চলমান
নববর্ষ
কমলবিকাশ
বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতীয়
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বৈদিক যুগে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি
চর্চার সাথে সাথে শুরু হয়েছিল ‘নক্ষত্র-বিদ্যা’। আর্য ঋষিদের কাছে কৃষিকার্যের তুলনায় যাগ-যজ্ঞাদি নানা ধর্মানুষ্ঠানের
গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন ঋতুতে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে তাঁরা
অনুভব করেছিলেন কাল নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা। ফলস্বরূপ, প্রণীত হয় পঞ্জিকা। হিন্দু
জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূলগ্রন্থ ‘সূর্য-সিদ্ধান্ত’। ভারতবর্ষে যে পঞ্জিকা তথা ক্যালেন্ডারের প্রচলন হয়েছিল তা এই
সূর্য-সিদ্ধান্তের নিয়ম মেনেই। এই ধারা এখনও বিদ্যমান।
দৈনন্দিন
জীবনে বর্তমানে আমরা যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি সেটা আমাদের কাছে ইংরেজি
ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হলেও আসলে সেটা হল গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার। সরকারি
কাজকর্মের জন্য গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অপরহার্য হলেও পূজা-পার্বন,
বিয়ে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি নানারকম সামাজিক উৎসবের জন্য ‘সূর্য-সিদ্ধান্ত’-র নিয়ম মেনে
রচিত ক্যালেন্ডারই আমরা এখনও ব্যবহার করি।
সারা
বিশ্বে সাধারণত দু’রকম ক্যালেন্ডারের প্রচলন দেখা যায় — চান্দ্র ও সৌর। তবে
বর্তমানে সৌর ক্যালেন্ডারই অধিক প্রচলিত। ভারতবর্ষে বেশির ভাগ অঞ্চলের ক্যালেন্ডার
চান্দ্র-সৌর হলেও বাংলা ক্যালেন্ডার কিন্তু সৌর। ব্যাপক প্রচলিত গ্রেগরীয়
ক্যালেন্ডারও সৌর হওয়ায় এই দুটো ক্যালেন্ডারের মধ্যে কোনও তফাত থাকা উচিত নয়।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারে বছর শুরু হয় গ্রেগরীয়
ক্যালেন্ডারের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল। স্বাভাবিক কারণেই মনে হতে পারে, কেন এমন হয়?
বৈদিক
ঋষিরা রাশিচক্র (Zodiacal belt)-এর
সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সূর্যের আপাত গতিপথকে বৈদিক সাহিত্যে ক্রান্তি বৃত্ত বা
রবিমার্গ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগবেদে এই ক্রান্তিবৃত্তকে তুলনা করা হয়েছে
বা্রোটি পাকিযুক্ত চাকার সঙ্গে। অনুমান করা হয় চাকার এই বারোটি পাকি হচ্ছে
রাশিচক্রের বারোটি প্রতীক।
সূর্যের
চারদিকে পৃথিবীর এক পাক দেওয়া মানে ৩৬০০ পথ অতিক্রম করা। এই পথকে ১২টি
ভাগে ভাগ করলে এক একটি ভাগ হয় ৩০০ অর্থাৎ রবিপথকে সমান বারো ভাগে ভাগ
করলে সূর্যের সরণ হয় ৩০০ করে। এই প্রতিটি ভাগকে নির্দিষ্ট করার জন্য
জ্যোতির্বিদরা সাহায্য নিলেন ‘নক্ষত্রমণ্ডলের’। তারাদের সমন্বয়ে গঠিত বারোটি নক্ষত্রমণ্ডলকে জ্যোতির্বিদরা
নির্দিষ্ট করলেন রবিপথের উপর ৩০০ অন্তর অন্তর। এদের প্রত্যেকটিকে বলা
হয় রাশি। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ
এবং মীন — এই বারোটি রাশির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে রাশিচক্র। আর একটা রাশি থেকে আরেকটা
রাশিতে সূর্যের আপাত সরে যাবার সময় কালকেই বলা হয় ‘সৌরমাস’।
যে
কক্ষপথে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সেই কক্ষপথের উপর চারটি নির্দিষ্ট বিন্দু
আছে। এদের মধ্যে দু’টির একটি হল উত্তরায়ণ শুরুর দিন, আর অপরটি হল দক্ষিণায়ণ শুরুর দিন।
বাকি দু’টির একটি উত্তরায়ণের পথের উপর এবং আরেকটি দক্ষিণায়ণের পথের উপর। উত্তরায়ণের
এবং দক্ষিণায়ণের পথের উপরের এই বিশেষ দিন দু’টিতে পৃথিবীর সর্বত্র দিন ও রাত্রির
দৈর্ঘ্য সমান। উত্তরায়ণের পথের দিবা-রাত্র সমান এই দিনটিকে আমরা বলি ‘বাসন্তী বিষুব’
আর দক্ষিণায়ণ পথের দিনটিকে বলি ‘শারদ বিষুব’। ক্যালেন্ডারের বছর শুরু করার জন্য এই চারটি দিনের যে কোনও একটিকে
বেছে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছিলেন প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদগণ। আর সেইমত
তাঁরা বছর শুরু করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ‘বাসন্তী বিষুব’কে। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে
বাসন্তী বিষুব হচ্ছে ২১ মার্চ। তাহলে আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারে ১ বৈশাখ হওয়ার কথা
২১ মার্চ। কিন্তু হচ্ছে না তো? হচ্ছে ১৪ বা ১৫ এপ্রিল। কেন এই পার্থক্য?
ষষ্ঠ
শতাব্দীর হিন্দু জ্যোতির্বিদরা এক বছর সমান ৩৬৫·২৫৮৭৫৬ দিন ধরছিলেন। বিজ্ঞানের
অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বর্তমানে আমরা জানি সৌর বছরের দৈর্ঘ্য হল ৩৬৫·২৪২১৯৯ দিন।
তাহলে দু’টি হিসেবের মধ্যে এক বছরে পার্থক্য হচ্ছে ০·০১৬৫৫৭ দিনের মতো। অর্থাৎ,
হিন্দু জ্যোতির্বিদিরা বছরের হিসেব প্রকৃত হিসেবের তুলনায় ০·০১৬৫৫৭ দিন বা প্রায়
২৩ মিনিট ৫০·৫০ সেকেন্ডের মতো বেশি ধরেছিলেন। জুলীয় ক্যালেন্ডারেও এক সময় অনুরূপ
ভুল ছিল। পরবর্তীকালে গ্রেগরীয় সংস্কারের মাধ্যমে সেই ভুল শুধরে নেওয়া হয়। ষষ্ঠ
শতাব্দীতে অর্থাৎ, প্রায় ১৪০০ বছর আগে ভারতীয় জ্যোতির্বিদগণ সূর্য-সিদ্ধান্ত
বইটিতে বছরের হিসেব করতে যে ভুলটুকু করেছিলেন পরবর্তীকালে সেটা কিন্তু আর শোধরানো
হল না। এই সামান্য ভুলটুকু থেকেই গেল। ১৪০০ বছর ধরে সেটা জমে জমে আজ প্রায় ২৩
দিনের গরমিলে এসে ঠেকেছে। তাই গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাসন্তী বিষুব ২১
মার্চ হলেও বাংলা নববর্ষ আসে ২৩ দিন পরে অর্থাৎ, ১৪ বা ১৫ এপ্রিল।
উত্তরায়ণ
যে দিন শুরু হয় সে দিনটিকে বলা হয় কর্কট ক্রান্তি। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের হিসেবে
উত্তরায়ণ শুরু হয় ২২ ডিসেম্বর। অথচ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মকর সংক্রান্তি উৎসব
পালিত হয় ১৫ জানুয়ারি নাগাদ — সেই ২৩ দিনের তফাত। কর্কট ক্রান্তির বেলাতেও দেখা
যায় সেই একই হিসেব। যে ভুলটুকুর জন্য এত গরমিল সেটুকু শুধরে না নিয়ে এইভাবে চলতে
থাকলে ১৪০০ বছর পরে বাংলা নববর্ষ পালিত হবে আরও ২৩ দিন পরে অর্থাৎ, ৭ বা ৮ মে।
প্রাচীনকাল থেকে যা চলে আসছে তাকে আঁকড়ে ধরে না থেকে এই ভুলটুকু এখনি শুধরে নেওয়া
প্রয়োজন।
ভুল
শোধরানোর চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। ১৯৫২ সালে ভারত সরকার বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ভারতীয় রাষ্ট্রীয়
পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা
পঞ্জিকায় কয়েকটি পরিবর্তন সুপারিশ করেন। এই সুপারিশে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে
এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস ৩০ দিনে করার কথা বলা আছে। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার
অনুযায়ী যে বছর লিপ-ইয়ার সেই বছরে চৈত্র মাস ধরতে হবে ৩১ দিনে। এরপরে আশির দশকে ড. সাহা কর্তৃক প্রবর্তিত পঞ্জিকায় অধিকতর
উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। লিপ-ইয়ারে বা অধিবর্ষে চৈত্র মাসের
পরিবর্তে ফাল্গুন মাসকে ৩১ দিন ধরার কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, দিন পরিবর্তনের
ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে রাত ১২টা সুপারিশ করা হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক এই
বাংলা পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করলেও আমাদের দেশে সনাতনপন্থী
পঞ্জিকাকারদের প্রবল বাধায় তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশে
চৈত্রসংক্রান্তি এবং বাংলা নববর্ষ নির্দিষ্ট দিনে (যথাক্রমে ১৩ এপ্রিল এবং ১৪
এপ্রিল) পালিত হলেও ভারতবর্ষে এই উৎসব কোনও কোনও বছরে ভিন্ন দিনে (যথাক্রমে ১৪
এপ্রিল এবং ১৫ এপ্রিল) পালিত হতে দেখা যায়। এমনকী দুর্গা পূজার তিথির ক্ষেত্রেও
কখনও কখনও ভিন্ন পঞ্জিকায় ভিন্ন মত লক্ষ্য করা যায়।
আমরা
জানি বারো মাসে এক বছর হয়। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই কেন বছরকে ১২ মাসে ভাগ করা হল? আর
এই বারো মাসের নামগুলোই বা এল কী ভাবে? পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যে
সময় নেয় তাকে আমরা বছর বলি। আর পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে চাঁদের যে সময়
লাগে তাকে বলা হয় মাস। দুটি সময়ের তুলনা করলে দেখা যাবে চাঁদ বছরে পৃথিবীকে ১২ বার
পাক খায়। এই ১২ বার প্রদক্ষিণের পথে ২৭টি নক্ষত্র মণ্ডলের সঙ্গে চাঁদের সাক্ষাৎ
হয়। পূর্ণিমার দিনে চাঁদ যে নক্ষত্র মণ্ডলে থাকে সেই নক্ষত্র মণ্ডলের নামানুসারেই
(বাংলা নাম) সেই মাসের নাম রাখা হয়েছে। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠা থেকে
জৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনীকুমার
থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা অগ্রহায়নী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা
থেকে পৌষ, মাঘী থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
ভারতবর্ষে প্রাচীনতম
মহাকাশ চিন্তায় তারকা এবং নক্ষত্র শব্দ দুটির মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য দৃষ্ট হয়
না। পরে নক্ষত্র অর্থে চান্দ্রপথের উপরে অবস্থিত কয়েকটি তারকামণ্ডল বোঝাত।
প্রাচীন ভারতবর্ষে কাল
(সময়) গণনার দুটি ভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। প্রথমটি চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত,
দ্বিতীয়টি রাশি সংক্রান্ত। তিথি সংক্রান্ত পদ্ধতিটি রাশির বহু পূর্বে আবিষ্কৃত।
- প্রাচীন
ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান; অরূপরতন ভট্টাচার্য, কলকাতা, পৃঃ ৬৯
|
তথ্য সূত্রঃ
১) Hindu
Astronomy; W. Brennand, London, 1896
২) History of
calendars - Wikipedia
৩) Bengali calendars - Wikipedia
৪)
প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চা; রমেশচন্দ্র মজুমদার, কলিকাতা, ১৩৬৩
৫) প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান;
অরূপরতন ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১৯৭৫
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment