গল্পের ম্যাজিক:: সেরা পরি - অনন্যা দাশ


সেরা পরি
অনন্যা দাশ

বসন্ত উৎসবের আগে ফুল্লরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর হবে নাই বা কেন? পরির দেশের সেরা দর্জি সে। ওর মতন জামা তো আর কেউ বানাতে পারে না। এবারে ওদের রাজা ঘোষণা করেছেন যে বসন্ত উৎসব এবার অন্যবারের চেয়েও ঘটা করে হবে। আর প্রতিবারের থেকে আলাদা যেটা হবে সেটা হল সেরা পরি নির্বাচন। রাজা, রানি আর রাজসভার লোকজন মিলে সেরা পরির উপাধির যোগ্য একজন কাউকে পুরস্কার দেবেন। সেই ঘোষণার পর থেকেই পরিদের মধ্যে ভয়ংকর রেষারেষি শুরু হয়ে গেছে। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে উৎসবে যেতে চায়।
হলুদপরি স্বর্ণিমার জন্যে হলুদ জামা, লালপরি রক্তিমার জন্যে লাল জামা, নীলপরি নীলিমার জন্যে নীল জামা। এমনি করে কত অজস্র রঙের জামা যে ওকে বানাতে হচ্ছে তার ঠিক নেই। তবে ফুল্লরাই যে পরিলোকের একমাত্র দর্জি, তা কিন্তু নয়। সরলা পরিও আছেন, কিন্তু ওনার বয়স হয়েছে। এখন আর চোখে তেমন ভালো করে দেখতে পান না তিনি। তাই ভালো করে একটা জামা বানাতে অনেক সময় লেগে যায় ওনার। তাছাড়া নতুন ডিজাইনও নেই তেমন তাঁর কাছে তাই ওনার কাছে আজকাল আর কেউ যায় না। সবাই ফুল্লরার কাছেই আসে। অথচ ফুল্লরাকে কাজ শিখিয়েছেন ওই সরলা পরিই। সরলাদি বলে ডাকে ওনাকে ফুল্লরা।
তা যে বসন্ত উৎসবের জন্যে সবার মধ্যে এত উত্তেজনা, সেই উৎসবের আর দু’দিন বাকি। ফুল্লরার সব জামা সেলাই প্রায় শেষ। একটু আগেই নীলিমা তার নীল রঙের জলের কণা দিয়ে তৈরি পোশাকটা নিয়ে গেছে। স্বর্ণিমা তার সোনালি রোদের সুতো দিয়ে সেলাই করা জামা আর রক্তিমা তার কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি দিয়ে বানানো জামাগুলোও নিয়ে গেছে। এছাড়াও বেগুনি, সাদা, গোলাপি, কমলা জামাগুলো আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যদিও সেসব পরিরা রূপে গুণে নীলিমা, স্বর্ণা, রক্তিমা বা পত্রালির ধারে কাছে নেই। সেই জন্যেই ওদের সেরা পরি খেতাব পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় নেই। এখন শুধু পত্রালির কচি সবুজপাতা দেওয়া ঝলমলে জামাটা নিয়ে যাওয়া বাকি। সেটা সে এসে নিয়ে গেলেই ফুল্লরার কাজ শেষ। সে তাহলে তারপর নিজের জন্যে একটা জামা বানাতে পারবে। গতবার ওর কাজ শেষ করতে এত সময় লেগে গিয়েছিল যে নিজের জন্যে নতুন জামা বানাবার সময়ই হয়নিপুরনো জামা পরেই উৎসবে যেতে হয়েছিল তাকে। সেটা আর কেই বা চায়? ফুল্লরার কি ইচ্ছে করে না অন্য পরিদের মতন নতুন জামা পরে উৎসবে যেতে? সবুজপরি পত্রালির জামাটাতে শেষ সেলাই দিয়ে সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখল ফুল্লরা। একটু পরেই পত্রালি এসে পড়বে। ওর চর সবুজ গিরগিটি একটু আগেই খবর নিয়ে গেছে জামাটা তৈরি হয়েছে কি না। পত্রালি আবার খুব মেজাজি। রানিমার কেমন জানি আত্মীয়া হয় সে। প্রতিবারই সে বলে যায় যে তার জামাটাই যেন সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু ফুল্লরা তা পারে না। সে সব পরিদের জামাগুলোকেই ভালো করে বানাবার চেষ্টা করে।
একটু পরেই পত্রালি এসে হাজির হল। জামাটা ওকে ভাঁজ খুলে দেখাতে হল। তবে ওর পছন্দ হল কি হল না ঠিক বোঝা গেল না। সে শুধু রাগি রাগি মুখে ফুল্লরাকে জিজ্ঞেস করল, “আর কার কার জন্যে জামা বানিয়েছ তুমি?”
ফুল্লরা ভয় পেয়ে ঢোঁক গিলে বলল, “লালপরি, নীলপরি, হলুদপরি... মানে সব পরিরাই তো প্রায় আমার কাছেই এসেছিল। সবার জন্যেই তো বানিয়েছি।”
“হুঁ, আমি চললাম। তোমার পারিশ্রমিক বসন্ত উৎসবের পরে পাবে,” বলে সে চলে গেল।
চোখ ফেটে জল এসে গেল ফুল্লরার। এত খেটেখুটে জামাটা বানাল সে আর তার পারিশ্রমিক কিনা পাবে বসন্ত উৎসবের পর! কিন্তু কিছু বলা চলবে না। রানিমার আত্মীয়া হয় যে।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফুল্লরা আলমারি থেকে নিজের জন্যে কেনা পছন্দের ফুরফুরে রামধনু রঙের কাপড়টা বার করেছে এমন সময় গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল। কাপড়ে দাগ কেটে কাঁচিটা দিয়ে সবে কাটতে যাবে এমন সময় রক্তিমা কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির।
“কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?” ফুল্লরা জিজ্ঞেস করল।
“এই দ্যাখ, তোমার বানানো সুন্দর জামাটার কী দশা হয়েছে!”
ফুল্লরা তাকিয়ে দেখল। সত্যিই তো! কে যেন তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে দিয়েছে জামাটাকে! রক্তিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ফুল্লরা, তুমি দয়া করে আমার জন্যে আরেকটা জামা সেলাই করে দাও। তোমার যত পারিশ্রমিক লাগে আমি দেব!”
রক্তিমাকে অঝোরে কাঁদতে দেখে ফুল্লরার মন ভিজে গেল সে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি এখুনি বাজারে গিয়ে নতুন কৃষ্ণচূড়া কাপড় নিয়ে আসছি। বসন্ত উৎসবের আগেই তুমি তোমার জামা পেয়ে যাবে। কিন্তু জামাটার ওই দশা কী করে হল সেটা জান?”
“নাহ, কাল নিয়ে গিয়ে আলমারিতে যখন ঝুলিয়ে রেখেছিলাম তখন ঠিক ছিল আজ সকালে মাকে দেখাবার জন্যে যখন বার করেছি তখন দেখি এই দশা!” বলতে বলতে আবার কাঁদতে শুরু করল রক্তিমা।
ফুল্লরা ওকে শান্ত করে ভরসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। একটু পরেই কিন্তু স্বর্ণিমা আর নীলিমাও এসে হাজির। ওদের দুজনের জামারও ওই একই অবস্থা! ওরা দুজনেই পীড়াপীড়ি করতে লাগল নতুন জামা বানানোর জন্যে। ফুল্লরা কী আর করবে! ওকে রাজি হতে হল। দুজনে কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ করে ফেলছে যে! তাছাড়া ওরা শুনেছে যে সে রক্তিমার জামা আবার বানিয়ে দেবে, তাই ওরা না শুনতে রাজি নয়।
নতুন কাপড় কিনে ভীষণভাবে কাজে লেগে গেল ফুল্লরা।
“কী ব্যাপার ফুল্লরা? কালকে শুনলাম তোমার সব জামা বানানোর কাজ হয়ে গেছে তাহলে আজকে এত কাপড় নিয়ে কী সেলাই করতে বসেছ আবার?”
ফুল্লরা চমকে তাকিয়ে দেখল সরলাদি!
“কী বলব সরলাদি, কে যেন স্বর্ণিমা, রক্তিমা আর নীলিমার জামাগুলো ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে। ওদের জন্যে আবার নতুন জামা বানাতে হচ্ছে।”
“সে কী! এ তো ভয়ানক ব্যাপার! পরিলোকে এরকম তো কখনও হয়নি কে করেছে জান?”
“না, আমি তো কিছুই জানি না। ওরাও কিছু জানে না।”
“হুঁ, আমার মনে একটা সন্দেহ আছে। তা সরে যাও তুমি একা কী করে একদিনে এতগুলো জামা বানাবে? এস, আমি সাহায্য করি আমি তাড়াতাড়ি করতে পারি না এখন, কিন্তু কিছু তো করতে পারব!”
আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলল ফুল্লরা। সত্যি সে কী করে একদিনে তিনটে জামা বানাবে সেই ভেবে ভেবেই হয়রান হচ্ছিল। সরলার কথা শুনে সে সরলার পা জড়িয়ে ধরল, “আমাকে ক্ষমা করে দাও সরলাদি! আমিই সবাইকে তোমার নামে এটা সেটা বলে তোমার ব্যবসা নষ্ট করছি। পৃথিবী থেকে বই চুরি করে এনে সেসব ডিজাইনের জামা বানিয়ে নতুন ডিজাইন বলে চালিয়েছি। পরিদের জামা নষ্ট হয়ে যেতে আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আমার প্রতি হিংসাতে এই কাজ করেছ। কিন্তু এখন তুমিই আমাকে সাহায্য করতে এসেছ আমি তো তোমার শত্রু!”
সরলা পরি হাসলেন, “এই যে তুমি ক্ষমা চেয়ে নিলে তাতেই তোমার সব অপরাধ ধুয়ে গেল। আমি সবই জানি। আর জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেন যে শত্রুতা নষ্ট করার সবচেয়ে ভালো উপায় হল শত্রুকে বন্ধু করে নেওয়া তাই আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। তবে কী, আমার তো সত্যি বয়স হয়েছে। এখন আর চোখে ভালো দেখি না, আঙুলে তেমন শক্তি নেই। বসন্ত উৎসবের আগে ওই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার আর ক্ষমতাও নেই। কাজ কম হয়ে আমার ভালোই হয়েছে। তবে জেনে রেখ, ক্ষতি করে নিজের লাভ করলে কখনও ভালো হয় না। আর কেউ জানুক না জানুক, তুমি নিজে তো জানবে। সেটাতেই তোমার দুঃখের শেষ থাকবে না। যাক ওসব থাক, এস, কাজগুলো শেষ করি।”
ফুল্লরা আর সরলা মিলে একদিনেই তিনখানা জামা তৈরি করে ফেলল। হলুদপরি, লালপরি আর নীলপরিকে বলা হল যেন বসন্ত উৎসবের দিন সকালবেলা এসে জামাগুলো নিয়ে যায়।
সরলা পরি বললেন, “শোনো ফুল্লরা, আজকের রাতটা আমি এখানেই থাকি। আমার মনে হয় কেউ হয়তো আবার জামাগুলো নষ্ট করার চেষ্টা করতে আসতে পারে
ফুল্লরা একটু পরেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু সরলা পরি জেগে বসে রইলেন। গভীর রাতে খুসখুস খসখস শব্দ ভেসে এল কেউ একটা আসছে ফস করে আগুন জ্বেলে মোমবাতির আলোয় সরলা দেখলেন একটা সরু সবুজ ল্যাজ দরজার তলা দিয়ে মিলিয়ে গেল!

বসন্ত উৎসবের দিন সকালবেলা পরিরা সব এসে তাদের জামা নিয়ে গেল। লোহার সিন্দুকে নিরাপদেই ছিল সেগুলো। ফুল্লরা তার পুরনো জামাগুলোর মধ্যে থেকে কোনটা পরবে তাই ভাবছিল এমন সময় সরলা পরি এসে বললেন, “এই নাও ফুল্লরা, এটা পরলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাবে
ফুল্লরা আশচর্য হয়ে দেখল ওর নিজের কেনা রামধনু রঙের কাপড় দিয়ে কখন জানি সরলা পরি ওর জন্যে সুন্দর একটা জামা বানিয়ে ফেলেছেন। আনন্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ফুল্লরা।
“আরে, কাঁদছ কেন? তোমাদের বয়স কম, বসন্ত উৎসবে তোমরা আনন্দ করবে না তো কারা করবে?”
বসন্ত উৎসব দারুণ হল। সবার শেষে সেরা পরি পুরস্কার ঘোষণায় রাজা বললেন, “এবারের সেরা পরি পুরস্কার পাচ্ছে ফুল্লরা পরি! ওর মতন সুন্দর জামা আর কেউ বানাতে পারে না আমাদের এখানে
ফুল্লরা তো এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষে সবাই ওকে ঠেলে মঞ্চে রাজা-রানির কাছে পাঠাল। রানি ওর মাথায় মুকুট পরাতে গেলেন আর রাজা ওর হাতে পুষ্পস্তবক দিতে লাগলেন। ফুল্লরা কিন্তু কিছুই নিল না হাত তুলে বাধা দিল। সবাই দেখল মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফুল্লরা ফিসফিস করে রাজা-রানিকে কীসব বলছে। ওর কথা শেষ হতে রাজা-রানি নিজেদের মধ্যে কীসব পরামর্শ করতে লাগলেন। অবশেষে রাজা ঘোষণা করলেন, “ফুল্লরা আমাদের সবকিছু বলেছে এবং সেই ভিত্তিতে আমাদের মনে হচ্ছে যে সেরা পরি পুরস্কার সরলা পরির পাওয়া উচিত কারণ, সে নিঃস্বার্থভাবে ফুল্লরাকে সাহায্য করেছে ফুল্লরা ওর ব্যবসা ভেঙে দিয়েছিল, তাও! তবে এটাও ঠিক যে ফুল্লরা যদি সাহস আর ভালো মনের পরিচয় দিয়ে আমাদের সত্যি কথাটা না বলত তাহলে আমরা তো কিছুই জানতে পারতাম না! সেই জন্যে এবারের সেরা পরি পুরস্কার যুগ্মভাবে ফুল্লরা আর সরলাকে দেওয়া হচ্ছে! সেই সঙ্গে পত্রালি আর তার পোষা গিরগিটিকে পরির দেশ থেকে নির্বাসিত করা হচ্ছে চিরকালের মতোআমরা জানতে পেরেছি যে সেরা পরি হওয়ার লোভে তারা অন্যদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। যাও, বেরিয়ে যাও তোমরা। আর কোনোদিন যেন তোমাদের এখানে না দেখি!”
সবুজপরি আর গিরগিটি চলে যেতে রানি বললেন, “পরিলোকে সবুজপরি থাকবে না তা তো হয় না, তাই তোমাদের মধ্যে থেকে যারা যারা সবুজপরি হতে চাও তারা আমাদের দরখাস্ত পাঠিও, আমরা বিবেচনা করে দেখে নির্বাচন করব

ফুল্লরা আর সরলা পরি দুজনে এখন একসঙ্গে পরির দেশের পোশাক তৈরির দোকানটা চালায়। ওদের দোকানের নাম ‘সেরা পরিদের সেরা পোশাক’।

_____
অলঙ্করণঃ নন্দন ঘর ও ঋতম মুখার্জি

2 comments: