ছোটোবেলার
পুজো
চন্দ্রনাথ
চট্টোপাধ্যায়
আমার ছোটোবেলা থেকে প্রৌঢ়বেলা যে বাড়িতে বা যে অঞ্চলে
কেটেছে সেখানে কাছাকাছির ভেতর দুর্গাপুজো বলতে কিছু ছিল না। যদিও খাস মধ্য-কলকাতার সি আই টি রোড অঞ্চল। আমাদের
বাড়ির পাশের গলি দিয়ে বেশ কিছুটা গেলে সেটা একটা টিমটিমে পুজো। প্রায় বাড়ির পুজোর
মতোই, নামে সর্বজনীন। বড়ো পুজো হলে যেতে হত আনন্দপালিত অঞ্চলে, একটা বাস-স্টপ পরে। কিন্তু পুজোর আনন্দটা ছিল ভরপুর। শরতের ছেঁড়া মেঘের সারি, শিউলির
প্রথম ফোটা গন্ধ। এগুলো মনের ভেতর পুজোর অনুরণন তৈরি করে দিত। তখন একটা পুজো গেলে গুনতে বসতাম
পরের পুজো কবে আসবে। কতদিন দেরি! ওরে বাবা! আর এখন মনে হয়, এই তো সবে পুজো গেল, এর
ভেতরেই একবছর পার! আসলে সময় তো বয়সের প্রলেপ পরিয়ে
দেয় মনের ওপর।
আমাদের পুজোর আনন্দটার
পারদ চড়ত ঠিক মহালয়ার দিন ভোর থেকে। ওইদিন থেকেই মন বাঁধনছাড়া। তখন খুব ছোটো। মানে
একলা বার হবার অধিকার নেই বাড়ি থেকে। তাই বসে বসে নতুন
জামাগুলো গুনতাম। পুজোর স্টাইল বলে কিছু ছিল না আমাদের। মনে আছে, বাবা নিয়ে বার হতেন একদিন আমায়। বিনি কোম্পানির কাপড় কেনা হত জামার জন্য।
আর রেডিমেড হাফপ্যান্ট। তারপর সোজা বাবার হাত ধরে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে চিনেদের
দোকান থেকে জুতো। তবে দিদির সঙ্গে বার হলে নিউ মার্কেটটা একবার ঘুরতে যাওয়া হত। তখন আমাদের ছোটোবেলায় একটা মজার পোশাক পাওয়া যেত। এখনও পাওয়া যায় বোধহয়। বেশ উর্দিধারী
সিপাহীদের পোশাক। মাথায় অলিভ কালারের টুপি। ফুল-প্যান্ট,
জামা, আবার
কোমরে গোঁজা পিস্তল। নিউ মার্কেটে ঢোকার পরেই ডানদিকে মনে আছে জামাকাপড়ের দোকানে
ওই পোশাকটা সাজানো থাকত। কী অসম্ভব
প্রিয় ছিল আমার এই পোশাকটা বলতে পারব না! কিন্তু মুখ ফুটে বাবাকে কোনওদিন কিনে দিতে বলতে পারিনি। যেমন কোনওদিন বলতে পারিনি বাবাকে যে বাটার দোকান থেকে জুতো কিনে দাও, নয়তো পরব না। এগুলো বলার ক্ষমতাই ছিল না। এটা নয় যে বাবা প্রচণ্ড রাশভারি
মানুষ। আসলে বাবা-মা হাতে করে যেটা দিতেন সেটাই
আমার কাছে বড়ো পাওনা ছিল তখন। চাহিদা ব্যাপারটা
আসেইনি।
তবে একবার বাবার কাছে
আবদার করেছিলাম একটা জুতোর। বাটা কোম্পানি সদ্য তখন সেটা বার করেছে। স্কুলে আমার
এত বন্ধুর পায়ে দেখে খুব মনে ধরেছিল। কিছুই না, জুতোর ভেতরের খোলটা তুললে একটা ছোট্ট কম্পাস বসানো ছিল। সেই প্রথম বাবার
হাত ধরে ফুটনানি ম্যানসনে,
ধর্মতলায় বাটার দোকানে ঢোকা। জুতো কিনলে যে সুন্দর হলুদ রঙের মুখোশ ফ্রি পাওয়া যায়
আর সঙ্গে দুটো বেলুন, এ তথ্য জানলাম তখনই আর সেটা
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের থেকে কিছু কম আনন্দের ছিল না।
পুজোর মজা ছিল বাবার সঙ্গে
বার হলে ওই একটা দিন পুডিং খাওয়া। বাবা নিয়ে যেতেন কলকাতা কর্পোরেশনের পেছনে
রিজেন্ট হোটেলে। সেখানকার পুডিংয়ের স্বাদ
এখনও মুখে লেগে আছে। আরেকটা জিনিস সে সময় বাবা
আনতেন আমার জন্য। একটা বড়ো পিচবোর্ডের বাক্সে একটা
করে খেলনা। দুটোর কথা এখনও মনে আছে। একবার
পেয়েছিলাম মেকানো, আরেকবার ট্রেনের রেলগাড়ি; দম দিলে টিনের পাতা গোল ট্রাকের ওপর দৌড়বে। পিচবোর্ডের বাক্সের গায়ে নীল
রঙের একটা চাঁদমালার ছবি দেওয়া। অন্যদিকে বড়ো করে
লেখা থাকত ‘কমলালয় স্টোর্স’। বাঙালি জাতির বাবুয়ানার নিজস্ব ট্রেড মার্ক। আজ বুঝি সে খেলনার মাহাত্ম্য কতটা।
আর আসত পুজো উপলক্ষে
প্রকাশিত শারদসম্ভার। মায়ের জন্য আসত বসুমতী, ঘরোয়া, উল্টোরথ। আর আমাদের জন্য দেব সাহিত্য কুটিরের আনন্দ, নীহারিকা, তপোবন। এই
সংকলনগুলো ছিল
আমাদের পুজোর স্পেশাল গিফট। সঙ্গে অবশ্যই মৌচাক আর শারদীয়া শিশুসাথী।
আমাদের বাড়ির পুরাতন কাজের
মানুষটি ছিলেন সৌরীদা। সৌরীদার কাজ ছিল পুজোর সময় আমার ও আমার দু-তিন বন্ধুকে বগলদাবা করে ওই আনন্দপালিত অবধি নিয়ে যাওয়া। প্যান্ডেলের বাঁশ পড়া থেকে শুরু হত তাঁর এই নিত্য
যন্ত্রণা। আমরা বাঁশ গুনতাম। বাঁশ লাগানো হলে সেটা ধরে ঝুলে ঝুলে দোল খেতাম। তখন
কোনওমতে একটা বাঁশের স্ট্রাকচার খাড়া
করে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে সামনে কাপড়ের কুঁচি দিয়ে প্যান্ডেল সাজানো হত। আর পাড়া সাজানো হত ষাট অথবা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বের ঝালর
করে। পরে অবশ্য টিউবলাইটের বাহার এল। কিন্তু দেখার মতো জিনিস ছিল
শুধু পুজোটা। সাবেক মূর্তি অথবা আলাদা আলাদা মূর্তি। কিন্তু পুজোটা করা হত অন্তর
থেকে। তখনও মা দুর্গা র্যাম্পে দাঁড়ানো সুন্দরীর মতো
প্রতিযোগিতায় নাম লেখাননি। থিমের পুজো কোনও ধারণাতেই ছিল না। ছিল শুধু আন্তরিকতার
প্রয়াস।
পরে
যখন একটু বড়ো হলাম মানে, ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি, তখন
প্রথম ফুলপ্যান্ট উপহার পেলাম মামার বাড়ি থেকে। আর পেলাম একটা ববি প্রিন্টের শার্ট।
তখন বছর দুই-তিন হল ববি সিনেমা দেখানো হয়ে গেছে। অমিতাভ বচ্চনের জমানা এসে
গেছে। বেলবটস কাটিং প্যান্ট তখন নতুন ট্রেন্ড। নতুন ফুলপ্যান্ট আর ববি কাটিং শার্ট
তখন আমাদের কিশোর মনের নতুন রোমাঞ্চ। বাড়ি থেকে ছাড় পাওয়া গেল দু’ঘণ্টা
ঘুরে আসতে পারি বন্ধুদের সঙ্গে, একা ফিলিপসের মোড় থেকে মাত্র দুটো স্টপ তালতলা অবধি। তাই তখন
আমাদের হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। পকেট খরচ পেলাম পাঁচ টাকা। ওই সময় পাঁচ টাকা এখন
প্রায় পাঁচশ টাকার সমান।
কিছুটা
স্বাধীনতা পেলেই সেটাকে আরও একটু বেশি করে অধিকারে আনা ওই বয়সের ধর্ম। চারবন্ধু
চলে গেলাম নিউ মার্কেট। ওই অবধি চিনি। তারপর নিজামে ঢুকে রোল খেলাম। সেই জীবনে
প্রথম রোল খাওয়া। পুজোয় বার হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিজামে রোল খেয়েছি, নিজেকে
বেশ লায়েক লায়েক মনে হচ্ছিল। তখনও আমাদের মধ্যে একটা খেলার চল ছিল। স্কুল খুললে
বন্ধুদের কাছে জানানো কে ক’টা ঠাকুর দেখেছে। কারোরই একশোর কম হত না। আসলে একই
ঠাকুর, যাতায়াতের পথে তিনবার দেখলাম ওটা, মানে
তিনটে ঠাকুর দেখা হয়ে গেল। আসলে আমাদের ওই কৈশোরে আনন্দ ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত।
বৈভবের এত প্রাচুর্য ছিল না এখনকার মতো। ছিল মারফি রেডিও,
বীরেন ভদ্রের গলায় মহালয়া, স্বচ্ছ আকাশ। সপ্তমী আর নবমীতে মায়ের
হাতের পাঁঠার ঝোল। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আলুকাবলি। পুজোর মেলায় বেলুন ফাটানো। কাঠের নাগরদোলায় ঘুর-ঘুর-ঘুর। আর
যে কোনও পুজো প্যান্ডেলে বসে জোরকদমে আড্ডা।
আমার পৈতৃক বাড়ি ভবানীপুর হরিশ মুখার্জি রোডের ওপর। সেইখানে
ভবানীপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব আজ প্রায় সাতাশি বছরের। আমাদের জ্যাঠা, বাবার
হাতে তৈরি পুজো। উলটোদিকেই সেকালের বিখ্যাত ব্যারিস্টার বি সি ঘোষের বাড়ি। আর পাশেই কুণ্ডুদের বাড়ি। তাঁরাও ছিলেন এই
পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা। সেই পুজোতেই ছিল আমার নাড়ির টান
বাঁধা। ষষ্ঠীর দিন আমাদের এন্টালির বাড়ি থেকে আমার জ্যাঠতুতো ন’দাদার
সঙ্গে গাড়ি করে চলে যেতাম ভবানীপুর।
যেহেতু
ভাইবোনেদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোটো, মানে আমি নিজের দিদির ও দাদার থেকে যথাক্রমে কুড়ি
ও আঠারো বছরের ছোটো, আমার সমস্ত ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে ছিল প্রায় আমার সমবয়সী, এমনকি
বয়সেও অনেকে বড়ো ছিল। তাই আড্ডা জমত নিচের ঘরে। এই ঘরটা পুজোর ক’দিন
আমাদের দখলে। কখন খাচ্ছি, কখন ঘুমোচ্ছি কোনও কিছুরই ঠিক নেই। আমার প্রিয় ভাগ্নে
ভাস্কর আমার থেকে ঠিক ছ’মাসের বড়ো। আর প্রিয়
ভাইঝি সুকন্যা আমার থেকে এক বছরের
ছোটো। এদের সঙ্গে
ঝগড়া, মারামারি হবেই। আবার
মিটে যেত ঠিক সন্ধ্যারতির সময়। ভাস্করের হাতের ঢাক বাজানো পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে শুনত। পরবর্তী
সময়ে ভাস্কর গান শেখে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। অসাধারণ বহুমুখী গুণের আধার ছিল। আর সুকন্যার সঙ্গেই
আমার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কিঞ্জল পত্রিকা। আজ আমার এই খুব প্রিয় দুই
মানুষের দুইজনেই নেই। শুধু তাদের স্মৃতিটুকু ঘুরে বেড়ায় এখনও,
ভবানীপুরের বাড়ির চাতালে দাঁড়ালে। মাঝরাতে বসে ভাস্কর ঢোল নিয়ে বসে গান ধরত, কাঠের
চৌকির ওপর। অক্লান্তভাবে গেয়ে চলত একের পর এক গান। প্রসঙ্গত আমার বিয়ের বাসরেও
ভাস্কর সারারাত গান গেয়ে আর লোক হাসিয়ে সবাইকে জাগিয়ে রেখেছিল। এ ধরনের ছেলেদের
আমাদের সময়ে বলা হত বাসর জাগানিয়া। এখন তো আর বিয়ের বাসর সেভাবে হয় না।
ফিরে
আসি পুজোর কথায়। তখন ভবানীপুরের পুজো মানেই লোকের ঢল। সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্রা,
মুক্তদল, বকুলবাগান। এরই মধ্যে প্রথম সঙ্ঘশ্রী। সাতের দশকের শেষে প্রথম থিমের
ঠাকুর তৈরি করল শোলা দিয়ে। ব্যস, ভবানীপুরের সব প্যান্ডেলে উপচে পড়া ভিড়। অষ্টমীর অঞ্জলির সময়টা আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যেত।
মানে আমরা ওই যাদের না হলে পুজো হয় না, তাদের দলে। একটু দুষ্টুমিও থাকত। সদ্য শাড়ি
পরে আসা ষোড়শীটির হাতে অঞ্জলির ফুল তুলে
দেওয়া। বা তারই পাশে অথবা পেছনে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেওয়া। শ্যাম্পু করা চুল উড়ে এসে
লাগছে নাকে। মনের মধ্যে হাজারো কাঠির ঝনৎকার। হয়তো আবার দেখা হবে পরের বছর
অষ্টমীতে। কতক চোখ খুঁজবে তাকে প্যান্ডেলের আঙিনায়। এসবই
তো তখন আমাদের বিনোদন।
আর ছিল অবশ্যই দুপুরবেলা
গান শোনা রেকর্ডে। আমার জ্যাঠতুতো বউদি বন্দনা সিংহ, তাছাড়া আমার জ্যাঠতুতো দুই দিদিও অসাধারণ
গান গাইত। ওদের বসত গানের আসর সন্ধ্যায়। আমরা দুপুরে রেকর্ডে গান শুনতাম। পুজোয় বার হওয়া নতুন রেকর্ডের গান। একটা হিজ মাস্টার’স ভয়েস বা এইচ এম ভি’র শারদ-অর্ঘ্য বই আসত বাড়িতে। সেই বই থেকে দেখে নতুন রেকর্ড কেনা হত। ই পি অথবা লং প্লেয়িং।
সুরের মায়াজালে ভাসতাম আমরা। মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে থেকে শুরু করে সতীনাথ-উৎপলা
পর্যন্ত গানের সবার নতুন রেকর্ড বার হত। আর বার হত ভানু বন্দোপাধ্যায়ের কমিক রেকর্ড।
দশমীর দিন সকাল থেকে মন-বিষাদের পালা। তবে নিয়ম ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ভাসানে যেতে হবে। আগেকার দিনে বাবারা নাকি কাঁধে করে নিয়ে
যেতেন প্রতিমা। এখন আর কাঁধে নয়, লরিতে
যাওয়া হয়। দশমীর দিন সিঁদুর খেলার পর আমাদের চাটুজ্যে বাড়ি থেকে মেজজেঠিমা সবাইকে
খাওয়াতেন ঘুগনি। আর কুণ্ডুবাড়ি থেকে আসত বোঁদে। সিদ্ধি খাওয়ারও প্রথা ছিল। এরপর পাড়ায়
একচক্কর দিয়ে ভবানীপুরের আদি গঙ্গায়
মায়ের বিসর্জন হত। ফিরে এলে ঘটে গঙ্গার জল নিয়ে, তারপর বড়োদের প্রণাম আর বিজয়ার কোলাকুলি। শূন্য প্যান্ডেলের মধ্যে জ্বলত একটা মাটির
প্রদীপ। বিষণ্ণতার ভেতরেও এই যে প্রাণের কোলাকুলি, বুকের ভেতর উষ্ণভাবে জড়িয়ে ধরা, এটাই
ছিল পরম প্রাপ্তি।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল এবং লেখক
asadharon laglo....
ReplyDeletedarun
ReplyDelete