নবাবখানায় নবাবি
প্রদীপ্ত ভক্ত
মাথার পোকাটা ফের নড়ে উঠল। ট্রেক করে এসেছি মাস দুই
তো হল। আবার
কোথাও পালাতে হবে। বেশি প্ল্যান-ট্যান করে যাওয়া না, হুড়ুম-দুড়ুম করে। দুই বন্ধুর কাছে
প্রস্তাব রাখলাম, লখনৌ যাবি? শুক্রবার
অফিস করে যাব, সোমবার ফিরে এসে অফিস। ব্যস, এক সপ্তাহ আগে কথা পাড়া হল, সেদিনই ফাইনাল, টিকিট কাটা শেষ। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি
বেরোতে হবে, তাই আগের রাতে মাঝরাত অবধি অফিস করে পরের দিন ভোরে ফের অফিস পৌঁছেছি। ব্যাগ নিয়েই সারাদিন ঘোরাঘুরি হবে। হোটেলে শুধু রাতটুকু কাটাব, তাই
লাগেজ খুব কিছু নেওয়ার নেই। তাও বৃষ্টির জন্য এক সেট
জামাপ্যান্ট বেশি নিতেই হয়,
ক্যামেরা, চার্জার, ব্রাশ - এই তো। খাওয়া কোথায় হবে জানি, থাকা কোথায় জানি
না। আমার অফিস হল গিয়ে তেপান্তরে, ট্রেন হল গিয়ে ভুশুণ্ডির
মাঠে। এবার দুটোকে মেলাতে গেলে কোন পথটা সোজা হয় ভাবছিলাম। সেদিনই আবার দেখি একগাদা
কাজ এসে হাজির। তেপান্তর থেকে ভুশুন্ডি যাব, তাই সময় নিয়ে বেরোতে হবে -
মহাযন্তন্না। সে যা হোক, সব সামলে, সৌগতদার থেকে খানতিনেক বই নিয়ে (অফিসেই দিয়ে
গেল। বন্ধুভাগ্য
আমার বরাবরই ভালো আর কী।) একটা খালি বাসে ওঠা গেল। আহিরিটোলা থেকে লঞ্চ ধরব।
দুপুরের লঞ্চে ভিড় নেই তেমন। বর্ষায় জল বেড়েছে গঙ্গায়। এক
জায়গায় দেখি নদীর জল বেড়ে পাড়ের গাছপালাকে হুটোপাটি খাওয়াচ্ছে। বুড়ো অশ্বত্থের বাঁধানো বেদীতে
একজন বসে বসে ভাঙা গাছপালা, গ্রাস করা বাড়িগুলোকে কী পাহারা দিচ্ছে কে জানে! একজন
টকঝাল লজেন্স বিক্রি করছে লঞ্চে, আর আকাশে ঝকঝকে রোদ বেড়াতে যাবার মনের সাথে সঙ্গত
দিচ্ছে।
হাওড়ায় পৌঁছে এক কাপ চা-বিস্কুট খেয়ে নয় নম্বর
প্ল্যাটফর্মের কাছে পৌঁছে সৌরভকে ফোন করা গেল। আমরা কানপুর পৌঁছাব কাল ভোরে। ওখান থেকে সমুকে নিয়ে লখনৌয়ের বাস।
উচ্চশ্রেণীর প্রতীক্ষালয়, তাই উচ্চ সোপান বেয়ে উঠতে
হয়। আমরা
সেই উচ্চ মার্গে ঢুঁ মেরে,
একটু কুলফি খেয়ে তারপর ট্রেনে ওঠার দম নিলাম। আসলে প্রভুজীর জমানা, কখন
বেলাইন হয় কে জানে। মরতে হলে শখ-সাধ মিটিয়ে মরাই ভালো
কিনা।
কানপুরে আধঘন্টা লেটে নামলাম যখন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
আমরা এখান থেকে ট্রেনেও যেতে পারতাম। কিন্তু ট্রেন নাকি যখন তখন মাঝরাস্তায়
থেমে যায় ঘন্টাখানেকের জন্য। এখানে বাসস্ট্যান্ডের নামটা ভারি অদ্ভুত, ঝগরগটি। ঝগড়া করে
গটগট করে হেঁটে চলে যায় হয়তো সবাই এখান থেকে। সমু এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তিন বাদশা লখনৌয়ের
সরকারি বাসে চড়ে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর দেখি মাথায় এক ফোঁটা জল পড়ল! মনের ভুল নিশ্চয়ই। আবার এক ফোঁটা। সে কী! আমরা কি মুক্তো আর বাসের ছাতটা
কি স্বাতী নক্ষত্র নাকি?
ভালো করে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মেলে দেখি, বাসটা সম্ভবত নবাবি আমলের,
তাই ছাদ-টাদ কিঞ্চিৎ প্রাচীন হয়ে ফুটো হয়ে গেছে আর কী। চারপাশে সব সিটই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
এর মধ্যে জানালা-টানালা বন্ধ করে হালকা একটা ঘুম লাগাতে গেলাম। হঠাৎ দেখি, ফুরফুরে ভেজা হাওয়া
আর বৃষ্টির ছাঁট। এবার
কি তবে জানালার কাঁচটাও...?
তাকিয়ে দেখি সামনের সিটে এক বাচ্চা নিয়ে বসে থাকা স্থানীয় মহিলার কীর্তি। তিনিই জানালা উন্মুক্ত করেছেন। ব্যাপার
কী? এরকমভাবে
বৃষ্টি-বাতাস খাওয়ার সাধ হল কেন এই সাতসক্কালবেলা? জিজ্ঞেস করলাম,
কী একটা বলল যেন বাচ্চাটাকে দেখিয়ে, উল্টি না কী, ঘুমের চোখে ভালো শুনতে
পাইনি।
“হ্যাঁ রে, সৌরভ, কী বলল রে? বমি করবে?”
সৌরভ নির্বিকার মুখে বলল, “হ্যাঁ।”
আমি তড়াক করে সোজা হয়ে বসেছি। হ্যাঁ মানে কী, ও বমি করা মানে সে
বমি ব্যাক ফায়ার করে আমার মুখেই তো আসবে, অ্যাঁ! নবাবি স্মৃতি দেখতে হাল আমলের টাটকা
ইয়ে স্মৃতি আমি নিয়ে যেতে চাই না কখনওই। তৎক্ষণাৎ উঠে অন্য সিটে।
কিন্তু সেগুলোর ছাদ প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ বাসে রেনকোট পরেই বসে। আমরা
কেউ ছাতা মাথায় ঘুমাতে পারি না বলে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে উঠে দেখলাম, সমু জামা খুলে নিংড়াচ্ছে!
শেষটুকু ছাতা মাথায় বসেই যাওয়া গেল।
লখনৌ শহরে যেখানেই যাও ভাড়া পার সওয়ারি দশ। কিন্তু সেদিন সকালে চারবাগে নেমে আমাদের
অত জানার কথা না, তায় বৃষ্টি। সুতরাং, আমরা একটা বেশি ভাড়ার অটোতেই
চললাম। লখনৌ শহরে দ্রষ্টব্য যা কিছু সব বেশ কাছাকাছি রেডিয়াসে। আর আমাদের যেহেতু উইক-এন্ড ট্রিপ,
তাই আগে থেকেই ঠিক করা যে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে খেয়ে একেবারে হোটেলে ফিরব। তাই হোটেল ঠিক করার ব্যাপার নেই।
বড়া ইমামবাড়ায় পৌঁছলাম যখন, তখনও বৃষ্টি পড়ছে। তবে সমুদ্রে
পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়? আমরা অলরেডি নবাবি আমলের বাসের কল্যাণে চান করেই আছি।
বড়া ইমামবাড়া বানান নবাব আসাফউদদৌল্লা, সতেরশো চুরাশি খ্রিস্টাব্দে। নবাবি ব্যাপার, খালি মহরমের জমায়েত
হবে? দূর, চল একটু লুকোচুরি খেলার ব্যবস্থাও হোক। অর্থাৎ, ভুলভুলাইয়া।
বড়া ইমামবাড়ার উপরের অংশই সেই বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া।
ভুলভুলাইয়া মানেই ফেলুদা, ভুলভুলাইয়া মানেই রহস্য, সেই গোরা সৈন্য যে বিকেলে ঢোকে আর পরেরদিন যার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এখানে ঢোকার
সময়েই গাইড আমাদের বলে দিল, গাইড ছাড়া ঘুরলে আমরা কত বোকামো করব। এক একটা দরজার এক
একটা ইটের ইতিহাস গাইডের কাছে আছে যা আমরা কোথা পাব আর। আমরা আগে থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম,
ভুলভুলাইয়া আমরা একাই ঘুরব। ফেলুদার মতো আমরাও পারব ভুলভুলাইয়ার গোলোকধাঁধা থেকে বেরোতে।
গাইডকে কাটিয়ে উপরে উঠলাম। মানে বড়া ইমামবাড়ার ভিতরে আছে নবাবের সমাধি, তার উপরে চারধার রেলিং ঘেরা ফাঁকা
সেই জায়গাটা যেখানে একদিক থেকে দেশলাই কাঠি জ্বালালে অন্যদিক থেকে শোনা যায়। আর তাকে
ঘিরেই আছে সে বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া। একটা সিঁড়ি আছে নিচ থেকে সোজা উঠে যাচ্ছে। মাঝে ভুলভুলাইয়াতে ঢুকে পড়, ওই সিঁড়িই সোজা ছাতেও
যায়। এবার ভুলভুলাইয়ার টার্গেট হল নিচের এই বারান্দায় পৌঁছতে হবে আর তারপর ফের ভুলভুলাইয়া
হয়ে ছাদে।
যেখানে ভুলভুলাইয়ার এন্ট্রান্স, বলা যায় সেখানে ছাদ
থেকে রুমি দরোয়াজাসহ গোটা চত্বর বেশ চমৎকার দেখা যায়। তারপর আমরা ভুলভুলাইয়ার
সুড়ঙ্গে হারিয়ে গেলাম।
আহা, হারিয়ে ফিরেছি আবার। গোরা সৈনিকের মতো মরে ভূত হলে তো এ
লেখা আপনার কানে ফিসফিস করে বইত, নাকি? হারিয়ে গেলাম মানে, কয়েক ধাপ নেমে আগ্রা অব্দি যাওয়ার টানেল বন্ধ দেখে
উপরে উঠে এ গলি ও গলি ঘুরে দেখি, বাইরের বারান্দার দিকে চলে এসেছি। প্রতি দেওয়ালে,
ছাদে, লক্ষ-কোটি নাম লেখা, প্রতিটা মানুষ
তাদের নিজেদের নাম অমর রাখতে মরিয়া, তা সে যেভাবেই হোক। আর আমাদের দেশে ইতিহাস এত
বেশি বলেই বোধহয় তাকে আর আলাদা করে কেউ গুরুত্ব দেয় না। রাজারাজড়াদের ইতিহাসের সাথে
এভাবেই হয়তো সাধারণ মানুষের ইতিহাস ঢুকে পড়ে। কোনও এক আগামীর পুরাতত্ত্ববিদ খুঁজে দেখে
জানবে, কোনও মাহমুদ
কোনও ফতিমাকে ভালোবেসেছিল। হয়তো ভালোবাসার চিহ্নটাই সে সময় বদলে
যাবে কিংবা, কিংবা প্রেম শব্দটাই বাড়তি হয়ে যাবে। কে জানে!
আবার কেঁচে গন্ডুষ করে ঢুকলাম ভিতরে।
আবার পাক খাচ্ছি এ গলি সে গলি। এখনও খুঁজে পাইনি সেই রেলিং
ঘেরা বারান্দা, দেশলাই কাঠি ধরানোর শব্দ কেমন দৌড়ে যায় দেখা হয়নি এখনও। হঠাৎ সেই গাইডের সাথে দেখা। দুলে দুলে
ব্যঙ্গ করে বলে, “কেয়া জনাব, বহুত সমজদার বনলিয়া না? আফসোস হোতা হ্যায়, পাতা হ্যায়?
আপলোগ ইতনা দূর সে আকে কুছ নহি দেখ পায়েঙ্গে।”
আমাদের মধ্যে সমুই মোটামুটি এ ট্যুরের গাইড। আগে বার দুই আসার কল্যাণে ওই জবাব
দিল আমাদের হয়ে, “আপ ফিকর মত কিজিয়ে।”
মানে লেগেছে আমাদের সবারই খুব। ইয়ার্কি হচ্ছে, তিনটে
দামাল ছেলে একটা তিনশো বছরের পুরনো ধাঁধার উত্তর জানবে না? ফের নতুন উদ্যমে শুরু
করলাম। সিঁড়ির ধাপে চটা উঠে গেছে, জল পড়ছে ইটের কোণ বেয়ে,
কোনও গলিতে চামসা গন্ধ মানেই এখানে যাতায়াত কম, মানেই এটা ভুল রাস্তা।
একটা গলি দিয়ে নামতেই দেখি বারান্দা না, একটা খোলা ফোকর। ঠিক নিচেই নবাবের সমাধি। গোরা
সৈনিকটা নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে এরকমই কোনও ফোকরের কাছে এসে পড়ে গেছিল। ভুল করে কানাগলি ঘুরে, তিনশো বছরের প্রাচীন
ইট, অন্ধকারকে হাসি তামাশায় উড়িয়ে দিয়ে আমরা পৌঁছলাম সেইখানে
অবশেষে।
যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে তিন নবাব ঝুল বারান্দায় ঘুরে আওয়াজের
কেরামতি শুনে বেরিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি খুঁজতে লাগলাম। মানে ভুলভুলাইয়ার ভিতর দিয়ে ছাদে
উঠব, এমনি
সিঁড়ি তো আছেই। আবার ভুল করা, আবার পাক খাওয়া। এটাই বুঝতে পারি না যে ভুল রাস্তাটাই
কেন চোখের সামনে ধরা পড়ে? ঠিক রাস্তাটা কিন্তু পাশেই। তবুও ভুলটাতেই ঢুকে হোঁচট খাওয়া বারংবার।
অবশেষে হিসেব কষে ছাদে। বৃষ্টির মধ্যেও আমরা ছাড়া কতকগুলো
ট্যুরিস্ট আছে অবশ্য। আমরা প্রকৃতির সবকিছুই মনোহর দৃষ্টিতে দেখি, ছাদ থেকে বৃষ্টিভেজা লখনৌ শহর,
ইমামবাড়ার গেট, ক্লক টাওয়ার হয়ে মানবী সবই।
দেখা-টেখা শেষ করে এবার নামার পালা। নামব মানে ভুলভুলাইয়ার
ভিতর দিয়েই। আবারও পথ ভুল। এবারে আবার সোজা সেই ফিসফিস বারান্দায়।
আরে, মহাযন্তন্না! যখন যেটা চাইব তার বিপরীতটাই পাওয়া ভুলভুলাইয়ার ধর্ম বুঝি? বেশ, তাই সই। এবারে আবার একটা কানাগলিতে ঢুকলাম যার মধ্যে কিছুই দেখা যায় না!
একেবারে সরু একফালি সুড়ঙ্গ দিয়ে এক এক করে পার হয়ে হুট করে একটা উঁচু সিঁড়ি,
আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলাম। ব্যাটা নবাবরা নিশ্চয়ই সেইসব বেগমদের
নিয়ে এখানে আসত যাদের পছন্দ হচ্ছে না। তারপর অন্ধকারে এক ধাক্কা মেরে দিত। ওহ্, বলাই হয়নি, এখানে কাপলরা ঢুকতে
গেলে কিন্তু গাইড মাস্ট। অর্থাৎ, এখনকার বাদশা-বেগমদের সে সুবিধে আর নেই।
নিচে নেমে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। বর্ষায় জায়গাটা পিচ্ছিল
না খুব একটা। কারণ, পাথরের মেঝে, কিন্তু কার্পেট পাতা আছে একটা। সেটা আবার জলে ভিজে শ্যাওলাদের
ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। জুতোজোড়া নিয়ে শাহি বাউলি দেখতে চললাম। এ জায়গাটার আর্কিটেকচার দেখার
মতো, মশাই। মানে
পুরো ইমামবাড়াটাই বলছি,
ভুলভুলাইয়া সমেত। এই ধরা যাক, শাহি বাউলি। গেট দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ উঠে সিঁড়ি
ফের নেমে গেছে। বিল্ডিংটার কিছু তল আছে মাটির লেভেলের নিচে, উপরে কিছু।
এবার ওই সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সেই জল যার মধ্যে পড়বে সিঁড়ির
কাছে দাঁড়ানো লোকের ছায়া। ফলে উল্টোদিকে অন্ধকারে থাকা লোকে এই ছায়া দেখে তির চালাতে
পারবে। যদিও লাভ কিছুই হয়নি সেটা আমরা জানি। মারের সাবধান কি আর দুর্গে হয়? এখানে
আমাদের এক গাইড জুটল। ত্রিশ টাকা মাত্র, ত্রিশ টাকা মাত্র বলে এমন হাঁকডাক করল, আমরা
আর ফেরাতে পারলাম না। যদিও আমাদের পার্মানেন্ট গাইডের এতে আপত্তি ছিল। তা গাইডসাহেব ভারি আয়েসি। নিজে আর সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন
না। আমাদের
আঙুল দিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন, “উধর যাইয়ে, জনাব। দাঁয়ে সে যাইয়ে, বাঁয়ে ঘুমিয়ে,
থোড়া নিচে দেখিয়ে” – এইসব করে।
বাউলি থেকে বেরিয়ে আমাদের খিদেয় অস্থির অবস্থা। সৌরভের
ব্যাগে গুপ্তধন ছিল। এক
প্যাকেট বিস্কুট। তা দিয়ে প্রাণরক্ষা করে শুনি টাঙ্গাওলারা খুব চেঁচাচ্ছে, ছোটা ইমামবাড়া যাবেন
চলুন, পঁচাস পঁচাস। কিন্তু ছোটা ইমামবাড়া খুবই কাছে, আমরা হেঁটেই যাব জানি।
তাই তাদের কাটিয়ে এগিয়েছি একটু, দেখি এক টাঙ্গাওলা বলে, আসুন আসুন, দশ টাকা তিন আদমিকে লিয়ে। বলে কী রে! তিনজনের দশ টাকা? আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি
করে টপ করে উঠে পড়লাম। কিছু পরে দেখি তার ঘোড়াও হেসে উঠেছে। সেই দেখে বিব্রত টাঙ্গাওলা বলল, “আপলোগ উতর যাইয়ে,
জনাব। হম
নহি যায়েঙ্গে।”
ক্লক টাওয়ার রাস্তা থেকেই দেখা যায়।
পাশেই একটা নোংরা, জল কম অথচ গ্যালারি করে সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর।
এর আশেপাশেই কোথাও পিকচার গ্যালারি আছে। পিছনের সরকারি অফিসের মতন ওই বাড়িটাই নাকি?
কাছে গিয়ে দেখি তাইই। পৌঁছতেই সাগ্রহে যেভাবে একজন, ‘আইয়ে, জনাব’ বলে
ছুটে এল, নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, গাইড।
বিভিন্ন রাজারাজড়াদের ছবি টাঙানো সব, বেশিরভাগ থ্রি-ডি
ছবি, মানে আমি বাঁদিক থেকে ডানদিকে গেলে ছবিও ঘুরবে। সেই গাইড
জনাব রসিক আছেন। সমুকে তো গাইড বলেই দিল, “আপকো নবাব ওয়াজিদ আলি
শাহ কি তরহা দিখনে মে হ্যায়।”
অবশ্য সে নিয়ে সমুর বিড়ম্বনাই বেশি হয়েছে আমাদের কাছে।
একটা ছবি দেখানোর সময় সৌরভকে বলল, “শেহজাদে, আপ মেরে বাঁয়ে তরফ আইয়ে
জরা”, আর আমায় বলল, “ছোটু, তুম মেরে
দাঁয়ে তরফ আও জরা।”
এরপরে আর কীই বা করার থাকে, কমণ্ডলু নিয়ে হিমালয়ের পথে
যাওয়া ছাড়া!
পিকচার গ্যালারির বাইরে দেখলাম, তারপর আরও বহু জায়গায়
দেখলাম, তখনকার লোকে খিলেন বানাত পাতলা ইট, যা দিয়ে পুরো বাড়িটা
বানাচ্ছে সেই ইট, কাত করে করে খিলেনের আকার দিত। পিকচার গ্যালারি থেকে ছোটা ইমামবাড়া
হাঁটাপথ।
বৃষ্টি থেমে গেছে। লখনৌ শহরটা একে এত পুরনো, তায় যত্রতত্র
অবাধে গরু-ঘোড়া ঘুরে বেড়ায়। পান-গুটখার পিক আর গোবরে রাস্তাঘাট ভরে আছে। কাদা, গোবর বাঁচিয়ে চলতে
গেলে বিক্রম মানে সিএনজি বা বড়ো অটো বিক্রমের সাথে এসে ঢুঁসো মারতে চায়। এখানে ট্র্যাফিক
সত্যি বড়ো অদ্ভুত। যার মন চাইছে যেমন খুশিতে যেভাবে সেভাবেই যাচ্ছে। যদি আপনি
দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তা পেরোবেন বলে তাহলে সারাদিন দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। বুক ফুলিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে। ‘পথেই এবার নামো সাথী’
গাইতে গাইতে, অটো বা টোটো বা বাইক স্পীড না কমিয়ে আপনাকে পাশ
কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। আপনি ইষ্টনাম জপতে জপতে বৈতরণী মানে রাস্তা পার হবেন।
ছোটা ইমামবাড়া আসলে মসজিদ। রিনোভেশনের নাম করে বেশ খানিকটা
নষ্ট করেছে আমাদের দেশের কোনও উচ্চ বুদ্ধির লোক। যাই হোক, যা আছে তাও দারুণ লাগে দেখতে।
ঢোকার দরজার মাথায় উড়ুক্কুমাছ বসানো। তখন জানতে গেলে গাইড নিতে হয়, তাই আমরা গুগল গাইড
থেকে জেনে নেওয়াই উচিত বোধ করেছি।
বর্তমানকে উপেক্ষা করে ইতিহাসে মুখ গোঁজার মন আমাদের
নয়, তাই পেট ত্রাহি মাম ত্রাহি মাম করে উঠছে বুঝেই আমরা সোজা টোটো ধরে টুন্ডে কাবাব
খেতে চললাম। চৌকের টুন্ডে অনলি বিফ আগেই শুনেছিলাম কুন্তলাদির ব্লগ থেকে। তাই আমাদের গন্তব্য আমিনাবাদ।
টোটো ধরা মহা ভুল হয়েছিল দেখা যাচ্ছে। খিদের গতি ঘন্টায় পাঁচশো মাইল আর টোটোর
গতি ঘন্টায় পাঁচ মাইল! এদিকে সে আবার চিকন ফ্যাক্টরি নিয়ে যাবেই। প্রথমে তো শুনছিলাম
চিকেন ফ্যাক্টরি। চিকেন
খেতে ভালোবাসি, কিন্তু পোল্ট্রি দেখতে যাবার মতো ভালোবাসি না। তাই বিস্মিত হয়েছিলাম খুবই। মুখ দেখেই বোঝা যায় মাংসভুক? ধরে ধরে পোল্ট্রি
নিয়ে যায়? পরে বুঝলাম, চিকন ফ্যাক্টরি। তারপর টোটোওলা এক ওয়ান
ওয়েতে ঢুকে পড়েছে। পুলিশ এসে বাতচিত করছে; সময় এগোচ্ছে, আমাদের
খিদে এবার চেঙ্গিস খাঁ হয়ে যাচ্ছে। শেষে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সে পুলিশের হাত থেকে রেহাই
পেল।
আগের গলিতে আমাদের নামিয়ে দিল। হেঁটে হেঁটে লখনৌয়ের পুরনো গলি দিয়ে
এগোচ্ছি। বাতাসে
জর্দার গন্ধ, রাস্তার পাশে পুরনো ভাঙাচোরা হাভেলি টাইপ বাড়ি। সে বাড়ির সামনে গণেশপুজো হচ্ছে। পাশেই
দাড়িওলা ফেজ টুপি ঠুক ঠুক করে কী যেন ঠুকছে ছোট্ট দোকান ঘরে। ডানদিকে দিব্যি জামাকাপড়ের
দোকান। সব মিলিয়ে ইতিহাস, বর্তমান একাকার হয়ে চলতে থাকে। হঠাৎ নাকে এল সুবাস আর আমরা
বুঝে গেলাম এসে গেছি আমাদের মোক্ষস্থলে।
(ক্রমশ)
_____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment