বিজ্ঞান:: সমুদ্রে বিপদ - পল্লব কুমার চ্যাটার্জী

সমুদ্রে বিপদ
পল্লব কুমার চ্যাটার্জী

-    স্যার, আমি ডাক্তার হব। মুকুল হাত তুলে বলল।
-    খুব ভাল। তবে ডাক্তার হতে গেলে আঁকার হাতটা ভাল হতে হবে। তার সঙ্গে চাই কঠিন কঠিন শব্দ মনে রাখার স্মৃতিশক্তি। সমীর কি হতে চাস?
-    আমি প্রোফেসার হব। কলেজের দাদা-দিদিদের পড়াব।
-    তুই যখন পড়াবি তখন কি আর তারা দাদা-দিদি থাকবে, রঞ্জিতবাবু হেসে ফেলেন। আর পার্থ?
-    আমি সৈনিক হব স্যার। যুদ্ধে গিয়ে দেশসেবা করব।
-    খুব ভাল চিন্তা। তবে খুব রিস্কি জীবন। তুই ত বাড়ির একমাত্র ছেলে, মা-বাবা ছাড়বে? বলতে বলতে রঞ্জিতবাবুর চোখ গেছে দরজার দিকে। আরে গুণা, তুই কতক্ষণ?
বাল্যবন্ধু গুণময় রায় দাঁড়িয়ে বাইরে। সে এখন ভারতের একটি নামকরা পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর ড্রিলিং ইঞ্জিনীয়ারকাজের অর্ধেক সময় তাকে সমুদ্রেই ড্রিলিং-জাহাজে কাটাতে হয়। আজ মনে হয় অনেকদিন পরে ছুটিতে গ্রামে এসেছে।
-    আয় আয়, ভেতরে আয়। তারপর, কি খবর বল।
-    তোদের গল্প শুনছিলাম। দেশসেবা করার কথা হচ্ছিল বুঝি। তা, ছেলেরা, দেশের সেবা করতে বুঝি যুদ্ধেই যেতে হয়?
-    কাকু, কী থ্রিলিং লাইফ বলুন! সবসময় জীবন হাতে নিয়ে চলা।
-    না রে, এই কাকুর মত ইঞ্জিনীয়ার হতে পারলে বড় সরকারি চাকরি পাওয়া যায়। ইনি সমুদ্রের মাঝে কাজ করেন, কী রোমাঞ্চকর বল দেখি! রঞ্জিতবাবু বললেন।
-    আমার রোমাঞ্চময় জীবনের গল্প শুনবে তোমরা? গুণময় শুধোলেন।
সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল। রঞ্জিতবাবু চেয়ার ছেড়ে ছাত্রদের মধ্যে এসে বসলেন। খবর পেয়ে আরও দু-চারজন শিক্ষক এসে ক্লাসরুমে বসলেন গল্পের আশায়। শুরু হল গুণময়ের উপাখ্যান।
-    আমাদের কাজ হল সমুদ্রের নীচে যে মাটি, তার নীচে পাথরের স্তর, সেখানে ছিদ্রময় লাইমস্টোন বা স্যান্ডস্টোন জাতীয় পাললিক শিলাস্তরে সঞ্চিত হয়ে আছে খনিজ তেল আর গ্যাস - তাকে মাটির ওপরে তুলে আনার পথ গর্ত খুঁড়ে অর্থাৎ ড্রিল করে তৈরি করা। এর জন্যে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় অফশোর ড্রিলিং রিগ। যদি সমুদ্রতলের গভীরতা বেশি হয় তাহলে ভাসমান জাহাজ থেকে ড্রিল করা হয়। তবে মুম্বাইয়ের অয়েলফিল্ডে সমুদ্রতলের গভীরতা ১০০ মিটারের মত, তাই সেখানে জ্যাক-আপ রিগ ব্যবহার করা হয়।
-    জ্যাক-আপ কি জলে ভাসে না? চারুবাবু অঙ্কের শিক্ষক জিগ্যেস করলেন।
-    প্রথমে ত ভাসেই, তবে নিজে থেকে নয়।* অন্য দুই বা তিনটি নৌকো তাকে টেনে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়, তারপর তার তিনটি পা বা leg  জলের নীচের জমিতে নামিয়ে র‍্যাক-এণ্ড-পিনিয়ন গীয়ার বক্স বা হাইড্রলিক সিস্টেমে পুরো জাহাজটিকে তুলে দেওয়া হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্ততঃ ১৮-২০ মিটার ওপরে।
-    কেন স্যার? জলের লেভেল থেকে কাজ হত না? প্রশ্ন করে মুকুল।
-    না। কারণ গর্ত খোঁড়ার জন্যে প্রয়োজনীয় স্লটেড জ্যাকেট আগেই তৈরি করা থাকে জল থেকে এতটা ওপরে যেখানে জোয়ারের জল ওঠে না। তারও খানিকটা ওপরে জাহাজের বডি বা ‘হাল’ তুলে দেওয়া হয়। আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে এইরকম একটা জ্যাকেটেড প্ল্যাটফর্মে জ্যাক-আপ করার সময় থেকে। এই কাজের জন্যে যে অভিজ্ঞ আর দক্ষ অফিসার থাকেন তাঁকে বার্জ ইঞ্জিনীয়ার বলা হয়। প্রথমে জ্যাকেট থেকে জাহাজের আফ্‌ট্‌ বা পেছন দিকটাকে এনে তিনটে লেগকে নামানো হল - ঠিক সমুদ্রপৃষ্ঠ ছুঁয়ে থাকে যাতে। একে বলে পিন-আপ। এই অবস্থায় রিগ নিজে থেকে ভাসে না, অথচ টেনেটুনে পোজিশন করা যায়।
-    তারপর?
-    তারপর পজিশন মনোমত হলে তিনটে লেগ দিয়ে একত্রে সমগ্র জাহাজকে জ্যাক-আপ করা হয়, ‘হাল’-কে সি-লেভেল থেকে প্রায় এক মিটার ওপরে রেখে। একে বলে প্রি-লোড পজিশন।
-    তুই কি এই বাচ্চাগুলোকে পুরো অফশোর টেকনোলজি একদিনেই শিখিয়ে দিবি? এই সব টার্ম ত আমরাও বুঝতে পারছি না - রঞ্জিত বললেন।
-    যাক গে সংক্ষেপে বলছি। একটা আস্ত রিগকে তিনটে লেগ দিয়ে তুলে দেওয়ার রিস্ক বোঝ? মাটিকে তার চাপ সহ্য করতে হবে। তা ড্রিলিং-এর সময় আরো বেড়ে যাবে। তাই পুরোপুরি জ্যাক আপ করার আগে মাটির সহ্যশক্তি পরীক্ষা করার জন্যে প্রি-লোড আর স্পাড-ট্যাঙ্কে জল ভরে প্রি-লোড টেস্ট করা হচ্ছিল।
রাত্রি দেড়টা আমরা নাইট-শিফ্‌টে গ্যালিতে বসে মিডনাইট লাঞ্চ খাচ্ছি। এমন সময় কড়-কড় করে বাজ পড়ার মত একটা শব্দ। কিছু বোঝার আগেই দেখি থালা-বাটি-কাঁটাচামচ সম আমার দিকে তেড়ে আসছে। তারপর সসের শিশি, আচারের বোতল, লবন-মরিচের কৌটো তারাও লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। এ কি ভৌতিক কাণ্ড - বলে আমি পেছন ঘুরলাম। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন ধাক্কা দিয়ে আমাকে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে চলল। অনিচ্ছার সাথে জোরে ধাক্কা মারলাম দরজায়, সশব্দে খুলে গেল সেটা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাব, দেখি সেটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওঠার উপায় নেই। হঠাৎ ভয়ানক একটা শব্দ। পুরো জাহাজ নড়ে-চড়ে একটু যেন বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এইবার আমরা হুড়মুড়িয়ে বাইরে এলাম।
-    কি হয়েছিল? একযোগে প্রশ্ন সবার।
-    হয়েছিল কি, একটা করে ট্যাঙ্কে জল ভরে একঘণ্টা করে রেখে প্রি-লোড টেস্ট করা হচ্ছিল। শেষ লেগটা টেস্ট হচ্ছে, পঞ্চাশ মিনিট পার হয়ে গেছে। এবার বার্জ ইঞ্জিনীয়ার রাম গজরে তার একজন সহকারীকে পাঠাল জল বের করে দিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে ধসে পড়েছে লেগের তলার মাটি, একবারে আট মিটার। রিগ হয়ত ডুবেই যেত, একযোগে ঘটত আমাদের সবার সলিল-সমাধি। একটা লেগ ধ্বসে ঘুরে পুরো জাহাজটা ‘ওভার-টার্ণ’ হয়ে ডুবতে বসেছিল, ভাগ্য ভাল যে সেই সময় ধাক্কা লাগে পাশের প্ল্যাটফর্মে, তাছাড়া জাহাজটি জলের উপর নেমে আসায় ‘ফ্লোটিং-ড্রাফ্‌ট্‌’ও স্থায়িত্ব ফিরে পায়। এই ঘটনাটাকে ইন্ডাস্ট্রিতে বলা হয় ‘পাঞ্চ-থ্রু’
-    কি দারুণ না! ভাবী সৈনিক পার্থের মন্তব্য।
-    হ্যাঁ রে, দৈবের সাহায্য ছাড়া তো এ ধরণের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা যায় না! রঞ্জিত বলে।
-    দৈবের হাতে মানুষ অবশ্যই অসহায়, চিরকালই। তাই বলে কেউ হাল ছেড়ে দেয় না। আমরা ইন্স্যুরেন্সের দলিল লেখার সময় বা জব কন্ট্রাক্টে যেটাকে ‘God’s act’বলে বর্ণনা করি, তারপর কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনীয়াররা বসে থাকে না। যেখানে বন্যার বা অতিবৃষ্টির ভয় সেখানে বাড়ির প্লিন্থ অনেকখানা উঁচুতে রাখা হয়। ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকায় ভিত গভীর বা স্টেপড বা পাইল করে বানানো হয়। আগে নিয়ম ছিল প্রি-লোড টেস্ট তিনটে লেগে একসাথে করা হবে, কিন্তু ১৯৮৬-তে একটি বড়ো দুর্ঘটনার পর তিনটি লেগের আলাদা আলাদা ভাবে প্রি-লোডিং করা হয়, তাতে একমুখী ঘাতের প্রভাবটা ঠিকভাবে জানা যায়। এছাড়া এখন কম্প্যুটার মনিটরিং আর ট্রেনিং-এর জন্যে পাঞ্চ-থ্রু সিমুলেটারও ব্যবহার করা হয়।
-    ওগুলো আমরা বুঝব না, বলুন?

চিত্র ১ ।। একটি জ্যাক-আপ রিগ


-    আপনারা বুঝলেও ছাত্রেরা এত সহজে বুঝবে না। তবে যারা বাড়িতে ভিডিও বা মোবাইল গেম খেলে তারা কিছুটা বুঝতেও পারে। এটা হচ্ছে সম্ভাব্য পরিস্থিতিকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ট্রেনিং আর অভ্যাস
-    ১৯৮৬-র ঘটনাটা কোথায় হয়েছিল, গুণময়বাবু, অঙ্কস্যার জানতে ছাইলেন।
-    এই বোম্বাইয়েই। তখন বোম্বাই-ই ছিল নাম, পরে মুম্বাই হয়। রিগের নাম ডিক্সিলিন-ফীল্ড ৮৩। জ্যাক-আপ করার সময় প্রি-লোড টেস্টে উৎরে গেছিল। তবে ড্রিলিংএর সময় একটা পাঞ্চ-থ্রুর ফলে লেগের স্ট্রাকচারাল ফেলিয়োর হয়, রিগটি ডুবে যায়। আশ্চর্য এই যে একই কোম্পানীর তিনটি একধরণের রিগ নম্বর ৮১, ৮২ ও ৮৩ পরপর নষ্ট হয় যথাক্রমে ১৯৮০, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে।
-    তোদের ওই লেগওয়ালা মানে জ্যাক-আপ রিগে আর কী কী বিপদের ভয় আছে বল তো।
-    আরো বেশ কয়েকধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন পদচিহ্ন বা foot-print সংক্রান্ত। এটা নতুন প্লাটফর্মে হয় না। কোনও জায়গায় আগে কোনও রিগ কাজ করে গেলে তার লেগের তলা, যাকে বলে স্পাড-ক্যান, তার গভীর ছাপ পড়ে সমুদ্র-পৃষ্ঠে, তাকে বলে foot-printএক রিগের পায়ের ছাপে অন্য রিগ দাঁড়াতে পারেনা, উলটে যেতে পারে, যদি না তা আগের চিহ্নের থেকে বড়ো হয়। বম্বের সাগর-প্রগতি রিগের স্পাড-ক্যান সবচেয়ে বড় হওয়ায় এ সমস্যা তার ছিল না। তাই কোনও অসমাপ্ত প্লাটফর্মে ড্রিলিং-এর কাজ পুনরায় চালু করা বা কূপ মেরামতির (work-over) কাজের জন্যে প্রগতির ছিল বিশেষ চাহিদা।
আর একটা সমস্যা হচ্ছে ভূমিকম্প জাতীয় উপদ্রবে তলার মাটি সরে যাওয়া। তবে তার আশঙ্কা খুবই কম। মনে পড়ে ২০০১ সালের ২৬শে জানুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় আমার রিগ সাগর-রত্নায় পতাকা উত্তোলন করতে যাচ্ছি, এমন সময় জোরালো এক শব্দের সাথে সমস্ত রিগ কেঁপে উঠল। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনও ফিশিং বোট লেগ-স্ট্রাকচারে ধাক্কা মেরেছে বুঝি। কিছুক্ষণ পরে বার্জ ইঞ্জিনীয়ার ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল গুজরাট সহ পশ্চিম উপকূলে ভয়ানক ভূমিকম্প, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারই একটা ঝাঁকুনি রিগের পায়ে এসে লাগে।
গুণময় চুপ করল। তখনও ছাত্র আর শিক্ষক দু-পক্ষই হাঁ করে শুনছে সমুদ্রের বিচিত্র জীবন সম্বন্ধেবিজ্ঞান-শিক্ষক বরুণবাবু কিন্তু গুণময়কে ছাড়তে রাজি নন। তিনি গুণময়কে অনুরোধ করলেন একদিন কিছু স্লাইড দিয়ে এই সুরক্ষার ব্যাপারটা একটু ভাল করে বোঝাতে। দুদিন পরে গুণময় আবার এলেন একটা ল্যাপটপ হাতে নিয়ে। হাজার হোক, এই স্কুলে তিনি নিজেও পড়াশুনা করেছেন এককালে, একটা আত্মিক যোগ তো আছেই এর সঙ্গে।

*                 *                 *

চিত্র ২ ।। একটি রিগ পাঞ্চ-থ্রু হয়ে ডুবে যাচ্ছে

আজ ছাত্র আর শিক্ষক সবাই কিছু না কিছু শিখে এসেছে ইন্টারনেট ঘেঁটে। স্কুলের সফল ছাত্রদের উদার সাহায্যে এখানে কম্প্যুটার বা নেটের অভাব নেই, একটা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টারও আছে।
প্রথমে দেখানো হল একটি সামুদ্রিক জ্যাক-আপ রিগের কার্যরত অবস্থার ছবি (চিত্র-১)।
এরপর উনি বোঝাতে লাগলেন জ্যাক-আপ বা ম্যাট জাতীয় রিগে কী কীভাবে দুর্ঘটনা হতে পারে ও তাদের শতকরা আনুমানিক সম্ভাবনা। দেখা যায় পাঞ্চ-থ্রু জাতীয় ঘটনার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫৩%। হিসাবটা এরকম -
অনপেক্ষিত অনুক্রমন (Unexpected penetration) ৮%
ভিত্তিমূলের প্রতিসরণ (
Sliding of mat foundation) ১০%
অসমতল সমুদ্রতল বা অন্য রিগের পদচিহ্ন (
Uneven seabed, Scour, Footprint) ১৫%
সমুদ্রপৃষ্ঠের অস্থিরতা, গতিশীল বালুকা, আগ্নেয় ক্রিয়াশীলতা (
Seafloor instability, Mudslide, Seabed slide, Volcanic activities) ৬%
পাঞ্চ থ্রু (
Punch-through) ৫৩%
অন্যান্য (
Others) ৮%

তাহলে বুঝতে পারছ যে পাঞ্চ-থ্রু হয়ে একদিকে ধসে গিয়ে একটি জ্যাক-আপ রিগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫৩%। এতে অনেক রিগ ডুবেও যায়। আল-মারিয়া রিগটি পাঞ্চ-থ্রু হয়ে ডুবে যায় ২০০০ সালে, চারজন কর্মীর মৃত্যু হয়। তার ছবি দেখানো হল (চিত্র-২)। এছাড়া ৩ নং চিত্রে আছে অন্য কয়েকটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত রিগের নাম।

চিত্র ৩ ।। কয়েকটি সামুদ্রিক দুর্ঘটনা

*                      *                       *

-    ঝড়ে জাহাজডুবি হয় না? সমীর প্রশ্ন করে।
-    হবে না কেন? তবে তার সঙ্গে জ্যাক-আপ রিগের কোনও তফাৎ নেই, এটা সব জাহাজের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। তবে ডুবে যাওয়া বা ধসে যাওয়ার মূল কারণ দুটি - এক ভারসাম্য (Equilibrium) হারানো ও দুই প্লবতা (Buoyancy) কমে যাওয়া। এই দুটো নিয়ে প্রশ্ন করলে কিন্তু আমার থেকে ভাল উত্তর পাবে তোমাদের বিজ্ঞান শিক্ষকদের কাছেগুরুত্ব-কেন্দ্র আর আর্কিমেডিস সিদ্ধান্ত - এই দুটো চ্যাপটার ভাল করে বুঝে নিও, কেমন?
এরপর গুণময় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। রঞ্জিতবাবুর কেন জানিনা মনে হল, সে কিছু চেপে যাচ্ছে বা বলতে দ্বিধা করছে। উনি থাকতে না পেরে বললেন - ‘গুণা, তুই চিন্তা করিস না, তোর বলার ধরণে সব ছাত্ররা ব্যাপারখানা জলের মত বুঝতে পারছে। কি রে, পারছিস না?’ এই কথাগুলো অবশ্য বলা হল ছেলেদের দিকে তাকিয়ে।
-    হ্যাঁ স্যার, অবনী বলে, আমি নোট করে নিচ্ছি। না বুঝলে পরে আপনাদের কাছ থেকে জেনে নেব।
-    না রে রঞ্জিত, গুণময় খোলসা করেন, আমার চিন্তা অন্য। তোর ছাত্রেরা হয়ত সমুদ্র-জীবনের রোমাঞ্চকর দিকটাই দেখছে, ঝুঁকি বা বিপদের সব কথা খুলে বলে তাদের মনে আমি ভয় ধরিয়ে দিচ্ছি না তো? দ্যাখ, এসব নিয়ে কিন্তু আমি বাড়িতেও বিশেষ আলোচনা করি না খুব বেশি চিন্তা করবে বলে।
-    না গুণময়বাবু, চারুবাবু বলেন, বরং তার উল্টোটা হবে। পথের বিপদ সম্বন্ধে সম্যক না জেনে কি পথ চলা যায়? তা ছাড়া এও তো এক বিজ্ঞান, সুরক্ষা-বিজ্ঞান। আরও যদি কোনও বিপদের অস্তিত্ব থাকে তবে নিঃসঙ্কোচে তার আলোচনা করুন, ছাত্রদের সঙ্গে আমরাও উপকৃত হই।
-    তাহলে আসি একটা ভয়াবহ প্রসঙ্গে গ্যাস-গহ্বর বা shallow-gas crater

*                        *                            *

-    পেট্রোলিয়াম কূপের খননকার্যের সময় সবচেয়ে বড় বিপদ কি দেখা যায় জান? ভূগর্ভস্থ তেল বা গ্যাসের চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, নয়ত অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস বা তরলপদার্থ হু-হু করে বেরোতে থাকবে যাকে এই ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় বলা হয় কিক, আর তাকে বশীভূত না করতে পারলে যে সাংঘাতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তার নাম ব্লো-আউট। তার ফল হবে মারাত্মক। প্রথমতঃ মাটির নীচের প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্বভাবিক চাপ নষ্ট হবে, দুই আশেপাশের জমি, বাড়িঘর, চাষ-বাসের ক্ষতি, তিন দাহ্য তেল ও গ্যাসে আগুন লেগে রিগ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, চার বিষাক্ত গ্যাসে মানুষ, জন্তু-জানোয়ারদের ক্ষতি ও মৃত্যুর সম্ভাবনা, পরিবেশের ক্ষতি ইত্যাদি।

উপায়? খুব সহজ। ড্রিলিং করার সময় উদ্‌স্থৈতিক চাপ (
hydrostatic pressure) দিয়ে এই ভূগর্ভের তেল-গ্যাসের চাপটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, অর্থাৎ ড্রিলিংএর সময় এমন এক তরল পদার্থ কূপে রাখতে হবে যার তরল চাপ কূপের ভেতরের তেল ও গ্যাসের চাপ থেকে বেশি হয়। খুব সাধারণ ফরমুলা, চাপ = ঘনত্ব x গভীরতা x একটি ধ্রুবসংখ্যা বা constantকিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা মেনটেন করতেই আমরা হিমসিম খেয়ে যাই।

সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি হয় যখন মাটির নীচের থেকে গ্যাস কিক আসে। বয়েলের নিয়ম অনুযায়ী কূপের গভীর থেকে গ্যাস যতই ভূতলের কাছাকাছি আসতে থাকে, তত তার চাপ কমে, অতএব আয়তন ততই বাড়তে থাকে। ফলে এক ঘনমিটার গ্যাস ১০০০ মিটার উপরে উঠে হয়ত ১০০ ঘনমিটার হয়ে গেল - এবার কে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনবে? কূপের মুখকে সাময়িক বন্ধ করা যায় ব্লো-আউট প্রিভেন্টার (
BOP) ব্যবহার করে। কিন্তু যদি গ্যাসের উৎসস্থল মাটির কাছাকাছি, এই ধর ৩০০ মিটার হয় মাত্র? বলত কী হবে?

-    খুব শিগ্‌গির সেটা ওপরে চলে আসবে। এক ছাত্র বলে।
-    ঠিক। তাতে চিন্তা করার সময় বা রিঅ্যাকশন টাইম কম পাওয়া যাবে। তবে সবচেয়ে ভয়ানক হল যে ভূস্তরের উপরের দিকের মাটি খুব নরম ও ছিদ্রময়(porous)  হয়। ফলে এই অবস্থায় একবার গ্যাস বেরোতে শুরু করলে বাধা দেওয়া চলবে না, মানে BOP বন্ধ করাই চলবে না। করলে কি হতে পারে জান? 
ছাত্রেরা চুপ। বরুণবাবু বললেন, ‘কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। মাটি ফুঁড়ে গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে।
-    একদম ঠিক বলেছেন। আর তাই করতে গিয়ে সমস্ত উপর-দিকের মাটি ধসে পড়াও বিচিত্র নয়, বরং এমনটাই হয়ে থাকে। আর সমুদ্রের মাঝখানে কোনও জ্যাক-আপ রিগে এরকম ব্যাপার ঘটলে সমস্ত রিগই চলে যেতে পারে মাটির তলার গহ্বরেMr. Louie নামে একটি রিগ ১৯৬৩ সালে নর্থ সী-তে কাজ করার অবস্থায় এরকম একটি দুর্ঘটনা ঘটে। মাত্র ৪০০ মিটার গভীরতায় একটি উচ্চচাপের নাইট্রোজেন পকেট ঘটায় অগভীর ব্লো-আউট। তৈরি হয় Figge-Maar নামে ৩১ মিটার গভীর এক মস্ত জ্বালামুখী। তবে রিগ রক্ষা পায় কোনওমতে।
-    একটা প্রশ্ন করি গুণা। সেফটি বা সুরক্ষার তো এত ব্যবস্থা থাকে সমুদ্রস্থ তেলের রিগ বা ইন্‌স্টলেশনগুলোতে। তা সত্ত্বেও এত দুর্ঘটনা হয় কী করে।
-    ভাল প্রশ্ন তুলেছিস। সেফ্‌টি সেকশন চিরকালই ছিল, তবে তা নিতান্তই দায়সারা গোছের। তার প্ল্যানের মধ্যে থাকত দুর্ঘটনা হলে কী করবে তার উপায় আর সমুদ্রে নিজেকে বাঁচানোর ট্রেনিং (Survival of Life at Sea বা SOLAS)তারপর ১৯৮৮ সালে ঘটে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। স্কটল্যান্ডের অ্যাবার্ডিন থেকে ১১০ মাইল পূর্বোত্তরে নর্থ-সীর পাইপার অঞ্চলের বিশাল অফশোর প্ল্যাটফর্ম ‘পাইপার অ্যালফা’ (Piper Alpha) পুড়ে ছাই হয়ে যায় শুধুমাত্র যোগাযোগ সমস্যা (communication), সঠিক হস্তান্তরণ-পদ্ধতি (proper hand-over system) আর একটি নিশ্ছিদ্র দুর্যোগ-মোকাবিলা প্রক্রিয়া (Disaster Management Plan) এর অভাবে। পাইপার আলফা দুর্ঘটনা একটা মাইলস্টোন, শুধু তেল-উদ্যোগ নয়, শুধু সমুদ্র নয়, গোটা বিশ্বের শিল্পোদ্যোগ জগতের সুরক্ষা-জগতে নিয়ে এল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সব কিছু ঢেলে সাজানো হল। এখন সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্যে তৈরি হয়েছে নানা সংস্থা, নতুন নতুন কার্যক্রম, প্রতিটি কোম্পানিতে স্বয়ং-সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য-সুরক্ষা-পরিবেশ (Health, Safety and Environment বা HSE) বিভাগ। অবশ্য এতে এ ধরণের দুর্ঘটনা কমানো গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এই ২০০৫ এর ২৭শে জুলাই মুম্বাইয়ের পশ্চিমে আরব সাগরে BHN প্ল্যাটফর্মটি পুড়ে ছাই হয়ে যায় সামান্য একটি মানবিক-ভুল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে। ২২ জন কর্মী ও অফিসার মারা যান এই দুর্ঘটনায়।
     
      ব্যস, আর নয়। এরপর তোমরাই ঠিক করবে বড় হয়ে কে কী হতে চাও। ছোট্ট বন্ধুরা, জেনে রাখো, জীবনের চলার পথ কিন্তু আগাগোড়া মসৃণ নয়। তবে সেই বিপদের ভয়ে পিছিয়ে আসাটা কাজের কাজ নয়, এর মোকাবিলা করা, বা বিপদের সম্ভাবনাটুকু উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করাটাই হচ্ছে সত্যিকারের সাহসী মানুষের কাজ। সেখানেই জীবনের সার্থকতা।

* বেশিরভাগ জ্যাক-আপ রিগই নন-প্রপেল্‌ড্‌, অর্থাৎ নিজে নিজে চলার ক্ষমতা থাকে না। ভারতের প্রথম নিজস্ব অফশোর জ্যাক-আপ রিগ সাগর-সম্রাট ছিল একমাত্র সেল্‌ফ প্রপেল্‌ডএছাড়া আর একটি বিশেষত্ব ছিল এর, এটি ছিল চতুষ্পদ, অর্থাৎ চারটি লেগ দিয়ে জ্যাক-আপ করা হত। পরবর্তীকালে সব রিগেরই তিনটি করে পা রাখা হয়, এতে স্টেবিলিটি বা স্থায়িত্ব বাড়ে।
_____

No comments:

Post a Comment