প্রতিদান
রাখী আঢ্য
“বাবু কোথায় যাবেন?”
প্রশ্নটার মধ্যে এতটাই আন্তরিকতা
ছিল যে সে ডাক শেষ পর্যন্ত বিনয়বাবু উপেক্ষা করতে পারলেন না। লোকাল ট্রেনটা পৌঁছানোর কথা ছিল দুপুরে। কিন্তু মাঝরাস্তায় একটা মালগাড়ি
উলটে যাওয়ায় ট্রেনটা ধিকিয়ে ধিকিয়ে যখন গড়বেতা স্টেশনে পৌঁছালো তখন সূর্যি মামা
পাটে বসে গেছেন। গড়বেতা
অঞ্চলটা বেশ জঙ্গলাকীর্ণ। সন্ধ্যার পর তাই যান চলাচল কমে যায়। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। আসার পথে মাঝে মাঝেই দু-এক পশলা মাঝারি থেকে
বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি পেয়েছেন বিনয় বাবু। নেহাৎ উপরওয়ালার বিশেষ আদেশ। তা না হলে এরকম বেয়ারা সময়ে এমন
জায়গায় কেই বা আসতে চায়! রাজ্য সচিবের একটি বিশেষ আদেশনামা পৌঁছে দিতে হবে ব্লক
অফিসের বিডিও সাহেবের কাছে। কাজটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গোপনীয়। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু ট্রেনটা লেট
করতেই যত বিপত্তি। একে সন্ধ্যা নেমে গেছে, তারপর বিনয়বাবুর কাছে জায়গাটাও নতুন। ওদিকে আকাশের মুখ ভার। কখন যে দুম করে বৃষ্টি নেমে আসবে তার
ঠিক নেই। স্টেশনের
বাইরে টোটো গাড়ি পেয়ে গেলে গ্রামের ভিতর দিয়ে ব্লক অফিস প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা। কোনও মতে অফিসে পৌঁছে গেলেই আজকের
জন্য নিশ্চিন্ত - এই ভাবতে ভাবতে বিনয়বাবু স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলেন এই বাদলার ভরসন্ধ্যাতেও
দূরে তিন-চারটে টোটো গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রফুল্ল মনে দু’পা বাড়িয়েছেন কি
পিছন থেকে ধরা গলার ডাকটা শুনে থমকে গেলেন বিনয়বাবু।
লোকটার পরনে একটা আধময়লা
ফতুয়া আর তাপ্পি মারা হাফপ্যান্ট। ডান হাতে রিকশার হাতলটা ধরে বাম হাত
বরাভয় মুদ্রায় একটু ওপরে তুলে বেশ হন্তদন্ত হয়েই এগিয়ে আসছিল লোকটা। কাছে আসতে লোকটাকে আরেকবার ভালো করে
দেখলেন বিনয়বাবু। পাকাটে
শীর্ণ চেহারা। মুখে
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। মাথায় একটা গামছা তিন পাক দিয়ে বাঁধা। কিন্তু তার মধ্যেও চোখ দুটো বেশ অস্বাভাবিক
উজ্জ্বল। পায়ে
নীল রঙের হাওয়াই চটি। জায়গাটা যেমনই হোক রিকশাটায় কিন্তু বর্ষাকালে চলার জন্য সব
রকম সুব্যবস্থা মজুত। লোকটা আর একবার জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন বাবু?” টোটো গাড়ির দৌরাত্ম্যে
রিকশা চালানো আজকাল বিলুপ্তপ্রায় জীবিকায় পরিণত হয়েছে। যাও বা দু-একজন রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে
পেটের তাগিদে, কিন্তু সেটা মরে বেঁচে থাকার সামিল। লোকে এখন তাড়াতাড়ি এক জায়গা থেকে
অন্য জায়গায় পৌঁছে যেতে চায়। সময়ের বড়ো অভাব তাদের কাছে। বিনয়বাবু মানুষটা বরাবরই পরোপকারী। তাই সন্ধ্যা নেমে এলেও উনি ভাবলেন,
আজ না হয় এর সঙ্গেই ব্লক অফিসে যাওয়া যাক। যেতে যেতে জায়গাটা সম্পর্কে দু’চার
কথা জেনেও নেওয়া যাবে। ন্যায্য ভাড়ায় এক কথায় রফা হয়ে যেতেই আর সময় নষ্ট না করে
রিকশায় চড়ে বসলেন বিনয়বাবু।
“তোমার নাম কী হে?”
“আজ্ঞে কানু মুন্ডা বাবু? কানু রিকশাওয়ালা
বলে এই অঞ্চলের সবাই আমায় এক ডাকে চেনে।”
লোকটার কথায় কোথায় যেন একটা
আত্মতুষ্টির সুর খুঁজে পেলেন বিনয়বাবু। যেন রিকশা চালানোটা কত গর্বের কাজ। সত্যিই তো, এই জঙ্গলমহলের গরিব
সাধাসিধে মানুষগুলোর জীবন আর জীবিকা এই অঞ্চলের চৌহদ্দির মধ্যেই কোথায় যেন স্থির হয়ে
আছে। আশা-নিরাশাই হোক বা স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, এদের জীবনের সবটাই যেন একরঙা। রিকশা ততক্ষণে স্টেশন চত্বর পার করে
গ্রামের পথ ধরেছে। ঢালাই
করা পাকা রাস্তা। দু’পাশে
ঢালু ধান জমি থেকে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে দু’একটা চায়ের
দোকান অথবা ছোটোখাটো টিনের ঘর থাকায় রাস্তাটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়। বিনয়বাবু লক্ষ করলেন, লোকটার পাকাটে
চেহারা হলে কী হবে, রিকশাটা চালায় বেশ জোরে।
“তা কতদিন হল রিকশা চালাচ্ছ?”
“সে কী আর মনে আছে বাবু? সেই কবে গ্রামের মাঠে
ফুটবল খেলতে খেলতে হঠাৎ করে খবর এল বাপটা মরে গেছে। তখন থেকেই শুরু। তারপর মা গত হল। ভাই বোনদের বিয়ে দিলাম। আমি বিয়ে করলাম। এসবই রিকশা থেকে বাবু। আপনাদের আশীর্বাদে ভগবান সব কিছুই
ঠিক সময়ে করে দিয়েছেন।”
“কয় ছেলে-মেয়ে তোমার?”
“আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে
বাবু। মেয়েটার
দু’বছর আগে বিয়ে দিয়েছি। আর দুই ছেলে মাঠে মজুরের কাজ করে।”
“বাঃ, এ তো খুব ভালো কথা। তা এই রিকশা থেকে তোমার দিন চলে যায়
ভালো ভাবে?”
“ওই যে বললাম বাবু, আপনাদের
আশীর্বাদে ভগবান সব কিছুই ঠিক সময়ে করে দিয়েছেন। তাই কোনও কিছুতেই আর দুঃখ নেই।”
একবার কড়াৎ শব্দে বাজ পড়তেই
সাদা আলোয় চকিতে বিনয়বাবু দেখলেন, সামনে রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। লক্ষ করলেন, ধান জমি প্রায় শেষ হয়ে
দু’পাশে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়ের জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। আর চালা ঘরের সংখ্যাও যেন একটু একটু
করে বাড়ছে। কথায়
কথায় বেশ অনেকটাই চলে এসেছেন তাহলে। মোবাইলটা বার করে দেখলেন, প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। মানে গন্তব্য প্রায় কাছাকাছি।
“আর কত দূর হে?” নিশ্চিন্ত হওয়ার
জন্য জিজ্ঞাসা করলেন বিনয়বাবু।
“এই তো এসে গেছি। আর মিনিট দশেক লাগবে।”
হঠাৎ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু
হয়ে গেল।
“এক মিনিট দাঁড়াই বাবু, প্লাস্টিকটা একটু
ঠিক করে দিই। আপনি ভালো করে বসুন, না হলে ভিজে যাবেন।”
“কিন্তু তোমার কাছে ছাতা নেই? তুমিও যে ভিজে যাবে!”
তাড়াহুড়োতে নিজের ছাতাটাও
যে বাড়িতে ভুলে এসেছেন সেটা এতক্ষণে খেয়াল হল বিনয়বাবুর।
“আমার আর ও সব গায়ে লাগে
না বাবু,” লোকটা ধরা গলায় উত্তর দিল।
দূরে দুটো আলোর বিন্দু ক্রমশ
অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল বলে বিডিও
অফিস এখনও খোলা। বাইরে
চায়ের দোকানে ঝাঁপটা অর্ধেক নামানো। দুটো বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছে। দোকানিটা হয়তো অফিসের ভেতরেই গুলতানি
দিচ্ছে।
“বাবু, এসে গেছি। ওই যে আপনার অফিস।”
“তোমার কাছে একশো টাকার ভাঙানি
হবে?”
“না বাবু। তবে আমাকে দিন,
আমি সামনের দোকানটা থেকে করে আনছি।”
“থাক, তোমাকে আর কষ্ট করতে
হবে না। অনেকটা
পথ রিকশা চালিয়ে এসেছ। তুমি বস, আমি অফিসের ভেতর থেকে খুচরো করে দিচ্ছি।”
এই অল্প
সময়েই
লোকটার
উপর
কেমন
যেন
মায়া
পড়ে
গেছে
বিনয়বাবুর।
মনে
মনে
ভাবলেন,
কাল
যদি
অঞ্চলটা
ঘুরে
দেখতে
হয়
তাহলে
একেই
একবার
ডেকে
নেবেন।
অফিসের
ভিতরে
বিডিও
সাহেব
আর
দু’জন
স্টাফ
বসেছিল।
বিনয়বাবু
ঘরে
ঢুকতেই
হই
হই
করে
অভ্যর্থনা
করে
উঠলেন,
“আরে
আসুন
আসুন। এই বৃষ্টি
বাদলার
দিনে
এতটা
পথ
কষ্ট
করে
আপনাকে
আসতে
হল, আমরা
সত্যিই
লজ্জিত।
আগে
এক
কাপ
চা
খান,
তারপর
কথা
হবে।”
“তার আগে এই টাকাটা যদি দয়া
করে একটু খুচরো করে দেন,
আমি রিকশার ভাড়াটা বাইরে মিটিয়ে দিয়ে আসি,” বিনয়বাবু বললেন।
“দাঁড়ান মশাই। কী বলছেন? আপনি স্টেশন থেকে
এখানে এলেন কী করে?”
“কেন? ঐ কানুর রিকশায়। লোকটা বেশ ভালো, বুঝলেন।”
ঘরের
আবহাওয়াটা
হঠাৎ
করে
যেন
নিস্তব্ধ
হয়ে
গেল।
বাইরে
আবার
কোথাও
একটা
বাজ
পড়ল
কড়াৎ
করে।
বিডিও
সাহেব
বললেন,
“আপনি
বসুন
বিনয়বাবু।
আপনি
ঠিক
বলছেন
তো? কিন্তু
যদি
ঠিক
বলেনও
তাহলে
তা
কী
করে
সম্ভব? আজ এক বছর হয়ে
গেল
আমরা
এই
অঞ্চল
থেকে
সমস্ত
রিকশা
বন্ধ
করে
দিয়েছি।
এখন
এখানে
শুধুই
টোটো
গাড়ি
চলে।
আপনি
যে
কানু
রিকশাওয়ালার
কথা
বলছেন,
সেও
মারা
গেছে
প্রায়
ছ’মাস
হতে
চলল।
আর
আপনি
যে
চিঠিটা
নিয়ে
এসেছেন
সেটা
ঐ
রিকশাওয়ালাদেরই
পুনর্বাসনের
একটা
প্রকল্পের
ডিটেইলস।
আদেশ
হয়েছে,
ওটা
যত
শীঘ্র
সম্ভব
বাস্তবায়িত
করার।”
কোথাও যেন হঠাৎ করে একটা শূন্যতা
অনুভব করলেন বিনয়বাবু। বেশ শক্ত প্রকৃতির মানুষ তিনি। তবুও মুহূর্তের জন্য হলেও কানুর মুখটা
সামনে ভেসে উঠল। তাহলে
এতটা রাস্তা উনি কার সঙ্গে এলেন? ভাড়াটাও যে দেওয়া হল না! নাকি উনি ওই প্রকল্পের চিঠিটি
নিয়ে এসেছেন বলে সরকারের প্রতি কানু এভাবেই কৃতজ্ঞতা জানাল? সত্যিই কি ভগবান সব কিছু
ঠিক সময় করে দেন? দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন বিনয়বাবু। কোথাও কেউ নেই। শুধু একটা নেড়ি কুকুর একটা ছেঁড়া
চটি মুখে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। বাইরের আবছা আলোতেও বিনয়বাবু বুঝতে
পারলেন চটিটার রং নীল।
_____
ছবিঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে
ReplyDelete