দিশাহীন দিশা
অনন্যা দাশ
(১)
মাঝরাতে কীসের একটা শব্দে
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল দিশার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। বাথরুম থেকেই আসছে মনে হচ্ছে
শব্দটা। দিশা বাথরুমে গিয়ে দেখল। এমিলির শরীরটা খারাপ মনে হয়, সে বমি করছে। দিশা
ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এমিলি তোমার?”
এমিলি দিশার রুমমেট। কিছুদিন
হল ওরা দুজনে একসঙ্গে রয়েছে কলেজের একটা অ্যাপার্টমেন্টে।
এমিলি খুব কষ্ট করে উত্তর
দিল, “শরীরটা একদম ভাল লাগছে না। এই নিয়ে চারবার বমি করলাম। কিছু একটা থেকে বদহজম
বা ফুড পয়জনিং হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।”
দিশার ভ্রূ কুঁচকে গেল,
“কিন্তু তুমি যা খেয়েছ আমিও তো তাইই খেয়েছি! আমার তো কিছু হয়নি, তাহলে...?”
এমিলি উত্তর দিল না। ও আর
মাথা তুলতে পারছিল না। দিশা ওকে ধরে ধরে বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
মিনমিন করে এমিলি এবার বলল,
“তোমার কাছে বদহজম বা পেট খারাপের কোনও ওষুধ আছে?”
ও আর চোখ খুলে রাখতে পারছিল
না, চোখ বুজে যাচ্ছিল। দিশার এবার বেশ ভয় লাগতে লাগল।
এমিলি কোনওরকমে চোখটা একটু
খুলে বলল, “শরীরটা খুব খারপ লাগছে।”
তারপরই অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল।
প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়ে দিশা
৯১১ নম্বরটায় ফোন করল। মার্কিন-মুলুকে এমারজেন্সি মানেই ৯১১। ওদিক থেকে কেউ একজন
ফোনটা ধরে বলল, “আপনার কী এমারজেন্সি বলুন?”
“আমার রুমমেট এমিলি প্রচন্ড
অসুস্থ। একটু আগে বমি করছিল আর এখন অজ্ঞান হয়ে গেছে। আপনারা এখুনি কাউকে পাঠান!”
“কোথায় এটা? ঠিকানা কী?”
দিশা কাঁপা কাঁপা গলায় নিজের
বাড়ির ঠিকানাটা বলল। যাক বাবা, সাহায্য আসছে!
(২)
“রিয়া তোমাকে একজন খুঁজছে,”
ল্যাবের স্টুডেন্ট জিয়ান এসে বলল।
“কে?”
“একটা মেয়ে। জানি না কে। দেখে
অবশ্য ফার্স্ট ইয়ার মেডিকেল স্টুডেন্ট বলে মনে হচ্ছে।”
“ও আচ্ছা, আমি যাচ্ছি,” বলে
রিয়া হাতের বিকারটা নামিয়ে রেখে ল্যাবের বাইরে গেল।
একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে
ভারতীয় বলেই মনে হচ্ছে। মেয়েটার চোখের কোলে কালি আর ফ্যাকাসে মুখ দেখে মনে হচ্ছিল
সে ভীষণ ভয় পেয়ে রয়েছে। রিয়াকে দেখে কষ্ট করে একটু হেসে বলল, “দিদি, আমাকে মনে
আছে? আমি দিশা। সেই হোলির সময় দেখা হয়েছিল।”
রিয়া মনে করার চেষ্টা করল।
নিউ চেরিভেলের যে মেডিকেল কলেজে ও পি.এইচ.ডি. করছে সেখানে ফেব্রুয়ারি-মার্চে
ঠান্ডার জন্যে হোলি খেলা হয় জুন মাসে। একটা মাঠে সব ভারতীয় স্টুডেন্ট আর
প্রোফেসাররা মিলে হোলি খেলে। কিন্তু সেদিন তো সবাই একগাদা রঙ মেখে ভূতের মতন
চেহারা হয়ে থাকে। অত ভূতের মতো চেহারার মধ্যে আলাদা করে দিশাকে মনে করা খুব মুশকিল।
“হ্যাঁ দিদি! আমি ভীষণ বিপদে
পড়েছি। তোমার কি একটু সময় হবে?”
“ঠিক আছে, চলো বাইরে গিয়ে
বসি। এই সময়টাই এখানে যা ভাল। তারপর তো আবার সেই ঠান্ডা শুরু হবে!” বলে রিয়া
মেয়েটাকে নিয়ে বাইরের বাগানে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল।
সুন্দর রঙিন ফুল ফুটে রয়েছে
চারিদিকে। মৌমাছি প্রজাপতি খেলা করছে। কয়েকটা কাঠবেড়ালিও ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে
ব্যস্তভাবে। এখানকার কাঠবেড়ালিগুলোর স্বাস্থ্য বেশ ভালো আর ইয়া মোটা ল্যাজ!
চারদিকটা সবুজ ঘাসে মোড়া, দেখলেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।
“কী হয়েছে বল এবার।”
দিশা বলল, “আমার পুরো নাম
দিশা প্যাটেল। আমি এখানে সেকেন্ড ইয়ার মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমি খুব বিপদে পড়ে তোমার
কাছে এসেছি দিদি!”
“কী হয়েছে আগে বলবে তো!”
“গতবছর থেকে এখানে মেডিকেল
পড়তে এসেছি আমি। আমার মা-বাবা দুজনেই গুজরাতের। নিউ ইয়র্কে মানুষ হয়েছি আমি। ওখানে
আমার বাবার ব্যবসা আছে। বেশ কয়েকটা দোকান আর হোটেল। নিউ ইয়র্কে তো প্রচুর গুজরাতি। আমি
গুজরাতি খাবার পছন্দ করি আর গুজরাতি বলতেও পারি। যাই হোক, এখানে আমি এমিলি বলে
একটা ফার্স্ট ইয়ার মেডিকাল স্টুডেন্টের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকি। কাল
রাতে কিছু একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি উঠে
দেখি আমার রুমমেট এমিলি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খুব বমি টমি করছে। আমার কাছে
ওষুধ চাইছিল কিন্তু আমি কিছু করার আগেই ও অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে ৯১১-এ
ফোন করলাম। ওরা এসে এমিলিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেই থেকে মেয়েটা কোমাতেই রয়েছে। ওর
মা-বাবা এসেছেন, ওর কাছেই আছেন। আমি ভেবেছিলাম হয়তো উলটোপালটা কিছু খেয়েছে যে
কারণে ওর বদহজম হয়ে গেছে, কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন ওর শরীরে নাকি বিষ পাওয়া গেছে আর
পুলিশ মনে করছে আমিই ওকে বিষ দিয়েছি!”
“সর্বনাশ! কিন্তু ওরা তোমাকে
সন্দেহ করছে কেন? এমিলিকে বিষ দেওয়ার কোনও কারণ আছে কি তোমার?”
দিশা কয়েক সেকেন্ড মুখ নিচু
করে বসে রইল। তারপর বলল, “এমিলির সঙ্গে আমার সম্পর্ক একটা
ব্যাপারে খুব একটা ভালো নয়। মানে ও ঘোরতর মাংসাশী – চিকেন, বিফ, ল্যাম্ব, পর্ক –
যা পায় তাই খায়। আমি এদিকে একদম আমিষ খাই না। তাই আমার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া নিয়ে ও
প্রায়ই লাগত। ও মাংস রান্না করলে আমি চেঁচাতাম আর আমি মশলা দিয়ে রান্না করলে ও চোখ
জ্বালা করছে, হাঁচি আসছে বলে চিৎকার করত। ফ্রিজে কী রাখা হবে সেই নিয়েও বচসা হয়েছে
আমাদের। আমরা দুজনেই অন্য রুমমেটের জন্যে আর্জি দিয়েছিলাম কলেজ কর্তৃপক্ষকে।
কিন্তু এইসব ব্যাপারে কিছু করতে ওদের সময় লাগে অনেক। তবে ওর মাংস খাওয়া বা অন্য
কোনও অভ্যাস আমার পছন্দ নাও হতে পারে। তা বলে আমি
ওকে প্রাণে মারতে যাব কেন? পুলিশকে ওর মা-বাবা নাকি বলেছেন যে আমি প্রচন্ড হিংস্র,
যখন তখন যা খুশি করতে পারি আমি!”
“হুঁ। তা
তুমি আমার কাছে এসেছ কেন?”
“তোমার নাম খুব শুনেছি আমি। তুমি
যদি এই ব্যাপারটার একটু গভীরে ঢুকে দেখতে পার তাহলে খুব ভালো হয়। আমি তো আর এখানে
কাউকে তেমন চিনি না যে আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।”
“এমিলির কি কোনও চেনা পরিচিত
কেউ এখানে থাকে?”
“না, ও তো কিছুদিন হল মিশিগান
থেকে এসেছে। ও তো ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট।”
রিয়ার ভ্রূ কুঁচকে গেল,
“ফার্স্ট ইয়ারদের তো সাধারণত সেকেন্ড ইয়ারদের সঙ্গে এক অ্যাপার্টমেন্ট দেয় না। তা
তোমার সঙ্গে কী করে ঘর পেল এমিলি?”
দিশা বলল, “এমিলির আগে আমার
ব্যাচের গ্যাবি বলে একটা মেয়ে আমার সঙ্গে থাকত। ওর সঙ্গে আমার একইরকম সমস্যা
হয়েছিল আমিষ-নিরামিষ খাওয়া দাওয়া নিয়ে। তারপর ও কোর্স ছেড়ে চলে যায় দুম করে। অন্য
কোথাও গিয়ে ভর্তি হয়েছে মনে হয়, বাড়ির কাছের কোনও কলেজে। গ্যাবি চলে যাওয়ার পর বেশ
কয়েকদিন অন্য ঘরটা খালিই ছিল, তারপর এমিলি আসে।”
“কাল রাতে তোমরা দুজনে কে কী
খেয়েছিলে?”
“কাল রাতে আমি ওকে পড়ায়
সাহায্য করছিলাম বলে ও কৃতজ্ঞ হয়ে আমাদের দুজনের জন্যেই পিৎজা আনিয়েছিল। ভেজ পিৎজা,
তাই আমরা দুজনেই সেটা থেকেই খেয়েছিলাম। অন্য সময় আমি নিজের খাবার খাই আর ও নিজের
কিছু খায়। পিৎজা ছাড়া আর অন্য কিছু খেয়েছিল কি না ও সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না।
তবে পুলিশ খাবারের থালা, পিৎজার বাক্স সব তুলে নিয়ে গেছে পরীক্ষা করে দেখবে বলে।”
“কোথায় বিষ পেল সে বিষয়ে
তোমাকে কিছু বলেছে ওরা?”
“না, তা তো বলেনি। ওরা আসলে
আমাকে কিছুই বলছে না। খুব ভয় লাগছে আমার। বিশ্বাস কর, আমি
এমিলির কোনও ক্ষতি করতে চাইনি!”
“ঠিক আছে। তা
তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি যদি ওর ক্ষতি না করতে চাও তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কেউ ওর ক্ষতি
চায়। সেটাই তো বার করতে হবে।”
“জানি না। কাল তো রবিবার ছিল
আর বৃষ্টি পড়ছিল, তাই আমরা দুজনেই সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। উইক-এন্ডে বাড়ি যাই আমি,
কিন্তু সামনে পরীক্ষা, তাই আর বাড়ি যাইনি। বাড়ি গেলে পড়াশোনা হয় না তেমন।”
“কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে
ওকে?”
“হোলি স্পিরিট।”
“ও আচ্ছা। আর তুমি কি এখন একা
আছ বাড়িতে?”
“হ্যাঁ, আপাতত। আমার দাদা আজ
বিকেলে আসবে।”
“ঠিক আছে আমি দেখি কিছু খোঁজখবর
করতে পারি কি না। এর মধ্যে তুমি কিছু জানতে পারলে আমাকে জানিও। ফোন, টেক্সট, ইমেল
– যা কিছু চলবে।”
দিশা খুব খুশি হয়ে রিয়াকে
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। রিয়া আস্তে আস্তে নিজের ল্যাবে ফিরে এল। ততক্ষণে কিম
ল্যাবে চলে এসেছে। কিমবারলি ডিমার্কো নিউ চেরিভেলের পুলিশ প্রধানের কন্যা।
তাই তার কাছ থেকে বাড়তি অনেক খবর পাওয়া যায়।
রিয়া ল্যাবে ঢুকে কিমকে
সুপ্রভাত ইত্যাদি করতে কিম বলল, “কোথায় ছিলে?”
রিয়া বলল, “একটা মেয়ে এসেছিল
আমার সঙ্গে দেখা করতে।”
কিম হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে
বলল, “দাঁড়াও, আমি বলি। ওই প্যাটেল মেয়েটা তো? যে নিজের
রুমমেটের সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে বিষ খাইয়েছে, সে-ই তো? আমি ভাবতেও পারছি না মেডিকেল
পড়তে এসে কেউ এইরকম কাজ করতে পারে!”
“কিন্তু ও তো বলছে ও কিছু
করেনি! দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো সবাই নির্দোষ, তাই না?”
“সে তো সবাই বলে যে তারা
নির্দোষ! আচ্ছা তুমি কি জানো যে মেয়েটা আগেও ওই একইরকম কাজ করেছে?”
“সে কি! সেটা তো আমাকে
বলেনি!”
“তা বলবে কেন? ওর নিজের
ব্যাচের একটা মেয়ে ছিল। সে এখন অন্য কলেজে বদলি করিয়ে নিয়েছে। ওর এমন মারাত্মক
বিষক্রিয়া হয়েছিল যে বলবার নয়! সব ওই প্যাটেল মেয়েটার কাজ।”
“দিশা, ওর নাম দিশা।”
“সে যাই হোক, তোমার ওই দিশা
গতবার পার পেয়ে যায় স্রেফ ও এখানে ছিল না বলে। এক সপ্তার জন্যে বাড়ি গিয়েছিল তখন
সে। গ্যাবি বলে মেয়েটা তখন তার মাসির সঙ্গে ছিল, তিনি ডাক্তার। উনি সঙ্গে সঙ্গে
স্টোমাক পাম্প ইত্যাদি করিয়ে দেন, তাই ওর এমিলির মতন বাড়াবাড়ি হয়নি। তারপর থেকে সে
ভয়ে আর এখানে থাকতে চায়নি, অন্য কলেজে ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে। ঘরটা এতদিন খালিই
ছিল। এখন নতুন মেডিকেল স্টুডেন্টদের ব্যাচ আসতে এমিলিকে ওই ঘরে ঢোকানো হয়েছিল। ফল
একদম একইরকম! ওই দিশা মেয়েটার মাথা খারাপ আছে। কাউকে আমিষ খেতে দেখলেই ও পাগল হয়ে
যায়!”
রিয়া শুধু বলল, “এমিলি মেয়েটা
তো কোমায়, তাই ওর কাছ থেকে তো কিছুই জানা যাবে না। কাল না হয় ওর মা-বাবার সঙ্গে
একবার কথা বলে দেখব।”
(৩)
পরদিন রিয়া ল্যাবে ঢুকে দেখল
কিম আগেই এসে বসে রয়েছে উৎসুক মুখে। হাই হ্যালোর পর্ব সারা হতেই বলল, “ভাল খবর আর
খারাপ খবর দুটোই আছে। কোনটা আগে শুনতে চাও?”
“খারাপটাই আগে শুনি,” রিয়া
বলল।
“বিষ কোথায় ছিল পাওয়া গেছে।
এমিলি ভিটামিনের বড়ি খেত। সেই শিশিটা নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। দেখা গেছে তাতে কয়েকটা
ক্যাপসুল যেমনটা হওয়া উচিত তেমন নয়। ওগুলোতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এ যুগে ওই বিষ
আর কেউ ব্যবহার করে না বলেই জানতাম। যাই হোক, তোমার ওই দিশা সামারে যে ল্যাবে কাজ
করছিল সেখানে আর্সেনিক নিয়ে কাজ হয়।”
“হুঁ, বুঝলাম। আর ভালো খবর?”
“এমিলি কোমা থেকে জেগেছে, তাই
ওর খুনের দায়ে জেলে যেতে হবে না তোমার দিশাকে।
বড়জোর খুনের চেষ্টার জন্যে যেতে হতে পারে। তবে এমিলি এখনও খুবই দুর্বল। ডাক্তাররা
ওকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছেন না। পুলিশের সঙ্গেও না।”
“ও!”
“তার মানে তুমি দেখা করতে
যাবে। তাই তো?”
“হ্যাঁ, মানে বিকেলের দিকে
একবার যাব ভাবছিলাম। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই, যদি দেখা হয়ে যায়!”
“ও আর শোনো, তুমি জানো কি না
জানি না, তোমার ওই দিশা বিশাল বড়লোকের মেয়ে। ওর বাবার দোকান আর মোটেল সব রমরম করে
চলে।”
“তাতে কী? বড়লোকের মেয়ে বলেই
সব দোষ ওর হয়ে গেল? বড়লোক মানেই তো আর খুনি নয়! সে তো পরীক্ষা পাশ-টাশ করে পড়তে
এসেছে রে বাবা!”
কিমের বারবার ‘তোমার ওই দিশা’
বলাটা রিয়ার মোটেই ভালো লাগছিল না।
“না, আমি তো বলিনি ও খুনি!
আমি শুধু বলছি যে ও যখন বড়লোক তখন ও অন্য অনেক বড়ো বড়ো ডিটেকটিভদের ধরতে পারত।
তোমার কাছে এসে সাহায্য চাওয়ার কী মানে?”
“সে প্রশ্নের জবাব তো আমি
দিতে পারব না, দিশাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে তুমি আমার বন্ধু সেটা সবাই জানে আর
সেই সুযোগে তোমার বাবার কাছে থেকে...”
“থাক থাক, বুঝেছি। আর
বলতে হবে না। সেইজন্যেই মনে হয় ও তোমাকে ধরেছে।”
(৪)
ক্লাস থেকে ফিরেই উশখুশ করছিল
দিশা। সে খবর পেয়েছে যে এমিলি কোমা থেকে জেগে উঠেছে। তাকে দেখতে যাওয়ার একটা প্রবল
ইচ্ছা পেয়ে বসল দিশাকে। এমিলিকে শুধু একবার দেখবার বাসনা ওর মনে। বার বার মনে
হচ্ছিল এমিলিকে একবার বলা দরকার যে দিশা কিছু করেনি। দাদা এসেছে, কিন্তু খুব
ব্যস্ত। ঘরে নেটের কানেকশান খুব আস্তে আসছিল বলে বেরিয়েছে। ভাগ্যিস সে বাড়িতে নেই।
দাদা যদি জানতে পারে ও হাসপাতালে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তাহলে কিছুতেই ওকে যেতে
দেবে না। ওদিকে এমিলির মা-বাবা এসেছেন। তারা তো দিশাকে চেনেন। এমিলি যখন প্রথম
এসেছিল তখন ওনারাও এসেছিলেন ওর সঙ্গে, তখনই ওনাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ওনারা বেশ
কিছুদিন ছিলেন ওদের বাড়িতে। এদিকে পুলিশ ওকে বলেছে ক্লাস আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া
চলবে না। কিন্তু এমিলিকে একবার অন্তত না দেখলে দিশা যে শান্তি পাবে না! প্রাণ
হাঁসফাঁস করছে। কেউ চিনতে পারলে তো ওকে ঘরে ঢুকতে দেবে না, তাই খুঁজে খুঁজে সোনালি
চুলের উইগটা বার করল সে। একটা নাটকের জন্যে কিনেছিল ওটাকে, কিন্তু ওর খুব পছন্দ
হয়েছিল, তাই রেখে দিয়েছে। সেটা মাথায় পরতেই অনেকটা অন্যরকম দেখতে হয়ে গেল ওর মুখটা। তারপর
চোখে সানগ্লাস পরে নিল, গায়ে একটা ঢলঢলে টি-শার্ট, ব্যস, আর ওকে চেনে কে!
গাড়িটাকে চিনে ফেলবে সবাই। তাই
বাসে করেই চলল দিশা। সে শুধু এমিলিকে
একবার দেখতে চায়, বলতে চায় যে সে তাকে মারতে চায়নি। মারাত্মক
একটা কিছু ভুল হচ্ছে কোথাও। ওইসব
কথাগুলো এমিলিকে বলতে পারলে ওর মনটা একটু হালকা হবে।
নির্বিঘ্নে হাসপাতালে পৌঁছে গেল
দিশা। প্রচুর লোক চারদিকে। কিন্তু
কেউ ওর দিকে তাকালও না। সুরক্ষা ব্যবস্থা
বেশ ঢিলেঢালা। কেউ কিছু চেকটেক করছে না। ওর কাছে
কেউ আইডি দেখতে চাইলে তো মুশকিল হত।
হাসপাতালে আগেই ফোন করে দিশা জেনে
নিয়েছিল যে এমিলি ৫০৬ নং ঘরে রয়েছে। আরে
কী ভাগ্য! এমিলির বাবা-মা এলিভেটারে করে নেমে এসে বাইরের
দিকে কোথাও গেলেন। মনে হয় খেতেটেতে
গেলেন হয়তো। এই সুযোগ! লিফটে করে সোজা পাঁচতলায় উঠে গেল দিশা। উঁকি
দিয়ে দেখল, তারপর কেউ কোথাও নেই দেখে ঝট করে এমিলির ঘরে ঢুকে পড়ল।
এমিলি চোখ বন্ধ করে খাটে শুয়ে
রয়েছে। চারদিকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি নানারকম শব্দ করে চলেছে। প্রচুর টিউব লাগানো ওর
সারা শরীরে। একটা লম্বা স্ট্যান্ড থেকে কীসব ড্রিপ চলছে। খুব কষ্ট হল এমিলিকে
এইভাবে দেখে।
“এমিলি, এই এমিলি!” নিচু গলায়
ডাকল দিশা।
ওর ডাকে চোখ খুলে তাকাল
এমিলি। ওকে চিনতে পারল কি? ওহো, ওর মাথায় তো সোনালি উইগ! উইগ আর সানগ্লাস খুলতেই
এমিলির চোখে ভয় ফুটে উঠল। ওকে চিনতে পেরেছে! অস্ফুট স্বরে সে বলল, “দিশা?”
হাউমাউ করে দিশা বলতে লাগল,
“এমিলি, তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতেই হবে! আমি তোমাকে বিষ দিইনি। প্লিজ তুমি
ভেবে দেখো তোমার আর কে শত্রু আছে।”
আর কিছু বলার আগেই হঠাৎ পেছন
থেকে একটা শক্ত হাত ওর কাঁধে নেমে এল, “কে আপনি? এখানে কী করছেন?”
(৫)
রিয়া আর কিম যখন হাসপাতালে
পৌঁছল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। কিমের বাবাও ছিলেন ওদের সঙ্গে। না
হলে তো ওদের ঢুকতে দেওয়ার কথা নয়। ইনফরমেশান ডেস্কে গিয়ে কথা বলতে ওদের তিনজনকে
‘ভিজিটার’ লেখা ব্যাজ দিল একজন। এমিলির ঘরের নম্বর ৫০৬। লিফটে করে পাঁচতলায় গিয়ে
৫০৬-তে যেতে দেখা গেল সেখানে হুলুস্থুল কান্ড চলছে।
দিশা নাকি ছদ্মবেশ ধরে এসে
এমিলিকে আবার মারার চেষ্টা করেছিল। এমিলির শরীরে যে বোতল থেকে স্যালাইন যাচ্ছিল,
সেই বোতলটাকে বদলে বিষ মেশানো একটা বোতল ঝুলিয়ে দিয়েছিল সে। স্যালাইনের বোতলটা
হাসপাতালে যে ব্র্যান্ডের ব্যবহার করা হয়, সেই ব্র্যান্ডের নয় দেখে ডাক্তারের
সন্দেহ হয়। উনি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে সরিয়ে ফেলে পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ে অন্য
নতুন স্যালাইন বোতল দিয়ে দেন। দেখা যায়
যে বোতলে বিষ ছিল। ভাগ্য ভালো, ডাক্তারের তৎপরতার জন্যে এমিলির শরীরে বিষ বেশি
ঢোকেনি।
দিশাকে ওখানেই আটকে রাখা
হয়েছিল। যদিও সে বারবার বলেছে যে সে ওসব কিছু করেনি। ও শুধু এমিলির সঙ্গে দেখা
করতে এসেছিল। সে কেমন আছে দেখতে আর সম্পূর্ণ সত্যটা জানতে চাওয়ার জন্যে।
এমিলি অবশ্য ওই অবস্থার
মধ্যেই বলেছে যে দিশা স্যালাইনে হাত দেয়নি। দিশা ওর ঘরে আসার একটু আগেই একজন সাদা
কোট পরা কেউ এসে ওটা বদলে দিয়ে যায়। সাদা কোট পরা ডাক্তার নার্সরা সবসময় ঘরে ঢুকছে।
তাই এমিলি তাকিয়েও দেখেনি কে ছিল বা তাকে কেমন দেখতে।
দিশা ঘরের একটা কোণে বসে বসে
কাঁদছিল। কিমের বাবা অফিসার ডিমার্কো তাকে প্রচন্ড ধমক দিয়ে বললেন, “অনেক পাকামো
করেছ তুমি! এরপর যদি তোমার কলেজ বা বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় তাহলে আমি
তোমাকে জেলে পুরে দেব!”
এমিলির মা-বাবা মনে হয় খেতে
গিয়েছিলেন। ওনারাও ফিরে এলেন। পুলিশ আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
ওনাদের মেয়েকে ঠিকমতন সুরক্ষিত রাখতে পারছে না বলে খুব রেগে গেছেন মনে হল।
কিমের বাবা ওদের সান্ত্বনা
দেওয়ার চেষ্টা করে কথা দিলেন যে এমিলির হাসপাতালের ঘরের সামনে পুলিশ পাহারা বসানো
হবে। দিশা বাসে করে এসেছিল বলে রিয়াদের সঙ্গে ফিরল। ফেরার পথে সে কেঁদে কেঁদে বলল,
“আমি কিছুই করিনি, তাও আপনারা আমার ওপর চোটপাট করছেন! আমি এমিলিকে সেটাই বলতে
গিয়েছিলাম যে আমার কোনও দোষ নেই। ওর কোনও শত্রু আছে কি না যে ওইরকম করতে পারে,
সেইরকম কিছু নাম যদি ওর মনে পড়ে সেইসব জিজ্ঞেস করতে।”
রিয়া বলল, “তোমার তো ওইসব
করার দরকার ছিল না। তুমি আমাদের বলেছ সেটাই তো যথেষ্ট।
আমি তো যাচ্ছিলাম ওকে ওইসব কথা জিজ্ঞেস করতে।”
তাই শুনে দিশা মুখ নিচু করে
বসে রইল।
রিয়া আবার বলল, “যাক, অন্য
কয়েকটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।”
“কী?”
“এমিলি যে রোজ ভিটামিন বড়ি
খায়, তুমি জানতে?”
“হ্যাঁ, একসঙ্গে বাজার করেছি
অনেকবার। ও দোকান থেকে ওগুলো কিনত, সেটা দেখেছি।”
“সেই ভিটামিনের বড়ির কয়েকটাতে
বিষ পাওয়া গেছে।”
দিশা প্রথমে মাথায় হাত দিয়ে
এলিয়ে পড়ল সেই কথা শুনে। তারপর সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, “আমি
ওসব কিছু জানি না। ওর সঙ্গে আমার ঝগড়ার একমাত্র কারণ ছিল ওর আমিষ খাওয়া। সেটা ছাড়া
এমিলিকে আমার ভালোই লাগত। ওরও তো আমার কড়া মশলা দিয়ে রান্নাতে
আপত্তি ছিল। ওই দুটো ছাড়া আর কোনও ব্যাপার নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়নি তো। তাই ওকে মেরে
ফেলার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কেউ কোনওদিন শুনেছে, এইরকম তুচ্ছ কারণে কেউ কাউকে
মেরেছে?”
কিম এবার মুখ খুলে বলল, “না,
শোনেনি। কিন্তু তোমার যে মাথা গরমের সমস্যা আছে সেটা তো সবাই জানে। তুমি খেপে গিয়ে
একবার তোমার আগের রুমমেট গ্যাবিকেও বিষ দিয়েছিলে মনে হয়। ওর ব্যাপারটা কোনও কারণে
ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল ফুড পয়জনিং ভেবে। তাছাড়া তুমি তখন ছিলে না এখানে।
তাই তোমার ঘাড়ে দোষটা পড়েনি। তখন কেউ ওষুধের শিশি পরীক্ষা করে দেখেনি। আমার মনে হয়
সেবার না ধরা পড়ে তোমার সাহস বেড়ে যায় আর তুমি একই পদ্ধতি এমিলির ওপরও ব্যবহার
করেছ!”
“ওষুধের শিশিতে আমার হাতের ছাপ
পাওয়া গেছে বুঝি?” দিশা ঠান্ডা স্বরে বলল।
“না, তা পাওয়া যায়নি।
কিন্তু তাতে কী? তুমি হাতের ছাপ মুছে ফেলতে পার না নাকি? হাতের ছাপ মুছে ফেলা তো
আর ব্রেন সার্জারির মতো শক্ত কিছু নয়!”
সেই শুনে দিশা আবার নেতিয়ে
পড়ল।
ওকে বাড়িতে নামিয়ে দেওয়ার সময়
দেখা গেল ওর দাদা বাড়িতে নেই। কিমের বাবা তাকেও ফোন করে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে
দিলেন।
ওর দাদা জিগিনেশ প্রচুর
সরি-টরি বলে বললেন, “আসলে ঘরের ওয়াই-ফাইটা তেমন ভালো কাজ করছিল না।
তাই আমি এখন স্টারবাক্সে এসে কাজ করছি।”
ফেরার পথে রিয়া শুধু কিমকে
বলল, “তুমি শুনলে তো? এমিলি বলছিল একজন সাদা কোট পরা কেউ এসে স্যালাইনের বোতলটা
বদলেছে। আমার মন বলছে ওই কাজটা দিশা করেনি, ওটা অন্য কেউ। তার মানে অন্য কেউ একজন
বাজারে আছে। কে হতে পারে?”
(৬)
পরদিন কিম ল্যাবে এসে বলল,
“গন্ডগোল, গন্ডগোল!”
রিয়া মাইক্রোস্কোপে কী একটা
দেখছিল। চোখ না সরিয়েই বলল, “আবার কী হল?”
কিম হাতে গ্লাভস পরতে পরতে
বলল, “ওই দিশা মেয়েটা মোটেই যেমন সাজার ভান করছে তেমন ধোয়া তুলসিপাতা নয়।
তুমি কেন ওর কথা বিশ্বাস করছ কে জানে!”
“কেন? কী হয়েছে বলবে ত!”
“কাল মিসেস পার্কার বলে একজন
বাবাকে ফোন করেছিলেন। মিসেস পার্কার গোল্ডেন লেনে থাকেন। ওনার
একটা বাড়ি আছে। মিস্টার পার্কার গত হওয়ার পর থেকে উনি ওই বাড়িটার ঘরগুলো ভাড়া দেন।
পেয়িং গেস্টের মতন লোকেরা থাকে আর কি। তা কয়েকদিন আগে অস্কার ম্যাথিউ বলে কেউ একজন
ওনাকে ফোন করে বলে যে সে ওনার বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিতে চায় মাস চারেকের জন্যে।
উনি শুনে রাজি হন। দিন কয়েক আগে সেই লোক এসেছে। তার বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন কি ষাট
হবে। মিসেস পার্কার কিছুটা ভাড়া অ্যাডভান্সে নেন। না
হলে অনেক সময় লোকে ঘরের জিনিস নষ্ট করে বা ভাড়া না দিয়ে পালায়। সেই অ্যাডভান্সের
জন্যে ৪০০ ডলারের একটা চেক দিয়েছিল লোকটা। চেকেতে কার সই সেটা উনি আগে খেয়াল
করেননি। কিন্তু কাল চেক জমা দিতে গিয়ে দেখেন চেকটা
দিশার। দিশা মিসেস পার্কারের নামে ৪০০ ডলারের চেক দিয়েছে যাতে ওই লোকটা ওনার
বাড়িতে থাকতে পারে। বাবা মিসেস পার্কারের কথা শুনে পুলিশ রেকর্ড চেক করে দেখেছেন।
ওই অস্কার আসলে দাগী আসামী! কয়েক সপ্তা আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে সে। দিশা ওইরকম
একটা লোককে এখানে ডেকে এনেছে কেন?”
রিয়া বলল, “ঠিক আছে, সেটা
তাহলে আজ বিকেলে ওর বাড়ি গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করব। এখন খুব ব্যস্ত। পরের সপ্তায়
প্রেজেন্টেশান আছে, কিন্তু তার স্লাইড কিছু তৈরি হয়নি।”
“ঠিক আছে, তুমি স্লাইড বানাও,
আমি কোর ফেসিলিটিতে যাচ্ছি। বিকেলে তাহলে দিশার বাড়িতে যাওয়া যাবে।”
বিকেলে ওদের বেরোতে একটু
দেরিই হয়ে গেল। তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। দিশার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই ওর
গাড়িটাকে দেখতে পেল ওরা।
রিয়া বলল, “গাড়িতে তো দিশাই
রয়েছে মনে হচ্ছে। পুলিশ ওকে কোথাও যেতে বারণ করেছে না? তবে ও মেয়ে মনে হয় শোনার
পাত্র নয়!”
কিম বলল, “ওর পিছু নেব?”
“হ্যাঁ নাও। দেখি মেয়েটা
কোথায় যাচ্ছে!”
কিম কিছুটা দূরত্ব রেখে
গাড়িটার পেছন পেছন চলল। গাড়িটা একটা গোলাপি রঙের টয়োটা র্যাভ-৪। পেছনের ভ্যানিটি
নম্বর প্লেটে লেখা রয়েছে ‘ফর দিশা’। একটু বেশি দাম দিলে ওইরকম ব্যক্তিগত লেখা-টেখা
দিয়ে গাড়ির নম্বর প্লেট করা যায় এখানে।
কিম বলল, “ওইরকম বিদঘুটে
গোলাপি রঙের গাড়ি আলাদা করে অর্ডার দিয়ে না করালে পাওয়া যায় না। যাদের
বাড়তি অর্থ আছে তারাই ওইসব করে। দিশার মনে
হয় গোলাপি রঙ খুব পছন্দ। আমাকে তো কেটে ফেললেও আমি ওই রঙের
গাড়ি চালাব না! তবে হ্যাঁ, ওই রঙের গাড়ি তো রাস্তায় আর দ্বিতীয়টি নেই, তাই পিছু
নিতে খুব সুবিধা।”
তাই শুনে রিয়া হি হি করে
হাসল।
কিছুদূর গিয়েই কিম বলল, “আমি
জানি ও কোথায় যাচ্ছে।”
“কোথায়?”
“গোল্ডেন লেন।”
“ও, মিসেস পার্কারের বাড়ি।
তার মানে ও কি অস্কারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।”
দিশা গোল্ডেন লেনে ঢোকার আগেই
একটা দোকানে নিজের গাড়িটা পার্ক করল। তারপর নেমে পায়ে হেঁটে মিসেস পার্কারের
বাড়িতে ঢুকল।
সেই দেখে কিম বলল, “কী চালাক
মেয়ে দেখেছ! পুলিশ কিছু বললে ভাজা মাছটি উলটে খেতে না পারার ভান করে বলবে, ‘আমি তো
দোকানে খাবার-দাবার কিনতে গিয়েছিলাম!’। সেইজন্যে দোকানের পার্কিং লটে পার্ক করেছে।
ফেরার সময় নিশ্চয়ই টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে নেবে পুলিশকে রিসিপ্ট দেখানোর জন্যে।”
মিনিট পনেরো পরই বেরিয়ে এল
দিশা। কিমের কথামত সুপার সেভার দোকানটায় ঢুকে গেল। একটু পরেই দুটো ব্যাগভর্তি
জিনিস হাতে বেরিয়ে এল। ব্যাগদুটোকে গাড়িতে রেখে বাড়ির দিকে চলল।
রিয়া বলল, “আর ওর সঙ্গে কথা
বলতে যাব না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল ওর বাড়ি গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করব কী
ব্যাপার।”
“ওই অস্কারই মনে হয় সাদা কোট
পরে হাসপাতালে ঢুকে স্যালাইনের বোতল বদল করার কাজটা করেছিল।”
“হ্যাঁ, হতেই পারে। আচ্ছা,
এমিলি এখন কেমন আছে? তোমার বাবা সেটা নিয়ে কিছু বললেন?”
“ভালোই আছে মনে হয়। দুর্গের
মতন পাহারা দেওয়া হচ্ছে ওকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়লেই ওর মা-বাবা ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে
চান। যাক, কাল দেখা হবে, শুভ রাত্রি!” বলে কিম রিয়াকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে
চলে গেল।
রিয়া গাড়ি কেনেনি এখনও, তাই
বাসের রুটের বাইরে কোথাও যেতে হলে কিমই ভরসা। কিম অবশ্য ওকে কোথাও নিয়ে যেতে কখনও
না করে না।
ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে
খাবারগুলো বার করে গরম করতে লাগল রিয়া। ভাগ্যিস আগেরদিনের রান্না করা চিকেন কারি,
আলু ফুলকপি আর ভাত রয়েছে। না হলে ম্যাগি খেতে হত। এত
ক্লান্ত যে রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না মোটেই।
(৭)
পরদিন খুব ভোরে দিশার ফোনটা
এল। রিয়া ধরতেই ওপাশ থেকে দিশা বলল, “দিদি, তুমি আজ একটু সকাল সকাল কলেজে আসতে
পারবে? তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।”
রিয়া জিজ্ঞেস করল, “কত
সকালে?” সে তখনও বিছানা ছাড়েনি। ঘড়িতে দেখল
৬.৩০।
“এই ধরো, ৭.৩০ নাগাদ। আমার
আটটা থেকে ক্লাস আছে।”
“ঠিক আছে, আমি আসছি।
ক্যাফেটেরিয়াতে দেখা করব। কফি লাগবে আমার।”
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায়
কলেজের ক্যাফেটেরিয়াতে পৌঁছে রিয়া দেখল দিশা একটা টেবিলে দুটো কফি আর মাফিন নিয়ে
বসে আছে। রিয়াকে দেখে হাত নাড়ল। ওর কাছে গিয়ে বসতে ও বলল, “আজকের কফি আর মাফিনটা
আমি খাওয়াচ্ছি। কাল কী হবে কে জানে!”
রিয়া গরম কফিতে চুমুক দিয়ে
বলল, “কী বলতে চাইছিলে বল! আমারও বেশ কিছু প্রশ্ন আছে তোমার জন্যে।”
“ও, তাহলে তুমিই আগে জিজ্ঞেস
কর, কী জানতে চাও।”
মাফিনে একটা কামড় বসিয়ে রিয়া বলল,
“তুমি অস্কার ম্যাথিউকে চেন?”
দিশার চোখ কপালে উঠল। সে
বলল, “তুমি কী করে জানলে তার কথা?”
“কী করে জানলাম সেটা আর তোমার
জেনে কাজ নেই। তুমি ওকে চেন কি না বল।”
“না দিদি, একদম না!”
“মিথ্যে কথা কেন বলছ দিশা?
কাল রাতে তুমি ওর বাড়িতে গিয়েছিলে সেটা অস্বীকার করতে পারবে তুমি?”
দিশা বলল, “না, সেটা তো আমি
অস্বীকার করছি না। আমি কাল ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাহলে পুরোটাই বলি শোনো। পরশুদিন
আমি মিসেস পার্কার বলে একজনের ফোন পাই। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি অস্কার
ম্যাথিউ নামের কাউকে চেক দিয়েছি ওনাকে দেওয়ার জন্যে। সেই চেকটা ব্যাঙ্কে দিলে
বাউন্স হবে কি না সেটাই ছিল ওনার প্রধান প্রশ্ন। আমি
তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনি তখন ওনার বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা
বললেন। আমি সব শুনে বললাম, কে অস্কার আপনার বাড়িতে ভাড়া নিচ্ছে তাকে আমি কেন চেক
দিতে যাব? তাতে মহিলা বেশ রেগে গিয়ে ধাপ্পাবাজ, দু’নম্বরি এইসব বলে গালাগাল দিতে
লাগলেন আমাকে! যাই হোক, ফোন ছেড়ে চেকবইটা খুঁজতে গিয়ে দেখি সেটাকে আর পাচ্ছি না!
আমার চেকবইটা মনে হয় হারিয়ে গেছে এবং কেউ একজন সেটা পেয়ে আমার নামে চেক কেটে একে
ওকে দিচ্ছে।”
“কিন্তু ওই চেকটাতে তোমার সই
আছে,” রিয়া জানাল।
“সই নকল করা এমন কী শক্ত কাজ
দিদি? যাই হোক, আমার খুব রাগ হচ্ছিল ওই অস্কার লোকটা আর তার বাড়িওয়ালি মিসেস
পার্কারের ওপর। কী করে লোকটা আমার চেকবই চুরি করল আমি জানি না। কাল বিকেলে তাই আর
থাকতে না পেরে আমি দোকানে খাবার কিনতে যাওয়ার ভান করে ওর কাছে গিয়েছিলাম।”
“কী বলল লোকটা?”
“আচ্ছা নির্লজ্জ লোক! কিছুই
বলল না, খালি খ্যাক খ্যাক করে হাসছিল। যেন কী মজার
ব্যাপার! শুধু বলল, ‘আমার অবস্থায় এসে পৌঁছলে নিজেরটা ছাড়া অন্য কারও কিছু দেখার
সময় বা সুযোগ থাকে না। আগে নিজে খেয়ে পরে বাঁচা, তারপর তো অন্য কিছু!’ কী বিশ্রী
কুটিল হাসিটা ওর! আমি যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে ও আমার চেকবই চুরি করেছে কি না তখন
ও সোজাসুজি না বলে দিল। এখন ওর মতন বদমাইশ জেলে থাকা আসামী সত্যি কথা বলবে না
সেটাই তো স্বাভাবিক। ফলে আমি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়েছি।”
রিয়া বলল, “কিন্তু তুমি এইরকম
করতে থাকলে তো তোমার কথাও বিশ্বাস করা মুশকিল হয়ে পড়ছে!”
দিশার মুখ কালো হয়ে গেল। সে
ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাকে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। ওই
অস্কারকে আমি চিনি না। কাল রাতের আগে জন্মেও দেখিনি। ও কী
করে আমার চেকবই পেল আমি জানি না। এমিলির সঙ্গে আমার খাবার নিয়ে বনিবনা হত না ঠিকই,
কিন্তু তার জন্যে ওকে আমি প্রাণে মারতে যাব কেন? আমি কি এতটাই বোকা যে মেডিকেল
স্কুল সবকিছু খুইয়ে জেলে গিয়ে বসে থাকব?”
রিয়ার হঠাৎ কী মনে হতে সে
বলল, “তোমার গাড়িটা...”
দিশা মাথা নাড়ল, “আর বোলো না!
আমার মা-বাবা ওটা আমার মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আমাকে উপহার দেন। বাড়াবাড়ি
করে ফেলেছেন অযথা। আমার গোলাপি রঙ পছন্দ বলে ওটাকে স্পেশাল অর্ডার
দিয়ে গোলাপি রঙ করিয়েছেন। আমার গোলাপি রঙ পছন্দ সে বিষয়ে কোনও
সন্দেহ নেই, তবে গাড়িতে নয়। আমি
বাবা-মাকে প্রচুর ধমকেছি ওটার জন্যে, কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে।”
রিয়া বলল, “তোমার দাদার সঙ্গে
একবার কথা বলতে চাই, ওনার কী মত সেই নিয়ে।”
দিশা বলল, “নিশ্চয়ই! দাদা
রয়েছে বটে এখানে, কিন্তু সবসময় হয় ফোনে নয়তো কম্পিউটারে ব্যস্ত। আসলে আমাদের বেশির
ভাগ ব্যবসাগুলোই ও সামলায় তো, তাই। এদিকে আমার বাড়িতে নেট ঠিকঠাক আসছে না, খুব
স্লো। তাই ওকে বাইরে গিয়ে নেট করতে হচ্ছে। তুমি আজ
বিকেলে চলে এসো, আমি ওকে বলে রাখব বাড়িতে থাকতে।”
আরও কয়েকটা কথা বলে দিশা
ক্লাস করতে চলে গেল।
তিনটে নাগাদ রিয়ার কাছে একটা
টেক্সট এল দিশার কাছ থেকে। তাতে সে বলেছে, ‘আমি আর দাদা আজ বিকেলে অ্যালোওয়েজে
থাকব সাড়ে আটটা নাগাদ। ওখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে?’
রিয়া তো মাথামুন্ডু কিছুই
বুঝতে পারছিল না। কিমকে টেক্সটটা দেখাতে সে বলল, “অ্যালোওয়েজ তো একটা রেস্তরাঁ।
ওরা মনে হয় ওখানে খেতে যাবে। ওর দাদার খাবার সময় ছাড়া আর সময় হয়নি মনে হচ্ছে।
ঠিক আছে, চলো অ্যালোওয়েজেই যাওয়া যাবে। এখান থেকে একটু দূরে, গাড়িতে আধঘন্টামতন
লাগবে। বল তো আমরা ওখানে ডিনারও সেরে নিতে পারি,” বলে মুচকি হাসল।
রিয়া বলল, “পাগল! আমি ওই
কাঁচা পাতা আর কাঁচা মাংস খাওয়ার জন্যে কিছুতেই এককাঁড়ি দাম দেব না।
তোমার ইচ্ছে হলে তুমি খেও, আমি বসে থাকব।”
কিম হি হি করে হাসল, “আমাদের
বাড়িতে তো ছ’টা সাড়ে ছ’টা নাগাদ ডিনার খাওয়া হয়ে যায়।
তাই সাড়ে আটটা তো ঢের দেরি! যাক, তাহলে আমরা দুজনেই ওখানে খাব না, শুধু ওদের সঙ্গে
দেখা করব আর চলে আসব।”
“হ্যাঁ।”
“আমি ৭.৪৫ নাগাদ তোমাকে তুলে
নেব তোমার ওখান থেকে। আধঘন্টা লাগবে যেতে। তাহলে আমরা
মিনিট পনেরো আগেই পৌঁছে যাব। ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, সেটাই ভাল।”
কিম ঠিক সময় গাড়ি নিয়ে রিয়ার
বাড়িতে এসে হাজির হল। রিয়া তৈরিই ছিল। হর্ন শুনেই দরজা-টরজা বন্ধ করে গাড়িতে গিয়ে
বসল।
রাস্তায় বেশি গাড়ি-টাড়ি ছিল
না। তাই আধঘন্টার মধ্যেই ওরা অ্যালোওয়েজের কাছে
পৌঁছে গেল। অন্ধকার হয়ে গেছে। এদিকে পার্কিং লটে তেমন আলো-টালো নেই।
কেমন যেন অন্ধকার ঘুপসিমতন।
কিম বলল, “আমার কেমন যেন ভালো
লাগছে না জায়গাটা। আমি কেবল একবার দিনেরবেলায় এখানে এসেছিলাম । রাতেরবেলা যে এইরকম
হয়ে যায় জায়গাটা আমার জানা ছিল না।”
রিয়া বলল, “হ্যাঁ, আমিও তো
কখনও আসিনি এখানে। এইরকম জানলে আসতাম না।”
ওরা গাড়ি থেকে নামার আগেই দমাস
করে একটা লোহার রডের বাড়ি পড়ল গাড়ির পিছনের কাচে। ঝন ঝন করে কাচ ভেঙ্গে গুঁড়ো
গুঁড়ো হয়ে গেল। কে যেন একটা জঘন্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে চলেছে।
রিয়া চিৎকার করে কিমকে বলল,
“এখান থেকে পালাও এখুনি! এটা ফাঁদ!”
কিম গাড়ি ঘুরিয়ে প্রচন্ড
গতিতে ফেরার রাস্তায় নেমে পড়ল। একটা লোক দৌড়ে ওদের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু কিম স্পিড তুলে দিয়েছিল বলে ওদের ধরতে পারল না।
দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণে
গাড়ি চালাতে লাগল কিম। বলল, “এখন বেশি স্পিডের জন্যে পুলিশ
ধরলেও ক্ষতি নেই, বরং ভালোই হবে।”
মাইল পাঁচেক যাওয়ার পর যখন দেখা
গেল পেছনে কোনও গাড়ি-টাড়ি কিছু নেই তখন স্বাভাবিক গতিতে নেমে এল সে। রিয়া বলল, “সরি,
আমারই দোষ। আমার বোঝা উচিত ছিল এটা ফাঁদ। শুধু শুধু তোমার গাড়িটার
ক্ষতি হল।”
“তোমার তো বোঝার উপায় ছিল না।
টেক্সট তো দিশার ফোন থেকেই এসেছিল।”
“হুঁ, চল তো একবার ওর বাড়ি।
গিয়ে দেখি সে আছে কি না।”
দিশার বাড়ি গিয়ে দিশা আর ওর
দাদা দুজনকেই পাওয়া গেল।
ওদের দেখে দিশা বলল, “কত দেরি
হল তোমাদের আসতে! আমরা তো সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছি তোমরা আসবে বলে।”
ওর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে
রিয়া জিজ্ঞেস করল, “তোমার ফোন কোথায়?”
“কেন? ফোন এই তো আমার কাছে
রয়েছে!” বলে দিশা হাতের ফোনটা তুলে দেখাল।
“তাহলে ওতে পাঠানো
মেসেজগুলোতে দেখো। তুমি আমাকে দুপুর তিনটে নাগাদ টেক্সট
করে বলেছিলে অ্যালোওয়েজে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে। আমরা সেখানেই গিয়েছিলাম।
ওখানে কিমের গাড়ির ওপর হামলা হয়। ওর গাড়ির পেছনের কাচটা ভেঙে গেছে। কোনওরকমে
পালিয়ে এসেছি আমরা!”
দিশা তাড়াতাড়ি মেসেজ খুঁজে
দেখতে লাগল। কিছু নেই।
রিয়া বলল, “তার মানে ডিলিট
করা হয়েছে। এই দেখো, আমার ফোনে রয়েছে এখনও!” বলে টেক্সটটা খুলে দেখাল।
কিম জিজ্ঞেস করল, “তোমার ফোন
কি হাতছাড়া হয়েছিল কখনও?”
দিশা বলল, “হ্যাঁ, ক্লাসেই
ভুলে ফেলে এসেছিলাম সকালে। পরে যখন মনে পড়ল তখন ক্লাসরুমে গিয়ে দেখলাম নেই। শেষে
লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টে ফোন করতে ওরা বলল ওদের কাছে রয়েছে। কেউ একজন
ওটাকে দেখতে পেয়ে ওদের কাছে জমা দিয়েছিল। কী সাংঘাতিক! তার মানে ওই সময়টাতেই কেউ
আমার ফোন থেকে তোমাকে ওই মেসেজটা করেছে! আরে, অ্যালোওয়েজে আমরা কোনওদিন যাই না!
ওখানে তো সব মাংস দেওয়া খাবারই বেশি! আমরা ওসব খাইই না!”
দিশার দাদা সব শুনে
ব্যাপারটার জন্যে খুব ক্ষমা-টমা চাইলেন। বললেন, কিমের গাড়ির কাচের দামটাও দিয়ে
দেবেন। সেটা শুনে অবশ্য কিম খুব খুশি হল। ইন্সুরেন্স কম্পানিকে দিয়ে কাচ সারালে
ওরা প্রিমিয়াম প্রচুর বাড়িয়ে দেবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
দিশার দাদা বললেন, “কী যে
হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি দিশাকে বলছি এখানকার মেডিকেল স্কুল ছেড়ে বাড়ি
ফিরে আসতে, কিন্তু ও শুনবে না। এই প্রোগ্রামটা নাকি খুব ভালো, সবাই সুযোগ পায় না
এইসব বলছে। তাছাড়া ওর এখানে ভালো লাগছে। কিন্তু আমার তো খুব মুশকিল হচ্ছে। এখান
থেকে ব্যবসার কাজ চালানো খুব মুশকিল। ফোনের
সিগনালের সমস্যা, ইন্টারনেট ঠিকমতো পাচ্ছি না। এদিকে মা-বাবা কিছুতেই আমাকে দিশাকে
এখানে একা ফেলে ফিরতে দেবেন না। আমার হয়েছে জ্বালা। এত কুসংস্কার ওনাদের! বলছেন,
কোনও শত্রুর কু-দৃষ্টি পড়েছে দিশার ওপর। তাই কীসব
পুজোটুজো করাচ্ছেন। কে বোঝাবে ওনাদের? মোট কথা ব্যাপারটার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত
আমাকে এখানেই থাকতে হবে।”
“আপনি ওই অস্কার লোকটাকে
চেনেন?”
“না, না। দিশাকে খুব বকেছি
আমি ওর কাছে যাওয়ার জন্যে। লোকটা খুনে বদমাইশ, কী করে বসবে তার কোনও ঠিক আছে?
বোঝাই যখন যাচ্ছে যে ওর হাত আছে, তখন ওর সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে যাওয়াটা খুব
বোকামি হয়েছে। আর পুলিশেরও বলিহারি যাই, দিশা একটা পিঁপড়ে
পর্যন্ত মারে না আর সে কিনা মানুষ খুন করবে, সেটা ভাবাটাই ওদের অন্যায়! আমি ওদের
কাজে মোটেই সন্তুষ্ট নই। ওপর মহলে কথা বলব ভাবছি।”
পুলিশের নামে বাজে কথা শুনে
কিমের মুখটা লাল হয়ে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না সে।
দিশা দাদাকে থামাতে চেষ্টা
করছিল, “দাদা, ওসব বলার কী দরকার? পুলিশ যা করার তো করছে। ওরা যে আমাকে জেলে পুরে
দেয়নি সেটাই তো অনেক বড়ো ব্যাপার!”
তাও ওর দাদা ছাড়বেন না।
বলেই চললেন, “আমার মনে হয় এমিলি বা ওর পরিবারের কেউ অস্কারকে লাগিয়েছে। দিশার চেকবইটা
চুরি করে তার থেকে চেক কেটে নিজেই মিসেস পার্কারকে দিয়েছে। কী যে চলছে বুঝতে পারছি
না!” বলে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন তিনি।
রিয়া আর কিম আর বসল না। দিশা
ওদের খেয়ে যাওয়ার জন্যে বলছিল। কিন্তু ওরা
দুজনেই খাওয়া হয়ে গেছে বলে কাটাল। বাইরে বেরিয়ে কিম বলল, “বাপ রে! ওর ওই দাদার
সামনে দিশা তো কিছুই নয়! ওর দাদাটা কী ভয়ঙ্কর বস্তু! দাঁড়াও, আজ বাবাকে গিয়ে বলব।”
রিয়া বলল, “না না, উনি মনে হয়
বোনের জন্যে টেনশানে ওইরকম ব্যবহার করছেন। তাই ওনার
কথায় রাগ করার দরকার নেই। তারপর এখান থেকে বিজনেস সামলাতে হচ্ছে...”
“তা বলে সব দোষ পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়ে
দিতে হয় বুঝি? নিজের বোন এদিকে ঝগড়া করে একের পর এক রুমমেটকে
তাড়াচ্ছে, তার বেলা কিছু না! আর অত বড়লোক যখন তখন শেয়ার করে থাকাই
বা কেন? নিজের আলাদা বড়ো বাড়ি নিয়েই তো থাকতে পারে!”
“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কলেজ
ক্যাম্পাসে গোটা বাড়ি পাওয়া মুশকিল। এত অ্যাপলিকেশান
জমা পড়ে যে ওরা কূল পায় না। আর যারা
ফ্যামিলি নিয়ে থাকে তাদের আগে দেওয়া হয়। আর ক্যাম্পাসের
বাইরে গেলে তো বেশ কিছুটা দূরে হয়ে যাবে। তখন
সকালে উঠে গাড়ি চালিয়ে আসতে হবে, সেটা তো হ্যাপা!”
কিম শুনে শুধু ‘হুঁ’ বলল। বোঝাই
যাচ্ছিল দাদা বা বোন কারও প্রতিই ওর কোনও সহানুভূতি নেই।
(৮)
পরদিন এমিলির সঙ্গে দেখা করতে
গেল রিয়া আর কিম। সে এখনও হাসপাতালে। বেশ দুর্বল, তবে সেরে উঠছে। ওর ঘরের বাইরে
এখনও পুলিশ পাহারা। কিম বাবার কাছ থেকে বিশেষ অনুমতিপত্র নিয়ে এসেছে। সেটা আর আইডি
ইত্যাদি দেখে তবে ওদের ঢুকতে দেওয়া হল।
ওরা সঙ্গে করে কিছু ফুল আর
একটা ছোটো টেডি বিয়ার নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো পেয়ে এমিলি খুব খুশি। একেবারে বাচ্চা মেয়ের
মতন ভাল্লুকটাকে নিয়ে বালিশে শোওয়াল। তারপর বলল,
“না, দিশা যে আমাকে মেরে ফেলতে চায় সেটা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার
মা-বাবা যত যাই বলুক, দিশা কিন্তু ওই এক খাবার ব্যাপার নিয়ে ছাড়া আমার সঙ্গে বাজে
ব্যবহার করেনি। আমাকে পড়ায় সাহায্য করত। মাঝে একবার আমার জ্বর হয়েছিল।
তখন ও-ই আমার জন্যে ওষুধ ইত্যাদি এনে দিয়েছিল। প্রথমদিকে আমি লেকচার আর পড়ার চাপে
হিমশিম খেতাম যখন, ও আমার লন্ড্রিও করে দিয়েছে বার দুয়েক। তাই আমি ওর প্রতি
কৃতজ্ঞ। আমার খুব অ্যালার্জির ধাত আছে। তাই ও যখন মশলা
দিয়ে রান্না করত তখন আমার প্রবল হাঁচি আসত। সেইজন্যে আমি ওকে বারণ করতাম। তবে
জানালা-টানালা খুলে দিলেই আবার ঠিকও হয়ে যেত। মুশকিলটা শীতকালে বেশি হবে।
কারণ, তখন ঠান্ডার জন্যে জানালা খোলা যাবে না। সেটা ভেবেই আমি অন্য ঘরে ট্রান্সফার
চেয়েছিলাম।”
“তুমি তো বুঝতে পারনি যে
তোমার ভিটামিন ক্যাপসুলগুলোকে কেউ নাড়াচাড়া করছিল?”
“না না, বুঝতে পারলে তো ফেলে
দিতাম ওগুলোকে!”
“তুমি তোমার বেডরুমের দরজায়
তালা দিয়ে রাখো?”
“না, প্রায়ই ভুলে যাই। শুধু
দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যাই। বাড়িতে ঢোকার সদর দরজাটাতে অবশ্য তালা দিতে ভুলি না।
ওটাতে তালা দেওয়া থাকে বলেই বেডরুমে তালা দিই না। আসলে সকাল সকাল বেরোতে হয় তো,
তখন তাড়া থাকে।”
“তুমি কি অন্য কলেজে
ট্রান্সফার নেবে?”
“না না! এটা এত ভালো কলেজ!
আমি এখান থেকে যেতে চাই না মোটেই! পুরোপুরি সেরে উঠলেই আমি কলেজে যাব। দিশার সঙ্গে
আর শেয়ার করে থাকতে পারব না অবশ্য। মা-বাবা ওই বাড়িতে আমাকে ফিরতে দেবেন না আর
কিছুতেই।”
আরও কয়েকটা কথা বলে ওরা
বেরিয়ে এল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা কিম বাবাকে
নিয়ে রিয়ার বাড়িতে এসে হাজির। অত বড়ো দুঁদে পুলিশ অফিসারের সামনে পড়লে অনেকেই ভয়ে
কেঁচো হয়ে যায়। অফিসার ডি মার্কোর বিশাল চেহারা। চোখগুলো অবশ্য খুব হাসিখুশি। রিয়ার
বাইরের ঘরের পুঁচকে সোফায় বেশ কষ্ট করে বসে উনি বললেন, “দেখো রিয়া, দিশার
ব্যাপারটা ক্রমে আরও বেশি প্যাঁচালো হয়ে চলেছে। অস্কারকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি,
কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তাই আমরা কিছু টোপ ফেলব ভাবছি। তুমি যাতে আশ্চর্য হয়ে কিছু
না করে বসো তাই তোমাকে বলতে এলাম। সিনেমা ইত্যাদিতে যেরকম দেখ, সেরকম মারাত্মক
কিছু নয়! আমরা শুধু রটিয়ে দেব যে আমরা জেনে গেছি কে দোষী খুব আশ্চর্যজনক কিছু
ক্লুয়ের সাহায্যে এবং শীঘ্রই তাকে অ্যারেস্ট করা হবে। এই গুজবটা ছড়িয়ে পড়লে তারপর
কী হয় আমরা দেখতে চাই। কারণ, বুঝতেই পারছ আমাদের এখানকার ডিপার্টমেন্ট খুবই ছোটো। বেশি
লোকবল নেই আমাদের। এমিলিকে সবসময় পাহারা দেওয়ার মতন অবস্থা আমাদের নয়। এদিকে দিশাও
আমাদের দিব্যি বোকা বানিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তাই টোপ ফেলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা দিয়ে যদি ব্যাপারটার একটা হিল্লে হয়ে যায়
তাহলে তো ভালোই হয়। কী বলো?”
রিয়া বলল, “সে তো ভালই হবে।
কিন্তু অপরাধী যদি টোপটা না গেলে, তাহলে?”
“সে না খেলে না খাবে, তাতে
ক্ষতি কিছু হবে না। আমরা এখন যে অবস্থাতে রয়েছি সেই অবস্থাতেই থাকব। তাছাড়া সেও তো
মানুষ, তার মনেও তো ভয় আছে। মনে হয় সে টোপ গিলবে।”
“তা ঠিক।”
“আরেকটা টোপ ফেলা হবে। তাতে
তোমাদের বিশেষভাবে সাহায্য চাই।”
“ও বাবা! আমি আবার কী করব?”
“না না, তেমন কিছু করতে হবে
না। আসলে এমিলিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাড়া পেয়ে এমিলি এখানে কলেজের
কাছের একটা বাড়ির একতলায় থাকবে। সেটাই বলে দেওয়া হবে।
কিন্তু আসলে এমিলি নিজে এখানে থাকবে না। থাকবে তুমি
আর কিম। এমিলি ঠিক আছে, কিন্তু এখনও খুব দুর্বল।
ওকে দিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কারণ, বিপদ
হলেও হতে পারে আবার কিছু নাও হতে পারে। দরজায় পুলিশ পাহারা থাকবে, তাই তোমাদের
ভয়ের কিছু নেই। তাও বলা তো যায় না।”
“ঠিক আছে। এটা কবে?”
“এটাও কাল। এখন কাল কিছু নাও
হতে পারে। দুয়েকদিন লেগে যেতে পারে জানাজানি হতে
ব্যাপারটার।”
“আশাকরি যা হওয়ার তাড়াতাড়িই
হয়ে যাবে। পরের সপ্তায় আমার একটা বড়ো প্রেজেন্টেশান আছে।
সেটার জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে।”
“আশা করা যাচ্ছে কয়েকদিনের
মধ্যেই ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত হবে।”
“আমার ভয়ের কিছু নেই।
কিম তো ক্যারাটে জানে!” রিয়া হাসল।
কিম অবশ্য হাসল না। ব্যাজার
মুখ করে বলল, “কিন্তু যে আসবে সে যদি বন্দুক নিয়ে আসে, তাহলে? বন্দুকের সামনে
ক্যারাটে দিয়ে কী করব?”
(৯)
পরদিন বিকেলে পুলিশের গাড়ি
এসে ওদের নিয়ে গেল। হাসপাতালে গিয়ে রিয়াকে রুগিদের গাউন আর টুপি পরিয়ে হুইল চেয়ারে
বসানো হল। তারপর সেই চেয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। কিম এমিলি বা রিয়ার চেয়ে
অনেকটা লম্বা আর স্বাস্থ্য ভালো। তাই সে নার্স সেজে হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে চলল।
অ্যাম্বুলেন্স ওদের দুজনকে নিয়ে এমিলির তথাকথিত বাড়িতে গিয়ে হাজির হল।
ইতিমধ্যে এমিলি টেক্সট করে
দিশাকে তার নতুন ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে, আর বলেছে ওর মা-বাবা পরে গিয়ে ওর জিনিসগুলো
নিয়ে আসবেন। দিশা টেক্সটের উত্তর দিয়ে লিখেছে, ‘আমি সুযোগ পেলে আজ বিকেলেই গিয়ে
তোমার কিছু দরকারি জিনিস দিয়ে আসব। বাকি যা আছে সেসব পরে নিলেও হবে’।
এমিলির কাছে সেই টেক্সট দেখে
কিমের বাবা তো দারুণ খুশি।
ওরা বাড়িটাতে ঢোকার পর বাইরে
একজন পুলিশ রইল পাহারায়। জানালা সব বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে দুজনে যে যার মতন কাজ
করতে লাগল। রিয়া কেবল একবার বলল, “আমার কিন্তু একটু খুঁত খুঁত লাগছে। দিশার
মোটিভটা বড্ড দুর্বল মনে হচ্ছে না?”
কিম বলল, “হ্যাঁ, আমারও তাই
মনে হচ্ছে। শুধু মাত্র মাংস খায় বলে একজনকে মেরে ফেলবে, ব্যাপারটা ঠিক যেন বিশ্বাস
করা যাচ্ছে না।”
রাত এগারোটা নাগাদ কিম বলল,
“ধুস, আমি ঘুমোতে চললাম। আজ আর কেউ আসবে না। তুমিও শুয়ে পড়ো।
কাল কী হয় তার ঠিক নেই। আমি শুধু রস্কোকে গুড নাইট বলে দিই। ও
বেচারা তো সারারাত জাগবে,” বলে দরজা খুলে মুখটা বাড়াল সে। কিন্তু রস্কোকে দেখতে
পেল না।
দরজাটা বন্ধ করে সে বলল,
“ব্যাপারটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। রস্কোর তো
দরজার কাছেই থাকার কথা, কিন্তু নেই! কোথায় গেল? বাবা তো বলেছিলেন ও নিজের কাজ
অবহেলা করে না কখনও! দেখি, বাবাকে ফোন করি।”
কিম বাবাকে ফোন করতে যাচ্ছিল।
এমন সময় রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, “গন্ধ! গ্যাসের গন্ধ! কিম, পালাও এখান থেকে!” বলে সে
দরজা খুলে কিমকে হ্যাঁচকা টান মেরে বাইরে ছুটল। ওরা বেরোবার কয়েক সেকেন্ড পরেই
কাঠের বাড়িটা ভুস করে জ্বলে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে জতুগৃহের মতন সারা বাড়িটা দাউদাউ
করে জ্বলতে লাগল। বাগানে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন অসহায়ভাবে
আগুনের সেই তান্ডবলীলা দেখল।
একটু পরেই পুলিশের গাড়ি,
অ্যাম্বুলেন্স সব এসে পড়ল। রস্কোকে অজ্ঞান অবস্থায় পেছনের বাগানে পড়ে থাকতে দেখা
গেল। ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছিল।
রিয়া বা কিম দুজনের কেউই
বুঝতে পারেনি কখন কেউ একজন রস্কোকে কাবু করে, নিঃশব্দে বাড়িটায় ঢুকে গ্যাসের লাইন
খুলে দিয়ে গেছে। পুলিস প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেসাবাদ করতে তাদের একজন বলল সে নাকি একটা
গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল কিছুটা দূরে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারেনি, তবে গাড়িটার
রঙ গোলাপি হলেও হতে পারে।
(১০)
বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছিল
দিশা। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। কাঁহা তক আর গল্পের বই, পড়ার বই পড়ে, টিভি দেখে
বা ভিডিও গেম খেলে সময় কাটানো যায়? এমনিতেও ওর ভিডিও গেম খেলতে ভালো লাগে না মোটেই।
ওগুলো সব দাদার পছন্দের জিনিস। এদিকে দুপুর থেকেই ফোনটা আবার খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ
বাড়িতে এনেছিল ওর স্পষ্ট মনে আছে। সোফার গদিগুলো তুলে খুঁজে দেখল, মাঝে মাঝে খাঁজে
পড়ে যায় ফোনটা। নাহ্, এখানেও নেই। কী যে হচ্ছে! এদিকে দাদা আবার বেরিয়েছে। দাদার
ব্যাগে মাঝে মাঝে অফিসের একটা দুটো বাড়তি ফোন থাকে সেই ভেবে দিশা দাদার ব্রিফকেসটা
খুলল। একটা ফোন পেলে অন্তত কোনও বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা যাবে। রাত অনেক হয়েছে, তবে
ওয়েস্ট কোস্টে ওর যেসব বন্ধুরা আছে তারা তো তিন ঘন্টা পেছনের সময়ে রয়েছে।
তাই তারা জেগে থাকবে।
নাহ, ব্রিফকেসে শুধু একগাদা
কাগজ, ফোন-টোন কিছু নেই। তাও পকেটগুলোতে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে দেখত লাগল দিশা, যদি
কিছু থাকে ভেবে। একটা পেছনের দিকের পকেটে হাত ঢোকাতে কী একটাতে হাতটা ঠেকে গেল।
ভালো করে দেখার জন্যে জিনিসটাকে টেনে বার করল দিশা। ওমা, একটা চেকবই। তবে যে সে
চেকবই নয়! ওর সেই হারানো চেকবইটা! দিশার মাথাটা ঘুরে গেল। ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল
সে। দাদা! চেকবইটা খুলে আর একটা জিনিস ও পেল। কী করবে সে বুঝে ওঠার আগেই বাইরের
দরজায় বেল পড়ল। দিশা এতটাই ঘোরের মধ্যে ছিল যে কিছু না দেখে না জিজ্ঞেস করেই
দরজাটা খুলে দিল। বাইরে রিয়া আর কিম দাঁড়িয়ে।
কেমন যেন কালো কালো ছাইমাখা দেখতে লাগছে ওদের। ওদের দেখে দিশা কেমন যেন ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে রইল।
“তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?”
কিম জিজ্ঞেস করল।
“না, আমার তো বাড়ি থেকে বেরোনো
বারণ! আমি তো এখানেই রয়েছি সারাক্ষণ।”
“এখুনি আমাদের প্রাণে মারার
একটা ভয়ানক চেষ্টা হয়েছে এবং তোমার গাড়িটাকে ওই এলাকাতেই দেখা গেছে।
সেই বিষয়ে তোমার কিছু বলার আছে?”
দিশা কেমন যেন একটু হতাশভাবে
মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“তোমার হাতে ওটা কী?” রিয়া
এবার জিজ্ঞেস করল।
“চেকবইটা।”
“মানে?”
“মানে, আমার যে চেকবইটা
হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা খুঁজে পেয়েছি।”
“কোথায় পেলে?”
উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি দিয়ে
ওদের দিকে তাকিয়ে দিশা বলল, “দাদার ব্রিফকেসে! একটা খাপের মধ্যে লুকানো ছিল। সঙ্গে
এটাও!”
বলে একটা ছবি ওদের বার করে
দেখাল। ছবিটায় চারজন রয়েছে। দিশা, দিশার দাদা আরও দুজন।
তারা ওদের মা-বাবা হবেন। ছবিটাতে দিশার মুখটা লাল কালি দিয়ে কাটা!
“তোমার দাদা!”
“হ্যাঁ, কী চলছে আমি ঠিক
বুঝতে পারছি না! এইসব দাদার কাছে কেন আমার মাথায় ঢুকছে না। বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে
যে দাদা কেন...”
“কেন, কঠিন কেন?”
ওরা চমকে ফিরে তাকাল। বন্দুক
হাতে দিশার দাদা ঘরে এসে ঢুকেছেন!
“জিগনেশ ভাইয়া!”
“একদম চুপ! নড়লেই গুলি করব।”
“কেন এসব করছ তুমি দাদা? আমি
তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
জিগনেশের মুখটা কেমন যেন
বেঁকে মতন গেল, ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়। পাগলের মতন উদ্ভ্রান্ত অস্বাভাবিক দৃষ্টি
তার। রিয়া আর কিমেতে চোখাচোখি হল। কিম হাতের সেল ফোনের ভিডিওটা অন করে ফেলেছে। সবকিছু
রেকর্ড হয়ে চলেছে।
জিগনেশ প্যাটেল বললেন, “আমার যখন ন’বছর বয়স তখন দিশা
এল। তার আগে আমি জানতামই না যে আমাকে দত্তক
নেওয়া হয়েছে! দিশা আসার পর আমি বুঝতে পারলাম পার্থক্য। সে যেন
রাজকন্যা! ওর জন্মের পর থেকে কেউ আমাকে পাত্তাই দিত না! তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না একটা ন’বছরের বাচ্চার পক্ষে
সেটা কতটা কষ্টকর। মা-বাবা সবসময় দিশাকে নিয়েই ব্যস্ত। ওর জামাকাপড়, ওর খাওয়া-দাওয়া। আমি
কাজের লোকেদের সঙ্গে বড়ো হতে লাগলাম। খুব
রাগ হত আমার তখন দিশার ওপর। তখনই
মনে হত ওর টুঁটি চেপে ধরে ওকে শেষ করে দিই! কিন্তু পারিনি,
অত সাহস তখন ছিল না। তাছাড়া
ওকে একা প্রায় পাওয়াই যেত না। ক্রমে
বড়ো হলাম, কলেজে গেলাম। কিছুই
বদলাল না। দিশার প্রতিটা সাফল্যে মা-বাবা যতটা গর্বিত হতেন, আমি কিছু করলে মোটেই হতেন না। কলেজের
পড়া শেষ করে আমি বাবার সঙ্গে বিজনেসে ঢুকলাম। ব্যবসায়
আমার মাথা ভালোই। তাই ধীরে ধীরে অনেকক’টা ব্যবসাই আমি পুরোপুরি
সামলাতে শুরু করে দিলাম। বাবারও বয়স হচ্ছে। আমার
হাতে সেগুলো তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন ভাবলাম। এদিকে
দিশা মেডিকেল কলেজে চান্স পেল। আমি
খেটে খেটে রোজগার করব আর মহারানি সেই অর্থ উড়িয়ে মেডিকেল পড়বেন! আশি হাজার ডলার টিউশান ফিস! এছাড়া থাকা-খাওয়া, বইপত্র আর আলাদা অন্য খরচ তো আছেই! কী হবে ডাক্তার হয়ে? তোর পারিবারিক ব্যবসা, অর্থের অভাব নেই। তুই সিটটা অন্য
কারো জন্যে ছেড়ে দে, তা না, তেনার শখ তিনি
মেডিকেল পড়বেন! আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা রোজগারে তিনি ফুর্তি
করবেন, বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করবেন! মাথায়
দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল আমার। তাও
অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজেকে শান্ত করেছিলাম যে যাক, ও ডাক্তারি পড়লে বিজনেসেগুলোর
দিকে তেমন মন দেবে না। সেগুলো তখন আমার হবে। কিন্তু
তারপর দেখতে পেলাম মা-বাবার উইলটা! এত কষ্ট করে
যেসব ব্যবসাগুলোকে দাঁড় করিয়ে সামলাই আমি, লাভের জন্যে
উদয়াস্ত খাটি, সেই সবক’টা বিজনেস কিনা দিশার নামে! আমি শুধু সিইও
হয়ে থাকব আর মাসে মাসে বাঁধাধরা একটা মাইনে পাব! এরপর যদি
কারও মাথা গরম না হয় তাহলে সে মানুষ নয়! এতটা পক্ষপাতিত্ব, হ্যাঁ?
তখন আমি ঠিক করলাম যে আমিও দেখে নেব। ওদের
আদরের মেয়েকে যদি সারাজীবন জেলে না পচাই তো আমার নামও জিগনেশ নয়! জেলে থাকলে তো আর সম্পত্তির কানাকড়িও সে ভোগ করতে পারবে না, আর মা-বাবাও তাদের পক্ষপাতিত্বের জন্যে যোগ্য শাস্তি
পাবেন! সেই চেষ্টা ওর প্রথম রুমমেটকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। যখন
দিশার সঙ্গে দেখা করতে এলাম তখন টুক করে ওর ওষুধের কয়েকটাতে একটু অন্যকিছু ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু
দুর্ভাগ্য, সেই প্রয়াস সফল হল না। এবারেও
একটুর জন্যে ফসকে যাচ্ছিল। এখানকার
পুলিশগুলোও যেন কেমন। ওর বিরুদ্ধে
এত অভিযোগ, তাও ওকে জেলে পুরছে না! মেয়েটা দু-দুবার বিষের
চোটে মরতে বসেছিল, ওর মোবাইল থেকে টেক্সট যাচ্ছে, ওর চেকবই থেকে অপরাধীরা চেক পাচ্ছে, তাও ওদের হেলদোল নেই! আর ওই অস্কার লোকটাও ভারী বোকা! কোনও কাজ যদি ওর দ্বারা
ঠিক করে হয়!”
দিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তাই
দেখে ওর দাদা কথা বলা থামিয়ে ওর দিকে বন্দুকটা ঘুরিয়ে বললেন, “অ্যাই, চোপ! কান্নাকাটি করলে এখুনি শেষ করে দেব!”
কেমন একটা উদ্ভ্রান্তের মতন দৃষ্টি
তার। মানসিক অবস্থা যে একেবারেই ভালো নেই সেটা
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।
রিয়া ঘরটার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল
ছুঁড়ে মারার মতন কিছু আছে কি না। জানালায়
একটা প্লাস্টিকের টবে একটা গাছ। সেটার
দিকে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল রিয়া। কিমকে
তার ক্যারাটে প্র্যাকটিসের সুযোগ দিতে হবে তো! টব ছুঁড়তে হল না। তার
আগেই কিম ক্যারাটের একটা মোক্ষম লাথি দিয়ে বন্দুকটা ওর হাত থেকে সরিয়ে দূরে ফেলে দিল। তবে
তার পর যা হল সেটা ওরা আশা করেনি। দেখা
গেল জিগনেশ প্যাটেলও ক্যারাটে জানেন! একলাফ দিয়ে এগিয়ে এসে
কিমের সঙ্গে...
তবে শুধু কয়েক সেকেন্ড সুযোগ পেলেন
তিনি। দিশা ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকা বন্দুকটা তুলে
নিজের দাদার দিকে তাক করে বলল, “একচুলও নড়বে না। এই ক’দিন
খুব জ্বালিয়েছ আমাকে। আমার ফোন সরিয়ে
সেটার থেকে মেসেজ, আমার চেকবই চুরি! তুমি যে এতটা নীচে নামবে
আমরা ভাবতেই পারিনি! তোমার সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার লুইস বলেছিলেন
তোমার সমস্যা আছে, কিন্তু আমরা তাতে কান দিইনি। আমাদেরই
ভুল! মা-বাবা ভেবেছিলেন, তুমি সেরে উঠেছ!”
তবে জিগনেশ প্যাটেল ভয় পাওয়ার
মতন লোক নয়। হা হা করে উন্মাদের হাসি হেসে তিনি দিশার
দিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু দিশার হাত থর থর কাঁপছিল। সে পারল
না নিজের দাদার ওপর গুলি চালাতে। ওর হাত
থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে ওর গলাটা চেপে ধরলেন জিগনেশ প্যাটেল। রিয়া
আর কিম পেছন থেকে ওকে টেনে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু লোকটার অসুরের মতন শক্তি। এক ইঞ্চিও
নড়ানো যাচ্ছিল না তাকে। তখুনি দুম করে
একটা শব্দ হল আর চিৎকার করে মাটিতে পড়ে ছটপট করতে লাগলেন তিনি। বন্দুক হাতে কিমের বাবা
আর পুলিশের আরও কয়েকজন এসে ঢুকল ঘরে।
“অস্কার ম্যাথিউ শেষ পর্যন্ত
ভেঙে পড়ে সব কবুল করেছে এই দশমিনিট আগে। কে আসল
অপরাধী সেটা আমরা বুঝতে পেরেই ছুটে এলাম!” কিমের বাবা অফিসার
ডিমার্কো বললেন।
(১১)
দিশার বাড়িতে বসেই কথা
হচ্ছিল। ওর মা-বাবা এসেছেন। ওর দাদা আপাতত হাসপাতালে।
তারপর জেল, রিহ্যাব এইসব চলবে কতকাল জানা নেই। দিশার
ফোনটাও তার কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিল।
দিশার মা গুজরাতি ছাড়া কিছু
তেমন বলতে পারেন না। তাই ওর বাবাই বলছিলেন, “তোমরা না
থাকলে দিশাকে হয়তো আর পেতামই না আমরা! জিগনেশের যে সমস্যা আছে আমরা জানতাম, কিন্তু
দিশার প্রতি ওর হিংসেটা ও আমাদের বুঝতে দেয়নি কোনওদিন। আমরা ভাবতাম বুঝি বা পড়া আর
কাজের চাপের জন্যে হচ্ছে। বিজনেস সামলাবার পর থেকে ভালোই ছিল। আমরাও খুশি ছিলাম।
কিন্তু ওর ভেতর ভেতর যে এইসব চলছে, কোনওদিন ভাবতেও পারিনি। আসলে
ওর যখন ন’বছর বয়স তখন ওর চিকেন পক্স হয়। দিশা তখন খুব ছোটো। তাই ওকে সরিয়ে রাখা
হয়, আর সেই কারণেই আমরাও দূরে থাকি। সেসময় ওর ঘর দোতলায় ছিল। সেখান থেকে জানালা
দিয়ে বেরিয়ে আমাদের ঘরে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পায়। সত্যি বলতে
কী, তখন জিগনেশের অবস্থা খুব খারাপ হয়। বাঁচবে কি না সে নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল।
যাক, ডাক্তারদের চেষ্টায় ও সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে ওই মাথায় চোট পাওয়ার পর থেকেই ও
কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করিয়েও কোন ফল হয়নি। এমনি সব ঠিকই ছিল,
স্বাভাবিক। কলেজ পাস করল, বিজনেসও দেখছিল ঠিকই।
কিন্তু অনেক সময় যা সত্যি নয় তাই ভেবে নিত।”
রিয়া বলল, “আসলে ওনাকে দত্তক
নেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা আর উইলে আপনাদের সবকিছু দিশাকে দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ওনাকে
খুব আঘাত করেছিল। হিংসেয় একেবারে পাগল করে দিয়েছিল!”
দিশার বাবা প্রায় কেঁদে ফেলে
বললেন, “দত্তক? কাকে জিগনেশকে? না না, তোমরা ভুল বুঝেছ। ও
তো আমাদের নিজেদের ছেলে। দিশাকে দত্তক নিয়েছি আমরা। ও
আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র মেয়ে। ওর বাবা মা পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। আর
উইল? কার উইল? আমরা তো কোনও উইলই করিনি এখনও!”
_____
ছবিঃ সুমিত রায় ও ইন্দ্রশেখর
Very nice story.
ReplyDeleteThank you
Deleteভাল লাগল
ReplyDeleteDhanyabad Arnab...tomar suggestion-ta mone thakbe :D
Deleteদারুন রহস্য উপন্যাস।শুরু থেকে শেষ পড়ে যেতে হয়।শেষটা আগেই অনুমান করেছিলাম।শেষের চমকটা বেশ ভালো।
ReplyDelete