তুন্তিয়া ও সাদা হাতি
রাজীবকুমার সাহা
সেদিন হল কী, আগেরদিনের
পান্তাভাতে একটুখানি ঝালঝাল গোদক মেখে খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলে শুয়ে পড়েছিল তুন্তিয়া।
একটু আগেই পাশের বাড়ির কচুবাগান লণ্ডভণ্ড করে এক শুয়োরছানার পেছনের একটা ঠ্যাং
খোঁড়া করে ফিরেছে। টংঘরের ঝাঁপ উঠানো খিড়কি দিয়ে ফুরফুর করে আসছে চৈত্রের
ঘুমপাড়ানি হাওয়া। চোখও লেগে গেল নিমেষেই। তারপর সেই বিকেল পড়তে মা-বাবা জুম থেকে
ফিরতেই ছেলের নাকডাকা থামিয়ে রোজকার চোটপাট শুরু করল।
তুন্তিয়ার বাবা তো এই মারে তো এই ধরে যাকে বলে। জোরে জোরে ধমকাতে লাগল, “তুই কি আর
কোনোদিন মানুষ হবি না, অ্যাঁ? হাট-বাজারে যেতে পারি না, জুমক্ষেতে
যেতে পারি না, কেবল তোর নামে নালিশ আর নালিশ। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
ক্লান্ত মা দাওয়ায় বসে পাছড়ার
খুঁটে চোখ মুছে বলল, “কেন যে এমন হলি বাবা তুই! কুটোটা পর্যন্ত তোকে দিয়ে নড়ানো
যায় না। আমরা ক্ষেতে বেরিয়ে পড়লেই গ্রামজুড়ে তোর দস্যিপনা শুরু। আমার আর ভাল্লাগছে
না। আর পারছি না আমি। চলে যাব যেদিকে দু’চোখ যায় একদিন দেখে নিস...।”
কান্নায় গলা আটকে আসায় মায়ের
শেষদিকের কথাগুলো আর স্পষ্ট শুনতে পেল না তুন্তিয়া। তুন্তিয়া অসম্ভব দুরন্ত
প্রকৃতির ছেলে হলেও মাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওকে ফেলে রেখে মা কোথাও চলে যাবে
এ কথাটা তার বুকে শেলের মতো বিঁধল গিয়ে। তুন্তিয়া মনে
মনে ঠিক করে নিল যে কাল থেকে সে ভালো হয়ে চলবে। জুমচাষে বাবা-মাকে সাহায্য করবে।
তুন্তিয়ার বাবা গামছাটা কাঁধে
ফেলে চলে যেতে গিয়েও আবার তেড়ে এল। অগ্নিশর্মা
হয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। কাল সকালে এই ঘর ছেড়ে চলে যাবি তুই। কোনও কথা শুনতে চাই
না।”
তুন্তিয়ার মা অনেক সাধ্যসাধনা
করেও স্বামীর কথা ফিরিয়ে আনতে পারল না।
বাবার মুখে এ কথা শুনে
তুন্তিয়ার সে কী অভিমান, কী অভিমান! সারারাত উপোস করে ফুলে ফুলে শুধু কেঁদেই গেল।
তারপর কাক ডাকার আগেই ভোররাতে নিঃশব্দে টংঘরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল। যাবার সময়
শুধু ওর প্রিয় টাক্কালটা নিয়ে গেল কোমরে গুঁজে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে হাতের কাছে
পাওয়া গাছগাছড়া কুচিকুচি করে শেষে ছড়ার জলে পা ডুবিয়ে বসল। আঁজলা ভরে জল খেয়ে খিদে
মেটাল খানিকটা। তারপর কী মনে করে হাত বাড়িয়ে
চারাগাছের একটা সরু ডাল ভেঙে নিয়ে টাক্কাল দিয়ে ছাল ছাড়াতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরেই খানিকটা দূরে
পাতলা জঙ্গলের ভেতর রাজবাড়ির সাদা হাতিটাকে নিয়ে হঠাৎ বিষম এক শোরগোল পড়ে গেল।
হাতিটা হঠাৎ যেন পাগল হয়ে গেছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই তাড়া করে আসছে আর ঘন ঘন
মাথা ঝাঁকাচ্ছে; শুঁড় নাড়াচ্ছে অনবরত। মহারাজের এই সাদা হাতিটা বিশেষ প্রিয়। এটাই
তাঁর পাটহস্তী। প্রতিদিন সকাল সকাল তিনজন মাহুতসহ প্রায় জনাকুড়ি সেপাই-সান্ত্রীর
ওপর একে এদিক ওদিক চরিয়ে আনার হুকুম রয়েছে। আজও সেইমতো ছড়ার পাড়ে আনা হয়েছে। নধর
নধর কলাগাছ ভেঙে দিব্যি আয়েশ করে খাচ্ছিল হাতিটা। হঠাৎ কী যে হল! কিছুতেই বাগ
মানছে না। এখন মহারাজকে এই খবরটা দেবে কে? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা!
ত্রিপুররাজের যেমন
দোর্দণ্ডপ্রতাপ তেমনি ভয়ংকর ক্রোধ। মাহুতেরা সাদা হাতিটাকে প্রাণ হাতে করে কোনওরকমে
হাতিশালে এনে ঢুকিয়ে ভালো করে বেঁধে রেখে সোজা মহামন্ত্রীর শরণাপন্ন হল। এই যে
বিচক্ষণ মহামন্ত্রী, সব শুনে তাঁরও মুখটা কালো হয়ে গেল। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে
মহামন্ত্রী রাজদরবার শুরু হতেই মহারাজকে কৌশলে হাতির কথাটা পাড়লেন। বললেন,
“মহারাজ, একটু সমস্যা হয়েছে। আপনার সাদা হাতিটা খানিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি
পশুবৈদ্যকে খবর পাঠিয়েছি, এই আসছেন।”
মহারাজ তো চমকে উঠে সিংহাসন
ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন প্রায়। হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, “আমার সাদা হাতি
অসুস্থ! কী হয়েছে ওর? এদিক ওদিক কিছু হলে আমি মাহুতগুলোর গর্দান নেব। এই বলে
রাখলাম। অপদার্থ সব।”
মহামন্ত্রী অনুনয় করে বললেন,
“দয়া করে শান্ত হোন মহারাজ। এখনই এতটা উতলা হয়ে পড়বেন না। শরীর থাকলে রোগশোক তো
থাকেই। গত আষাঢ়েও তো এর হজমে গণ্ডগোল হয়েছিল বেশ ক’দিন ধরে। পশুবৈদ্যই তো চিকিচ্ছে
করে সুস্থ করে তুললেন। উনি এলেন বলে।”
মহারাজ কিছুটা শান্ত হলেও
অস্বস্তি গেল না তাঁর। অল্পক্ষণ পায়চারি করে শেষে লম্বা লম্বা পা ফেলে সোজা রওনা
হলেন হাতিশালের দিকে। পেছন পেছন মহামন্ত্রীও দৌড়ে গেলেন। পশুবৈদ্যও এসে পড়েছেন এর
মধ্যে। মহারাজ একবার প্রিয় হাতির দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে ওর
পশুবৈদ্য? কোথায় সমস্যা?”
“আমি দেখছি, মহারাজ। একটু সময়
লাগবে।”
“ওর কিছু হলে কিন্তু আমি
সবক’টাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব,” গর্জন করে উঠলেন মহারাজ।
তারপর অনেক পরীক্ষা হল,
নিরীক্ষা হল। কিন্তু পশুবৈদ্য কিছুতেই রোগটা ধরতে পারলেন না।
শেষে পিছিয়ে এসে দু’হাতের পাতা বেঁধে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সাদা হাতিটা ঠিক
আগের মতোই মাথা আর শুঁড় ঝাঁকিয়ে চলেছে একনাগাড়ে। অনেকটা
নেতিয়েও পড়েছে এর মধ্যেই। শ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে খানিকটা। মহারাজ নিজেও
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
“মহারাজের জয় হোক।”
একরাশ বিরক্তিসহ পেছন ফিরে
তাকালেন মহারাজ। চোখমুখ লাল করে ধমকে উঠলেন, “কে তুমি? কী চাই?”
“আমি একজন ওঝা, মহারাজ।
ঝাড়ফুঁক আর কিছু তন্ত্রমন্ত্র জানি। আপনার আজ্ঞা হলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে
চাই।”
মহারাজ চিন্তিত মুখে
মহামন্ত্রীর দিকে তাকাতেই মহামন্ত্রী ইশারায় সম্মতি দিলেন। ওঝা তার কাজ শুরু করল।
অনেক মন্ত্রতন্ত্র আওড়ে, গুনেটুনে ওঝা বলল, “মহারাজ, হাতির বিশেষ কিছু হয়নি। শুঁড়ে
একটা বাদুড় ঢুকে আছে মাত্র।”
“কী! বা-দুড়! জান তো, মিথ্যে
বললে...”
“জানি মহারাজ, প্রাণ নিয়ে আর
ফিরতে পারব না। নিশ্চিন্ত থাকুন মহারাজ, যা বললাম সেটাই সত্যি। এবার যত তাড়াতাড়ি
ওটাকে বের করার ব্যবস্থা করা হয় ততই মঙ্গল।”
মহারাজ খানিক ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়ে হাঁক দিলেন, “মহামন্ত্রী, মাহুত...”
মহামন্ত্রী ব্যস্তসমস্তভাবে
এগিয়ে এসে বললেন, “এখুনি সব ব্যবস্থা করছি মহারাজ। আপনি ততক্ষণ একটু বিশ্রাম...”
“একদম নয়। আমি স্বচক্ষে দেখতে
চাই। আর ওই ওঝাকে আপাতত পাহারায় রাখুন।”
অভ্যেসমতো মহামন্ত্রী
‘ব্যবস্থা করছি’ তো বলে ফেললেন, কিন্তু ব্যবস্থাটা করবেন কী! পড়লেন মহা সমস্যায়।
অনেক মাথাটাথা চুলকেও মহামন্ত্রী হাতির শুঁড়ের ভেতর থেকে বাদুড় বের করার ফন্দি বের
করতে পারলেন না। শেষে ডাক পড়ল সভাসদদের, মহারাজের উপদেষ্টামণ্ডলীর। হাজারটা কথা
হল, তর্কবিতর্ক হল, মাহুতদের ওপর চোটপাট হল। কিন্তু কেউই কোনও উপায় বের করতে সফল
হলেন না। ওদিকে রাজার সাদা হাতি তো যায় যায় অবস্থা। মহারাজ অধৈর্য হয়ে উঠে হঠাৎ
ওঝাকে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “কীরকম ওঝা হে তুমি, অ্যাঁ? একটা কিছু মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে
ওটাকে বের করে আনতে পার না?”
ওঝা শান্ত গলায় জবাব দিল,
“মাপ করবেন মহারাজ, এ আমার ক্ষমতার বাইরে।”
মহারাজ চটেমটে লাল হয়ে আদেশ
করলেন, “অ্যাই কে আছিস, লোহার শিক গরম করে নিয়ে আয়। উনুন জ্বালা। আজ ওই হতচ্ছাড়া
বাদুড়ের একদিন কি আমার একদিন। যা শিগগির।”
এই কথা শুনে শুঁড়ের ভেতর আটকে
থাকা বাদুড় তো ভয়ে দিশেহারা। বেরোলে মহারাজ জীবিত রাখবেন না, আবার শুঁড়ের ভেতর বসে
থাকলেও গনগনে লাল শিকের খোঁচা খেয়ে মরতে হবে। সে তাড়াতাড়ি বলল, “মহারাজ, আমি অনেক
চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারছি না। তবে একটা উপায় বলতে পারি, যদি কাজে লাগে...”
মহারাজের তো ভিরমি খাবার
জোগাড়। হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! তবুও সামলে নিয়ে বললেন, “অ্যাঁ, তুই
বাতলাবি উপায়! তা, কী উপায়? শুনি একবার।”
বাদুড় বলল, “হাতিকে হাঁচবার
ব্যবস্থা করুন মহারাজ, তাতে যদি একমাত্র বেরিয়ে আসতে পারি।”
গুম মেরে থাকা সভাসদদের মধ্যে
এবার গুঞ্জন উঠল। মহামন্ত্রী কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না
মহারাজ। তবে হাতিকে হাঁচি দিতে আমি দেখিনি যদিও।”
না, বাদুড়ের বুদ্ধিতে কাজ
হয়েছে। তিন সের ইয়াব্বড়ো বড়ো শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে হাতির শুঁড়ের সামনে ধরতেই এক
রামহাঁচির চোটে মাহুত ছিটকে গিয়ে এক্কেবারে তিনহাত দূরে পড়েই হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর
করে মারল দৌড়। সবাই প্রস্তুত হয়েই ছিল। সারাগায়ে
হাতির সর্দিটর্দি মেখে বাদুড় বেচারি তোপের গোলার মতো ছিটকে এসে মাটিতে পড়তেই দুজন
জাল পেঁচিয়ে তুলে নিল মুহূর্তেই। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাদুড় জোড়হাতে বলল, “মহারাজ,
আমার বিন্দুমাত্রও দোষ নেই। আমি ইচ্ছে করে ঢুকিনি। ওই শুয়োরটা যদি না ধাক্কা মারত
গাছে...”
“কে ধাক্কা মেরেছে?”
“একটা শুয়োর মহারাজ। বেশ
তাগড়াই আর দাঁতালো। গাছে ধাক্কা মেরে আমার বাসা ভেঙে
দিয়েছে মহারাজ। আমি প্রাণের ভয়ে সামনে যা পেয়েছি
তাতেই ঢুকে গেছি। সাদা হাতির শুঁড়ের চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর খুঁজে পাইনি হুজুর।”
“অ্যাই, ওই শুয়োরব্যাটাকে ধরে
নিয়ে আয় এক্ষুনি। যা।”
‘যে আজ্ঞে’ বলে সৈনিকেরা
বেরিয়ে পড়ল। শুয়োর তো তাদের দেখামাত্রই কচুবনের থিকথিকে পচা কাদায় শরীর ডুবিয়ে নাক
উঁচিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। তবে কিছুক্ষণ পরেই শুয়োরটাকে হাত পা বেঁধে
লম্বালম্বিভাবে বাঁশ গলিয়ে কাঁধে করে হাজির করল সৈনিকেরা। শুয়োর
সটান বলল, “কী করব মহারাজ! আমি তো আপন মনে কচু খাচ্ছিলাম। ছিরকুট্টি ধারালো দাঁত
দিয়ে যদি কেউ লেজ কামড়ে ধরে তবে কি আর হুঁশ থাকে বলুন! আমার কোনও দোষ নেই মহারাজ।”
“কে কামড়ে ধরেছে তোর লেজ?”
মহারাজ ধমকে উঠলেন।
“আজ্ঞে, ওই শোলমাছটা মহারাজ।
ছড়ায় থাকে।”
রাজার আদেশে জেলে নামিয়ে ছড়া
থেকে শোলমাছকে তুলে আনা হল। শোলমাছ নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে আড়চোখে শুয়োরের
দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “মাথায় যদি বেমক্কা এক টাক্কাল এসে পড়ে তখন কি আর মাথা
ঠিক থাকে হুজুর! ভাগ্যিস লেজটা সামনে পেয়েছি, তাতেই কামড় বসিয়েছি। নইলে কোথায়
কামড়ে দিতাম কে জানে ওই কচুখেকোটার।”
মহারাজ এবার বেশ মজা পেয়ে
গেলেন। আয়েশ করে বসে জিজ্ঞেস করলেন, “টাক্কাল! কে মারল?”
“ওই তুন্তিয়াটার হাতে ছিল
মহারাজ। বলা নেই কওয়া নেই, আমার গায়ে ছুঁড়ে মারল আচমকা। আমি জল থেকে লাফ মেরে উঠেই
ওই কচুখেকোটাকে সামনে পেলাম। আমি কী করব!”
মহারাজের এবার রাগ হয়ে গেল
বেশ। হুকুম করলেন, “অ্যাই, তুন্তিয়া না পান্তুয়া, ওটাকে পাকড়ে নিয়ে আয় তো। এত
বড়ো আস্পর্ধা! শুধুমুধু টাক্কাল ছুঁড়ে মারে!”
তুন্তিয়া শেষপর্যন্ত খিদের
জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়ে রাগ-অভিমান সব ছড়ার জলে বিসর্জন দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরেছিল
সবে। সেপাই এসে টেনে নিয়ে চলল রাজবাড়িতে। রাজার
চেহারা দেখে তুন্তিয়া তো হাঁউমাউ করে কেঁদেই ফেলল। এদিকে ছেলেকে রাজা ধরে এনেছেন
শুনে তুন্তিয়ার মা-বাবাও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এল। মূল
অভিযুক্ত হাজির। রাজা এবার বিচার শুরু করলেন। জিজ্ঞেস
করলেন, “তোর নাম তুন্তিয়া? শোলমাছকে টাক্কাল ছুঁড়ে মারলি কেন বল?”
তুন্তিয়া হাতের চেটো দিয়ে
নাকটাক মুছে ভাঙা গলায় বলল, “আমি শোলকে মারিনি মহারাজ।”
“অ্যাঁ! কাকে মেরেছিলি!”
“আজ্ঞে, ওই দুষ্টু
চিংড়িটাকে।”
“চিংড়ি? চিংড়ি কোত্থেকে এল
আবার!” বেশ হতাশ হয়ে পড়লেন মহারাজ।
“ছড়ার জলেই ছিল মহারাজ। আমি
বসেছিলাম পা চুবিয়ে। হঠাৎ আমার পায়ে কুট্টুস করে কামড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমার কেন
জানি রাগ হয়ে গেল। হাতে টাক্কালটা ছিল, ছুঁড়ে মেরেছিলাম। ওর গায়ে না লেগে শোলের
গায়ে লেগে যাবে কেমন করে জানব!” বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তুন্তিয়া।
“বেশ। তা তুই ছড়ার পাড়ে কী
করছিলি, এত সকালে?”
এবার তুন্তিয়ার মা-বাবা এগিয়ে
এল। আদ্যোপান্ত সব খুলে বলল রাজাকে। তুন্তিয়ার আলসেমি আর দুরন্তপনার কথাও গোপন করল
না। রাজা শুনতে শুনতে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন তুন্তিয়ার মুখের দিকে। তারপর হুকুম
করলেন, “অ্যাই, কে আছিস, ওই চিংড়িটাকে ধরে আন। আজ ওর পাঁচ জোড়া পা খোঁড়া করে দেব
আমি।”
তারপর তুন্তিয়ার মা-বাবাকে
উদ্দেশ করে বললেন, “তুন্তিয়া আজ থেকে রাজবাড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা করবে। পাঠ শেষ হলে
বাড়ি ফিরে যাবে। এর আগে নয়। মাঝে মাঝে তোমরা এসে দেখে যেও ছেলেকে। যাও।”
হতভম্ব তুন্তিয়া মায়ের দিকে
তাকিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। ওর মা-বাবার চোখে তখন আনন্দের জল চিকচিক করছে।
চিংড়িকে বেঁধে আনা হল। কিন্তু
সে আত্মপক্ষ সমর্থনে তেমন কোনও যুক্তি দেখাতে পারল না। একের পর এক এতসব ঘটনার মূল
অভিযুক্ত হিসেবে চিংড়িকেই চিহ্নিত করা হল।
এবারে শাস্তিবিধানের পালা।
ওঝা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “মহারাজ, আপনি অনুমতি দিলে চিংড়ির একটা উপযুক্ত শাস্তির
ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমন মন্ত্র পড়ে দেব যে কেউ চিংড়িকে কড়ার তেলে ছাড়লেই সে
আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাবে। নিজের জলজলে রং আর থাকবে না। তাহলে ভবিষ্যতে এদের মধ্যে
কেউ আর দুষ্টুমি করার সাহস করবে না। কারণ, চিংড়িরা সবাই লাল রঙকে ঘেন্না করে,
পছন্দ করে না।”
মহারাজ খানিক ভেবে নিয়ে মুচকি
হেসে বললেন, “ঠিক আছে। তবে তাই হোক। উনুন জ্বেলে কড়া চাপা রে, তেল ঢাল।”
(ত্রিপুরদেশের পার্বত্য অঞ্চলের
শ্রুতিগল্প অবলম্বনে)
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জী
দিব্যি মজার গল্প
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
DeleteKhub bhalo laglo Rajib babu..ekdom chotoder upojogi mojar golpo ja boroder o mon bhalo kore debe..
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
Delete