পুরোনতুন গল্প:: পিতার মস্তক থেকেই কি গ্রীকদেবী আথেনার জন্ম? - সোহিনী দেবরায়


পিতার মস্তক থেকেই কি গ্রীকদেবী আথেনার জন্ম?
সোহিনী দেবরায়

বৃষ্টিটা আরও জোরে শুরু হল। আকাশ বাতাস সমগ্র অলিম্পাস পর্বত কেঁপে আরও একটা বাজ পড়ল। তখনই শোনা গেল এক শিশুর কান্না। হ্যাঁ, একটু মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যাবে এ এক নবজাত শিশুর কান্না। শিশুর পিতা দু’চোখ ভরে শিশুটিকে দেখলেন। কী অপরূপ দীপ্তি শিশুটির চোখে মুখে! সূর্যের মতো গায়ের রঙ, সোনালি চুল। পৃথিবীর সমস্ত রূপ নিয়ে জন্মেছে এই কন্যা। কী নাম রাখা যায় এই দেবকন্যার! না না, এখন অত সময় নেই নাম ভাবার। সে পরে হবে’খনআপাতত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। যদিও সে ছোট্ট একটি লোহার বর্ম দিয়ে শিশুটিকে ঢেকে নিয়েছে তবুও একবার মনে হল বটে যে এই সদ্যোজাত শিশু মাকে ছাড়া বাঁচবে তো! কিন্তু তা ভাবার সময় এখন নয়। এই ঝড়জলের রাতেই তাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। কেউ যেন জানতে না পারে এই শিশুর মা কে কেউ জানবে না। কেউ না। কেউ যাতে না জানে তাই জন্যই তো তিনি এই ঝড়জলের রাতে একা এতটা এসে নিজে সন্তান প্রসব করিয়েছেন। না না না। মেটিস-এর গর্ভে এই সন্তান জন্মেছে তা কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না। তিনি দেবরাজ জিউস। আর তার মেয়ের মা হবে কিনা জ্ঞান ও হস্তশিল্পের দেবী মেটিস! না, তা কিছুতেই হতে পারে না। মেটিস এখনও অজ্ঞান অবস্থায় আছে। এই সময়েই তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
দেবরাজ জিউস শিশুটিকে বুকে আগলে দ্রুত পায়ে এগোতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তার রাজপ্রাসাদে পৌঁছে গেলেন। সারারাত বৃষ্টির পর সূর্যের প্রথম আলোতে সোনার রাজপ্রাসাদ অনেক দূর থেকেই জ্বলজ্বল করছে। মুখটা আরও ভালো করে ঢেকে নিলেন। যদিও প্রয়োজন ছিল না। সৈন্যরা কেউই পাহারায় নেই। অন্যসময় হলে তিনি হুঙ্কার দিতেন। কিন্তু না, আজ সৈন্যরা পাহারায় না থাকায় তিনি বেশ খুশিই হলেন। রাজপথ পেরিয়ে তিনি দ্রুত তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলেন। শিশুটিকে সোনার পালঙ্কে শুইয়ে দিলেন। নিজেও পাশে শুয়ে পড়লেন। সারারাত তিনি বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন। তাঁর জ্বর এল এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথায় তিনি কাতরাতে লাগলেন। ঘরের বাইরে থেকে তাঁর বিশাল শরীরের পাশে ছোট্ট শিশুটিকে দেখা গেল না। দেবরাজকে অনেকক্ষণ ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট অ্যাপোলো এবং রাজপ্রাসাদের দাসদাসীরা ছুটে এলেন। রাজা তখন অসহ্য মাথাব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেনসবাই রাজার কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজার অনুমতি ছাড়া তো আর কক্ষে প্রবেশ করা যায় না! কেউই বাইরে থেকে শিশুকে দেখতে পেল নাহঠাৎ এক শিশুর কান্না শোনা গেলরাজা পাশ ফিরলেন। বাইরে দাঁড়ানো সবাই দেখতে পেল এক নবজাত শিশু তার ছোট্ট একখানি হাত রাজার মুখে কপালে দিচ্ছেন। শিশুটির গায়ে লোহার বর্ম। রাজার মাথাব্যথাও কমে গেলতিনি অবাক নয়নে শিশুটিকে দেখতে লাগলেন। তিনি বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলেন সবাই কি সবকিছু বুঝে গেল! এই চিন্তার কাছে তার মাথাব্যথা কিছুই নয়। কিন্তু তাঁর কানে অন্য কথা এল
‘আচ্ছা, দেবরাজ কি কিছু ভাবছেন!’
‘কিন্তু শিশু এখানে এল কীভাবে!’
বাইরে দাঁড়ানো সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলকেউ কেউ বলল, ‘হয়তো দেবরাজ জিউসের মস্তক থেকে এই দেবশিশুর জন্ম
‘হয়তো এই শিশু জন্মাবে বলেই মহারাজের মাথায় এত ব্যথা হচ্ছিল
দেবরাজ নিশ্চিন্ত হলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মুহূর্তের মধ্যে এই খবর সমস্ত অলিম্পাস পর্বতে ছড়িয়ে পড়ল। রাগী দেবতা জিউসকে কেউ নিজের মুখে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না আর দেবরাজ নিজে মুখেও কাউকে কিছু বললেন না।


সুতরাং শিশুটি দেবরাজ জিউসের মানসকন্যা রূপেই বড়ো হতে লাগলেনরূপে গুণে এই কন্যা অতুলনীয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই এই মেয়ে সবরকম অস্ত্রচালনায় পারদর্শী। শুধু কি তাই! বছর বারো হতে না হতেই এই কন্যা ন্যায়-নীতি, আইন, হস্তশিল্প, সাহিত্যকলা ইত্যাদি নানান বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলেনসমগ্র দেবলোকে এই কন্যা বিশেষ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলেনজিউস জানতেন এই কন্যা অনেক গুণের অধিকারী হবে। কারণ, চিন্তাশক্তি, হস্তশিল্প ও জ্ঞানের দেবী মেটিস এবং সর্বশক্তিমান দেবরাজ জিউসের মিলনে যে তাদের চেয়েও শক্তিশালী কেউ জন্ম নেবে এটাই স্বাভাবিক। দেবরাজ তার কন্যার নাম দিলেন ‘অ্যাথেনা’। অ্যাথেনা হলেন জিউসের প্রিয় সন্তান, চোখের মণি।
সমগ্র গ্রীসদেশের মধ্যে দেবী অ্যাথেনার নাম ছড়িয়ে পড়ল। অ্যাথেনা জ্ঞানের দেবী, যুদ্ধের দেবী। গ্রীসদেশের মানুষ মনে করতেন দেবীর দয়াতেই তারা তাদের দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারছেন। তার নামানুসারেই গ্রীসের রাজধানীর নাম হল এথেন্স। অ্যাথেনাকে এথেন্সের রক্ষাকর্ত্রী বলা হত। গ্রীসে তার মন্দির স্থাপন করাও হয়। তার স্মরণে ‘প্যানাথেনিয়া’ নামে এক বিরাট উৎসব গ্রীকরা পালন করেন। গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়াড এবং ওডিসিতে এই দেবীর নাম পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন এক কুমারী দেবী। ভয়-শঙ্কাহীন এক বিরাট যোদ্ধা জিউসের মতোই খুব রাগী ছিলেন এবং অন্যায় ক্ষমা করতেন না।
অ্যাথেনাকে নিয়ে অলিম্পাস পর্বতের সব দেবতারা গর্ব করতেন। শুধু একজন নিজের মেয়ে জেনেও সর্বক্ষণ মেয়ের থেকে দূরে দূরে থাকতেন। হাজার কষ্টে বুক ফেটে গেলেও নিজের মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে পারতেন না। আর এভাবেই আথেনার জন্মবৃত্তান্ত সমগ্র অলিম্পাস পর্বতের দেবতা ও গ্রীকবাসীর কাছে অধরাই রয়ে গেলএক ক্ষমতাশালী রাগী রাজার প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে এক দুঃখিনী মায়ের কান্না ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে গেল।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল


লেখক পরিচিতিঃ জন্ম ৩রা মার্চ ১৯৯৫, ব্যারাকপুর। বর্তমানে এম.এস.সি. পাঠরতা। লেখালিখির শুরু খুব ছোটবেলায়, ২০০০ সালে স্কুলের দেওয়াল পত্রিকার শিশু-বিভাগে লেখার মাধ্যমে। লেখার বিষয় প্রধানত রূপকথা। তবে বিজ্ঞানবিষয়ক ও সামাজিক গল্প বেশ কিছু লেখা হয়েছে। লেখালিখি আর বিজ্ঞানচর্চা ছাড়াও আরেক নেশা ফুটবল। গান শুনতেও খুব ভালো লাগে।

3 comments: