গল্পের ম্যাজিক:: ভোরের স্বপ্ন - রাজীবকুমার সাহা


ভোরের স্বপ্ন
রাজীবকুমার সাহা

ঘন সবুজে মোড়া এক টিলায় থাকে এক জুমিয়া পরিবার বছর সাতেকের দুই যমজভাই মঙ্গাই-লঙ্গাই আর তাদের মা কুসুমতি মঙ্গাই-লঙ্গাই বছর দুয়েক আগেই তাদের বাবাকে হারিয়েছে গভীর জঙ্গলে বাঁশ-কড়ুল তুলতে গিয়ে দাঁতাল বুনো শুয়োরের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিল সে কুসুমতি বেজায় কষ্ট করে মানুষ করছে ছেলেদুটোকে সারাদিন জুমক্ষেতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিকেল পড়তেই আনাজপাতির ঝুড়ি পিঠে টিলা বেয়ে নেমে যায় সমতলের হাটে তারপর একটা কুপি জ্বেলে ফিরে আসে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে মঙ্গাই-লঙ্গাই তখন টিলার মাথায় টংঘরে বেড়ার দরজা এঁটে বসে থাকে জড়সড় হয়ে থেকে থেকে শেয়াল, কুকুর, ঝিঁঝিঁর ডাক আর গাছগাছালির পাতায় পাতায় বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দে চমকে চমকে ওঠে

সেদিনও আর পাঁচটা দিনের মতোই জুমে ব্যস্ত ছিল কুসুমতি ক্ষেত কুপিয়ে গাদা গাদা ছাই আর শুকনো গোবরের চাকা গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিচ্ছিল মাটির সঙ্গে হঠাৎ কী খেয়াল হল, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটু দূরে ঝাঁকড়া কুর্চিগাছটার নিচে শুধু লঙ্গাই একা বসে মনের আনন্দে এক টুকরো মায়দুল (শুকনো ভাতের মোচা) চিবোচ্ছে ইতিউতি কোত্থাও মঙ্গাইয়ের পাত্তা নেই বুকটা ধড়াস করে উঠল কুসুমতির দৌড়ে গিয়ে লঙ্গাইকে জিজ্ঞেস করতেই সে আঙুল তুলল দূরের একটা ঝোপের দিকে মঙ্গুটা জন্ম থেকেই বেজায় দুষ্টু, বেপরোয়া দুদণ্ড একজায়গায় বসে না কুসুমতি ছুটে গেল সেদিকে
না, ঝোপটার চারদিক আর এদিক সেদিক খুঁজেও মঙ্গাইকে পাওয়া গেল না কোত্থাও দুদিন আগেই স্বামীকে হারানোর আতঙ্ক দুঃস্বপ্নের মতো জমাট বেঁধে রয়েছে বুকে কুসুমতি কাঁদতে বসল
হঠাৎ আবছা কানে এল খিলখিল হাসির আওয়াজ দখিন-পুব কোণের ওই জংলাটার ভেতর থেকে আসছে যেন কুসুমতি লঙ্গাইয়ের হাত টেনে ধরে পড়িমরি দৌড়ে গিয়ে ঢুকল জংলার ভেতরে তারপর যা দেখল তাতে সারা শরীর কাঠ হয়ে গেল তার
মঙ্গাই মনের আনন্দে পুতুলের মতো তুলতুলে একটা বাঘছানাকে জড়িয়ে ধরে হুটোপুটি খাচ্ছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে কুসুমতি কী করবে স্থির করতে না পেরে তাড়াতাড়ি দুটোকে ছাড়িয়ে দিল প্রথমে তারপর হাঁটু গেড়ে বসে মঙ্গাইয়ের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে পরখ করতে লাগল কোথাও আঁচড় বা কামড়ের দাগ চোখে পড়ে কি না মঙ্গুর ওদিকে হুঁশ নেই সে হেসেই চলেছে
এমনি সময় পিঠের দিকে কীসের একটা ছোঁয়া পেতেই শিউরে উঠল কুসুমতি বাঘছানাটা সামনের দুই থাবা কুসুমতির পিঠে তুলে দিয়ে মুখ ঘষছে তার গায়ে শরীরজুড়ে আতঙ্কের এক ঝলক বিদ্যুৎ বয়ে যেতেই ছিটকে সরে এল কুসুমতি পরক্ষণেই কীসের এক অনুভূতিতে টনটন করে উঠল বুকটা আহা রে, ওটুকু দুধের শিশুটা একা হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই মা-বাঘটাকে কেউ মেরে ফেলেছে, নয়তো অন্য কোনও বিপদে পড়েছে বাঘছানাটা ততক্ষণে আবার কুসুমতির কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে এসে আর অনবরত গোঁফ চেটে চলেছে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়ই মঙ্গাইয়ের দেখাদেখি লঙ্গাইও ততক্ষণে খানিকটা সাহস জুটিয়ে বাঘছানাটার গায়ে হাত বুলোতে লেগেছে
একটুক্ষণ থম মেরে থেকে শেষে মঙ্গাই-লঙ্গাইয়ের লাগাতার আবদার আর নিজের মমতার কাছে হার মেনে ছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এল কুসুমতি দুভাই মিলে ছানাটার নাম রাখল বাঘা

দিন যায় মঙ্গাই-লঙ্গাই বড়ো হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে বাঘা গা-গতরে দুভাইকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে আগেই দিন দিন তেজ বাড়তে থাকে তার মানুষের সঙ্গে থেকে মানুষের মতোই বড়ো হতে থাকে সে কুসুমতির চোখে বাঘা মঙ্গাই-লঙ্গাইয়ের চেয়ে আলাদা কেউ নয়
দেখতে দেখতে বছর দশেক পার হয়ে গেল মঙ্গাই-লঙ্গাই এখন বছর পনেরোর তাগড়াই ভূমিপুত্র আর বাঘা তো এক্কেবারে পূর্ণবয়স্ক মঙ্গাই বেশ চালাক-চতুর ছেলে তুলনায় লঙ্গাইটা খানিক মাথামোটা নিজের বুদ্ধিসুদ্ধি না খাটিয়ে মঙ্গাই যা বলে তাই মেনে নেয় নির্বিবাদে
ইদানিং একটা জিনিস লক্ষ করেছে মঙ্গাই, বাঘা কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়ছে দিন দিন সারাদিন বেতের চাটাই পাতা দাওয়ায় বসে থাকে দুই থাবায় মুখ গুঁজে এক শুধু যেদিন শিকারে বেরোয় দুই ভাই, সেদিন তার ফুর্তি দেখে কে জঙ্গলে ঢুকে নিমেষে মোরগটা, শুয়োরটা তুলে নিয়ে আসে ঘাড় কামড়ে দু-চারদিন অন্যদের মতোই মাংসের স্বাদ পায় বাঘা তারপর আবার অলস বসে থাকে তবে তার চোখের দৃষ্টিতে হামেশা কী একটা খেলা করে বেড়ায়, মঙ্গু তা লক্ষ করেছে

ঘন বাদলা কাটিয়ে ভাদ্রের কড়া রোদ পড়তে না পড়তেই একদিন মঙ্গু-লঙ্গুকে ছেড়ে চলে গেল কুসুমতি মাত্র দিন তিনেকের জ্বরে কবিরাজমশাই ওষুধ পালটানোরও সুযোগ পাননি তেমন কুসুমতি চোখ বুজতেই বাঘা যেন সাপের পাঁচ পা দেখতে পেল কুসুমতির মধ্যে কী ছিল কে জানে, বাঘা কোনওদিনও অবাধ্য হয়নি তার এখন সে একা একাই কোথায় সটকে পড়ে যখন তখন এদিক ওদিক থেকে চুপিসারে হাঁসমুরগি, শুয়োর-বাছুর গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা কানে আসে মঙ্গুর কেমন যেন সন্দেহ হয়, এ বুঝি বাঘারই কাজ
দু-চারদিন কাটতে না কাটতেই বাঘা একদিন এসে দাঁড়াল লঙ্গুর সামনে কাঁচুমাচু মুখে বলল, “লঙ্গুভাই, একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম ঠিক ভোরবেলায় তবে কেমন করে যে তোমায় বলি বুঝতে পারছি না মনটা খুব ভার হয়ে আছে
লঙ্গু তখন উঠোনে বসে টাক্কাল ধারাচ্ছিল মঙ্গাই জুমে চলে গেছে ভোর ভোর লঙ্গাইও পান্তা খেয়ে জুমে যাবে খানিক বাদেই আহ্লাদভরে জিজ্ঞেস করল, “কী স্বপ্ন রে, বাঘু? কী দেখলি?”
বাঘা মুখ ভার করে বলে, “আর বোলো না এমন স্বপ্নের মানে হয়? অথচ শাস্ত্রে আছে ভোরের স্বপ্ন অবহেলা করলে দারুণ পাপ হয়
আহা, ধানাইপানাই বন্ধ করে কী দেখলি সেটাই খুলে বল না!” অধৈর্য হয়ে ওঠে লঙ্গাই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে বিন্নি ধানের ক্ষেতের ঘাসগুলো বেছে ফেলতে হবে রোদ চড়ার আগেই
বাঘা একবার লঙ্গাইর পানে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল, “দেখলাম, কে একজন দেবতা, আমি ঠিক চিনতে পারলাম না জান, চোখ পাকিয়ে বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে মেরে খেয়ে ফেলতেবলেই মাথা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাঘা
কথাটা কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুখটা সাদা হয়ে গেল লঙ্গাইর আমতা আমতা করে বলল, “দে-দেবতা! কো-কোন দেবতা চিনতে পারিসনি?”
বাঘা মাটিতে চোখ রেখেই জবাব দেয়, “না গো লঙ্গুভাই, চিনতে পারিনি তোমাদের ওসব দেবদেবতা কি আর আমার চেনার কথা?”
লঙ্গাই চেষ্টা করে একটু হাসি টেনে আনল মুখে বলল, “যাহ্‌, তুই মশকরা করছিস কেন বল তো খামোখা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে সর
বাঘা এবারে খানিকটা মরিয়া হয়ে উঠল তাড়াতাড়ি বলল, “একদম সত্যি বলছি আমি একদিন নয়, অন্তত চার-পাঁচদিন ধরে একই স্বপ্ন দেখছি আমি শেষে আজ ইনি দেখা দিয়ে বললেন, এবারে আর দেরি করলে ঘোর বিপদ হয়ে যাবে
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে লঙ্গাই বলল, “আচ্ছা, আজ জুম গিয়েই মঙ্গাইকে বলব কথাটা তারপর ও যা বলবে, তাই হবে কেমন?”
বাঘা চকচকে চোখে ঘাড় নাড়ে

মঙ্গাই সবই বুঝল বাঘার মুখে এখন কাঁচা মাংসের স্বাদ লেগেছে এ থেকে তাকে ফেরানো অসম্ভব বাঘার চোখমুখ ধূর্ত হয়ে উঠছে দিন দিন এতদিন সে যে রাতবিরেতে ঘুমিয়ে থাকতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে দুভাইকে সাবাড় করে দেয়নি, এই রক্ষে তবে সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, তখন শেষ চেষ্টা একটা করতে হবে বৈকি
মঙ্গাই সন্ধেবেলা জুম থেকে ফিরে বাঘাকে ডেকে বলল, “ভাই বাঘা, তুই মহা পুণ্যবান যে অমন একখানা স্বপ্ন দেখেছিস, স্বয়ং ভগবান তোকে দেখা দিয়েছেন লঙ্গাইকে মেরে খেয়ে ফেললে যদি তোর স্বপ্ন পূর্ণ হয়, আমার ভাই তাতে আপত্তি নেই বিন্দুমাত্র চাই কি পরে একসময় আমাকেও খেয়ে ফেলতে পারিস তোর ভোগে লাগতে পারলে ধন্য মনে করব নিজেদের আমরা দুভাই
লঙ্গাইর তো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে আতঙ্কে মঙ্গাই এ কী বলছে! এত সাধের শরীরটা শেষে এক বাঘের পেটে যাবে! যেটাকে কিনা মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনে সবাই মিলে বড়ো করে তুলেছে, সেটার পেটে! অকৃতজ্ঞ আর কাকে বলে আর মঙ্গাইও কিনা সেই বদমাশ বাঘেরই পক্ষ নিল শেষে? এজন্যেই বোধহয় জুমে সব ঘটনা শুনে মুচকি মুচকি হাসছিল মঙ্গাই? চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল লঙ্গাইর দারুণ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল মঙ্গাই তাকাতেই
ওদিকে বাঘার তো নাল গড়িয়ে এই পড়ে তো সেই পড়ে অবস্থা খুশি হয়ে গলায় মধু ঢেলে বলল, “আসলে আমিও তো এ পরিবারেরই একজন তা বাঘ বলে কি আর মানুষ নই? তোমাদের অমঙ্গল আমি ডেকে আনি কী করে, বল?”
মঙ্গাই এবারে গম্ভীর গলায় বলল, “সে দশ কথার এককথা বলেছিস, ভাই তবে কিনা একটা শর্ত রয়েছে আমার আমিও তোর মতো একখানা স্বপ্ন দেখেছি কিনা আমারও তো নিজের দেখা স্বপ্নের মান রক্ষা করতে হয়, বল!”
বাঘা খানিক দমে গিয়ে শুধোল, “কী স্বপ্ন, মঙ্গুভাই? আর শর্তটাই বা কী?”
আমার ইষ্টদেবতা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে আমরা দুভাই যেন তোর পেটে যেতে আপত্তি না করি তবে তোকে খেতে হবে অন্য যে কোনও তিনজনের অনুমতি নিয়ে তারা বিচার বিবেচনা করে সম্মতি জানালে তবেই আর শর্তটা হল, মারবি খাবি সব ঘরে ফিরে এই উঠোনেই পরের জায়গায় আমার ভাইয়ের একফোঁটা রক্তও পড়তে পারবে না রাজি থাকিস তো বল
বাঘ-ব্যাটা কী বুঝল কে জানে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় কাত করে রাজি সিদ্ধান্ত হল, পরদিন ভোরে বেরিয়ে যে তিনজনের সঙ্গে প্রথমে দেখা হবে একে একে তাদেরকেই বিচার করার ভার দেওয়া হবে
সেইমতো পরদিন কাক ডাকতেই লঙ্গাই আর বাঘা বেরিয়ে গেল উঠোন পেরিয়ে লঙ্গাই আকুল নয়নে বারবার টংঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মঙ্গাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিল ফিরে ফিরে তার প্রিয় এই আশ্রয়ে আর ফিরে আসতে পারবে কি না কে জানে মঙ্গাইয়ের রাখা ওই শর্তটুকুই যা ভরসা সঙ্গে কুসুমতির দিব্যিও অবশ্য দিয়েছে মঙ্গাই কিন্তু লঙ্গাই ওই অকৃতজ্ঞটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে কীভাবে?

বনবাদাড় মাড়িয়ে খানিকটা এগোতেই সামনে পড়ল একটা বড়সড় বানর দুজনে মিলে বানরটাকেই প্রথম বিচারপতি হিসেবে ঠিক করল লঙ্গাই হাঁক দিল, “ও বানরভাই, আমাদের একটা বিচার করে দাও না ভাই
বানর উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সবচেয়ে নিচু ডালটায় নেমে বসল এসে দারুণ কৌতূহল হল তার জিজ্ঞেস করল, “কী বিচার গো, মানুষের পো?”
লঙ্গাই বাঘার সেই স্বপ্নের কথা ব্যাখ্যা করেছে কি করেনি, বাঘা বানরকে লঙ্গাইর অলক্ষ্যে অ্যায়সা দাঁত খিঁচুনি দিল যে বানর ব্যাটা তিন লাফে ফের সেই উঁচু ডালে ওখানে নিরাপদ দূরত্বে বসে ক্যাঁচরম্যাচর করে রায় শোনাল, “মামলায় লঙ্গাই হারল, বাঘা জিতল লঙ্গাইকে বাঘার এখনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলা উচিত
মনমরা লঙ্গাই বলল, “আরও দুজন বাকি রয়েছে, বাঘা চল
অতএব আবার হাঁটা হাঁটতে হাঁটতে এক খামারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল দুজনে কেউ নেই কোথাও এর মধ্যে খানিক দূরেই জমানো গোবরের ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে বেজায় গর্বে গলা উঁচিয়ে একটা মোরগ ডেকে উঠতেই ঘাড় ফেরাল লঙ্গু আর বাঘা অগত্যা মোরগকেই দ্বিতীয় সালিশি মানতে হল মামলার শুনানি শেষ হতেই বাঘার এক চোখ রাঙানিতে মোরগ উড়ে-দৌড়ে কোনওরকমে প্রাণ নিয়ে পালাল বলতে বলতে গেল, “বাঘামামার স্বপ্ন পূর্ণ হোক
লঙ্গাইর ততক্ষণে বুক কাঁপতে শুরু করেছে একটা ঢোঁক গিলে কোনওমতে বলতে পারল শুধু, “আর একজন
খানিক এগোতেই দেখা মিলল এক বাদুড়ের সারারাত চষে বেড়িয়ে এবারে আস্তানায় ফিরছিল সে তুলোগাছের ন্যাড়া ডালে উলটো ঝুলে সমাহিতের মতো খুব মনোযোগ দিয়ে পুরো ঘটনা শুনল সে প্রথমে তারপর গলা খাঁকরে বলল, “এ তো সাঙ্ঘাতিক গম্ভীর বিষয়, হে এভাবে হুট করে কোনও রায় শোনানো যায় নাকি, অ্যাঁ? আমি তো বলি, এ জঙ্গলে এমন কেউ নেই যে নিরপেক্ষভাবে এ মামলার নিষ্পত্তি করতে পারে বলি কী, বরং রাজার কাছেই একবার যাও তোমরা ওখানে অনেক বুদ্ধিমান মন্ত্রী-সান্ত্রীরা রয়েছেনকী হে, কী বল বাঘা? আর তোমার ওই হম্বিতম্বি আমাকে অন্তত দেখিও না, ভাই রাতে কখন দেখবে চোখদুটো গেলে দিয়ে গেছি, বুঝলে?”
বাঘা দোনামনা করতে লাগল ভেতর ভেতর তেতে উঠছিল সে প্রথম দুই হাকিমের রায় যেন তেন প্রকারে নিজের পক্ষে টেনে নেওয়া গেছে এবারে তৃতীয়জনকেও খানিক ধমকে ধামকে দলে টানতে পারলেই কাজ হাসিল হয়ে যায় চাপা একটা আনন্দে টগবগ করছিল এতক্ষণ ভেতরটা পাজি বাদুড়টা দিল জল ঢেলে এক্কেবারে এখন আবার দশ ক্রোশ ঠেঙিয়ে রাজবাড়ি যাও কী কুক্ষণেই যে মানতে গেল মঙ্গুর কথা
ওদিকে বাদুড়ের প্রস্তাবে বুকে খানিকটা বল এসেছে লঙ্গুর বলল, “ও বাদুড়ভাই, একটা কথা রাখবে? তুমিও চল না আমাদের সঙ্গে যাবে ভাই?”
বাদুড় পড়ল মহাবিপদে এমনিতেই দিনেমানে ভালো চোখে দেখতে পায় না সে দিনকানা মানুষ তার ওপর রাজরাজড়াদের ব্যাপার-স্যাপার পান থেকে চুন খসলেই কখন কার গর্দান যায় বলা মুশকিল এদিকে লঙ্গাইয়ের আকুল আর্তি সরলসিধে ছেলেটা ছলচাতুরীর শিকার হতে যাচ্ছে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে ইমান বলতেও তো কথা আছে একটা, নাকি!
খানিক চুপ করে ভেবে নিয়ে বাদুড় রাজি হল শেষে বলল, “ঠিক আছে, চল যাচ্ছি তবে পথে আমি কিন্তু এক বন্ধুর বাড়ি যাব একবার দেখা হয়নি অনেকদিন তোমরা সোজা দরবারে ঢুকে যাবে আমি যথাসময়ে উপস্থিত থাকব সেখানে উড়ে যাব কোনাকুনি, হয়তো দেখবে তোমাদের আগেই পৌঁছে গেছি ভেবে দেখো
লঙ্গাই এককথাতেই ঘাড় কাত করে ফেলল বাঘার কোনও হেলদোল নেই ওর এখন নিজের থাবা নিজে কামড়াতে ইচ্ছে করছে দুজনেরই পেট চুই চুই করছে খিদেয়

গণ্ডায় গণ্ডায় খাড়াই উতরাই আর বনজঙ্গল পেরিয়ে লঙ্গু আর বাঘা যখন রাজবাড়ির প্রকাণ্ড ফটকের মুখে এসে দাঁড়াল সূর্য তখন ঢাল বেয়ে নিচে নামার তাল করছে কমবয়সী এক ছোকরার সং সাজিয়ে এক বাঘ নিয়ে সটান ফটক পেরোনোর চেষ্টা করতে দেখে সান্ত্রী-সেপাই সব রে রে করে তেড়ে এল বাঘা দাঁত খিঁচিয়ে ঘ্রাউ করে পেল্লায় এক হাঁকার ছাড়তেই লাঠি সড়কি ফেলে পরক্ষণেই চোঁ চা দৌড় সবাই লঙ্গু আর বাঘা সোজা গিয়ে হাজির হল রাজসভায় রাজা তখন সভা মুলতুবি ঘোষণা করে অন্দরমহলে যাওয়ার ফিকিরে আছেন বাঘা হাতজোড় করে বলল, “মহারাজ, বিচার চাই
রাজা চোখ গোল্লা গোল্লা করে বললেন, “আরে দ্যাখো দ্যাখো, এ যে মানুষের গলায় কথা কইছে, দ্যাখো!” তারপর লঙ্গাইয়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, “অ্যাই জাদুকর, তোমার জাদু দেখার সময় নেই এখন সভা আজকের মতো সাঙ্গ হয়েছে পার তো কাল এস সক্কাল সক্কাল এখন বিদেয় হও তো বাপু
লঙ্গাই তাড়াতাড়ি বলল, “এ সত্যিই রক্তমাংসের বাঘ, মহারাজ আর আমিও কোনও জাদুকর নই আমরা বিচারপ্রার্থী
এ কথায় ভীষণ বিরক্ত হলেন মহারাজ বললেন, “সময় নষ্ট না করে শিগগির শোনাও তোমাদের ফরিয়াদ
লঙ্গাই আর বাঘা একে একে যার যার বক্তব্য পেশ করল সব শুনে তো সভায় হাসির রোল উঠল বিচার হবে কী! মহারাজ তেতো গলায় বললেন, “কী জ্বালা! মহামন্ত্রী, দেখুন তো ব্যাপারখানা কী আমি অন্দরে চললাম আর যদি বোঝেন যে দুটোই মিছে কথা কইছে, সময় নষ্ট করছে তবে সোজা ফাটকে পুরে রাখবেন কাল সভায় এসে গর্দান নেব
লঙ্গুর তো বটেই, মহারাজের এ হুকুমে বাঘা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপতে লাগল ঠক ঠক করে লঙ্গাই প্রাণপণে বাদুড়কে স্মরণ করে চলেছে সেই যে বন্ধুর বাড়ির নাম করে মাঝপথে উধাও হয়ে গেল সে, আর তো নামগন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না তার কাঁদোকাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল লঙ্গাই
এমনি সময় মহারাজ সভা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই কী একটা থপ করে পড়ল তাঁর পায়ের সামনে পড়েই তুর্কি নাচন লাগাল সেটা লঙ্গাইয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল একচিলতে অস্ফুটে বলল, “বাদুড়ভায়া! ছিলে কোথায় এতক্ষণ?”
নাচ থামিয়ে বাদুড় হাতজোড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মহারাজের সামনে বলল, “মাপ করবেন হুজুর, ওই থামের কার্নিশে বসেছিলাম চুপটি করে কখন চোখ লেগে গেল আর পা আলগা হয়ে পড়ে গেলাম টেরটি পাইনি
মহারাজ দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, “তা বসেছিলি বেশ কথা নাচছিলি কেন রে, হতভাগা?”
বাদুড় খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, “কী করব মহারাজ, ওই তন্দ্রামতো আসতেই একটা দারুণ স্বপ্ন দেখলাম যে!”
তুই আবার স্বপ্নও দেখিস! বলিস কী রে! তা কী স্বপ্ন দেখলি, শুনি?”
দেখলাম, আজ সন্ধেতে আপনি নিজে বসে থেকে রাজকন্যেকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন এ স্বপ্নে কার না আনন্দ হবে বলুন
মহারাজ বাদুড়ের এই আস্পর্ধায় এত ভয়ংকর রেগে গেলেন যে কী করবেন, কী বলবেন ঠিক করতে পারলেন না কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে বসে পড়লেন সিংহাসনে আবার
মহামন্ত্রী এগিয়ে এসে ধমকে উঠলেন, “অ্যাই কে আছিস, এটাকে খাঁচায় ঢোকা আগে যা হোক কিছু স্বপ্ন দেখলেই হল আর কী! রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে? ইয়ার্কি পেয়েছিস, অ্যাঁ?”
বাদুড় বিনীতভাবে বলল, “কেন হবে না, হুজুর? বাঘার দেখা স্বপ্নের কারণে যদি সে লঙ্গাইকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয় তবে এ তো সাধারণ ব্যাপার আপনারা আমার স্বপ্ন সার্থক করতে সামান্য বিয়েটার আয়োজন করতে পারেন না?”
বাদুড়ের এই জোর সওয়ালেও টনক নড়ল না রাজসভার রায় অভাগা লঙ্গাইয়ের বিপক্ষেই গেল বাঘা যেহেতু স্বপ্ন দেখেছে আর লঙ্গাই থেকে বাদুড় সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তা মানছে সেক্ষেত্রে লঙ্গাইয়ের আর্জি অবৈধ ক্ষুণ্ণমনে সে ফিরে চলল টগবগ করে ফুটতে থাকা বাঘার সঙ্গে মঙ্গাইয়ের শর্তমতো বাঘার তো এখন শুধু বাড়ি পৌঁছনোটুকুই অপেক্ষা মাত্র পথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় বাদুড় বিষণ্ণ মনে বলে গেল, “পারলাম না ভাই লঙ্গাই, ক্ষমা কোরো

লঙ্গাই আর বাঘা যখন গাঁয়ের সীমানায় ঢুকল তখন বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে ঘন গাছগাছড়া বেয়ে খানিক এগোতেই মঙ্গাই বেরিয়ে এল কোত্থেকে লঙ্গাইকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ফিরে এসেছিস, ভাই! খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম রে চল, ওই রাস্তায় ঘরে চলে যাই তাড়াতাড়ি হবে আয় বাঘা
ক্রোশটাকও এগোয়নি ওরা হঠাৎ চারদিক থেকে দাউ দাউ আগুনের মশাল জ্বেলে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী হৈ হৈ করে দৌড়ে এসে একটা গর্তকে ঘিরে দাঁড়াল হাতে হাতে মোটা বাঁশের লাঠি আর মোটা মোটা কাছি গর্তর গভীর থেকে উঠে আসছে বাঘার গর্জন লঙ্গাই অবাক দৃষ্টিতে মঙ্গাইয়ের দিকে তাকাতেই সে বলল, “সারাদিন ধরে এই ফাঁদটা তৈরি করেছিলাম ওই শয়তানটার জন্যে গভীর গর্ত করে মুখটা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম ইচ্ছে করেই তোদের এই পথে ডেকে এনে বাঘাকে ফেললাম এই ফাঁদে
লঙ্গাই জিজ্ঞেস করল, “কী করবি এখন ওকে, ভাই?”
তেমন কিছু নয় একটু সেবা করে ছেড়ে দেব কত কষ্ট করল আজ সারাদিন বেচারা, বলমুচকি হাসল মঙ্গাই
এরই মধ্যে সবাই মিলে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে টেনে হিঁচড়ে তুলে এনেছে বাঘাকে বাঁশের সহস্র খোঁচায় আধমরা হয়ে পড়ে রয়েছে ঘাসের ওপর কোনওমতে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, “আমার অপরাধটা কোথায়, মঙ্গাইভাই? রাজাও তো শেষে আমার পক্ষেই রায় দিলেন তাহলে তোমরা আমার সঙ্গে এমনধারা ব্যবহার করছে কেন?”
মঙ্গাই এগিয়ে এসে জবাব দিল, “তোমার কোনও অপরাধ নেই ভায়া সব দোষ ওই পোড়া স্বপ্নের হয়েছে কী, ভোরবেলা তোমরা বেরিয়ে পড়তেই আমি জুমে চলে গেলাম সারাদিন খাটুনির পর বিকেল দিকে খানিক জিরোতে বসে কখন চোখ লেগে গেল টেরই পাইনি এরই মধ্যে ঠিক ভর সন্ধেবেলা দেখলাম আরেক স্বপ্ন
লঙ্গাই এবারে উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী স্বপ্ন রে, ভাই? কী দেখলি?”
দেখলাম, সেই ইষ্টদেবতা নির্দেশ দিচ্ছেন, আমাদের ঘাড় মটকাবার আগে বাঘাকে যেন অবশ্যই আগুনের কুণ্ডে শুদ্ধ করে নেওয়া হয় নইলে বাঘার স্বপ্নপূরণে পুণ্যলাভ হবে না তা আগুনে ফেলে দিলে তো পুড়েই মরবে বেচারা তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম যে ওর গায়ে গরম কিছু একটা ছুঁইয়ে দিলেই হবে ভোরের স্বপ্নের মতো ভর সন্ধের স্বপ্নও কিন্তু পবিত্র তার মান রাখতে হয় শাস্ত্রে আছেবলেই ঘাড় ফিরিয়ে হাঁক দিল মঙ্গাই, “কই গো, হল তোমাদের? শিকটা নিয়ে এস শিগগির বাতাস লাগলে ঠাণ্ডা না হয়ে যায় আবার
লঙ্গাই বিস্ফারিত চোখে লক্ষ করল, কে একজন কাঠে গাঁথা আগুনে পোড়া লোহার মোটা একটা লাল গনগনে শিক এগিয়ে ধরেছে মঙ্গাইয়ের দিকে বাঘা প্রাণপণে ধড়ফড় করে যাচ্ছে; দড়িদড়া ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সম্ভব হচ্ছে না

বছর পাঁচেক কেটে গেছে তারপর লেজকাটা বুড়ো বাঘা এখন ঘন জঙ্গলের গহিনে মোটা একটা গাছের গুঁড়ির নিচে পড়ে পড়ে মৃত্যুর দিন গুনছে পিঠে একটা বিরাট বড়ো পোড়া দাগ কালো হলুদে ডোরার ফাঁকেও স্পষ্ট আলাদা করে চোখে পড়ে গাঁয়ের লোকেরা সেদিন লেজখানা মুড়িয়ে কেটে রেখে দিয়েছিল বাঘার স্মৃতি রক্ষার্থে সেদিনের পর জীবনে আর কোনওদিন গাঁ মুখো হয়নি সে
_____
(ত্রিপুরদেশের লোককথা)
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়

2 comments:

  1. খুব সুন্দর লেখা। লেখকের কলম দীর্ঘজীবি হোক।

    ReplyDelete
  2. বড়ো ভালো গল্প, শুধু শেষে কেমন যেন দুঃখের ভাব হয়ে গেল।

    ReplyDelete