সুমনবাবুর
সমাজসেবা
প্রকল্প
ভট্টাচার্য
সুমনঃ উফফ্, আজ এক সপ্তা কেটে গেল একজন রোগীরও দেখা নেই! এ কেমন জায়গা
রে বাবা! ভাবলাম ডাক্তারি পাশ করে একটু সমাজের সেবা করব, তা সমাজ যে এত সুস্থ, তা তো আগে জানতাম না! এইভাবে মাছি মেরে কতদিন কাটাব! নাহ্, আর কিছুদিন দেখি। নয়তো চেম্বার বন্ধ করে কোনও হাসপাতালেই
যোগ দেব না হয়।
ব্যক্তিঃ
ডাক্তারবাবু আছেন নাকি? (ব্যক্তির
প্রবেশ)
সুমনঃ হ্যাঁ আসুন, বসুন। কী হয়েছে?
ব্যক্তিঃ আর হওয়ার
কী বাকি রইল! জানেন, পই পই করে
বলেছিলাম অমন করিস না রে, করিস না। শুনল আমার কথা! তাই আমাকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে
আসতে হল।
সুমনঃ আপনার পায়ে
ব্যথা?
ব্যক্তিঃ আরে না না, সে বয়সকালে একটু হয়। এলাম ওই সুবীরটার জন্যে।
সুমনঃ সুবীরবাবু
কি এসেছেন আপনার সঙ্গে?
ব্যক্তিঃ আরে, সে এলে তো হয়েই যেত! একটা কথাও কি শোনে! জানেন, ওর যখন দশ বছর বয়স ছিল, নেড়া ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে উঠেছিল। কত্তোবার বারণ করলাম, শোনেনি। ব্যস, তারপর যা হওয়ার... কেউ বাঁচাতে পারল না।
সুমনঃ বাঁচাতে
পারল না মানে! উনি মারা গেছেন?
ব্যক্তিঃ বালাই ষাট, মরবে কেন! সবক’টা ঘুড়ি ভো-কাট্টা হল! আমরা কেউ তো নেড়া ছাদে
উঠিনি যে ওর ঘুড়ি বাঁচাব! তখন থেকেই ও এইরকম।
সুমনঃ ওহ্, তা এখন উনি কেমন আছেন?
ব্যক্তিঃ কেমন আবার, নির্বিকার! নদের নিমাইয়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! আরে, মাথায় ঢুকলে তো!
সুমনঃ না, মানে, ওঁর
কী হয়েছে জানতে পারলে...
ব্যক্তিঃ কিছুই
হয়নি। উনি দিব্যি আছেন, যত জ্বালা
হয়েছে আমার।
সুমনঃ কোথায়
জ্বালা? এদিকে আসুন, জিভটা দেখি।
ব্যক্তিঃ জিভ? না না, জিভে
জ্বালা হোক শত্তুরের! জিভে জ্বালা করলে আমি এতক্ষণ আপনার সাথে বকে যেতে পারতাম?
সুমনঃ তা আপনার
হয়েছেটা কী?
ব্যক্তিঃ এখনও হয়নি, তবে হবে। শরীর আনচান করবে, পেট খোলসা হবে না, ভুটভাট করবে।
সুমনঃ ওহ্-হো!
এগুলো কি প্রতিদিনই হয়?
ব্যক্তিঃ হয় না, তবে হতেই পারে। যে কোনও দিনই।
সুমনঃ হুম। কতদিন
থেকে হচ্ছে?
ব্যক্তিঃ তা বছর
দুয়েক টের পাচ্ছি।
সুমনঃ দু’বচ্ছর!
কোনও ডাক্তার দেখাননি!
ব্যক্তিঃ না, নিজেই একটা কাগজ পড়ে নিই। সেরে যায়।
সুমনঃ কাগজ...
মানে, প্রেসক্রিপশন?
ব্যক্তিঃ আরে না না, খবরের কাগজ। সেটার জন্যেই তো!
সুমনঃ খবরের
কাগজ! সেটার থেকে আবার কী অসুখ!
ব্যক্তিঃ আরে,
সক্কালবেলা খবরের কাগজটা পড়ে যা সুখ, সেটা হাতে না পেলে অসুখ করবে না! তা আমি ঐ সুবীরের কাগজটাই
পড়তাম এতদিন। সে ব্যাটা আজ থেকে দিল কিনা কাগজ বন্ধ করে! কতবার বলেছিলাম, ওরে কাগজটা বন্ধ করিস না, না পড়লেও, কত্ত
কাজে লাগে... শুনলই না কথা! তা আমি আর কী করি; চলে এলাম আপনার চেম্বারে। ডাক্তারবাবু, একটু আজকের কাগজটা দেবেন, পড়ি?
সুমনঃ কাগজ! আপনি
খবরের কাগজ পড়বার জন্যে চেম্বারে এসেছেন!
ব্যক্তিঃ ইয়ে, মানে, আহা, রাগ করলেন নাকি!
সুমনঃ না না, রাগ
কেন করব! খুব মজা পেলাম। তবে কিনা, আমিও তো কাগজ নিই না।
আপনি বরং কাছাকাছি কোনও সেলুনে..
ব্যক্তিঃ ঠিক
বলেছেন! তাই তো! সেলুনে তো
একসাথে দু-তিনটে কাগজ পাব! এইজন্যেই জানেন তো, ডাক্তারদের এত দরকার! আচ্ছা আসি, কেমন? (প্রস্থান)
সুমনঃ হ্যাঁ, সেই তো! এইজন্যেই ডাক্তারদের দরকার! যত্তসব আপদ!
(বাইরে থেকে) ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?
সুমনঃ হ্যাঁ আছি।
আসুন। আপনি কি আনন্দবাজার, না আজকাল?
(ব্যক্তির প্রবেশ) আজকাল! না তো, আজকাল আমি এই তল্লাটে তো আসিই না!
সুমনঃ তাহলে
গণশক্তি? বর্তমান?
ব্যক্তিঃ না না
বর্তমান নয়, অনেক অতীতে
একবার...
সুমনঃ যুগান্তর? টেলিগ্রাফ? স্টেটসম্যান? দ্য হিন্দু? টাইমস অফ ইন্ডিয়া? ডেকান ক্রনিকল?
ব্যক্তিঃ আরে,
দাঁড়ান দাঁড়ান। এগুলো তো খবরের কাগজের নাম!
সুমনঃ হ্যাঁ,
সেটাই তো জানতে চাইছি আপনি কোনটার
খোঁজে এসেছেন এখন।
ব্যক্তিঃ খোঁজে! কেউ
আবার খবরের কাগজের খোঁজে ডাক্তারখানায় আসে নাকি!
সুমনঃ আসে, আসে! এই একটু আগেই এসেছিলেন একজন। তা আপনি যখন বলছেন সে
জন্য আসেননি, তাহলে বলুন
কেন এসেছেন।
ব্যক্তিঃ শখ করে কি
আর কেউ ডাক্তারখানায় আসে, দাদা! এসেছি বিপদে পড়েই।
সুমনঃ হ্যাঁ, সে
তো ঠিকই। তা বিপদটা আপনারই তো? নাকি...
ব্যক্তিঃ আরে না না,
আমারই বিপদ! বেশ ভালো বিপদ। আপনিই যদি কিছু...
সুমনঃ অবশ্যই!
সেই জন্যেই তো আমি আছি! আচ্ছা, তাহলে বলে ফেলুন কী বিপদ আপনার।
ব্যক্তিঃ শুনেছি, ডাক্তারদের কাছে কিছু লুকোতে নেই, তাই...
সুমনঃ ঠিকই তো, লুকোবেন কেন! আচ্ছা, লজ্জা করলে এই পর্দার আড়ালে এসে...
ব্যক্তিঃ আরে না না,
সেরকম কিছু নয়। আসলে গত দু'দিন আমি জল
ছাড়া কিছুই খেতে পারছি না।
সুমনঃ সে কী!
খিদে পাচ্ছে না, নাকি হজমের
গন্ডগোল? দেখি জিভটা।
ব্যক্তিঃ খিদে খুবই
পাচ্ছে। কিন্তু.. আর না খেলে হজমই বা হবেটা কী!
সুমনঃ সেও ঠিক, কিন্তু কিছুই খেতে পারছেন না কেন? অসুবিধেটা কীরকম?
ব্যক্তিঃ আজ্ঞে
অসুবিধা, মানে, ঠিক শারীরিক নয়...
সুমনঃ বুঝলাম না। পেটের গন্ডগোল? বুকে ব্যথা?
ব্যক্তিঃ কোমরের
কাছাকাছি আর কী...
সুমনঃ কোমরে
ব্যথা?
ব্যক্তিঃ ঠিক কোমরেও
নয়, মানে পকেটে...
সুমনঃ পকেটে! পকেটে
আবার ব্যথা করে নাকি!
ব্যক্তিঃ করে দাদা, করে! পকেট একেবারে ফাঁকা থাকলে বুঝবেন এ ব্যথা কী যে
ব্যথা...
সুমনঃ ধুর মশাই, আপনার হয়েছেটা কী বলুন তো? আর আমার কাছেই বা এসেছেন কেন?
ব্যক্তিঃ হয়েছে অভাব
মশাই, অভাব! পকেটে পয়সা নেই। চাকরি
হারিয়ে নানা জায়গায় ধূপ বিক্রি করি।
গত দু'দিন কোনও বিক্রিই হয়নি। সেইজন্যেই আপনার কাছে
আসা। দাদা, কিছু
ধূপের প্যাকেট কিনুন প্লিজ!
সুমনঃ ধূপ!
ব্যক্তিঃ হ্যাঁ দাদা, ধূপ। জুঁই, চন্দন এবং গোলাপ - এই তিন সেন্টের ধুপ। দাদা, একবার কিনে দেখুন, গন্ধে আপনার চেম্বারে রোগী গিজগিজ করবে! সক্কলে ধন্য ধন্য
করবে, আহা, এমন গন্ধমাদন ডাক্তার আর দুটো দেখিনি!
সুমনঃ আচ্ছা,
হয়েছে হয়েছে। দিন দু’প্যাকেট আর এখন আপনি আসুন।
(বাইরে থেকে) ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?
সুমনঃ সর্বনাশ, এই বোধহয় আর এক নমুনা এল! (জোরে) না, আমার ধূপ-দীপ-সলতে-দেশলাই
কিচ্ছু চাই না!
(ব্যক্তির প্রবেশ) ধূপ-দীপ-দেশলাই... তার মানে?
সুমনঃ আপনি কি
গায়ে মাখা সাবান? নাকি মাথায়
মাখা তেল? সর্বরোগহরা বটিকা, নাকি যাত্রাপালা
অদ্য রাত্রি নয় ঘটিকা?
ব্যক্তিঃ বিশ্বাস
করুন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
সুমনঃ আপনি কি
সেলসম্যান? তাহলে বলে দিই, আমার এখন কিছুই দরকার নেই।
ব্যক্তিঃ ওহ্, এই ব্যাপার! না না, আমি সেলসম্যান নই।
সুমনঃ তাহলে
নিশ্চয়ই খবরের কাগজ পড়তে এসেছেন? বলে
রাখি, সে গুড়েও বালি।
ব্যক্তিঃ কাগজ? না না, সে
তো আমি বাড়িতেই পড়ে এসেছি।
সুমনঃ আহা, শুনেও
ভালো লাগল। তাহলে আসুন, বলুন কী
জন্য এসেছেন।
ব্যক্তিঃ আমি কিন্তু
এসেছি আপনারই জন্যে।
সুমনঃ আমার
জন্যে! তার মানে?
ব্যক্তিঃ আপনি নতুন
এসেছেন এই পাড়ায়, আদবকায়দা
জানেন না হয়তো। তাই অসুবিধায় পড়তে পারেন, সেই ভেবেই...
সুমনঃ ওহ্, হ্যাঁ, তা
যা বলেছেন! আরে, আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না!
ব্যক্তিঃ বসব? আচ্ছা, আমি
কিন্তু রুগী নই। এমনিই এসেছি আলাপ করতে।
সুমনঃ আরে মশাই,
রুগী যে আজ আর আমার চেম্বারে আসবে না, সে আমি জানি। মনে হয় এই এলাকায় কারও জ্বরজারিও হয় না।
ব্যক্তিঃ আরে না না,
তা কেন? তবে লোকজন
বেশিরভাগ নিজে নিজেই...
সুমনঃ নিজে
নিজেই!
ব্যক্তিঃ মানে
ওষুধের দোকান থেকে, বা গুগল
সার্চ করে ব্যবস্থা করে নেয়। ডাক্তারদের ওপর ভরসা প্রায় হারাতে বসেছে সকলে। চিকিৎসার
খরচ, সেই সঙ্গে সুস্থতার কোনও
গ্যারান্টিও যখন নেই...
সুমনঃ সর্বনাশ, তাহলে আমার সমাজসেবা!
ব্যক্তিঃ আমি একটা
আইডিয়া দিতে পারি। এই চেম্বারে একটা লাইব্রেরি খুলুন।
সুমনঃ লাইব্রেরি!
ডাক্তারি পাশ করে লাইব্রেরিয়ান হব!
ব্যক্তিঃ তেমন বুঝলে
হাসপাতালেও জয়েন করতে পারেন।
তবে রোগীর পরিবার রেগে গেলে মারধোরও করতে পারে। তখন আমি
আপনাকে বাঁচাতে পারব না।
সুমনঃ মারধোর করে
নাকি! ওরে বাবা!
ব্যক্তিঃ করে বৈকি!
সেইজন্যেই তো এই এলাকায় আর কেউ ডাক্তারি করতে আসতে চায় না!
সুমনঃ আপনি
বাঁচলে বাপের.. না না, ডিগ্রির
নাম। হ্যাঁ, লাইব্রেরিই হোক।
ব্যক্তিঃ অত
ঘাবড়াচ্ছেন কেন! বইপত্রের ব্যবস্থা আমি কিছু করে দেব। আপনি চাইলে
কোচিং সেন্টার খুলতে পারেন একপাশে। পড়াশোনাটাই তো আসল, তাই না?
সুমনঃ হ্যাঁ, সে
তো বটেই।
ব্যক্তিঃ আর
চিকিৎসকের থেকে শিক্ষক কি সমাজসেবায় পিছিয়ে আছেন?
সুমনঃ কখনওই নয়!
ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কেনা গেলেও, বিদ্যাবুদ্ধি তো আর কেনা যায় না! সেই ভালো। আমার
সমাজসেবাও হবে, আর এইভাবে
মাছি না তাড়িয়ে সত্যিকারের কাজের কাজও হবে। অনেক ধন্যবাদ, দাদা। তা আপনার পরিচয়টা কিন্তু...
ব্যক্তিঃ আমি এখানে
একটা স্কুল খুলেছি, তারই প্রধান
শিক্ষক।
সুমনঃ ওহ্, আপনিও শিক্ষক? তাহলে তো কথাই নেই! আপনার নামটা...
ব্যক্তিঃ ডঃ শ্যামল
রায়, এম.ডি.।
সুমনঃ তার মানে!
ব্যক্তিঃ তার মানে
আমি আপনার আগে এখানে, এই
চেম্বারেই বসতাম। আর অন্যদের কাগজ পড়িয়ে, ধূপ কিনে দিন কাটাতাম।
সুমনঃ সে কী!
ব্যক্তিঃ হ্যাঁ, আর সেইজন্যেই আপনার নেমপ্লেট দেখে ভাবলাম আমার তো সমাজসেবা
অনেক হল, এবার আর এক বন্ধুকে সাবধান করে দিই।
সুমনঃ অনেক
ধন্যবাদ, দাদা। তাহলে কাল থেকেই সমাজসেবা, মানে লাইব্রেরি চালু।
_____
অলঙ্করণঃ
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
Bah besh natok..
ReplyDelete