গোলটেবিল:: ভয়ংকর স্বীকারোক্তিঃ হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত :: আলোচনাঃ অরিজিৎ পাত্র


বইঃ ভয়ংকর স্বীকারোক্তি
লেখকঃ হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
প্রকাশকঃ দেব সাহিত্য কুটির; দাম - ১৮০ টাকা
আলোচনাঃ অরিজিৎ পাত্র

মাত্র একদিনের মধ্যে পড়ে ফেললাম হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের লেখা এক ডজন রহস্য রোমাঞ্চকর গল্পের সংকলন ‘ভয়ংকর স্বীকারোক্তি’ পড়বার পর একটাই কথা মুখ থেকে বেরলো, ‘অসম্ভব সুন্দর।’ রহস্য-রোমাঞ্চ যারা ভালোবাসেন তাদের জন্যে এই বইখানা অবশ্যপাঠ্য। প্রথমেই বলি, বইয়ের গল্পগুলো প্রতিটাই বেশ বড়ো ১২টা গল্পের বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯২টি। এবার আসি গল্পগুলোর প্রসঙ্গে -

১) অপত্য স্নেহঃ বছর খানেক আগে কিশোর ভারতীতে প্রকাশিত এই গল্পখানা মন ছুঁয়েছিল। আবার পড়লাম, আর একইরকম শিহরণ অনুভব করলাম আবার। ডাক্তার অচিন্ত্য সেনের পেশেন্ট মণিময় গুপ্ত রক্তাল্পতায় ভুগছেন। বার কয়েক রক্তও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তবুও অবস্থার উন্নতির কোনও লক্ষণ নেই। সেই সাথে রয়েছে গাউটের প্রকোপ। কাজের লোক মারফত চিঠি পেয়ে ডাক্তারবাবু এলেন মণিময়বাবুর বাড়িতে, তাঁকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। জানা গেল, মণিময়বাবুর দুই ছেলে রয়েছে। সারাক্ষণ দোতলার ঘরে থাকে, খায় আর ঘুমায়। মাঝরাতে তারা নেমে আসে খাবার খেতে কিন্তু কেন? কীসের এত লুকোচুরি? নাহ্, আর বলতে পারব না। তবে একটা কথাই বলব, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের পর বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের লেখা খুব কমজনই সার্থকভাবে লিখতে পেরেছেন।

২) আসল গোয়েন্দাঃ সমুদ্র বসু সিরিজের এই গোয়েন্দা কাহিনিটিও বেশ অভিনব। ব্যাঙ্ক ডাকাতির আগাম খবর পেয়ে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি ‘ঈগলস আই’-এর কর্ণধার মিস্টার মিত্রকে। আর মিস্টার মিত্রও ছদ্মবেশে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে শুরু করলেন। তারপর এল সেই ডাকাতির রাত। আদৌ কি ঈগল আই সফল হল? গল্পের শেষে অবধারিতভাবেই রয়েছে হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত সুলভ চমক।

৩) ভয়ংকর স্বীকারোক্তিঃ যেহেতু এই গল্পের নামেই বইয়ের নামকরণ, কাজেই এটিই যে এই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উত্তরবঙ্গে শীতের রাতে এক সার্কাসের তাঁবুতে রাত কাটাতে গিয়ে গল্পের কথক ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার অনিরুদ্ধের পরিচয় হল নেপালি ভদ্রলোক মিস্টার সুব্বার সাথে। আর সেই রাতেই অনিরুদ্ধের কাছে মিস্টার সুব্বা এক ‘ভয়ংকর স্বীকারোক্তি’ করলেন। যা পড়তে পড়তে পাঠক শিউরে উঠতে বাধ্য। এমন একখানা গল্পের জন্যেই পুরো বইটা কিনে ফেলা যায়।

৪) বোয়িং ২০৫০ : যতদূর মনে পড়ছে, মাস কয়েক আগে শুকতারায় প্রকাশিত হয়েছিল কল্পবিজ্ঞানের এই গল্পটি। এক দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে গোটা বিশ্ব। এই প্রথমবার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সাতটি মহাদেশে পা রাখতে চলেছে পৃথিবীর মানুষ। সারা পৃথিবীর নির্বাচিত কিছু ধনী ব্যক্তিই এই সুযোগ পেয়েছেন। রয়েছেন অনেক ভিআইপিও। নির্দিষ্ট সময়ে বিমান ছাড়ল আর তারপরই বোঝা গেল বিমান হাইজ্যাক করেছে জঙ্গীরা। তারপর? জঙ্গীদের দাবি কি পূরণ হল? নাকি অন্যরকম কিছু ঘটল?
হিমাদ্রিবাবুকে একটাই কথা বলব, আপনি মাঝে মাঝে এমন কিছু কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখতেই পারেন। আপনার কলমে খুব বেশি কল্পবিজ্ঞান পাইনি আজ অবধি

৫) সোনার কলমঃ গোয়েন্দা সমুদ্র বসু সিরিজের এই গল্পটাও ভালো। তবে অসাধারণ বলব না। সমুদ্র বসুর ক্ষুরধার বুদ্ধি আর গল্পের শেষের আকস্মিক চমক এই সিরিজের গল্পগুলোর অন্যতম সম্পদ। সেই দুটো উপাদানই সামান্য কম লাগল এই গল্পে।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন হঠাৎ মারা যান সোনার কলম পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাহিত্যিক জলধর ঘোষাল। পুলিশের ধারণা মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। স্বভাবতই রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব আসে সমুদ্র বসুর কাঁধে। আর তারপর সেই খুনের সূত্রেই সামনে আসে জলধর ঘোষালের ছেলেবেলার ইতিহাস!

৬) বান্ধবগড়ের রাজাসাহেবঃ বান্ধবগড়ের পটভূমিতে লেখা গল্প। কাজেই গল্পে বাঘ আসবেই। তিন বন্ধু মিলে বান্ধবগড় বেড়াতে গিয়ে জানতে পারে ফরেস্ট লজের কোনও রুম ফাঁকা নেই। শেষমেশ মঙ্গল সিং-এর সহযোগিতায় স্থানীয় রাজবাড়িতে থাকার সুযোগ চলে আসে। পরিচয় হয় রাজাসাহেবের সাথে। তারপর সেদিন রাতেই তাদের সামনে অভিনীত হয় পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক কাহিনি এই অভিনয়ের কতটা সত্যি আর কতটা কল্পনা, সেটাই এই গল্পের সবচেয়ে বড়ো চমক।

৭) এক টুকরো কাচঃ সমুদ্র বসু সিরিজের অত্যন্ত সুন্দর একখানা গোয়েন্দা গল্প। খুন হয়েছেন কৈবর্ত লেনের ব্যারিস্টার অবনী ঘোষ। আর সেই রহস্য উন্মোচনের ভার যথারীতি সমুদ্র বসুর ঘাড়ে। সামান্য এক টুকরো কাচের সূত্রকে কাজে লাগিয়ে কী করে একখানা খুনের রহস্যের কিনারা করা যায়, তা জানতে হলে পড়ে দেখতে হবে গল্পটি।

৮) চন্দ্রদেবতার মূর্তিঃ কয়েক মাস আগে শুকতারার পাতায় প্রকাশিত এই গল্পটা পাঠকদের চমকে দিয়েছিল। সেই চমকের স্বাদ আবার পেলাম গল্পটা পড়তে পড়তে। সমুদ্র-তীরবর্তী এক প্রাচীন মন্দিরে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মহামূল্যবান চন্দ্রদেবতার মূর্তি। সেটা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে যাচ্ছেন মিউজিয়াম অধিকর্তা ডক্টর বিনায়ক মাথুর, সঙ্গী অতনু। সেখানে গিয়ে তাদের পরিচয় হয় চন্দ্রদেবতার উপাসকের সাথে। তিনি নিষেধ করেন তাঁদের ঐ মূর্তির ব্যপারে আগ্রহ দেখাতে। এরপর কী হল? সেই নিষেধ শুনে তাঁরা কি ফিরে এলেন? নাকি...?

৯) পিশাচগড়ের পিশাচ বুরুজঃ এটিও সমুদ্র বসু সিরিজের আর একখানা গল্প। প্রকাশিত হয়েছিল গত শারদীয়া ‘ছোটদের কলরব’-এ। আগেও বলেছি, এই সিরিজের গল্পগুলোর সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমুদ্র বসুর ক্ষুরধার বুদ্ধি, আর গল্পের শেষের আকস্মিক চমক। এই গল্পে দুটোই পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। ব্যক্তিগতভাবে আমার সমুদ্র বসু সিরিজের সবচেয়ে পছন্দের গল্প এটি।

১০) কুৎসিত সুন্দরঃ এবারের শারদীয়া সন্দেশে প্রকাশিত হয়েছিল কাহিনিটি। শুধু ভালো বললে বোধহয় এই কাহিনিকে ছোটো করা হবে, আর অসাধারণ বললেও কিছুটা কম বলা হবে। দৈহিক সৌন্দর্য, নাকি মানসিক সৌন্দর্য - কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে আছে গল্পজুড়ে। নিজের দৈহিক সৌন্দর্যকে বড়ো করে দেখানোর নেশায় একজন মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে সেই কাহিনিই এর মূল বিষয়। তবে গল্পের শেষের মেসেজটুকু পাঠকদের মনে যে ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করে, তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ।

১১) ব্যোমকেশ তপাদারের ডায়েরিঃ এই কাহিনিটি পড়তে পড়তে বারবার একটি নামই মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় তিনি হলেন এক এবং অদ্বিতীয় প্রফেসর শঙ্কু। গল্প বলার ধরন এবং বিষয়বস্তু, সবক্ষেত্রেই সত্যজিৎ রায়ের সেই অনবদ্য সৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায় বার বার। সম্ভবত লেখক সচেতনভাবেই এটা করেছেন। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, গল্প হিসেবে এটি পড়তে দারুণ লেগেছে। আমি অপেক্ষা করে থাকব এই সিরিজের আরও কিছু গল্পের জন্যে। ব্যোমকেশ তপাদারের ডায়েরি ভরে উঠুক, প্রত্যাশা রইল

১২) কনয়্যাকের দেশেঃ ভয়ংকর সুন্দর এই কাহিনিটি দিয়েই শেষ হয়েছে এই সংকলনটি। নাগাল্যান্ডের এক বিশেষ অঞ্চলের মানুষরা সারা শরীরে ট্যাটু আর মুন্ডু শিকার করার জন্য বিখ্যাত। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও এখানকার লোকেরা দেবতাকে তুষ্ট করতে মানুষের মুন্ডু শিকার করতযদিও এখন পুলিশের ভয়ে এসব আর হয় না। এমনই এক গা ছমছমে এলাকায় বেড়াতে আসে সুদূর ইংল্যান্ডের স্মিথ আর এক বঙ্গসন্তান আভাস। এরপর নাটকীয় মোড় নেয় পরিস্থিতি। কাহিনি সম্পর্কে এর বেশি লেখার সামর্থ আমার নেই। একবার পড়তে শুরু করলে আর না শেষ করে আর থামা যাবে না, এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি। সংকলনের এই শেষ কাহিনিটি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল।
_____

No comments:

Post a Comment