গল্পের ম্যাজিক:: অশরীরীর শরীর - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস


অশরীরীর শরীর
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

গড়ঘাট রেলস্টেশনের লাগোয়া বাজার পেরিয়ে প্রায় কিলোমিটার খানেক এগিয়ে গেলে আমার পৈতৃক বাড়ি, গড়বাড়ি কিছু কিছু জায়গাতে আমার বাঁ হাতের পেশীতে কাঁপন ধরে, আর আমার নাকে নানারকম গন্ধ আসতে থাকে একের পর এক। আমার এই পিতৃভূমিতে এটা আমি খুঁজে পাই চারপাশের পরিবেশ, মানুষজন, জল-হাওয়া আর মাটি থেকেএই টানেই দু-তিনমাস অন্তর চলে আসি কিম্বা আসতেই হয় আমার পিতৃভূমি আর এই শতাব্দী প্রাচীন পৈতৃক আবাস গড়বাড়িতে
মাস পাঁচ-ছয় হল গড়বাড়িতে আমি জুঁই, গোলাপ আর হাসনুহানা মিশিয়ে একটা নতুন গন্ধ পাই। এই গন্ধে তিনি জানান দেন যে তিনি এসেছেন আমার আশেপাশে। আলাপ-পরিচয় হয়েছে আমাদেরইনি আমার প্রপিতামহের পিতৃদেব শ্রীযুক্ত বিজয়নারায়ণ সিংহ।

ঘড়ির বাইরের অংশটাকে বলে কেসিং আসল মেশিনটা ভেতরে থাকে। আমাদের শরীরটাও তাই আসল মেশিনটা, যার নাম আত্মা, সে হাড়-মাংসপেশির স্তরের ভেতরে থাকে। এনার সুবিধার জন্যে হাত, পা, চোখ, নাক এইরকম সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে এই দেহ। দেহটা কোনও কারণে বিকল হলে আত্মা তখন দেহকে ছেড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যায়
এসব কথা আমাকে হিমালয়ের এক পাহাড়ি গ্রামে গুরুজি নামে এক যোগীপুরুষ বলেছিলেন। অবশ্য একদিনে নয়, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে। একদিন এই প্রসঙ্গে উনি বললেন, তবে কখনও কখনও কোনও আত্মা অখণ্ড থেকে এই সংসারে রয়ে যায়
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এদেরকে রাতে-ভিতে দেখতে পেলে...
হা হা করে হেসে উনি বললেন,শুন বেটা, ভূত বা অশরীরী দেখা যায় না অনুভব করা যায়, তাও অনেক চেষ্টার পর এদের কারও অনিষ্ট করবার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনওটাই নেই
গুরুজি পরে আমাকে অনুভূতির তীক্ষ্ণতা আর একাগ্রতা বাড়াবার কতগুলো মানসিক ব্যায়াম শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা আমার সহজাত মানসিক ক্ষমতা তো ছিলই, সেটা আরও বেড়ে গেল। এরপর থেকে কোথাও অশরীরীর উপস্থিতি আমি অনুভব করতে পারি অন্য অনেকের চাইতে অনেক তাড়াতাড়ি অন্যদের মতো ভয় না পেয়ে তার সাথে আলাপ জমিয়ে নিই
আমার এই অশরীরী ঠাকুরদার সঙ্গে আমার তেমনই ভাব-ভালোবাসা আছে গড়বাড়িতে আমি এলেই উনি আসেন ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে।

আমরা এখানকার প্রাক্তন রাজার বংশধর গড় বা দুর্গের আকারের এই বাড়িকে স্থানীয় লোকেরা আজও গড়বাড়ি বলে আর আমাদেরকেও নাম ধরে না ডেকে বড়ো, মেজো বা ছোটো হুজুর বলে ডাকেআমার জেঠতুতো দাদা, আমাদের বড়দা প্রতাপনারায়ণ সিংহ বংশ-গৌরবের ধারক-বাহক হয়ে এখানেই রয়ে গেছেন কলকাতা থেকে তিন-চার মাস অন্তর শিকড়ের টানে আসা আমাকে পুরনো লোকেরা বেশি চেনে লোকে নমস্কার করে আমিও প্রতি-নমস্কার করি দু-চারটে কথাবার্তাও হয়।
একটু আগে রমেশকাকার সঙ্গে দেখা হল কিছুক্ষণ ঠাওরে দেখে বললেন, ছোটো হুজুর, কাল সকালে কলকাতা ফিরে যাবার সময় কোনও জিনিস বুঝি গড়ে ফেলে গেছেন?
কাল আবার আমায় এখানে কোথায় দেখল? শুধু কাল কেন, গত দু-তিন মাস ধরে আমি তো কলকাতার বাইরে কোথাও যাইইনি যাক গে, বুড়োমানুষ, ছানিপড়া চোখে কী দেখতে কী দেখেছে। উনি চলে যেতেই আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হলঅবাক ব্যাপার, শুধু কাল নয়, পরশু বিকেলেও ছোটোবড়ো সব বয়সী লোকেরা অনেকেই আমাকে এখানে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে যারা দেখেছে, তারা কেউই কিন্তু হেলাফেলার লোক নয়মজার কথা হল, সবাই কিন্তু আমার মতো দেখতে সেই লোকটিকে দেখেছে কথা বলেনি কেউ। আমার ডুপ্লিকেট আবার কে এল এখানে? কী মতলবে কে জানে দশচক্রে ভগবান ভূত - এরকম কিছু নয় তো?
এসব কথার জেরে হল কী, প্রতিবার যেমন এ-এলাকার মাটি, হাওয়া এমনকি গড়বাড়ির সামনে যে লাল ফুলগুলো ফুটে থাকে, না হল তাদের দেখা, না পেলাম তাদের সুগন্ধমনটা খিঁচড়ে রইল।
সিংদরজা পেরিয়ে অন্দরমহলের পেছনদিকটায় আমার ভাগের অংশ। সেদিকে এগোতে যাব, দেখি হলধরদা, বড়দার খাস বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্যই হয়তোএ-তল্লাটে বড়দার চর-চামচের অভাব নেই আমি যে এসে পৌঁছেছি সে খবরটা ওঁর কানে চলে গিয়েছে এতক্ষণে
হলধরদা আমাকে সেলাম করে বললে, ছোটো হুজুর, আপনাকে বড়ো হুজুর সেলাম দিয়েছেন এখনি একবার যেতে বললেন
মনটা খিঁচড়ে ছিলই একটু জোর গলাতেই বলে উঠলাম, এই তো এলাম কলকাতা থেকে বড়দাকে বলুন একটু সময় লাগবে আসতে
আমি এখানে এলে সনাতনদা আমার দেখভাল করে স্নান সেরে বেরিয়ে আসতেই সে ফিসফিসিয়ে বললে, বড়ো হুজুর নিজে এয়েছেন এইমাত্র। বসার ঘরে আছেন, চা দিয়েছি ওঁকে।”
ব্যাপারটাতে সনাতনদা নিজেই আমার চাইতে বেশি অবাক হয়েছে
বসার ঘরে এসে দেখি উনি অবাক হয়ে দেখছেন ঘরসাজানোআর্কিটেক্ট হলে ইনটিরিয়র ডেকরেশনও একটু আধটু জানতে-শিখতে হয়। এরকম তিনমহলা সাবেকি বাড়ির মেজাজ অক্ষুণ্ণ রেখে মেরামতির কাজ সামান্য করিয়ে নিয়েছি আসবাবপত্রও যতটা সম্ভব সারিয়ে নিয়েছি সেই পুরনো দিনের মেজাজ কতটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, সেসব বড়দাই বুঝতে পারবে। এক হিসেবে ভালোই হল উকিল বড়দা এবার বুঝবে যে গড়বাড়ির এই উত্তরাধিকার আমি কাউকে বেচে দেবার জন্য এত মাথা খাটিয়ে সাজাইনি
সনাতনদাকে ডেকে বলি, সনাতনদা, আমার ব্যাগে ভীমনাগের কড়াপাকের সন্দেশ আছে বড়দার জন্য নিয়ে এস
বড়দার গলাটা বেশ কিছুটা অমিতাভ বচ্চনের মতো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, থাক ছোটু, মিষ্টি আমার চলে না
তবুও আমি তো ছাড়ব না, সনাতনদা প্যাকটা খুলো না এখনি ও-মহলে বউদির কাছে পৌঁছে এস
ভালোই হল আমিও চাইছিলাম না আমার আর বড়দার মধ্যে আলোচনার সময় সনাতনদা আশেপাশে থাকে বড়দা সবসময় ডেকে পাঠায় কিন্তু আজ নিজে যখন এসেছে, কিছু একটা ব্যাপার আছে।
চারদিকে তাকাতে তাকাতে বড়দা বলে, সাজিয়েছিস ভালোই। পরশু এসে বোধহয় অনেক রাতে ফিরেছিসআর এই গাঁজাখোর হলধরটাও তেমনি। কে আসছে যাচ্ছে খেয়ালই রাখতে পারে না
আমি বললাম, পরশু আমি এখানে এসেছিলুম, একথা তোমাকে কে বললে?
বড়দা বললে, পরশু বিকালে তোকে এখানের অনেক লোক দেখেছে বাজারে ঘুরে বেড়াতে। শুধু তাই নয়, সোনাপট্টিতে বিজয় সাহার দোকান থেকে বেশ কিছু কেনাকাটাও করেছিস
আমি বললাম, বড়দা, কারা কী দেখেছে সে আমি জানি না। শুধু পরশু কেন, গত দু-তিন মাসে আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাইনি, তার অজস্র প্রমাণ আছেআর সোনাদানা তো আলু-পটল বা গায়ের গামছা নয় যে বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ইচ্ছে হল আর কিনে নিলামসেসব যদি কিছু কিনতেই হয় তবে এখানে বিজয় সাহার দোকানে কেন? কলকাতায় আমার বাড়ি থেকে বউবাজার বেশি দূরে নয়
বড়দা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আমাকে বললে, কথাটা সেইখানেই মনে হচ্ছে, এ বাড়ির কোনও জায়গাতে হঠাৎ করেই তুই কিছুর সন্ধান পেয়ে যাস। আর সেটা পাবার পর আর স্থির থাকতে পারিসনি
গেলাস থেকে এক ঢোঁক জলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে উনি বললেন, তুই সোজা বিজয় সাহার দোকানে না গিয়ে বাজারে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে ঢুকলি ওর দোকানে আর হঠাৎ যেন চোখে পড়েছে বলে শো-কেসে রাখা হিরের নেকলেসটা তোর ভালো লেগে গেল
বড়দা একটা সিগারেট ধরাবার জন্য থামল।
মনে হচ্ছে আদালতে বড়দা যেন শুনানির শেষে জজকে পুরো কেসটা সাম-আপ করছে আর দোষী সাজিয়ে দেওয়া নির্দোষ ব্যাক্তির মতো আসামির কাঠগড়ায় দাড়িয়ে আমি অবাক হয়ে শুনছি।
বড়দা সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে বললে, যেন হঠাৎ করেই পছন্দ হয়ে গেছে আর সেজন্যই অত টাকাও তো পকেটে নেই। একটু ইতস্তত করেই তুই বার করলি একটা-দুটো ভারী মোহর আর ইশারায় জানতে চাইলি এটা দিয়ে হবে কি না
আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বড়দা বলল, “বিজয় সাহার জহুরির চোখ কষ্টিপাথরে না ঘষে চোখে দেখেই রাজি হয়ে গেল। তুই ঠিক এটাই জানতে চাইছিলি যে মোহরগুলো সত্যি সোনার কি না আর আনুমানিক দাম কত। কাল বেরোবার সময় তুই তাড়াতাড়িতে হয় নেকলেসটা নয়তো বাকি মোহরের থলি কোনও একটা ফেলে চলে যাস, অথবা এক সঙ্গে দুটোই নিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিতে চাসনি। সে কারণে কাল কলকাতা ফেরত গিয়ে আজ আবার চলে এসেছিস
এতক্ষণ আমি মাথা ঠাণ্ডা করে শুনছিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমার উকিল বড়দা ঠিক কোন রাস্তায় হাঁটছে বা কোন কথাটা আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চাইছে। আমি যে আজকেই এখানে এসেছি তার হাজারো প্রমাণের রাস্তায় না গিয়ে যেন বড়দার কথাতেই চলছি সেভাবে এগোলাম
আমি বললাম, বড়দা, তুমি ঠিক কী জানতে চাইছ? এই গড়বাড়িতে আমি কোনও গুপ্তধন পেয়ে গেছি এবং তার কিছু দিয়ে কাল বিজয় সাহার দোকানে হিরের হার কিনেছি? কোনও কারণে কাল সেগুলো নিইনি, সেজন্য আজ আবার কলকাতা থেকে ফিরে এসেছি? তবে এটা বুঝতে তোমার মতো ঝানু উকিলের সময় লাগবে না যে ওই দুটো জিনিসের মধ্যে কমপক্ষে যদি একটাও আমার কাছে থাকে তবে আমি নিশ্চয়ই সেসব খিড়কি বাগানের মাটিতে পুঁতে রাখিনি
সোফা থেকে উঠে পাশের ঘরের তালা খুলতে খুলতে বললাম, এই ঘরে কর্তাদের আমলের একটা মজবুত স্টিলের আলমারি আছে, তুমি জান নিশ্চয়?
বড়দা সেদিকে তাকাতে তাকাতে বললে, ওটা বন্ধ হয় না বা চাবি লাগে না এরকম কিছু সমস্যা আছে শুনেছি। কাজ করছে তাহলে এখন?
ঘরে ঢুকবার আগে বললাম, বেশ সুন্দর কাজ করছে দেখে যাও এসে
বড়দা বললে, সিগারেটটা শেষ করে আসছি তুই খোল ততক্ষণ।
আমার উকিল বড়দা ভালোমতোই বোঝে যে নেহাতই আলমারিটা কাজ করছে কি না তা দেখাতে আমি ডাকছি না বিজয় সাহার দোকানের হিরের হার বা মোহর তাড়াতাড়িতে রেখে চলে গেলে সেটা এখানেই আছে কি না তা দেখাতেই ডাকছি এই আলমারিটার পাল্লাদুটোর লেভেল ঠিক করতেই সুন্দর কাজ করে। দরজার পাল্লার গা-তালা আর কম্বিনেশন লক দুটো খুললে তবেই আলমারি খুলবে। আলমারিটা ঠিক করার পর আমি কম্বিনেশন লকটার খোলা বন্ধ করার কোড বদলে নিয়েছি। আমি ছাড়া এখন এই আলমারি পাকা চোরও খুলতে পারবে না আপাতত এতে একটা দামি বিদেশি মাউথ অর্গান, বেহালা আর এক সেট বাঁশি রেখেছি। এখানে এলে ওগুলো বার করে বাজাই। গানবাজনা আমার ভারি প্রিয় আসলে রক্তে আছে যে
আলমারির ডানদিকের পাল্লা খুলে মাউথ অর্গান আর বাঁশিগুলো দেখে নিয়ে হঠাৎ ওপরের তাকে কী একটা চৌকো বাক্সমতো নজরে এল। বাঁদিকের পাল্লাটা খুলতেই এবার যা দেখলাম তাতে আমার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল, আর সেটা খুলতেই আমার বুকের ভেতর থেকে একটা এমন জোরে আওয়াজ বেরিয়ে এল যে বড়দা বসার ঘর থেকে ছুটে এল কাস্কেটে রাখা হিরের নেকলেস থেকে তখন আলো যেন ঠিকরে পড়ছে।
কাস্কেটের ভেতরে সাদা সাটিনের লাইনারের ওপর সোনার জলে লেখা বিজয় সাহার নাম আর নেকলেসটা ভালো করে দেখে বড়দা আমার দিকে কটমট করে তাকাল পারলে তখনই চিবিয়ে খায়। যাবার সময় বড়দা কর্কশ গলায় বললে, বসতবাড়ি আর জমিজমা ভাগ হয়েছে, কিন্তু গুপ্তধনের তো ভাগ হয়নি। তুই পেয়ে থাকলে সেটা পুরোটা তোর একার নয়
বড়দা চলে যাবার ঘণ্টাখানেক পরেও হতভম্বভাবটা রয়েই গেল। নির্দোষী লোকের ওপর দোষ চেপে বসলে তার এইরকম অবস্থা হয় বোধহয়। একটা লোক আমার মতো দেখতে হতেই পারে। সে সোনার দোকান থেকে তার কাছে রাখা মোহর দিয়ে কিছু কিনতেই পারে কিন্তু সে সেই নেকলেস এই বাড়িতে এসে, এই ঘরের তালা খুলে, আলমারির গা তালা আর কম্বিনেশন লক আনলক করে আমার জন্য আলমারিতে তুলে রেখে দিয়ে গেছে, এটা শিশুতেও বিশ্বাস করবে না। আবার কলকাতাতে আমার অফিসের লোকজন, আমার বউ, অফিসের সিসি টিভির ফুটেজ এইসব জলজ্যান্ত সাক্ষী যে কাল-পরশু কেন, গত দু’মাসে আমি কলকাতাতেই আছি অফিস আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যাইনি
গত দু’মাস ধরে আমি আর আমার সহকর্মীরা মিলে একটা বড়ো বিজনেস-গ্রুপের আধুনিক টাউনশিপের ডিজাইন বানাতে ব্যস্ত ছিলাম। দু’দিন আগে ক্লায়েন্ট সেই ডিজাইন দেখে পাঁচ কোটি টাকার পুরো ঠিকে আমাকে দিয়েছে। খবরটা পেয়ে মনে হয়েছিল আমার শিল্পী-বউ শ্বেতার জন্যে একটা হিরের কিছু কিনি। কলকাতার তিন-চারটে বড়ো বড়ো দোকানে ঘুরে এক বিখ্যাত জুয়েলারের দোকানে একটা হিরের নেকলেস পছন্দ করেও আর নেওয়া হয়নি। এইসব দোকানের সিসি টিভির ক্যামেরার ফুটেজ ঘাঁটলে আমাকে দিন-সময়সমেত দেখা যাবে।
আমি কাল-পরশু কেন, তার অনেক আগেও কলকাতাতেই ছিলাম সেটা যেমন সত্যি আবার কাল-পরশু এখানে শুধু যে ছিলাম তাই নয়, রীতিমত দামি গয়না কিনেছি তার পক্ষেও বেশ তাগড়া সাক্ষী-প্রমাণ আছে বিজয় সাহার সেকেলে দোকানটাতে নিশ্চয়ই সিসি টিভি লাগানো নেই। থাকলে একবার দেখতাম সেই ডুপ্লিকেট বাছাধনকে
হতভম্ব ভাবটা কেটে গেলেও আমাকে নিয়ে এই ধাঁধাটা শুধু যে মাথা ধরিয়ে দিল তাই নয়, আমার বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। প্রাক্তন সাংসদ আর ক্রিমিনাল কোর্টের উকিল বড়দা কিছু একটা জিনিসে আমাকে ফাঁসাবার বা কোনও দশচক্রে ভগবান ভূত জাতীয় কোনও ফন্দি আঁটেনি তো? কথাটাতে আমার প্রিয় ব্রাজিলিয়ান কফি আর দুটো কফি মগ এ-ঘরে নিয়ে আসার কথা মনে হল। একা লোকের জন্য দুটো মগ কী কাজে লাগবে সে কথায় পরে আসছি।
ডাইনিং প্লেসে এসে দেখি সনাতনদা ট্রেতে দুটো মগ, স্নাক্সস, বড়ো ফ্লাস্ক ভর্তি ব্রাজিলিয়ান কফি আর রাতের রান্না হটপটে রেখে চলে গেছে এ-বাড়িতে থাকলে রাত্রে আমার যা যা লাগে সনাতনদা তার পুরো খেয়াল রাখে। এসব নিয়ে আলমারির ঘরে ফিরে এসে গোলাপ, জুঁই আর হাসনুহানা মেশানো চেনা সুবাস না পেয়ে একটু নিরাশই হলাম। এর মানে আমার চার পুরুষ ওপরের সেই ঠাকুরদা যার কথা আমি প্রথমেই বলেছি, তিনি এখনও এলেন না। অথচ ছমাস হল আমি গড়বাড়িতে এসে পোঁছাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আলমারির ঘরটাতে ওঁর উপস্থিতি বোঝা যায় ব্রাজিলিয়ান কফির গন্ধ উনি খুব ভালোবাসেনআসামাত্রই পুরো মগ ভরে দিতে হয়। কফির গন্ধ কমে এলে সেটা ফেলে ফ্লাস্ক থেকে আবার দিতে হয়। না দিলে উনি রাগ করে চলে যান।
ওঁর জন্য কফি মগে ভরে আলমারি থেকে বেহালা আর বাঁশি বার করলাম। বাঁশি আর বেহালার যুগলবন্দীতেই তো প্রথম আলাপ ঠাকুরদা আর নাতির
মাস আগের কথা। গড়বাড়ির এই অংশ তখন সামান্য মেরামতি করে কোনওরকমে বাসযোগ্য করে তুলেছি। সে রাতে এই আলমারির ঘরে বেহালাতে মারুবেহাগ বাজাবার চেষ্টা করছিশরৎ পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোতে পুরো গড়বাড়ি ভেসে যাচ্ছে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রাগ মারুবেহাগের নিচেরটা ঠিকঠাক ধরলেও ওপরের সুরগুলো ধরছে নাভাবছিলাম কেউ একজন যদি সঙ্গত করত একটু। এই করতে করতে কখন যে ঠিকঠাক বাজিয়ে ফেলেছি নিজেই জানি নাআনন্দে আত্মহারা হয়ে বাজিয়েই চলেছি দ্রুত লয়ের শেষদিকে অভ্যেসমতো সঙ্গতকারের দিকে চেয়ে জোরে মাথা নাড়তে গিয়ে খেয়াল হল বাঁশি বাজিয়ে কেউ যেন সঙ্গত করছিল কে সে? আশেপাশেই তো কেউ বাজাচ্ছিল নাকি মনের ভুল? এদিকে পুরো ঘর জুঁই, গোলাপ আর হাসনুহানার গন্ধে ভরে উঠেছে। অবাক হলাম। তিনটে ফুলের একটাও আমাদের গড়ের বাগানে নেই।
ফ্লাস্ক থেকে এককাপ কফি বার করে বন্ধ করতেই স্পষ্ট শুনলাম বাঁশির মতো স্বর করে কেউ যেন বলছে, আমার জন্যেও এককাপ দাও
এই সময় কে আবার এল? দরজার দিকে যেতে গিয়ে দেখি আলমারিটা খোলা। বেহালা বার করার সময় ভুলে গেছি বোধহয় বন্ধ করতে। পাল্লাদুটো বন্ধ করবার সময় চোখে পড়ল যে বাঁশির ব্যাগটা খোলা আর আড়বাঁশিটা নেই। এটা কী করে হয়? আমার তো স্পষ্ট মনে আছে বাঁশির ব্যাগে আমি হাতই লাগাইনি।
জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখি দরজা তো বন্ধই আছে সনাতনদা যাবার সময় আমি তো নিজে বন্ধ করেছি। আড়বাঁশিটা তাহলে গেল কোথায়? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বাগানের দিকের বড়ো খড়খড়ি লাগানো জানালাটার চওড়া বেদিতে আড়বাঁশিটা পড়ে আছে অবাক ব্যাপার! আমি বাঁশি বার করলাম আর সেটা ওখানে রাখলাম, তার কিছুই মনে নেই?
যাই হোক, কফিটা শেষ করি, তারপর তুলব’খন, এই ভেবে বসতে যাব, দেখি আড়বাঁশিটা এবার সোফার ওপরে। বাঁশিটা সামান্য উঠল শূন্যে। শুনতে পেলাম, কেউ আড়বাঁশিটা বাজিয়েই বলছে, আমার কফিটা সেন্টার টেবিলে দাও।
বুঝলাম এতক্ষণে আমার পরম সৌভাগ্য যে কেউ একজন মহান অশরীরী এসেছেন।
হিমালয়ের সেই পাহাড়ি গ্রামে দেখা হয়ে যাওয়া যোগীজির উপদেশমতো পদ্মাসনে বসে বাঁদিকের নাকের পাতা বন্ধ করে ডানদিকের নাক দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা মূলাধার চক্রে পাঠানোর চেষ্টা করলাম। তিনবারের পর আমার সামনে যে অশরীরী বসে আছেন তাঁর কাছ থেকে সাড়া পেলাম আলাপও হয়ে গেল তার সঙ্গেইনি আমার চার পুরুষ ওপরে শ্রীযুক্ত বিজয়নারায়ণ সিংহ উনি বললেন যে কণ্ঠের অভাবে বাঁশির মাধ্যমে বেশিক্ষণ কথা বলা ওঁর পক্ষে কষ্টকর। তবে উনি জানেন যে মর্স কোড সাবলীলভাবে আমাদের দু’জনেরই জানা। আলাপচারিতা তাতে হতে পারে।
আমি যদি সেন্টার টেবিলে রাখা প্যাডে পেনসিলটা শুধু শুরুতে একটু ধরে রাখি তবে ওঁর সুবিধে হয়। পেনসিল পরে আর ধরতে হবে না। তবে আমার জন্য মর্স কোডের দরকার নেই। শব্দের জন্য হাওয়ার কাঁপনের হেরফের উনি ধরতে পারেন।
এভাবেই চলল দাদু-নাতির আলাপ। আমার বলা শেষ হতে না হতেই ওঁর পেনসিল সাদা প্যাডে হালকা ঘা দিয়ে নিমেষের মধ্যে ডট আর ড্যাশ দিয়ে তার জবাব দিয়ে দেয় ব্রাজিলিয়ান কফি খাবার উপায় না থাকলেও তার গন্ধ ওঁর ভালো লাগে।
বিজয়নারায়ণ সিংহ ব্যাবসার কাজে নিজের জাহাজে বিদেশ ঘুরেছেনলক্ষ্মীর আরাধনার সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞান আর সঙ্গীতের চর্চাও করেছেন সেসব দেশে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর দাদু যুগলবন্দীতে কিছুক্ষণ বাগেশ্রী আর ইমন বাজালাম।
রাত শেষে আহির ভৈরব শুনে বিদায় নেবার আগে বললেন, জুঁই, গোলাপ আর হাসনুহানা ফুলদের গন্ধ ওঁর খুব প্রিয় ফুলগুলো আশেপাশে এখন না থাকলেও উনি ওদের কথা ভাবলেই অনেক দূর থেকেও এই গন্ধ চলে আসে ওঁর কাছে। দুটো চোখ হারালে যেমন অন্য অনুভূতি প্রবল হয়ে পুষিয়ে দেয়, সেইরকম শরীর হারিয়ে অশরীরী হবার কিছু সুবিধেও আছে। ওঁর ইচ্ছেশক্তি আর অনুভূতি এখন প্রচণ্ড শক্তিশালী।
এরপর যখনই গড়বাড়িতে এসেছি, ঠাকুরদা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে এসেছেন এই আলমারির ঘরে। আজ কী যে হল?
ঠাকুরদার অপেক্ষায় জেগে থাকবার জন্য বাজাবার চেষ্টা করছিলাম। এখানে এসে ওঁর সঙ্গে গল্পসল্প হবে না এটা তো এখন ভাবতেই পারি না তার ওপর আজ মনের যা অবস্থা ওঁর সঙ্গে একটু গানবাজনা আর গল্প খুব দরকার।
আরে, আরে! এটা তো মাথাতেই আসেনি! আমার ডুপ্লিকেট এই লোকটাকে নিয়ে আসল ব্যাপারটা কী সেটা সবচাইতে ভালো বলতে পারবেন ঠাকুরদা। এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সেই জুঁই, হাসনুহানা আর গোলাপ মেশানো গন্ধতে ঘর ভরে উঠল। বাঁচলাম যেন! দেরিতে হলেও এসেছেন ঠাকুরদা।
আমি অন্যবারের মতো সঙ্গে সঙ্গে কফি ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে ওঁর কাপ সোফাসেটের ডানকোণের ছোটো তেপায়া টেবিলের ওপর রেখে অপেক্ষা করছি কখন সেন্টার টেবিলে রাখা প্যাডের ওপর পেন্সিলটা কেঁপে উঠবে আর আমি ওটাকে একটু দাঁড় করিয়ে দেব। তারপরই ওটা আমার হাত থেকে বেরিয়ে ডট-ড্যাশে লিখবে, দাদুভাই ভালো তো? কফি দারুণ!
ঠাকুরদা কিন্তু সোফার কাছে এবার এলেন না মনে বলছে আছেন উনি সেই বড়ো খড়খড়ি দেওয়া জানালার কাছে। বুঝতে পারছি না উনি আজ দূরে দূরে কেন তবে কি উনিও অন্যদের মতো ওই ডুপ্লিকেট নিয়ে ভুল বুঝলেন? তা কী করে হয়? এটা তো ওঁর বোঝা উচিত ছিল। প্রচণ্ড অভিমান হল আমার সেটা চাপতে চাইলেও কিছুটা অভিমান গলার স্বরে চলেই এল। চাপা গলায় ডাকলাম, কী হল, দাদু? আজ কফি ভালো লাগেনি নাকি?
ফুলের গন্ধটা এল একেবারে আমার কাছে ঘাড়ে আর চুলে একটা হালকা হাওয়া বয়ে গেল। বুঝলাম, আমাকে আর কিছু বলতে হবে না কাল-পরশু দুদিন ধরে আমার ডুপ্লিকেটকে নিয়ে ব্যাপারটা ঠাকুরদা সব জানেন। আশ্বস্ত হলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে কেউ আর আমার কোনও ক্ষতি চাইলেও করতে পারবে না।
পেনসিলটা কেঁপে উঠতেই দেখি প্যাডটা ডিভানে ওখানে নিয়ে গিয়ে পেনসিলটা দাঁড় করাতেই শুরু হয়ে গেল প্যাডের সাদা কাগজে পেনসিলের ঘা দিয়ে ডট-ড্যাশ লেখা। কিন্তু এ কী! উনি লিখেছেন, দুঃখিত আমি আমার ভুলের জন্য সবকিছু হয়েছে। তবে আমার অবশ্য জানা ছিল না এরকম হতে পারে
ঠিক বুঝলাম না এর মধ্যে আপনি...
আমার বলা শেষ হবার আগেই পেনসিল উত্তর দেওয়া শুরু করে দিয়েছে দেখি, দু-তিন মাস তুই গড়বাড়িতে আসিসনি এমনিতেই ভাবছিলাম তোর কথা। ভাবনা আর ইচ্ছেশক্তি দুটো এক সঙ্গে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেখলাম তুই কোনও জুয়েলারের দোকানে বউমার জন্য একটা হিরের হার পছন্দ করেও কিনতে ইতস্তত করছিস। তা সেই দেখে আমি ঠিক করে ফেললাম বৌমাকে তো আমারও কিছু একটা দেওয়া উচিত। এই তোর কথা এত ভাবতে গিয়েই ব্যাপারটা ঘটে গেল জানলাম সেটা আমি অনেক পরে
পেনসিলটা এলিয়ে গেল বুঝলাম, উনি কফির ঘ্রাণ নিচ্ছেনচুপ থাকাই ভালো এখন।
পেনসিলটা সোজা হয়েছে দেখছি আমি পড়ে চললাম মর্স কোডে লেখা, বাগানে যেখানে আমার শরীরটাকে কবর দেওয়া হয়েছিল, দু-তিন থলি মোহর তার আশেপাশে আমি আগেই একটা বটগাছের তলায় পুঁতে রেখেছিলাম। সেখান থেকে এক-দুটো মোহর সঙ্গে নিয়ে সাহাদের বাড়িটা খুঁজছিলাম। কিন্তু এটা আমার খেয়ালে নেই, যে ভাবনা আর ইচ্ছেশক্তিকে বাড়িয়ে তোকে দেখে ফেলেছিলাম সেটা আর কমিয়ে আনিনি আমি গড়বাড়ির চৌহদ্দি পার হবার সঙ্গে সঙ্গে ওই দুটো মিলে হুবহু তোর মতো দেখতে একটা সচল প্রতিমা তৈরি হয়ে গেল। মানে তোরা সেই যে কোনও কোনও সিনেমা দেখিস হলে দেওয়া চশমা দিয়ে, সেইরকম।
তার মানে এই দাঁড়াল যে পরশু সন্ধেবেলায় আর কাল সকালে হুবহু আমার মতো দেখতে একটা ত্রিমাত্রিক কাল্পনিক ছবি ঘুরে বেড়িয়েছেসবাই এটাকেই আমি ভেবে ভুল করেছে ফারাক একটাই, এটা দেখতে কারও থ্রি-ডি সিনেমা দেখার মতো কোনও চশমা লাগেনি ঠাকুরদা আজ অবধি আমায় কোনও ভুল জিনিস বলেননিএখনকার বিজ্ঞানেও ওঁর প্রশংসনীয় দখলহতে পারে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আরেকটা খালি কাপ আমি রেডি রেখেই ছিলাম। পেনসিলটা এলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই আগের কাপটা সরিয়ে নিয়ে নতুন কাপে কফি ঢেলে তেপায়া টেবিলে রাখলাম। কফি ভালো লেগেছে ওঁর। প্রথমেই লিখলেন তাই, এবারের কফি খুব পিওর কোনও চিকোরি নেই। বেশ জোরদার গন্ধ। মুশকিল হচ্ছে, বেশিরভাগ লোকই আসল-নকল ধরবার চেষ্টাও করে না। সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়ঠিক যেমনটা কাল হয়েছিল
পরশু সন্ধেবেলায় বাজারে তোমার ডুপ্লিকেট থ্রি-ডাইমেনশনাল ছবি ঘুরে বেড়ালযারা সে সময় সেই ছবিকে তুমি ভেবে তোমাকে নমস্কার জানিয়েছে বা হাত মেলাতে গেছে তারা কেউ লক্ষও করেনি যে এই সচল ছবিটা প্রতি-নমস্কার করছে না বা এর সঙ্গে হাত মেলানো যাচ্ছে না তোমার চোখের দিকে একটু তাকালেই বুঝতে পারত যে এটা তুমি নও, তোমার একটা নিস্পলক প্রাণহীন প্রতিচ্ছবিঅথচ সবাই বলে দিলে তারা তোমাকে দেখেছে।
আমি বললাম, ঠাকুরদা, আপনাকে একটা আবদার করি। এই নেকলেস যেমনভাবে আমার আলমারিতে আপনি দিয়েছেন সেরকম করেই এটাকে বড়দার শোবার ঘরের আলমারিতে দিয়ে আসুন সঙ্গে কিছু মোহরও দেবেন। বড়দা খুশি তো হবেই, আমাকেও আর কোনও প্যাঁচে ফেলবে নাএখানে আসা-যাওয়া আর আপনার সঙ্গে বসে বাজনা বাজানো, এছাড়া আমার আর কিছুই চাই না
ডট-ড্যাশে ঠাকুরদা বললেন, ও লোভী মানুষ এসব হাতে পেয়ে যদি আরও পাওয়া যায় সেই লোভে পুরো গড়বাড়ি আর বাগান খুঁড়ে ফেলবে
আমি বললাম, তাতে ক্ষতি কী? গড়বাড়ির মেরামতি আর কলি ফেরানো তো হবে। আর বাগানটার ঝোপ-জঙ্গল সাফ হবে। আপনার সমাধির জায়গাটা বোঝা যাবে। তার চারপাশে আমি জুঁই, গোলাপ আর হাসনুহানা লাগিয়ে দেব
ঠাকুরদা নিশ্চয়ই খুব জোরে হাসতে চাইছিলেন কেননা, পেনসিলটা দুবার কাগজে ঘা মেরে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। পেনসিলটা তুলে আনতে আনতে বলাম, ঠাকুরদা, ইচ্ছেশক্তি আর ভাবনা এরকম বাড়িয়ে আপনার নিজের কোনও এরকম কাল্পনিক প্রতিবিম্ব অন্তত আমাকে দেখান। একটিবার সেরকম করুন আমার জন্য
ঠাকুরদা জবাব দিলেন প্যাডে, যে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে তার কাল্পনিক প্রতিবিম্ব করা আমার ইচ্ছেশক্তি আর ভাবনার ক্ষমতার বাইরেএই কারণেই কোনও অশরীরীর শরীর হয় না, হতে পারে না।
আমি তো আপনার বংশধর আমি কি কিছুটা আপনার মতো দেখতে?
তোমার মুখটা যদি আর একটু চৌকোমত হয়, আর তাতে ছাঁটা দাড়ি, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো চুল আর দুই কানে মুক্তোর কুণ্ডল থাকে তবে কিছুটা আমার মতো হতে পারে

পনেরদিন পরে গড়বাড়িতে ফিরে এসে দেখি বড়দার অংশের মহলে পুরো মেঝে আর কোথাও কোথাও দেওয়ালের মেরামতি চলছে। কবে নাকি স্যাকরা বিজয় সাহা চলে যাবার সময় দাদা-বউদি দু’জনেই মেঝে দেওয়ালের ফাঁকফোকরে বিছে আর সাপ দেখেছে। বিজয় সাহা এসেছিল মানে ঠাকুরদা আমার কথা রেখেছেন। আর এজন্যই আরও পাবার লোভে গড়বাড়ির চারদিকের জঙ্গল সাফদেওয়াল আর মেঝে খুঁড়ে ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরনো বাগান, ফোয়ারা আর এককোণে একটা সমাধি এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
ঠাকুরদা আর আসেন না আলমারির ঘরে সেখানে শ্বেতার আঁকা ঠাকুরদার পেল্লাই অয়েল পেন্টিং লাগিয়েছি। পুরো সমাধি ঘিরে কলকাতার সেরা নার্সারি থেকে জুঁই, গোলাপ আর হাসনুহানা লাগিয়ে দিয়েছি। ফুলের গন্ধ নিয়ে ঠাকুরদা ওখানেই বেশ জমিয়ে আছেন। আমারও সুবিধে, গড়বাড়িতে গিয়ে ওঁর আসার জন্যে আর অপেক্ষা করতে হয় না। কফির ফ্লাস্ক, দুটো কফি মগ, বেহালা আর বাঁশি নিয়ে আমি ওখানে বসলেই আমাদের আলাপ জমে ওঠে।
_____
অলঙ্করণঃ অরিজিৎ ঘোষ

4 comments:

  1. বহুদিন পর এতো সুন্দর একটা ভুতের গপ্প পড়লাম। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ । এটি বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া একটি পারিবারিক কাহিনীর অংশ বিশেষের ভিত্তিতে লেখা। তবে এটা সত্যি, ঠাকুরদা, গান শোনা আর কফির গন্ধের টানে, আজও আসেন । অশরীরীরি দের নিয়ে শুধু মিথ্যে ভয়ের গল্প লোকপ্রিয় । কিন্তু সত্যিটা হল ওনারা গল্প করতে আর গন্ধ শুনতে ভালবাসেন ভয় পাওয়াতে নয় ।

      Delete
  2. বাহ! দারুণ লাগল! শিহরিত হলাম।

    ReplyDelete
  3. চমৎকার পাঠ

    ReplyDelete