বিজ্ঞান-ভ্রমণ
পল্লব কুমার চ্যাটার্জী
ছোট্ট বন্ধুরা, অবাক হ’লে
বুঝি শীর্ষকটি দেখে? আমাদের দেশে এটা অবাক হবার মতোই কথা। আমরা বেড়াতে গেলে কী কী
দেখতে যাই সাধারণতঃ? তীর্থস্থান, মন্দির-চার্চ-দরগা, ঐতিহাসিক স্থান, প্রাকৃতিক
দৃশ্য – যেমন পাহাড়, সমুদ্র, ঝর্ণা, জঙ্গল, জীবজন্তু, প্রাচীন সৌধ, প্রত্নতাত্ত্বিক
খোঁড়াখুঁড়ি, এরকম কত কিছু। কিন্তু এরকম কি শুনেছ কোথাও যে বৈজ্ঞানিক আশ্চর্য দেখতে
লোকে ছুটছে দেশ-বিদেশে? কবে কোথায় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে আগ্নেয় পাথর বা মহাকাশ থেকে
খসে পড়েছে উল্কাপিণ্ড, পাহাড়ের বুক থেকে চুঁইয়ে আসা খনিজ-ধোয়া জল থেকে গজিয়ে ওঠা
অজস্র স্ফটিক (crystal) ছুঁচের মত
খাড়া হয়ে আছে। কোথাও মাইলের পর মাইল প্রান্তর দুধের মত সাদা আবার কোথাও বা খোলা
মাঠে যখন তখন আগুনের কুণ্ডলি ঝলসে উঠছে – এসবকে তোমরা কী বলবে? ঈশ্বরের লীলা ভেবে
শুধু ভক্তিভরে প্রণাম করবে? না কি এর বৈজ্ঞানিক রহস্য জানার জন্যে কৌতূহলে ছুটে
যাবে, খুঁজে বেড়াবে বই-পত্র, কারণ জিজ্ঞেস করবে মা-বাবা-টিচারদের কাছে? অবশ্য
ঈশ্বরের লীলা ভাবলে দোষের কিছু নেই, কারণ এই মহাবিশ্বে যেখানে যা কিছু ঘটছে তার
পিছনে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তাকেই যদি ভগবান বল তাহলে সব সৃষ্টি তাঁরই লীলা, কিন্তু
তার যে একটা বিজ্ঞান-সম্মত কারণও আছে তা জানতে পারলে দেখবে আনন্দটা লাফিয়ে চারগুণ
বেড়ে যাবে।
এত বড় ভূমিকাটা কেন দিলাম
জান? কারণ ভ্রমণ করতে গিয়ে কোনও কিছুর সৌন্দর্য, ইতিহাস বা ধার্মিক মাহাত্ম্য নিয়ে
আমরা এত ব্যস্ত থাকি যে তার পেছনে যে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে সে কথা নিয়ে
খুব কমই মাথা ঘামাই, অন্ততঃ আমাদের দেশের লোকেরা। তাই আমরা কুতুব মিনারের চত্বরের
লৌহস্তম্ভ দেখে পেছন-দিক দিয়ে সেটা জড়িয়ে ধরতে যাই - যে পারে সে নাকি খুব ভাগ্যবান
বা তার প্রাচীনত্ব নিয়ে মাথা ঘামাই, কিন্তু ভাবি না যে স্তম্ভটি কত উন্নতধরণের
ইস্পাতে তৈরি যে আজ হাজার বছরেও তাতে মরচে ধরেনি। তেমনই হিমাচলের জ্বালামুখী
অঞ্চলে দেবীর মন্দিরে যে এক জায়গায় একটানা আগুন জ্বলছে নিজে থেকেই, তার ব্যাখ্যা
হিসেবে বোঝান হয় নাকি সতীর জিভ পড়েছিল সেখানে তাই দৈবশক্তিতে আগুন জ্বলছে,
জ্বালামুখী পুরাণোক্ত একান্ন পীঠের একটি। কেউ কিন্তু একথা বলে না যে মাটির নিচে
জমা হাইড্রোকার্বন গ্যাস ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে ভূগর্ভ থেকে, তাই জ্বলছে সারাক্ষণ।
তাই বলছি, সর্বত্র ঘুরে বেড়াও, ভালো জিনিস দেখে খুশি হও, তারিফ কর, কিন্তু
জিজ্ঞাসা থামিও না। তাহলে এবার আমরা এই ভারতেরই কয়েকটা বৈজ্ঞানিক তীর্থক্ষেত্র
ঘুরে আসি, আপাততঃ ম্যাজিক ল্যাম্পের পাতা ধরে, পরে সুযোগ পেলে কিন্তু জায়গাগুলো
দেখতে ছেড়ো না।
১)
স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট (Stalactite and Stalagmite)
বরাগুহালু, আরাকুভ্যালী (অন্ধ্রপ্রদেশ)
স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট (Stalactite and Stalagmite)
বরাগুহালু, আরাকুভ্যালী (অন্ধ্রপ্রদেশ)
চিত্র - ১ |
১নং
ছবিটি দেখ। এটি অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপট্টনম থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে
অনন্তগিরি পাহাড়ের আরাকু উপত্যকায় স্থিত বোরা বা বরগুহালুর গুহার ভেতরের একটি
দৃশ্য। ৭০৫ ফুট উচ্চতায় স্থিত প্রায় ২০০ মিটার লম্বা এই গুহা ৮০ মিটার গভীর, যার
মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন আকৃতির ও সাইজের চুনাপাথরে গড়া প্রচুর প্রাকৃতিক
ভাস্কর্য। তার মধ্যে কয়েকটা মাটি থেকে উপরে উঠেছে, কিছু ছাত থেকে ঝুলছে, আবার কিছু
মোটা স্তম্ভের মত মাটি থেকে গুহার ছাত পর্যন্তও উঠেছে। সাধারণ যাত্রী-দর্শক এসব দেখে
হর-গৌরী, কালী, ভূত, হাতীর শুঁড়, ঋষির দাড়ি - কত কিই না কল্পনা করে। এই কল্পনা
শুরু হয় গুহার শেষপ্রান্তে থাকা একটি শিবলিঙ্গের আকারের স্তম্ভ থেকে যার উপরে আছে
একটি গরুর আকৃতির মূর্তি। তার নিচ দিয়ে নেমে আসা জলস্রোত একটি নদীতে পরিণত হয়, তাই
সেই নদীর নাম ‘গোস্থান’। কিন্তু এগুলো আসলে কী বা কীভাবে এর উৎপত্তি সে নিয়ে কে মাথা
ঘামায়? এস তাহলে আমরা একটু ভাবি।
গাঢ়
তরল বা দ্রবণ যখন মাটি বা ছাত থেকে চুঁইয়ে বেরোয়, তার পৃষ্ঠ-টানের (surface tension) ফলে তা খসে পড়ে না আর তার
মধ্যে দ্রবীভূত বা তরল অবস্থায় থাকা বস্তু কঠিন হয়ে মূল জায়গা থেকে একটু একটু করে
বাড়তে থাকে। যদি এটা মাটি থেকে ওপরে ওঠে তাকে আমরা বলি স্ট্যালাগমাইট (stalagmite)
আর ছাত থেকে ঝুলতে থাকলে তাকে বলা হয় স্ট্যালাকটাইট (stalactite)। মনে রাখার
সুবিধের জন্যে জানাই প্রথমটির মাঝে ‘g’ আছে, তার মানে ground থেকে ওঠে। পরেরটার মাঝে ‘c’ আছে অর্থাৎ সেটা ceiling থেকে ঝোলে। এই
স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইট বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু থেকে তৈরি হতে পারে, যেমন
চুনাপাথর (limestone), লাভা, কাদামাটি, কয়লা এমনকি বরফও।
বরফের তৈরি স্ট্যালাগমাইটের সেরা উদাহরণ অমরনাথের তুষার শিবলিঙ্গ - তবে সেখানে
গিয়ে এসব বলতে যেও না, ধর্মভীরু তীর্থযাত্রীরা তাড়া করবে! বরং Stalactite
and Stalagmite নামে একটা ভিডিও গেম আছে, সেটা খেলে থাকলে বেশ
খানিকটা ধারণা জন্মাবে এ নিয়ে।
চুনাপাথরের
ফর্মের আরও এমন নিদর্শন আছে মেঘালয়ের মজমাই (Mawsmai) বা অন্ধ্রপ্রদেশের কুরনুল জেলার বেলাম গুহাতে। এগুলির জন্ম কিন্তু আজ নয়,
শুরু হয়েছে প্রায় পনের কোটি বছর আগে থেকে আর ভাঙ্গাগড়া এখনও চলছে।
(২)
মনোলিথিক ইনট্রুশন (Monolithic Intrusion)
গিলবার্ট হিল, মুম্বাই
গিলবার্ট হিল, মুম্বাই
চিত্র – ২ |
মুম্বাইয়ের
পশ্চিম আন্ধেরির ভবন কলেজের পাশেই একটি ঘিঞ্জি বস্তির মধ্যে দুর্গম স্থানে মাথা
উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি ৬১ মিটার (২০০ ফুট) উচ্চতার স্তম্ভের মত একশিলা কালো বেসাল্ট পাথরে গড়া পাহাড় যার
নাম গিলবার্ট হিল। উচ্চতা এমন কিছু বেশি নয়, এর চেয়ে উঁচু পাহাড় ত মুম্বাইয়েই আরও
আছে। তাহলে কী এর বিশেষত্ব? সেটা জানতে গেলে আবার কিছুটা বিজ্ঞান বুঝতে হবে, জানতে
হবে পৃথিবীর গঠন আর বৈচিত্র্য সম্বন্ধে।
চিত্র – ৩ |
পৃথিবীর
জন্ম ৪৫০ কোটি বছর আগে হলেও তার ভেতরটা, যাকে আমরা লিথোস্ফেয়ার বলি, এখনও বেশ
কাঁচা মানে তরল ও গ্যাসীয় ধাতু-পাথরে ভরা। মাঝে মাঝে ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলিত শিলা বা
ম্যাগমা মাটি ফুঁড়ে উপরের স্তরে কিম্বা তাও ভেদ করে মাটির উপরে চলে আসে। এরই নাম
অগ্ন্যুৎপাত বা volcanic eruption। ভূমিকম্পের ফলেও
এরকম হতে পারে। এইরকম অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গলিত পাথর পৃথিবীর ভেতরেই যদি থেকে যায় তাকে
বলা হয় intrusion, আর মাটির বাইরে উঠে এলে তার
নাম extrusion। Extrusion বাইরে বেরিয়ে সাধারণতঃ টুকরো
পাথরপিণ্ড হয়ে বা ভূস্তরের উপর গড়িয়ে গিয়ে জমাট বেঁধে যায়, গিলবার্ট হিলের মত খাড়া
দাঁড়ায় না। তাই এই পাহাড় আসলে একটি intrusion, এর গঠনকে বলা
হয় ল্যাকোলিথ (Laccolith), পরে চারপাশের মাটি ধুয়ে পুরো
পাথরটা বেরিয়ে পড়েছে। Laccolith হল intrusion ঘটা জমাট লাভার এমন গঠন যার তলদেশ চওড়া, উপরটা গোলাকৃতি বা উত্তল আর সবার
নিচে ছড়ানো ম্যাগমার স্তর থাকে। ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠের উপর বেরিয়ে যখন স্রোতে বয়ে চলে, তাকে বলা
হয় লাভা। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ম্যাগমা আর লাভা গঠিত আকৃতিগুলোর একটা পরিচয় দিলাম
চিত্র-৩-এ। এ জাতীয় পাহাড়ের আবিষ্কার প্রথম করেন আমেরিকার ভূতাত্বিক Grove Karl Gilbert, ১৮৭৫-৭৬ সালে। আমেরিকার
উটাহ রাজ্যের হেনরি হিলের গঠন সম্বন্ধে তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী এটিও একটি monolithic
laccolith intrusion of black basalt rock। এটা তৈরি হয় আজ থেকে
সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। মনোলিথিক কথাটার মানে একটি মাত্র পাথর দিয়ে গড়া, যেমন
মাইশোরের চামুণ্ডী পাহাড়ের বা তাঞ্জোরের নন্দীমূর্তি, কিংবা ইলোরার কৈলাশ মন্দির,
যদিও মানুষ তার উপরে পরে অনেক কারুকাজ করেছে। আমরা আরও জানতে পারি যে ৬১ মিটার
উঁচু গিলবার্ট হিল বিশ্বে সম্ভবতঃ এ জাতীয় দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড়, প্রথমটি হল
আমেরিকার ওয়াইয়োমিং-এর খাড়া ২৬৫ মিটার উঁচু ‘ডেভিলস টাওয়ার’ (চিত্র-৪)।
চিত্র – ৪ |
অবশ্য
গিলবার্ট ভদ্রলোকটি কে তা নিয়ে ভিন্নমতও আছে। আন্ধেরি অঞ্চলে একজন
সেনাপ্রধানের নামও ছিল গিলবার্ট যিনি ১৮৯১ এর আগে এই পাহাড়েরই মাথায় একটি কামান
বসিয়েছিলেন আরব সাগর দিয়ে যাওয়া শত্রুদের জাহাজ উড়িয়ে ফেলার জন্যে। তবে জানিনা এর
মাথায় কবে তৈরি হয় গামদেবীর মন্দির আর তারপর ১৯৩৯ সালে পাহাড়টি বিক্রি হয়ে যায় একদল
ব্যবসায়ীদের কাছে যারা সেটাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। হ্যাঁ,
দক্ষিণ ভাগটা উড়িয়েও ফেলে তারা, আর তাইতে পাহাড়ের বাইরের আবরণ সরে বেরিয়ে পড়ে
অসংখ্য ছুঁচলো কালো বাসাল্টের স্তম্ভ, জানা যায় পাহাড়ের আসল ভূতাত্ত্বিক পরিচয়।
এসব
জানার পর থেকেই ভূতাত্ত্বিকরা গিলবার্ট হিলকে সংরক্ষণ করার জন্যে আন্দোলন শুরু
করেন। তারপর কীভাবে বোম্বের জমি মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচিয়ে বাকি পাহাড়টিকে উদ্ধার
করা হয় ও ১৯৫২ সালে ভারত সরকার এটিকে ফরেস্ট অ্যাক্টের ধারা অনুযায়ী ‘ন্যাশানাল
পার্ক’ ঘোষিত করে, সে গল্পও কম রোমাঞ্চকর নয়। তারপর এই
সেদিন ২০০৭ সালে মুম্বাই ম্যুনিসিপালিটি একে দ্বিতীয় শ্রেণীর হেরিটেজের সম্মান
দেয়। এবার বুঝতে পারলে আমাদের দেশের ভূতত্ত্ব আর বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান আর
বাস্তবিক চেতনা কেমন? তোমরা যারা মুম্বাই বা তার আশেপাশে থাক সময় করে একবার ঘুরে
আসতে পার, একটা তৃপ্তির অনুভূতি হবে, দেখে নিও।
(৩)
চিত্র – ৫ |
গুজরাটের
উত্তর পশ্চিমে আছে কচ্ছ জেলা, যার উত্তরার্ধে (চিত্র- ৫) বিস্তীর্ণ এলাকার সাথে
পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের বেশ খানিকটা অংশ নিয়ে প্রায় ৭৫০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে
আছে জলাভূমি বা swamp, যেখানে শুকনো
ঘাস আর আগাছা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই উৎপন্ন হয় না। এরই নাম কচ্ছের বৃহত্তর রাণ (Greater
Runn of Kutch)। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সেখানে গেলে দেখা যাবে এক অদ্ভুত
সুন্দর দৃশ্য। দিগন্তব্যাপী প্রান্তর দুধের মত সাদা হয়ে আছে, যেন রূপো গলিয়ে ছড়িয়ে
দিয়েছে কেউ। এও এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য, যার পেছনেও বেশ খানিকটা বিজ্ঞান আছে। কী
সেটা? জানতে গেলে চল ঘুরে আসি কচ্ছ থেকে।
উত্তর
কচ্ছের বান্নি তৃণভূমি অভয়ারণ্যের সংলগ্ন দোরডো গ্রামের উত্তর থেকে কচ্ছের বৃহৎ
রাণের শুরু, লেখককে ছবিতে (চিত্র-৬) দেখা যাচ্ছে এই শ্বেত-মরুর দেশে। অন্য জায়গা থেকেও
দেখা যায় এই শ্বেত মরু, তবে পাকিস্তানের সীমানা-সংলগ্ন এলাকা বলে যাত্রীদের
সর্বত্র যাবার অনুমতি নেই। এই বালি কি সত্যিই সাদা, কিন্তু কেমন করে? সব রহস্য
ভাঙল যখন কাছ থেকে দেখলাম, জিনিসটা আর কিছুই নয়, সামুদ্রিক লবণের দানা বা স্ফটিক
(চিত্র-৭)। কিন্তু সমুদ্রের থেকে এত দূরে মাইলের পর মাইল জুড়ে এত নুন কে ছড়াল? এবার সে গল্পটা বলি।
চিত্র – ৬ |
চিত্র – ৭ |
সমুদ্রের
জল লবণাক্ত কেন হয় জান ত? বিভিন্ন নদী বা প্রবাহিকার জল নানা অঞ্চল থেকে মাটিতে
মিশে থাকা নানা জাতীয় প্রচুর লবণ বয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনও বড়ো হ্রদ বা সমুদ্রে
এনে ফেলে। তাই মোহানার যত কাছাকাছি আসে নদীর জলে নুনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
রাজস্থান থর মরু অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত এককালীন সরস্বতী আর সিন্ধুনদের কিছু শাখা
যেমন লোনী, ঘগ্ঘর, বানস, রুপেন ইত্যাদি নদী উপযুক্ত ঢালু জমি আর যথেষ্ট জলধারার
অভাবে এই কচ্ছ অঞ্চলে এসেই মরে যায় তাদের অবশিষ্ট জল ঢেলে দিয়ে। তবু কিন্তু তারা
হারায় না। রবীন্দ্রনাথের গান আছে না, ‘যে নদী মরুপথে হারাল ধারা/ জানি হে জানি তাও
হয়নি হারা’, সেভাবেই তারা দিগন্তবিস্তৃত এই জলাভূমি তৈরি করে চলেছে। জুলাই-আগস্ট
পর্যন্ত এই জলধারা এসে রাণে পড়ে আর নভেম্বরের শেষ নাগাদ রোদের তাপে তা শুকিয়ে
লবণের স্ফটিক সাদা ফুলের মত ফুটে ওঠে থরে থরে। সৃষ্টি হয় শ্বেত মরুর। রাতে চাঁদের
আলোয় এর সৌন্দর্য অতুলনীয়, তবে সন্ধের পর সেখানে যাওয়া অনুমতিসাপেক্ষ।
আর
একটা জিনিস সেখানে সন্ধের পর দেখা যায় মাঝে মাঝে, লোকে তাকে বলে ‘চির-বাত্তি’ বা ভৌতিক
আলো (চিত্র- ৮)। হঠাৎ হঠাৎ যেখান-সেখান থেকে আগুনের গোলা শূন্যে লাফিয়ে ওঠে
বিনা কারণেই। গ্রামের অশিক্ষিত লোকেদের কাছে তা ভৌতিক উপদ্রব মনে হলেও, তোমরা যারা
স্কুলে কেমিস্ট্রিতে মিথেন বা মার্শ গ্যাস সম্বন্ধে পড়েছ তারা নিশ্চয়ই বুঝবে ওটা
ওই জলায় তৈরি হওয়া মিথেনের কারসাজি যাকে আমরা সাদা বাংলায় ‘আলেয়া’ বলি।
চিত্র – ৮ |
(৪)
উল্কা-গহ্বর
(Meteoritic Crater)
লোনার, বুলঢানা, মহারাষ্ট্র
লোনার, বুলঢানা, মহারাষ্ট্র
আজ
থেকে প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে এক বিশাল উল্কা, তা অন্ততঃ ৬০ মিটার ব্যাসের আর কুড়ি
লক্ষ টন ওজনের ত হবেই, ছুটে এসেছিল মহাকাশ থেকে। ৯০,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার
দুরন্ত গতিতে আছড়ে পড়েছিল মহারাষ্ট্রের বুলঢানা জেলার লোনার গ্রামে। ফল কী হল?
উল্কাপিণ্ডটি মাটির উপরের কঠিন বেসাল্ট পাথরের আবরণ ভেদ করে ১৫০ মিটার গভীর আর
১.৮২ কিলোমিটার ব্যাসের এক বিরাট গহ্বর বানিয়ে উধাও হয়ে গেল মাটির গভীরে। সেই
গহ্বর ভরে উঠল ভূগর্ভের জলে, সাথে মিশল বৃষ্টি আর অন্য চারপাশ থেকে গড়িয়ে নামা
জলের ধারা। তৈরি হল এক বিশাল হ্রদ বা লেক। বাটির আকারের এই গর্তটি সম্বন্ধে
ভারতবাসী খুব কম জানলেও, এই লেক ও গহ্বর, যা লোনার ক্রেটার (Lonar Crater) নামে বিখ্যাত (চিত্র - ৯) বিশ্বে
এ ধরণের তৃতীয় সবচেয়ে বড় লেক। এ নিয়ে গবেষণা করে চলেছে দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীদের
দল, প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য।
কী সেই বৈশিষ্ট্য
এই ক্রেটারের আর তার জলের যার অদ্ভুত সবুজ রঙের জলের যাদুতে ছুটে আসে অজস্র
তীর্থযাত্রী, যদিও এ জল পান তো দূর, এ জলে স্নান করাও বিপজ্জনক, এত তীব্র এর ক্ষারকতা,
pH প্রায় ১১। তোমরা
বোধহয় জান যে শুদ্ধ জলের pH হয় ৭। তার কম
হলে তা হয় অম্লধর্মী আর বেশি হলে ক্ষারক। একই সাথে জলে লবণের পরিমাণও খুব বেশি। এই
হ্রদেরই এক প্রান্তে কিন্তু সাধারণ জলও আছে, আর তাকে কেন্দ্র করেই নানাজাতীয়
বিচিত্র গাছপালা-জীবজন্তু রাজত্ব করছে এই বাটির মত ক্রেটারের গায়ের উপর। আরও আশ্চর্য, এই ধরণের বেসাল্ট ক্রেটার পৃথিবীতে কম থাকলেও মঙ্গলগ্রহে প্রচুর
দেখা যায়।
চিত্র – ৯ |
একটা মজার কথা জানাই। লোনার
ক্রেটার আমারও সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ২০০৪-এ অজন্তা-ইলোরা দেখতে ঔরঙ্গাবাদ গেছিলাম,
উঠেছিলাম MTDC-র হোটেলে। সেখানকার ম্যানেজারই
লোনার সম্বন্ধে আমাদেরকে জানান। ঠিক ক্রেটারের সামনে রাস্তার ধারেই মহারাষ্ট্র
ট্যুরিজমের একটা চমৎকার গেস্ট হাউস আছে, অনলাইন বুকিং করা যায়। তাই সময় করে একবার
ঘুরে এলেই পার। আরও অনেক আশ্চর্যজনক ব্যাপার আছে লোনারে। তার মধ্যে একটা হল উল্কা
থেকে ছিটকে পড়া চুম্বকীয় পাথর যার আকৃতি দেখে হনুমানের মূর্তি ভেবে মন্দির বানিয়ে
পুজো করা হয়। এ ছাড়া আছে উল্কার আঘাতে ভূ-স্তরে ওলট-পালট ঘটে তৈরি হওয়া একটা
আর্টিসান ওয়েল, যা থেকে নিজে থেকেই জল পড়ে, দৈবশক্তি মেনে সেখানেও বেশ কিছু মন্দির
তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়া একটা রহস্যজনক বিশেষত্ব যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও বোঝার
চেষ্টা করে চলেছেন - সেটা লেকের চারধারের ঢালে জন্মানো গাছপালা নিয়ে। লেকের
চারধারের অংশটা বিভিন্ন বৃত্তীয় পথে ভাগ করে দেখা গেছে সবচেয়ে
বাইরের বৃত্তে জন্মায় মূলতঃ খেজুর গাছ। তার ঠিক ভেতরের বৃত্তে শুধু তেঁতুল আর তার
ভেতর দিকে বাবুলের গাছ। আর কিছু বলছি না, সেখানে গেলে আরও অনেক কিছুই জানতে পারবে, সব আগেই
জেনে গেলে চলবে?
চিত্র - ১০ |
______
গ্রন্থসূচীঃ
গ্রন্থসূচীঃ
No comments:
Post a Comment