গল্পের ম্যাজিক:: রাজপুত্রের বন্ধু - কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


রাজপুত্রের বন্ধু
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)

সাত সমুদ্রের এক সমুদ্র। সমুদ্রের পারে বিশাল রাজ্য। রাজ্যের নাম চন্দনপুর
সে রাজ্যের দক্ষিণে সমুদ্র, উত্তরে উত্তুঙ্গ পাহাড়গোটা পুবদিকটা জুড়ে প্রতিবেশী রাজ্য সূর্যগড়আর পশ্চিমে? সেখানেই তো সেই গভীর চন্দনকাঠের বন, যার নামে এ রাজ্যের নামসেই বন এত গভীর আর এত বড়ো যে, রাজ্যের কোনও কাঠুরেই তার পনেরো মাইলের বেশি গভীরে ঢুকতে পারেনি কখনও
তবে রাজপুত্র শঙ্খবর্মার কথা আলাদা। সে একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। প্রাণে তার ভয়ডর বলে কিছু নেইতাই কোমরে তরোয়াল আর পিঠে তীর-ধনুক সম্বল করে সে একা একাই চলে যায় চন্দনবনের গভীর থেকে আরও গভীরে। সঙ্গে থাকে শুধু বজ্রক কুমার শঙ্খবর্মার প্রিয় ঘোড়া
আসলে তার তো কোনও প্রিয় বন্ধু নেই, যাকে সবসময় সে কাছে কাছে রাখবে, সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেঅন্য দেশে যেমন হয়, মন্ত্রীপুত্র বা সেনাপতির পুত্র রাজকুমারের বন্ধু হয়। এখানে সে হবার উপায় নেইকারণ, চন্দনপুর রাজ্যের কোনও মন্ত্রীপুত্র নেই, আছে মন্ত্রীকন্যামন্ত্রী শান্তিবর্ধনের একটিমাত্র কন্যা আছে, যার নাম সোমচন্দ্রাঅবশ্য সেনাপতি প্রতাপশঙ্করের একটি পুত্র আছে, কিন্তু সে তো কুমার শঙ্খবর্মার থেকে বয়সে অনেকটা বড়োকাজেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কী করে?
তাই কুমার একা একাই ঘুরে বেড়ায় সেই গভীর চন্দনবনে। ঘুরে বেড়ায় আর পাখি, হরিণ এসব শিকার করে
সেরকমই একদিন ঘুরতে ঘুরতে শঙ্খ গিয়ে পড়েছিল বনের অনেকটা ভেতরে। এদিকে এর আগে সে আসেনি কখনওএখানে ঘন বনের ভেতর সূর্যের আলো ম্লানযে কোনও সাধারণ লোকের গা ছমছম করবে এই পরিবেশে। কিন্তু শঙ্খের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেইসেই আধো অন্ধকারে সে দিব্যি চলেছিল বজ্রকের পিঠে চেপেযেতে যেতে তার হঠাৎ জলতেষ্টা পেল খুব। বজ্রকেরও সেই একই অবস্থাকাজেই কাছাকাছি কোনও ঝর্ণার খোঁজে তারা এগিয়ে গেল।
বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ঝোপঝাড়। লতাপাতা আগাছা ডিঙিয়ে তারা এগিয়ে চলল। এসব ব্যাপারে জন্তু-জানোয়ারদের নিজস্ব একটা অনুভূতি থাকে, শঙ্খ জানে। তাই সে শুধু লাগামটা আলগা করে ধরে বসে রইল, আর বজ্রক তাকে পিঠে নিয়ে এগিয়ে চলল কোনদিকে কে জানে
খানিকটা যাবার পর শঙ্খের কানে যেন দূর থেকে ভেসে এল জলের কলকল ধ্বনি। কোথায়? কোনদিকে? বজ্রক তো সেদিকেই চলেছে মনে হচ্ছে!
আরও কিছুটা এগোবার পর কয়েকটা উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে শঙ্খের নজরে পড়ে, একটু দূরেই একটা ছোট টিলাতারই একপাশ দিয়ে পাথরের গা বেয়ে নেমে এসেছে একটা ঝর্ণার ধারাদেখেই প্রাণটা যেন খুশিতে নেচে ওঠে শঙ্খেরআর বজ্রকও যেন সেই আনন্দেই লাফিয়ে এগিয়ে যায় সামনেকিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই শঙ্খের নজরে পড়ে, টিলাটা যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানে একটা মস্ত বড়ো বটগাছ, যার নিচে বসে আছে একটা মানুষ!
দেখেই অবাক হয়ে যায় শঙ্খএই গভীর বনের মধ্যে এ কে? কোত্থেকে এল?
ভালো করে দেখবার জন্যে আরও কয়েক কদম এগিয়ে যায় শঙ্খতারপর বুঝতে পারে, না, সাধারণ কেউ নয়, জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী বসে আছেন বটগাছটার গুঁড়ির কাছেসামনে তাঁর জ্বলন্ত ধুনি, খালি গা, পরনে রক্তবর্ণ এক কৌপীনআর আশ্চর্যের ব্যাপার, এই আলো-আঁধারির মধ্যে যেন এক আলোর আভা ঘিরে রয়েছে সেই সন্ন্যাসীর সারা শরীরটিকে। কী অদ্ভুত!
সন্ন্যাসীও ততক্ষণে দেখতে পেয়েছেন শঙ্খকেআর দেখামাত্রই তিনি হাত তুলে কাছে যেতে ইশারা করলেন শঙ্খকেএক মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হল শঙ্খবর্মাতারপর খানিকটা কৌতূহলেই ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। হাতে ধরা রইল বজ্রকের লাগাম
সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই শরীরের মধ্যে কেমন একটা শিহরণ খেলে যায় শঙ্খেরসন্ন্যাসী তীব্র প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন তার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে কীরকম যেন কুঁকড়ে যায় শঙ্খসন্ন্যাসী কী বলতে চাইছেন তাকে?
কয়েক পলক ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে একটা প্রসন্ন হাসি ফুটে ওঠে সন্ন্যাসীর ঠোঁটের কোণেশঙ্খও তা দেখে একটু আশ্বস্ত হয়এবার সন্ন্যাসী হাত দিয়ে দেখিয়ে তাঁর সামনে বসতে বলেনসন্ন্যাসীর মুখে কোনও কথা নেইশুধুমাত্র ইশারায় তিনি নির্দেশ দিয়ে চলেছেন আর শঙ্খবর্মা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা পালন করে চলেছে
শঙ্খ সন্ন্যাসীর সামনে মাটিতে আসন গ্রহণ করলএবার সন্ন্যাসী তাঁর পাশের দিকে হাত বাড়ালেনতাঁর পাশেই মাটিতে গাঁথা একটা ছোট্ট ত্রিশূল, যেটা এতক্ষণ শঙ্খর নজরে পড়েনিসেই ত্রিশূলের গায়ে ঝোলানো একটা কাপড়ের ঝোলাএবার সন্ন্যাসী তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বার করে আনেন একটা অদ্ভুত জিনিস, এক বিঘৎ লম্বা একটা পুতুল শঙ্খ অবাক হয়ে সন্ন্যাসীর হাতে ধরা সেই পুতুলটা দেখতে থাকে। কী অদ্ভুত চেহারা সেই পুতুলটার! কেমন যেন জবরজং ধরনের পোশাক পরা, অনেকটা মানুষের মতোই চেহারা, তবুও ঠিক যেন মানুষ নয়কেমন কাঠ কাঠ শক্তপোক্ত ধরনের গড়ন, মুখচোখ কাটা কাটাআর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, পুতুলটার দুই চোখের ওপর কপালের মাঝখানে আর একটা চোখের মতো আঁকাশঙ্খ খুব আশ্চর্য হয়ে যায় দেখেএরকম পুতুল সে এর আগে কোনওদিন দেখেনি
সন্ন্যাসী পুতুলসমেত হাতটা শঙ্খের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। আর এতক্ষণে তাঁর মুখে কথা ফুটল। সন্ন্যাসী বললেন, “নে বেটাতোর কোনও বন্ধু ছিল না। এই লড়কা আজ থেকে তোর বন্ধু হল একে সবসময় তোর সঙ্গে সঙ্গে রাখবিদেখবি, ও তোকে বন্ধুর মতোই সাথ দেবেআর হ্যাঁ, যদি কোনও সময় ঘোর বিপদে পড়িস, তখন এই যে এর বুকে একটা বোতাম দেখছিস, এটা টিপে ধরবি আর মনে মনে বলবি...”
সন্ন্যাসী আচমকা চুপ করে যানশঙ্খ এতক্ষণ অবাক হয়ে পুতুলটা দেখতে দেখতে সন্ন্যাসীর কথাগুলো শুনছিলএবার কৌতূহলে তাঁর মুখের দিকে তাকায়। সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বলেন, “যেটা বলবি সেটা একটা মন্ত্রআমি তোর কানে কানে সেটা বলব, আর তুই সেটা মুখস্থ করে রাখবি। আয়, কাছে আয়।”
শঙ্খ সন্ন্যাসীর আরও কাছে এগিয়ে যায়তিনি ওর কানে কানে মন্ত্রটা বলেনএকবার, দু’বার, তিনবারতারপর শঙ্খ চোখ বুজে সেটা মনে মনে আউড়ে নেয় একবারধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠেযাক, আজ থেকে ওর একটা বন্ধু হলতারপরেই শঙ্খ জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু বাবা, ওর নাম কী? আমার বন্ধুকে আমি কী বলে ডাকব?
সন্ন্যাসীর মুখমন্ডল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেতিনি বলেন, “ঠিক বলেছিস বেটাবন্ধুকে তো নাম ধরেই ডাকতে হয়বেশ, তুই ওকে তুলকালামবলে ডাকবিদেখবি, ও ঠিক সাড়া দেবে
নাম শুনে ভারী খুশি হয় শঙ্খবেড়ে নাম, দারুণ নামপুতুলটা মুখের সামনে তুলে ধরে তার দিকে তাকিয়ে একবার ডেকে ওঠে, “তুলকালাম!”
ও বাবা, পুতুলটা কি একবার চোখ পিটপিট করল? কী জানি, মনে হয় শঙ্খর চোখের ভুলযাই হোক, ও যে শঙ্খের বন্ধু হতে রাজি হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই
এবার পুতুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শঙ্খ সন্ন্যাসীর দিকে তাকায়তিনি এতক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলেনবোধহয় মনে মনে উপভোগ করছিলেন ব্যাপারটাশঙ্খ তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আমাকে হঠাৎ এই পুতুলটা দিচ্ছেন কেন বাবা?
সন্ন্যাসী গম্ভীরমুখে একটুক্ষণ চুপ করে থাকেনতারপর বলেন, “সে তোর জানার দরকার নেই বেটাশুধু শুনে রাখ, এই জগৎ চলছে মহাকালের খেলায়সেই মহাকালের নির্দেশেই এই তুলকালাম আজ থেকে তোর বন্ধু হলযা বলেছি, সবসময় মনে রাখবি, আর তোর বন্ধুর যত্ন-আত্তি করবিযা, ঘরে যা
এই বলে সন্ন্যাসী চুপ করেনতারপর দু’চোখ বুজে দুই ঊরুর ওপর দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বসে থাকেনশঙ্খ আরও দু’একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তাঁকে, কিন্তু আর কোনও জবাব পায় নাসন্ন্যাসী সমাধিস্থ হয়ে গেছেন
অগত্যা শঙ্খ পুতুলটা কোলে নিয়ে উঠে পড়েতারপর বজ্রকের লাগাম ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় টিলার পাশের ঝর্ণার দিকে

(২)

চন্দনপুর রাজ্যে আজ দারুণ আনন্দের দিন। রাজা আদিত্যবর্মার আদেশে সারা রাজ্য জুড়ে উৎসব। এ উৎসব চলবে টানা তিনদিনকারণ, আজ বেলা ঠিক দুই প্রহরের শুভ লগ্নে কুমার শঙ্খবর্মার অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হবেশঙ্খবর্মা কুমার থেকে যুবরাজে উত্তীর্ণ হবেন
সেই উপলক্ষে গোটা রাজ্যবাসীর মনে আনন্দের তুফান কুমার তাদের কাছেও যে বড়ো প্রিয়
রাজবাড়ির প্রশস্ত চত্বরে খাওয়াদাওয়ার ঢালাও আয়োজন। গোটা রাজ্যবাসী আজ রাজার অতিথিরাজপ্রাসাদ ফুল আর লতাপাতা দিয়ে সাজানো হয়েছেরাজশিল্পীদের আঁকা আলপনায় সেজে উঠেছে প্রাসাদভান্ডারে মজুত করা হয়েছে রাশি রাশি আতসবাজি। সন্ধে নামলে সেগুলো পোড়ানো হবেতুরী আর ভেরী বেজে উঠছে মুহুর্মুহুসবমিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দের হাওয়া যেন বয়ে যাচ্ছে চন্দনপুরের রাজপ্রাসাদ জুড়ে
দরবারকক্ষে আলোর রোশনাইসেখানেই অনুষ্ঠিত হবে আজকের অভিষেক পর্বসেই উপলক্ষে রাজমঞ্চের ওপর রাজার সিংহাসনের পাশে আজ আরও দুটি নতুন আসন রাখা হয়েছেএকটি যুবরাজ শঙ্খবর্মার আর অপরটি?
সেখানে বসবে কুমার শঙ্খবর্মার প্রাণের বন্ধু তুলকালাম হ্যাঁ, এতদিনে তুলকালাম একটু একটু করে তার প্রাণের বন্ধুই হয়ে উঠেছে বটে। সারাদিনে একমুহূর্ত তাকে ছাড়া কুমারের চলে নাআপন মনে শঙ্খ তার সঙ্গে কথা বলে, আর সেও যেন শঙ্খর সব কথা বোঝে আর ইশারায় তার জবাবও দেয়যদিও সে ইশারা একা শঙ্খ ছাড়া আর কেউ বোঝে না
কুমার শঙ্খবর্মার এই অদ্ভুত বন্ধুর কথা এখন আর সারা রাজ্যের কারোরই জানতে বাকি নেইএমনকি, লোকেরা আড়ালে আবডালে রাজপুত্রের এই ছেলেমানুষী নিয়ে হাসাহাসিও করেতবুও রাজা আদিত্যবর্মা কিছুতেই কুমারকে শাসন করতে পারেন নামা-হারা রাজপুত্রের এই একটিমাত্র ভালবাসাকে তিনি কেড়ে নেবেন কী করে?
দিনের দ্বিতীয় প্রহর আসতে আর দেরি নেইএকে একে দরবারকক্ষ লোকজনে ভরে উঠতে থাকেপ্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রীরা, সেনাপতি, পাত্র, মিত্র, কোষাধ্যক্ষ, বিদূষক, রাজবৈদ্য, পন্ডিতের দল, ছোট ছোট গ্রামের জমিদারেরা, একে একে সবাই এসে সারি সারি আসনগুলো ভরিয়ে তুলতে থাকে রাজ্যের সাধারণ নাগরিকরাও এসে ভিড় করে দাঁড়ায় রক্ষীপ্রহরার বাইরেদূর থেকেই তারা দেখবে এই অভিষেকক্রিয়া
দরবারকক্ষ জুড়ে শান্তিবারি ছেটানো হচ্ছেশাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতেরা উচ্চারণ করছেন মঙ্গলমন্ত্রমঞ্চের দু’পাশের যবনিকার আড়াল থেকে শঙ্খ বাজাচ্ছেন পুরনারীরাএই পবিত্র আবহাওয়ার মধ্যেই অন্তঃপুর থেকে দরবারে প্রবেশ করলেন সৌম্যকান্তি রাজপুরোহিততাঁর পরিধানে শ্বেতবস্ত্র, হাতে ধূপ-দীপ-চন্দনে সাজানো সোনার থালা
পরক্ষণেই কক্ষদ্বারে বেজে ওঠে তূর্যধ্বনিরক্ষীদের হাতের বল্লম একযোগে ঝন্‌ঝন্‌ করে ওঠেরাজকর্মী আর অতিথির দল সসম্মানে যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ানদরবারে প্রবেশ করেছেন রাজা আদিত্যবর্মা ও কুমার শঙ্খবর্মাতাঁদের ঠিক পেছনেই রাজার ব্যক্তিগত অনুচর ও দেহরক্ষীর দল সমবেত জয়ধ্বনির মধ্যে চারণের দল মঞ্চের নিচে সার বেঁধে দাঁড়ায়রাজার বন্দনাগানের জন্য তাঁরা প্রস্তুত আর ঠিক সেই সময় —
আচম্বিতে দরবারের সমস্ত কলরবকে ছাপিয়ে বাইরে শোনা যায় তুমুল এক কোলাহলযেন বহুদূর থেকে এক সমবেত আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসে প্রাসাদের এই নিভৃত দরবারে
এক নিমেষে বিশাল দরবারকক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে যায়জমায়েত হওয়া শত শত মানুষ বিস্মিত আর বিহ্বল এই আনন্দের পরিবেশে এ কোন্ অশুভ সঙ্কেত? কেউ কিছুই বুঝতে পারছে নাচুপ করে সবাই শুধু একে অপরের মুখের দিকে তাকায়উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা খেলা করে তাদের চোখেমুখে
রাজা আদিত্যবর্মাও দু’এক মুহূর্তের জন্য হতচকিততারপরেই রাজোচিত গাম্ভীর্যে পাশে দাঁড়ানো প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, “কী ব্যাপার, মন্ত্রী? বাইরে ঐ কোলাহল কীসের?”
মন্ত্রী শান্তিবর্ধন তটস্থ হয়ে বলেন, “জানি না মহারাজ। আমি এখনই খবর নিচ্ছি
তিনি ইঙ্গিত করেন অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীপ্রধানকেসে তৎক্ষণাৎ একটু ঝুঁকে একটা অভিবাদনের ভঙ্গী করেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় কক্ষদ্বারের দিকে
কিন্তু দ্বার পর্যন্ত তাকে আর যেতে হয় নাতার আগেই ঝড়ের বেগে দরবারে প্রবেশ করে এক ব্যক্তিসামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই দ্বাররক্ষীর বল্লম দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে সোজা এগিয়ে আসে মঞ্চের দিকে। দরবারের অন্য রক্ষীরা চিৎকার করে দৌড়ে আসেকিন্তু লোকটি ততক্ষণে মঞ্চের নিচে এসে পৌঁছে গেছেরাজার দিকে দু’হাত তুলে সে ভগ্নস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে, “মহারাজ! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
ঘটনার আকস্মিকতায় গোটা দরবার নিশ্চুপরক্ষীরাও দাঁড়িয়ে গেছে যে যার জায়গায়মহারাজ আদিত্যবর্মা ক্ষণকাল লোকটির দিকে তাকিয়েই অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, “একি, প্রবুদ্ধ! তুমি এখানে? তোমার না সীমান্তে থাকার কথা?”
লোকটি হাতজোড় করে দ্রুতস্বরে বলে ওঠে, “মহারাজ, ক্ষমা করবেন নিরুপায় হয়ে আমাকে নিজে ছুটে আসতে হয়েছে এখানে। ভয়ংকর বিপদ মহারাজ, ভয়ংকর বিপদসূর্যগড়ের সৈন্যরা চন্দনপুর আক্রমণ করেছে।”
আগত লোকটির এই সামান্য ক’টি কথায় যেন কেঁপে ওঠে সবাই। এ কী ভয়ংকর কথা!
আদিত্যবর্মা স্থাণুর মতো প্রশ্ন করেন, “কী বলছ প্রবুদ্ধ? তুমি...”
“হ্যাঁ মহারাজ। যা বলছি দয়া করে শুনুন। সময় অতি অল্পকাল গভীর রাতে সূর্যগড়ের যুবরাজ তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করেছেন আমাদের রাজ্যতারপর এই উৎসবের সুযোগ নিয়ে আজ সরাসরি প্রবেশ করেছেন নগরীতেবাধা দেওয়ার কোনও সুযোগই ছিল নাএমনকি, আমার পাঠানো দূতও ওদের হাতে নিহততাই সে সংবাদ আপনার নিকটে পৌঁছোয়নিআজ তাই আমি নিজে...”
শুনতে শুনতে ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছিল রাজা আদিত্যবর্মার মুখচোখপ্রবুদ্ধর কথার মধ্যেই বাধা দিয়ে তিনি বললেন, “ওরা এখন কতদূরে প্রবুদ্ধ?”
“রাজধানীর দ্বিতীয় তোরণ অতিক্রম করেছে মহারাজআর আধ প্রহরের মধ্যেই ওরা প্রাসাদের সীমানায় প্রবেশ করবে।”
“বেশ। প্রতাপশঙ্কর!” রাজা সেনাপতির দিকে ফেরেন
প্রতাপশঙ্কর এতক্ষণ মুষ্ঠি দৃঢ়বদ্ধ করে রাজার আদেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। উত্তেজনায় থমথম করছিল তাঁর মুখএবার রাজার ইঙ্গিতমাত্র তিনি বলে উঠলেন, “মহারাজ, আমি এই দন্ডে সৈন্য পাঠাচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন প্রাণ থাকা পর্যন্ত আমরা লড়াই করে যাব।”
প্রণতি জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন সেনাপতিমন্ত্রী শান্তিবর্ধন রক্ষীপ্রধানকে ডেকে চটপট দু’একটা নির্দেশ দিয়ে রাজার দিকে ফিরলেন। বললেন, “মহারাজ, লক্ষণ খুব একটা ভালো নয়এই অপ্রস্তুত অবস্থায় সেনাপতি কতদূর কী করতে পারবেন জানি নাতাই বলি, আপনি সকলকে নিয়ে সত্বর নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যান মহারাজ। নইলে সমূহ বিপদ।”
প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিচক্ষণ, রাজা জানেনতাই তাঁর প্রতি রাজার আস্থাও প্রচুর। তবু ইতস্তত করে বললেন, “মানে... তুমি কি ওখানে যাবার কথা বলছ?”
রাজার সঙ্গে মন্ত্রীর দৃষ্টি বিনিময় ঘটে
মন্ত্রীর চোখে এক বিশেষ ইঙ্গিত, “হ্যাঁ মহারাজআপনি, যুবরাজ ও পুরনারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুনআমি রক্ষীদের নিয়ে প্রাসাদ রক্ষার চেষ্টা করছি। সত্বর করুন মহারাজ।”
রাজা তবুও দ্বিধাভরে একবার রাজপুরোহিতের দিকে তাকান। তাঁর চোখেও একই বার্তাএবার আর রাজা দ্বিধা করেন নাপুত্রের হাত ধরে দ্রুত অন্তঃপুরের দিকে প্রস্থান করেন

(৩)

রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে অতি গোপন স্থানে এই গুপ্তঘরটিনা জানলে বাইরে থেকে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। পরিসরও খুব একটা বড়ো নয়কোনওক্রমে জনাতিরিশ মানুষ এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে
       শঙ্খ এখানে আসার আগে এই ঘরটার কথাই জানত নাকোনওদিন দরকার পড়েনি, আর রাজাও কোনওদিন জানাননি। আজ তাই দেখে অবাক হয়ে গেছে
এই ঘরে এসে আজ লুকিয়েছে আঠারোজন মানুষতার মধ্যে মহারাজ আদিত্যবর্মা আর কুমার শঙ্খ ছাড়া বাকি সবাই মহিলাকিন্তু শঙ্খ সবথেকে খুশি হল সেই দলের মধ্যে সোমচন্দ্রাকে দেখতে পেয়েসেও আজ প্রাসাদে এসেছিল শঙ্খবর্মার অভিষেক দেখবে বলে। তারপর এই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে তাকেও এসে ঢুকতে হয়েছে এই গুপ্তকক্ষে
ঘরটার ভেতর দেয়ালের ধারে ধারে ছোটবড়ো অনেকগুলো পাথরের তৈরি বসার জায়গা। তারই একটাতে চুপ করে বসে ছিল শঙ্খসবাই শুকনো মুখে এধারে ওধারে বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়েরাজা চিন্তিতমুখে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন হাতদুটো পেছনে রেখেউপস্থিত সবার মনেই একটা অজানা আশঙ্কার ছায়া খেলা করছে যেন
একসময় সোমচন্দ্রা আস্তে আস্তে উঠে এসে শঙ্খর পাশে বসল চুপটি করেশঙ্খ মুখ তুলে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “কী হবে বল তো সোমচন্দ্রা?”
সোমচন্দ্রা একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “একটা কথা বলব রাজকুমার?”
শঙ্খ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সোমচন্দ্রা বলে, “তোমার বন্ধুকে তুমি কাজে লাগাতে পার না? সেই যে তুমি বলেছিলে, বিপদে পড়লে কী একটা বোতাম টিপে মন্ত্র পড়লে নাকি... একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি?”
কথাগুলো শুনতে শুনতে শঙ্খর চোখদুটো ক্রমে বিস্ফারিত হচ্ছিলএবার উত্তেজিত হয়ে সে প্রায় চেঁচিয়েই বলে ওঠে, “কী আশ্চর্য! একদম ঠিক বলেছ তো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলামসন্ন্যাসী হয়তো এরকম কোনও বিপদের কথাই বলতে চেয়েছিলেন।”
কথাগুলো বলতে বলতে জামার ভেতর থেকে তুলকালামকে বার করে শঙ্খমুখের সামনে তুলে ধরতেই দেখে, তুলকালামকে আজ যেন কেমন অচেনা লাগছেযেন একটা কঠিন শপথের ভঙ্গী তার মুখে!
ইতিমধ্যে রাজা আদিত্যবর্মা এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানেঘরের সকলের দৃষ্টিও এখন শঙ্খের দিকেশঙ্খ চোখ বুজে সন্ন্যাসীর মন্ত্রটা মনে করার চেষ্টা করেকিছুক্ষণের চেষ্টার পরেই তার মনে পড়ে যায় পুরো মন্ত্রটাএবার বাঁ হাতে তুলকালামকে তুলে ধরে সামনেতারপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে তার পোশাকের ভেতর বুকের মাঝখানে বোতামটা টিপে রেখে মনে মনে মন্ত্রটা উচ্চারণ করেমন্ত্রের শেষ শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন এক প্রলয় ঘটে যায়তুলকালামের ছোট্ট শরীরটায় এক প্রবল ঝাঁকুনিবিদ্যুতের আঘাতের মতো সেই ঝাঁকুনিতে তুলকালাম ছিটকে পড়ে শঙ্খের হাত থেকে
কিন্তু কী আশ্চর্য! মাটিতে পড়ে গিয়েও যেন কী এক অলৌকিক শক্তিতে সেই ছোট্ট পুতুল তার দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠেতারপরেই ঘটে যায় সেই আশ্চর্য কান্ড! একটা দূরাগত ঝড়ের শব্দের মতো শোঁ শোঁ আওয়াজের সঙ্গে পলকে পলকে তার শরীরটা ক্রমশ বড়ো হতে থাকে। বড়ো, আরও বড়োকয়েক নিমেষের মধ্যে ঘরের আঠারোজোড়া চোখের অবাক দৃষ্টির সামনে তুলকালামের ছোট্ট শরীর পরিণত হয় বিশাল লম্বা এক শক্তিশালী পুরুষেতার গোটা দেহে মাংসপেশীর আস্ফালন, চোখেমুখে ক্রোধের রেখা, আর কী আশ্চর্য, তার কপালে আঁকা সেই চোখের মতো জিনিষটা কেমন দপদপ করছে! সেদিকে তাকালেই ভয়ে যেন অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়
ঘরের সবাই, এমনকি রাজা আদিত্যবর্মাও আতঙ্কে ছিটকে চলে গেছেন পেছনে। শুধু কুমার শঙ্খ একটুও নড়েনিঅবাক চোখে প্রিয় বন্ধুকে দেখতে দেখতে সে ডেকে ওঠে, “তুলকালাম!”
তুলকালাম একবার অবহেলায় ঘরের চারদিকে দেখেতারপর শঙ্খের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে ভারী ভারী পায়ে গুপ্তকক্ষের দরজার দিকে এগোয়, তারপর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। শঙ্খ তাকে অনুসরণ করে। নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায়


(৪)

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছেচন্দনপুরের পশ্চিম আকাশে সূর্যদেব রঙের খেলায় মেতেছেনচন্দনপুরের প্রজারাও মেতেছে উৎসবে। ঠিক সেই সকালের মতোতাদের মনে আর কোনও ভয় নেই, কোনও ভাবনা নেইশত্রুর দল বিনষ্ট হয়েছে। একজন সৈন্যও আর বেঁচে নেই। কেবল সূর্যগড়ের যুবরাজ বন্দি হয়ে রয়েছেন বন্দিশালায়। আগামীকাল তার বিচার হবে। আর এ সমস্ত কিছুর মূলে সেই আশ্চর্য পুতুল, কুমার শঙ্খবর্মার প্রাণের বন্ধু তুলকালাম

সে এক আশ্চর্য কান্ড! তখন গুপ্তঘর থেকে তুলকালাম বাইরে বেরোতেই গোটা প্রাসাদ জুড়ে আতঙ্কের বন্যা বয়ে যায়। তার ভয়ংকর চেহারা দেখে যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালাচ্ছেকিন্তু তুলকালাম কোনওদিকে না তাকিয়ে বড়ো বড়ো পায়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায়যেন এক মহাকালের নির্দেশেই সোজা গিয়ে পৌঁছোয় দ্বিতীয় তোরণের কাছে, যেখানে তখন রাজার সৈন্যরা প্রাণপণে যুদ্ধ করছে সূর্যগড়ের বিরাট বাহিনীর সঙ্গে
তুলকালাম গিয়ে দাঁড়ায় সেনাপতি প্রতাপশঙ্করের পাশেআর তারপরেই সেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায় চন্দনপুরের সৈন্যরাতুলকালামের সেই কপালের চোখ থেকে যেন এক ভয়ংকর রশ্মি বেরোতে থাকে যেখানেই সেই রশ্মি পড়ে সেখানেই আগুন ধরে যায়সূর্যগড়ের সৈন্যসামন্ত, হাতি, ঘোড়া, একের পর এক পুড়ে যেতে থাকে সেই সর্বগ্রাসী আগুনেকয়েক লহমার মধ্যে সেই বিশাল বাহিনীর সবকিছু পুড়ে খাক হয়ে যায়আর তারই ফাঁকে শঙ্খবর্মা গিয়ে অনায়াসে বন্দি করে আনে সূর্যগড়ের যুবরাজকেএই ভয়ানক দৃশ্য দেখে তার দেহে আর যুদ্ধ করার মতো কোনও ক্ষমতা ছিল না
এখন সবকিছু মিটে গিয়ে চন্দনপুর আবার সুখের রাজ্যআবার সেখানে ফিরে এসেছে উৎসবের মেজাজএইমাত্র নির্বিঘ্নে শেষ হল যুবরাজ শঙ্খের অভিষেক পর্বমহারাজ আদিত্যবর্মা শঙ্খের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিতেই প্রজার দল চেঁচিয়ে ওঠে, “জয় যুবরাজ শঙ্খবর্মার জয়
শঙ্খ হাত তুলে চেঁচিয়ে ওঠে, “না। আমার জয় নয়আজ আপনারা শুধু তুলকালামের জয়ধ্বনি করুন।”
প্রজারা সহর্ষে জয়ধ্বনি করে, “জয় তুলকালামের জয়
শঙ্খ তার পাশের আসনে বসা বন্ধুর দিকে তাকায়সে আবার পরিণত হয়েছে সেই এক বিঘৎ লম্বা ছোট্ট পুতুলে কিন্তু তার চোখদুটো ঠিক পিটপিট করেযেন সে বলছে, ‘বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোই তো আসল বন্ধুর কাজ, তাই না বন্ধু?
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল

3 comments:

  1. রূপকথার গল্পের সঠিক পরিবেশ এবং কাহিনী । তবু মনে হয় তুল্যকালামের যুদ্ধ টা একটু আরও প্রাণবন্ত করা যেতেই পারত অর্থাৎ এলাম দেখলাম আর জয় করলাম না করে একটু উত্থান পতন এবং তাতে জুবরাজকেও সামিল করা যেতেই পারত । এতে কাহিনী টা আরও বিশ্বাস যোগ্য হয়ে উঠত ।

    ReplyDelete