আমার ছোটোবেলা:: আমার ছেলেবেলা - রূপা মজুমদার


আমার ছেলেবেলা
রূপা মজুমদার

আমার ছেলেবেলা লিখতে বসে আজ মনের মধ্যে একগুচ্ছ স্মৃতি ভিড় জমিয়েছে। সবচাইতে বেশি মনে পড়ছে বাবার কথা। তিনি এখন আমাদের মধ্যে নেই। তিন বছর আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে তিনি চলে গেছেন। আমার একদম ছোটোবেলায় বাবা প্রথমে শিলিগুড়ি, তারপরে বহরমপুরে পোস্টেড ছিলেন। আমার যখন চার বছর বয়স তখন বাবা কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে আসেন। শিলিগুড়ির কথা আমার প্রায় কিছুই মনে নেইশুধু মনে আছে আমাদের রান্নাঘরের জানালা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত। বহরমপুরে সেন্ট ইমাকিউলেট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু বছরের মধ্যভাগে বাবার ট্রান্সফার হওয়াতে দু-তিন মাসের মধ্যেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। মনে আছে, আমাদের চলে আসার আগের দিন স্কুল থেকে দুজন সিস্টার বাড়িতে এসে আমাকে একটি গ্রিটিংস কার্ড, বই ও একটি খেলনা-ট্রেন উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো এখনও সযত্নে রাখা আছে।
আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা ছিলেন আই.আই.টি.র ইঞ্জিনিয়ার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। স্বচ্ছলতার মধ্যে বড়ো হলেও বাজে আবদার বা বায়না আমার কোনদিনই ছিল না। প্রয়োজনের বাইরে কিছু চাইতে বা নিতে আমি কোনদিনই পছন্দ করতাম না। অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল বইয়ের ব্যাপারে। বই উপহার পেতে ভালো লাগত এবং বইয়ের দোকানে গেলে একসাথে অনেক বই কিনে ফেলতাম। আর ভালোবাসতাম গল্প শুনতে। ঠাকুমাকে মনে আছে আবছা আবছা। তিনি আমাকে মেছোভূতের গল্প শোনাতেন। মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাটের কাছে গোপালনগর আমাদের আদি নিবাসঠাকুমা বিয়ের পর বছর পাঁচেক ওখানে থাকেন। তারপর কলকাতায় চলে আসেন। ঠাকুরদা ছিলেন অঙ্কের মাস্টার। হেয়ার স্কুলের হেড মাস্টার। ঠাকুমার গল্পে বারবার চলে আসত গোপালনগর গ্রামের কথা। সন্ধ্যার পর স্টেশন থেকে যদি কেউ মাছ কিনে মেঠোপথ দিয়ে গ্রামে ফিরত, ভূতপেত্নীরা নাকি সুরে কেঁদে কেঁদে মাছ চাইত। এমনকি রাতের বেলায় সেই বাড়ির গিন্নি যখন মাছ ভাজতে বসত, সেই ঘ্রাণের টানে তারা অন্ধকার থেকে হাত বাড়িয়ে বলেই চলত - এঁকটা মাঁছ দেঁ নাঁ। আমার এই আজগুবি গল্প শুনতে খুব ভালো লাগত আর বার বার এই একই গল্প শুনতে চাইতাম। আবার ভয়ও পেতাম। ভয় পেলে ঠাকুমা বলতে শিখিয়েছিলেন
‘ভূত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি
রামলক্ষ্ম সাথে আছেন
করবে আমার কী?’
তা আমার এই ঠাকুমা অসুস্থ হয়েছেন, খবর এল বম্বে থেকে। তখন তিনি বম্বেতে ছিলেন আমার জেঠুর কাছে। আমি স্কুল থেকে বাড়ি এসে শুনলাম বাবা তৎক্ষণা বম্বে পাড়ি দিয়েছেন। আমি তখন কে.জি. ক্লাসে পড়ি সেন্ট থমাস স্কুলে। সেই রাতেই বাবা ট্রাঙ্ক-কল করে ঠাকুমার মৃত্যুসংবাদ দিলেন। মৃত্যুকে আমার সেই প্রথম জানা। কয়েকদিন পর মা আমাকে নিয়ে বম্বে গেলেন। আমার জেঠতুতো তিন দাদা মনে আছে, আমি অত শোক বা দুঃখ বুঝিনি। তিন দাদার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম। ঠাকুমার কাজ হয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুদিন বম্বেতে ছিলাম। আর বড়দা, মেজদা, ছোড়দা আর ওদের ফ্ল্যাটের বন্ধুদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গিয়েছিল। বড়ো হয়ে দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় কাজে বা বেড়াতে গিয়েছি। বম্বেও জেঠুর বাড়ি বহুবার গিয়েছি, কিন্তু ছেলেবেলায় জেঠুর বাড়িতে থাকার সেই স্মৃতি আজও আমার মনে জাগ্রত। ঠাকুমা আমার পাঁচ বছর বয়সে চলে গেলেন। ঠাকুরদা আমার জন্মের আগেই।
দাদু-দিদার আদর বলতে বুঝতাম আমার মামার বাড়ি। দাদু ছিলেন ডি.ভি.সি.-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেবেলায় কত যে তিলাইয়া, পাঞ্চেৎ, মাইথন, কোনার ড্যামের ওপর বেড়িয়েছি তার হিসেব নেই। হাইডেল পাওয়ার প্ল্যান্টের ভিতরেও দাদু কয়েকবার নিয়ে গিয়েছিলেন। অবাক হয়ে দেখতাম মেশিনের কাণ্ডকারখানা। পাঞ্চেতে বছরে দুবার যেতাম। যখন ড্যামের গেট খোলা হত, জলের কণা হাওয়ায় ভেসে বাংলো পর্যন্ত চলে আসত। কী ভালোই না লাগত! আর কী শব্দ! রাতের বেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে জলের সেই শব্দ উপভোগ করতাম। বাগানে দুজন মালী ছিল। পদদাদা আর কোরবানদাদা। তারা আমার পুতুলের জন্য খাট আর চাকি-বেলুন তৈরি করে দিয়েছিল। এখনও আমার ওই দুটো আছে। আমি দাদু-দিদার খুব আদরের ছিলাম। দাদু আমাকে কুচুকমণি বলে ডাকতেন। রোজ রাতে শোওয়ার সময় দিদার কাছে গল্প শুনতাম। দিদা ঘুমিয়ে পড়লে ঠেলে ঠেলে তুলে দিয়ে বলতাম, তারপর?
দাদুর সঙ্গে আমার ছিল সবচাইতে বেশি ভাব। দাদুর যে টেবিলে ফোন রাখা ছিল তার পাশে একটা অকেজো বাতিল ফোন থাকতওটা আমার। দাদু যখন ফোনে কোনও কথা বলতেন আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে ওই ফোনটা থেকে আবোলতাবোল বকতুম। যত বড়ো হয়েছি, দাদু-দিদার আদর একটুও কমেনি। বরং বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছিল।
দাদু যখন রিটায়ার করে কলকাতা চলে এলেন, আমার আনন্দ আর ধরে না। মামার বাড়ি বেড়াতে গেলেই দাদু বলতেন, কুচুকমণি কী কী চাই তার লিস্ট তৈরি করে ফেল
আর আমি কিছুতেই লিস্ট করতাম না। দাদুও ছাড়ার পাত্র নন শেষে দিদা মধ্যস্থতা করে বলতেন, ও যখন লিস্ট তৈরি করতে চাইছে না তখন তুমি জোর কোরো না। তুমি নিজেই পন্দ করে কিনে দাও
তাই হত। দাদু বিভিন্ন জিনিস কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করতেন। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কেক, নিউমার্কেট থেকে টয়লেট-ট্রি, লেক মার্কেট থেকে চিংড়িমাছ, হাজরা মিট শপ থেকে মটন ইত্যাদি ইত্যাদি। দিদা খুব ভালো রাঁধতেন, বিশেষ করে চপ-কাটলেট। চিপ খেতে ভালোবাসতাম বলে বাড়িতে কী সুন্দর করে চিপ তৈরি করে প্যাকেটে ভরে দিতেন। সঙ্গে টোম্যাটো সস। না বলে দিলে কেউ বুঝবে না যে ওগুলো বাড়ির তৈরি। আজ তাঁরা নেই, কিন্তু আমার ছেলেবেলার বেশিরভাগটাই তাঁরা জুড়ে আছেন। লিখতে বসে পুরনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আর মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

আমি খুব পুতুল খেলতে ভালোবাসতাম। বেশ কয়েকটি পুতুল ছিল সংগ্রহে। তাদের জামাকাপড়, খাট – বিছানা, চিরুনি, রান্নার বাসন নিয়ে ছিল আমার সংসার। আর ভালোবাসতাম রঙিন হার্ড বাউন্ড ছবির বই দেখতে ও পড়তে। বাড়িতে শুকতারা, চাঁদমামা, চম্পক আসতমা রাশিয়ান ফেয়ারি টেলস কিনে দিতেন। ঠাকুরমার ঝুলি পড়তে খুব ভালো লাগত বার বার পড়তাম। একবার কাকা আমাকে রাক্ষস-খোক্কস-এর একটি বই দিয়েছিলেন। খুব ভালো লেগেছিল। এত ভালো লেগেছিল যে যেখানেই যেতাম বইটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। একবার বেড়াতে গিয়ে বইটা হারিয়ে ফেলি। কী মনখারাপই না হয়েছিল! বহুদিন পরে এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে একদিন গো-ডাউনে পুরনো বই দেখতে গিয়ে হঠাৎ হাতে আসে আমার সেই ছেলেবেলার বইটি। নাম ‘ভূত-পেত্নী-দত্যি-দানো’ - প্রকাশক দেব সাহিত্য কুটির।
তখন স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে অত যাওয়া আসার ব্যাপার ছিল না। তাই বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা হত স্কুলের গণ্ডির মধ্যেই। স্কুলের বাইরে বন্ধু বিশেষ ছিল না। ফ্ল্যাটে আমার বয়সী কেউ ছিল না, নয় বড়ো বা একদম ছোটোতাও ওদের সঙ্গেই বিকেলে আই স্পাই বা লক অ্যান্ড কট খেলতাম। বন্ধু বলতে বুঝতাম আমি মাকে। বাবা তো অফিসের কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন, তাই অফিসের কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। শুধু রবিবার আমরা তিনজন সিনেমা দেখে, পার্ক স্ট্রিটে রেস্তরাঁয় খেয়ে ফিরতাম। আমার এবং বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব ছিল মায়ের ওপর। মায়ের কাছেই পড়তাম অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত। গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে আত্মীয়দের বাড়িতে দেখা করতে যেতাম। এখন তো আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া উঠেই গেছে। আমার ছেলেবেলায় কিন্তু এই রীতি ছিল। সকলের বাড়িতে তো ফোন থাকত না। তাই না জানিয়েই চলে যেতাম। এখন অবশ্য কেউ কারোর বাড়িতে না জানিয়ে যাওয়া কল্পনাই করতে পারবে না। বিজয়ার সময় আবার আত্মীয়দের বাড়িতে যেতাম। তখন অবশ্য বাবাও যেতেন। আমাদের বাড়িতে অনেকে আসতেন। মা বাড়িতে কুচো নিমকি, ঘুগনি, নারকেল নাড়ু বানিয়ে রাখতেন। ফ্রিজে মিষ্টিও রাখা থাকত, কে কখন চলে আসে!
স্কুলে সেশন শুরু হত জানুয়ারি মাস থেকেপরীক্ষা হয়ে যেত নভেম্বরে। তাই ডিসেম্বর মাসটা পুরো ছুটি পেতাম। এই সময় প্রচুর বই পড়তাম আর পুতুল খেলতাম। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যেতাম চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, তারামণ্ডল। আর যেতাম নিউ মার্কেট। খ্রিস্টমাসের সময় নিউমার্কেট যাবই যাব। সেই অভ্যাস আমার এখনও আছে। শীতকালে এই সময় আরেকটা জিনিস খুব ভালো লাগত সেটা হল নতুন ক্লাসের বইপত্র। মা ব্রাউন পেপার দিয়ে কভার দিতেন। আমি সামনে বসে লেভেল আটকাতাম। আর নাম লিখতাম। খ্রিস্টমাসের দিন মা বাড়িতে কেক বানাতেন। বাবা দোকান থেকেও আনাতেন। তাও বাড়িতে কেক হতই। তখন তো দোকান মানে ফ্লুরি, গ্রেট ইস্টার্ন, নাহোমস এবং জলযোগ। তা একবার হল কী, মা সবে আভেনে কেক বসিয়েছেন আর মনি একটা শব্দ করে আভেনটা ফিউজ হয়ে গেল। কী হবে? মা বললেন, কড়াইয়ের ওপর বালি দিয়ে তার ওপর পাত্রটা বসালে কেক বেক করা যেতে পারে। যেমনি বলা অমনি কাজ। কাছেই মিস্ত্রিরা কাজ করছিল সেখান থেকে বালি যোগাড় হল। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু আমার অতিরিক্ত উৎসাহে পাত্রের ঢাকাটা বার বার খুলতে হচ্ছিল মাকে। তাই যখন কেক তৈরি হল খেতে গিয়ে দেখি বালি কিচ কিচ করছে। অগত্যা সেবার দোকানের কেক দিয়েই মন ভরাতে হয়েছিল।
ছেলেবেলায় নিউ ইয়ারের সময় গ্রিটিংস কার্ডের খুব চল ছিল। আমরাও কিনতাম। মা ঠিকানা লিখতেন আর প্রেরকের জায়গায় আমি নাম লিখতাম। এখন তো গ্রিটিংস কার্ডের কনসেপ্ট উঠেই গেছে।
তখন সকলের বাড়িতেই রেডিও শোনা হত খুব। আমিও শুনতাম গল্পদাদুর আসর। আর দেখতাম চিচিং ফাঁক। চিচিং ফাঁকে একবার এল কথা বলা পুতুল মাইকেলকী আনন্দই না পেয়েছিলাম! পরে বড়ো হয়ে একটা মেলাতে সামনাসামনি মাইকেলকে দেখেছিলাম। তখন কি আর জানতুম, একে বলে ভেন্ট্রিলোকুইজম?
বাবা ব্যস্ত মানুষ ছিলেন কিন্তু আমার পড়াশোনার প্রতি নজর তাঁর বরাবর ছিল। হয়তো বাবার থেকেই আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহটা পেয়েছি।
আজকে ছেলেবেলার বেশিরভাগ মানুষগুলোই হারিয়ে গেছে কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা, স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় সযত্নে রক্ষিত আছে।
_____

3 comments:

  1. এ যেন আমাদের সবার ছেলেবেলা, রূপা দিদির হাত ধরে এ এক অনন্য মানস ভ্রমণ

    ReplyDelete
  2. স্মৃতি র আলাপন

    ReplyDelete