পাই ও
প্রকৃতি
সূর্যনাথ
ভট্টাচার্য
কবি
গেয়েছিলেন, নদী
আপন বেগে পাগলপারা। — কবি জানতেন না, পাগল নয়, নদীকেও চলতে
হয় হিসেব মেনে। রীতিমত অঙ্ক কষে।
নদীর
এঁকেবেঁকে চলার যে গতিপথ,
কে সেই পথ নির্ধারণ করে দেয়? কোনও নির্দিষ্ট তত্ত্ব আছে কি? মনে তো হয়
না। নদীপথের ভূপ্রাকৃতিক গঠন, উৎস ও মোহানার উচ্চতার তারতম্য, জলধারার
পরিমাণ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে তা নির্ধারিত হয়। সব
বাধাবিপত্তির বিরুদ্ধে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে সবচেয়ে কম প্রতিরোধের পথে জলরাশি
প্রবাহিত হয়। তার ফলে নদী সরলরেখায় বয় না। তার জলপথের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। উৎস থেকে
মোহানার যে সরলরৈখিক দূরত্ব নদী তার চেয়ে অনেকটা লম্বা হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই
দুই দৈর্ঘ্যের, অর্থাৎ
নদীর জলপথে দূরত্ব ও উৎস ও মোহানার সরলরৈখিক দূরত্বের অনুপাত সর্বদা একের চেয়ে বড়
হয়। নদীর গতিপথ যত সোজা হবে, এই অনুপাত একের কাছাকাছি হবে এবং যে নদীর গতিপথ যত বিসর্পিল, তার
ক্ষেত্রে এই অনুপাত হবে তত বেশি।
এ পর্যন্ত
বুঝতে কোনও সমস্যা নেই। আমাদের গঙ্গানদীর কথাই ধরা যাক। আমাদের কাছে পুণ্যতোয়া এই
জলধারার মোট দৈর্ঘ্য যেখানে ২৫২৫ কিলোমিটার, গঙ্গোত্রী থেকে সুন্দরবন ব-দ্বীপের
সটান দূরত্ব হল ১৫৪২ কিলোমিটার। সংখ্যাদুটির অনুপাত ১.৬৪ এর কাছাকাছি। এইরকম অনুপাত
সব নদীর জন্যেই বার করা যায়।
ক্যালিফোর্নিয়ার
স্যাক্রামেন্টো নদীর ক্ষেত্রে এই অনুপাত সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে। প্রায় সাড়ে চারশ' মাইল লম্বা
এই নদীটির জন্য অনুপাতটি হল মাত্র ১.২৪। আবার আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরকে ঘিরে আশি
মাইলের ক্ষুদ্র তটিনী লিফি-র ক্ষেত্রে তা হল সাঙ্ঘাতিক রকমের বিশাল — প্রায় ৫.৯ — এ
পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বেশি।
এককথায়
এই অনুপাতকে বৈজ্ঞানিকেরা সাইনোসিটি নাম দিয়েছেন। এই বিষয়ে প্রথম গবেষকটির নামে
একে স্টোলাম নাম্বার-ও বলা হয়।
নদীর
সাইনোসিটি বা স্টোলাম সংখ্যা কত হবে তা কি কোনও ফর্মুলায় বাঁধা যায়? সহজ বুদ্ধি
বলে, কোনওমতেই
সম্ভব নয়। বিভিন্ন স্থানের ভৌগলিক গঠন নিয়ন্ত্রণ করে নদীর গতিপথ। তাকে কোন নিয়মে
ধরা যাবে?
আজ
থেকে প্রায় বিশ বছর আগে কেম্ব্রিজের বৈজ্ঞানিক হান্স হেনরিক স্টোলাম কিন্তু তাঁর
এক গবেষণাপত্রে এইরকমই একটা অবাস্তব প্রস্তাব রাখেন। পরীক্ষামূলক কিছু তত্ত্ব ও
তথ্যে আধারিত গবেষণায় তিনি ঘোষণা করেন, পৃথিবীর সব নদীর গড় সাইনোসিটি হল
গিয়ে — পাই!
হ্যাঁ, ঠিকই
শুনেছেন, পাই!
মানে যে কোনও বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত। যা একটা বিশ্বজনীন ধ্রুবক এবং এর
মান ৩.১৪১৫৯২৬৫...। এটি একটি অমূলদ রাশি, দশমিকের পর লক্ষ লক্ষ স্থান পর্যন্ত
কষে দেখা গেছে, বলা
বাহুল্য যন্ত্রগণকের সাহায্যে, এর কোনও শেষ নেই।
স্টোলামের
গবেষণাপত্রে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও তত্ত্বের অভাব ছিল না। তিনি তাঁর সংগৃহীত
আপাতবিশৃঙ্খল সব তথ্য ফ্র্যাকটাল জ্যামিতির দ্বারা সিমুলেশন করে বিশ্লেষণ করেছেন।
সেই সব করে তাঁর সিদ্ধান্ত হল, সব নদীর সাইনোসিটি ২.৭ ও ৩.৫ এর মধ্যেই থাকবে। গড়পড়তা এই
রাশির মান ৩.১৪-এর বেশ কাছাকাছি! অনুমান করা খুব অযৌক্তিক নয়, সব নদীর
বাস্তবিক তথ্য যাচাই করলে,
এই মান হবে পাই! কারণ এখনও অজানা, কিন্তু হয়তো বা লুকিয়ে আছে কোনও
অজ্ঞাত প্রাকৃতিক রহস্য!
নদীর
সাইনোসিটির মতো এক নৈসর্গিক তত্ত্বে পাই কোত্থেকে আসে, তা কিন্তু
মোটেই বোধগম্য হয় না। তবে সাইনোসিটি ছাড়াও, প্রকৃতিতে আরও কিছু অনপেক্ষিত
ক্ষেত্রেও পাই-এর অস্তিত্ব বিশুদ্ধ গাণিতিক পদ্ধতিতেই পাওয়া যায়। সম্ভাব্যতা
তত্ত্ব এইরকম একটা ক্ষেত্র। প্রোব্যাবিলিটি থিওরিতে এমন অনেক সম্ভাব্যতা পাওয়া যায়
যেখানে পাই-এর কোনও অবদান থাকার কথা নয়। অথচ সেখানে পাই-এর অতর্কিত উপস্থিতি! যেমন
'বাফোঁর
সূচী-সমস্যা'।
অষ্টাদশ
শতাব্দীতে ফরাসী গণিতজ্ঞ কোম-ডী বাফোঁ প্রথম এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। সহজ কথায়
প্রশ্নটি এইরকম — ধরুন একটা সমতলে রুলটানা খাতার পাতার মতো নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর
অনেক সমান্তরাল সরলরেখা টানা আছে। এখন একটা সূচ, যার দৈর্ঘ্য সমান্তরাল রেখাগুলির
দূরত্ব অপেক্ষা কম, ঐ
সমতলের ওপর ফেললে, সেটি
কোনও একটা রেখাকে স্পর্শ বা ছেদ করার সম্ভাবনা কতটা?
আপাতদৃষ্টিতে
মনে হয়, এ
প্রশ্নের কোনও সমাধান হতে পারে কি? সূচটি কিভাবে পড়বে তা তো জানা নেই, বহুরকম ভাবে
পড়তে পারে। সেই অসীমসংখ্যক বিন্যাসগুলো সমস্ত ভেবে বার করা যায় নাকি? আর তা না
করতে পারলে এই প্রোব্যাবিলিটি কষে বার করা কি সম্ভব?
হ্যাঁ
সম্ভব, কিন্তু
তা সম্ভাব্যতা নিরূপণের গতানুগতিক পদ্ধতিতে নয়। সে পদ্ধতি বেশ চিত্তাকর্ষক এবং
নির্ভুল। তার দ্বারা এই আপাত অসম্ভব সম্ভাব্যতাও বার করা গেছে। সূচের দৈর্ঘ্য সমান্তরাল
রেখাগুলির দূরত্বের সমান হলে বাফোঁর সমস্যার সম্ভাব্যতা হল দুইকে 'পাই' দিয়ে ভাগ
করলে যা হয় তাই, অর্থাৎ
প্রায় ৬৩.৭ শতাংশ। বাফোঁ তাঁর প্রশ্নে সূচের দৈর্ঘ্য আরও কম হলে এই সম্ভাব্যতা কী
হয়, তাও
আলোচনা করেছেন।
বাফোঁর পরে সূচের
দৈর্ঘ্য রেখাগুলির দূরত্বের চেয়ে বেশি হলে প্রোব্যাবিলিটি কত হবে, সেটাও দেখা
হয়েছে। — ভারী মনোজ্ঞ আলোচনা, অন্তর্জালে অনুসন্ধান করলেই সেসব পেয়ে যাবেন।
দেখা
যাচ্ছে, প্রকৃতিতে
পাই-এর অস্তিত্ব আছে। অদ্ভুত ভাবে কখনও কখনও তা প্রকাশ পায়। নদীর সাইনোসিটিও কি
সেইরকম কোনও অনাবিষ্কৃত তথ্য?
স্টোলামের
সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহেই চাঞ্চল্যকর। গাণিতিক তত্ত্বের ভিত্তি আছে কিন্তু কোনও
প্রাকৃতিক তত্ত্বের দ্বারা এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এদিকে অনেক নদীর ক্ষেত্রে
সাইনোসিটির মান বাস্তবিক পরিস্থিতিতে অন্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, স্যাক্রামেন্টো
১.২৪, গঙ্গা
১.৬৪, লিফি
৫.৯...! সবই তো সিদ্ধান্ত সীমার বাইরে! তাহলে? শুরু হয়ে গেল ব্যবহারিক যাচাইয়ের
কাজ।
ওয়েবসাইট
তৈরি হল, সফটওয়্যার
ইনসটল হল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া তথ্য তাতে ভরা হতে লাগল। শ'আড়াই নদীর
পরিসংখ্যান বিশ্লিষ্ট হতেই ব্যাপার পরিস্কার হয়ে এল। স্টোলামের সিদ্ধান্ত টলে
গেছে। দু'শ
আটান্নটি নদীর তথ্যে গড় সাইনোসিটি এসে দাঁড়িয়েছে ১.৯৪! পাই-এর থেকে বহুদূরে!
অথচ
স্টোলামের তত্ত্বে তো কোনও ভুল ছিল না? ফ্র্যাকটাল জ্যামিতিও এখন প্রতিষ্ঠিত
শাস্ত্র। সেখানেও ভ্রান্তির বিশেষ অবকাশ নেই। অতএব তত্ত্ব ও তথ্যের এই বিষমতা নিয়ে
যথেষ্ট ধাঁধা সৃষ্টি হল। বিবিধ গবেষণাও শুরু হল।
অবশেষে
এই নিষ্কর্ষে আসা গেছে যে নদীর সঠিক দৈর্ঘ্য নিরূপণে গলদ হচ্ছে। কালের প্রবাহে
অনেক নদীর খাত পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে সেই সব নদী, যাদের পথ
খুব বেশি আঁকাবাঁকা ছিল। সে সব ক্ষেত্রে নদীর দীর্ঘ বৃত্তীয় অংশ মূলধারা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। নদীর দৈর্ঘ্য কমে গেছে। সেই সঙ্গে
সাইনোসিটিও। নদীর মূল দৈর্ঘ্যগুলি পাওয়া গেলে হয়তো স্টোলামের সূত্র সত্য প্রমাণ হত!
সে
যাই হোক, স্টোলামের
অনুমানে 'পাই'-এর
উপস্থিতি এখন আর খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নেই। বৈজ্ঞানিকেরা এরপরেও অবশ্য হাল ছেড়ে
দেননি। বাস্তবিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে গড় সাইনোসিটি পাই নয়, কিন্তু তা
একটা সংহত মানের দিকেই যেন যাচ্ছে — ১.৯৪...। এখন
প্রশ্ন হল, তাহলে
পাই না হলেও তা কি আর কোনও একটি ধ্রুবক?
সর্বাগ্রে
মনে আসে 'ফাই'! অর্থাৎ
স্বর্ণানুপাত। পাই-এর মতো জনপ্রিয় না হলেও ফাইও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি অমূলদ
ধ্রুবক। সোজা কথায় বললে,
এই ধ্রুবক থেকে এক বাদ দিলে যা হয় তা এরই অন্যোন্যক বা রেসিপ্রোকাল। ফাইএর মান
১.৬১৮...। হাতের কাছে ক্যালকুলেটর থাকলে দেখে নিতে পারেন, ১/১.৬১৮
প্রায় ০.৬১৮ এর সমান,
অর্থাৎ ১.৬১৮ - ১।
কিন্তু
নদীর গড় সাইনোসিটি তাহলে ফাইও নয়। সেক্ষেত্রে আর কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে মাথায়
আসে, পাইও
নায়, ফাইও
নয়। তাহলে পাই আর ফাই-এর অনুপাত নয় তো? আর কী আশ্চর্য! পাই ও ফাই-এর অনুপাত
গণনায় আসে ১.৯৪...! তবে কী...? এখনও আরও গণনা চলছে, কাজেই স্থির সিদ্ধান্ত করা যায়নি।
নব্বই
দশকের শেষে স্টোলামের গবেষণা বেশ খানিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু দুঃখের
বিষয়, ব্যবহারিক
ভাবে প্রাপ্ত ফলাফল খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। নদীর গড় সাইনোসিটি যে পাই নয় তা তো
প্রমাণ হয়েই গেছে। তা ফাই-ও নয় তাও দেখা হয়ে গেছে।
শেষ
করার আগে নদীর সাইনোসিটি নিয়ে গবেষণার এখনো অবধি প্রাপ্ত ফলাফল একবার দেখে নেওয়া
যেতে পারে। 'পাই-মী-এ-রিভার
ডট কম' ওয়েবসাইটটির
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ২৭২ টি নদীর ডাটা ফীড হয়ে সাইনোসিটি পাওয়া যাচ্ছে
১.৯০৫৮...। অতএব স্টোলাম নাম্বার যে পাই ও ফাই-এর অনুপাত বলে মনে করা হয়েছিল, অবশেষে দেখা
যাচ্ছে সেটাও ঠিক নয়।
সুতরাং, বিজ্ঞানীরা
এখনও অন্ধকারেই। প্রকৃতিরহস্য ভেদ হয়নি। সে প্রাথমিক উৎসাহও আর নেই। এই প্রকল্পে
নির্মিত ওয়েবসাইটটি সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে।
_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment