপরিবারে মা দুগ্গা। যদিও সেই মাটির
মূর্তির মুখগুলোই কেবল চোখমুখ এঁকে তৈরি। আর হাতের পাতাগুলো। বাকি মেটে শরীরটায়
কেবল একটা সাদা রঙের প্রলেপ।
মা দুর্গা, লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে লালপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি
পরিয়ে দিতেন পাড়ার মেয়ে–বউরা। যদিও ওটা সাময়িক। তিনজনেরই
মাথা থেকে পা শেষপর্যন্ত ঢাকা পড়ত সাদা শোলার সাজে। মাথায় কালো রঙ করা পাটের চুল
লাগানো হত, সিংহের মাথায় শনের কেশর, অসুরের
কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা ঝাঁকড়া বাবরি চুল, কার্তিকের সামনে
ফাঁপিয়ে রাখা অ্যালবার্ট কাট, সরু পাকানো গোঁফ। আমাদের
কার্তিক–গণেশ ধুতি পরত। সরু পাড়ের ধবধবে সাদা শান্তিপুরি
ধুতি। শুধু গণেশের মাথায় একটা ছোটো শোলার মুকুট গোছের থাকত। কিন্তু কার্তিক প্রায়
অলঙ্কারহীন। সে তো দেবসেনাপতি। শুধু দু’হাতের মণিবন্ধে থাকত শোলার চওড়া বালা।
এই যে এতসব গয়নাগাটি, এগুলো তৈরি হত আমাদের চোখের সামনে। গাঁটরি বাঁধা
খসখসে বাদামি শোলার বান্ডিল আসত, সঙ্গে মালাকারেরা। ওদের এক
বিশেষ ধরনের সরু বাঁকানো ছুরি থাকত। সেই ছুরির লম্বা টানে বাদামি খোসা ছাড়িয়ে বের করে
আনা হত ঝকঝকে সাদা শোলা। তারপর নিপুণ দক্ষতায় তাই দিয়ে তৈরি হত ঠাকুরের সাজ। ওই
শোলার কারিগরদের থেকে তখনই শিখেছিলাম, গলার নিচ থেকে পা
পর্যন্ত ঝোলে কারুকাজ করা যে চওড়া অংশটা, তাকে বলে পাটা। তার
দু’পাশে আঁচল, কোল–আঁচল। দশ থেকে বারোজন
কারিগর মিলে দিনরাত কাজ করে তিন–চারদিনে তৈরি করে ফেলত পুরো
সাজ। একটু একটু করে তৈরি হয়ে যেত বিরাট শোলার মুকুট। চোখের সামনে সাদামাটা মাটির
মূর্তি থেকে চোখজুড়নো প্রতিমার ‘ঠাকুর’ হয়ে ওঠা দেখতাম আমরা।
পঞ্চমীর সন্ধেয় হত আরও
একটা দারুণ ব্যাপার, যা
নিয়ে আমাদের আগ্রহ আর উত্তেজনা থাকত তুঙ্গে। প্রতিমার হাতে অস্ত্র দেওয়া হত। আর পাঁচটা বারোয়ারি পুজোয় যেরকম টিনের তৈরি ফনফনে ত্রিশূল আর খড়গ
দেওয়া হয়, আমাদের পাড়ার ঠাকুরের তেমনটা
ছিল না। আমাদের ঠাকুরের অস্ত্র ছিল বেশ ভারী আর জমকালো নিকেল করা। ঠাকুরের দশ হাতে
দশ প্রহরণ ধরিয়ে দিত পাড়ার দাদারা। তার মধ্যেও কখনও-সখনও আমাদের ছোটোদের কাউকে
ডেকে নেওয়া হত সাহায্য করার জন্যে। যেন কপাল খুলে যেত আমাদের। সবথেকে বেশি আকর্ষণ
ছিল অসুরের ভারী খাঁড়াটার। তার পরে গণেশের গদা, মা দুর্গার
হাতের বজ্র।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম, যদি একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও ছুঁয়ে দেখার
সুযোগ পেতাম।
আর ঠাকুরের সাজগোজ শেষ
হয়ে যাওয়া মানেই পুজো শুরু। ষষ্ঠীর সকাল থেকে কতবার যে অকারণে এক চক্কর ঘুরে আসতাম
পুজোর মাঠে। শুধু ওই মন ভালো করে দেওয়া দেবীমূর্তি আরও একবার দেখব বলে। আর বোধনের
সন্ধেয় যখন বেজে উঠত ঢাক, ধূপধুনোর
ধোঁয়ায় দুর্গার ওই আয়তনয়ান হাসিমুখের দিকে যতবার চোখ যেত, সত্যিই
মনে হত, ঠিক যেন মায়ের মতো।
_____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment