গ্রাফের বিন্দু-বিসর্গ
অমিতাভ প্রামাণিক
আমার মেয়ে অন্বেষার যখন ক্লাশ নাইন, একদিন এসে আমার কাছে গলে পড়লো – বাবা!
- কী?
- ম্যাথ্স্ পারছি না।
- এ আর নতুন কী! অঙ্ক শুনলেই তো তোমার গায়ে জ্বর আসে। কী পারছো না?
- গ্রাফ।
- গ্রাফ তো খুব সহজ। মানে ওর চেয়ে সহজ তো আর কিছু হতেই পারে না।
- আমি পারছি না। এই দ্যাখো ইকুয়েশন দেওয়া আছে। পয়েন্ট বের করতে হবে।
- করে ফেলো। এ আর কঠিন কী!
- ম্যাম বলেছে, মিনিমাম তিনটে পয়েন্ট বের করতে। তারপর সেগুলো গ্রাফবুকে বসিয়ে পয়েন্টগুলোর মধ্যে দিয়ে স্কেল দিয়ে স্ট্রেট লাইন ড্র করতে হয়।
- ম্যাম তো ঠিকই বলেছেন। ওয়েল, অ্যাকচুয়ালি দুটো পয়েন্ট বের করলেই চলে। তবে একটা পয়েন্ট যদি ভুল করো বাই চান্স, তিনটে বের করাই ভালো।
- না, না, আমাদের তিনটেই করতে হবে। না হলে ম্যাম মার্ক্স দেবে না।
- ঠিক আছে, তিনটেই করো। চারটে পাঁচটা করলেও দোষের না।
- আমি পারছি না। অনেক কষ্টে একটা বের করতে পেরেছি। আর বেরোচ্ছে না।
- সে কী! যেভাবে একটা বের করলে ওভাবেই আরও দুটো করে ফেলো।
- হচ্ছে না। তুমি প্লীজ হেল্প করো।
- কী ইকুয়েশন দেওয়া আছে?
- এই যে দেখো। থ্রী এক্স প্লাস সেভেন ওয়াই ইজ ইকুয়াল টু এইট।
- বেশ। তুমি কী করলে?
- আমি ওটাকে রি-অ্যারেঞ্জ করে লিখলাম 7y = 8 – 3x
- বেশ। তারপর?
- তারপর y = (8 – 3x)/7
- একদম ঠিক লিখেছ। সমস্যাটা কী তাহলে?
- পয়েন্ট বের করতে গিয়ে হচ্ছে না। এই দেখো, এক্স-এর জায়গায় জিরো, এক, দুই, তিন, চার দিয়ে ট্রাই করে মিললো না। তখন মাইনাস ওয়ান, মাইনাস টু দিয়ে ট্রাই করলাম। মাইনাস টু-তে এসে মিললো। একটা পয়েন্ট পেলাম (-2, 2)। আবার মাইনাস থ্রী, মাইনাস ফোর, মাইনাস ফাইভ, মাইনাস সিক্স দিয়ে ট্রাই করছি, কিছুতেই মিলছে না। কত ট্রাই করবো এ রকম ভাবে?
x | -2 | ? | ? |
y | 2 | ? | ? |
কী করে চট করে পয়েন্ট বের করে ফেলা যায়, তা ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়ে দেওয়ার আমি ঠিক পক্ষপাতী নই। আমিও এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছি। অনেক ইকুয়েশন সল্ভ করতে করতে নিজে নিজেই বের করে ফেলেছি একটা চটজলদি উপায়। সেটা এখানে লিখে দিচ্ছি শুধু একটাই কারণে। অঙ্ক এখন শুধু সল্ভ করার খেলাই তো নয়। উত্তর দিতে হবে ফটাফট। অনেক সময় মাত্র এক নম্বরের জন্যেও একটা মাইলস্টোন মিস হয়ে যেতে পারে। সুতরাং একটা কায়দা জানা থাকলে হয়ত সেই অসুবিধেটা হবে না।
না, কোনো ম্যাজিক না এটা। একখানা পয়েন্ট খেটেখুটে বের করতেই হবে। সেটা বেরিয়ে গেলেই বাকি হাজারখানেক পয়েন্ট বেরিয়ে আসবে জলপ্রপাতের মত।
কেমন করে? ওয়েল, দেখে নাও। ইকুয়েশনটা এমনভাবে লেখো যাতে এক্স আর ওয়াই দুটো ইকুয়াল চিহ্নের দুদিকে থাকে। মানে এক্ষেত্রে যেমন 7y = 8 – 3x. এখানে -3 হচ্ছে এক্সের কোয়েফিশিয়েন্ট আর 7 হচ্ছে ওয়াই-এর কোয়েফিশিয়েন্ট। (মনে রেখো, ইকুয়েশন চিহ্নের দুদিকে আছে এরা!)
এবার একটা যে পয়েন্ট বেরিয়েছে, ঐ যে (-2, 2), তার প্রথমটার সাথে ওয়াই-এর কোয়েফিশিয়েন্ট আর দ্বিতীয়টার সাথে এক্সের কোয়েফিশিয়েন্ট যোগ (বা বিয়োগ, যা করবে দুক্ষেত্রেই একই) করে দিলেই পরের পয়েন্ট বেরিয়ে যাবে। -2 এর সাথে 7 যোগ করলে হয় 5; 2-এর সাথে -3 যোগ করলে হয় -1, সুতরাং পরের পয়েন্ট হচ্ছে (5, -1)। এভাবে চালিয়ে গেলে ফটাফট পয়েন্ট আসতে শুরু করবে। 5-এর সাথে 7 যোগ করে 12, -1-এর সাথে -3 যোগ করে -4, তাই পরের পয়েন্ট (12, -4)। বিয়োগ করলেও হত। প্রথম পয়েন্ট দিয়ে শুরু করা যাক। -2 থেকে 7 বিয়োগ করলে -9; 2 থেকে -3 বিয়োগ করলে 5, তাই একটা পয়েন্ট হবে (-9, 5)। তারপরে (-16, 8), ইত্যাদি।
দুদিকেই যোগ করলে –
x | -2 | -2 + 7 = 5 | 5 + 7 = 12 | 12 + 7 = 19 |
y | 2 | 2 + (-3) = -1 | -1 + (-3) = -4 | -4 + (-3) = -7 |
দুদিকেই বিয়োগ করলে –
x | -2 | -2 - 7 = -9 | -9 - 7 = -16 | -16 - 7 = -23 |
y | 2 | 2 - (-3) = 5 | 5 - (-3) = 8 | 8 - (-3) = 11 |
কী করে হচ্ছে এটা? বলে দেওয়ার আগে নিজে একটু ভেবেচিন্তে দেখো। মনে রেখো, নিজে নিজে একটা নতুন নিয়ম বের করার আনন্দই আলাদা। সুতরাং, ভাবো আর একটু।
ও হ্যাঁ, এতটা বললাম যখন, আর একটু বলে নি। ক্লাশে সাধারণত শেখানো হয়, ওয়াই-টা ইকুয়াল সাইনের বাঁদিকে রেখে বাদবাকি অংশটা ইকুয়াল সাইনের ডানদিকে নিয়ে আসার কথা, যাতে পুরো এক্সপ্রেশনটা ওয়াই ইকুয়াল টু সামথিং করে লেখা যায়। তুমি একে একে এক্স-এর (ইন্টিজার) ভ্যালু বসিয়ে চেক করে দেখবে ওয়াই-এর ইন্টিজার ভ্যালু পাও কিনা। তাই তো?
শিক্ষকরা ভুল শেখান না। তবে একটু ভাবলে বুঝতে পারবে, এতে হয়ত অনেক সময় বেশি সময় লাগছে সল্ভ করতে। কেন? ওপরের উদাহরণে দেখো। ওয়াই-এর এক্সপ্রেশনটা এমন হয়েছে, যাতে ডানদিকে এসে গেছে (8 – 3x)/7। (8 –3x)এর মান 7-এর গুণিতক হলে তবেই তুমি একটা ইন্টিজার ভ্যালু পাবে, আর এক্স-এর একটা নাম্বার পেয়ে গেলে তুমি যদি এক এক করে বাড়িয়ে বা কমিয়ে ট্রাই করতে থাকো, তবে তার পরবর্তী নাম্বার আসবে আরো সাতটা নাম্বার পরে। (-2, 2) যে একটা পয়েন্ট অন্বেষা পেয়েছিল, সেই -2–এর থেকে 7-এর গুণিতকে ছোটো (বা বড়ো) নাম্বার ভিন্ন আর কোনো নাম্বারে মিলবে না। সেই জন্যেই অন্বেষা নাম্বার খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্বেষা করছিল –
x | 0 | 1 | 2 | 3 | 4 | -1 | -2 | -3 | -4 |
y | 8/7 | 5/7 | 2/7 | -1/7 | -4/7 | 11/7 | 14/7=2 | 17/7 | 20/7 |
ওর চাই দুটোই পূর্ণসংখ্যা। এতক্ষণ খেটেখুটে ওর বেরিয়েছে মাত্র একখানা!
এটাকেই যদি এক্স-ওয়ালা অংশটা ইকুয়াল চিহ্নের বাঁদিকে রেখে সিমপ্লিফাই করতে, তবে ওটা হত এই রকমঃ x = (8 – 7y)/3। এখন তোমাকে ওয়াই-এর (ইন্টিজার) ভ্যালু ট্রাই করে যেতে হবে এক এক করে, যাতে (8 – 7y) এর মান 3-এর গুণিতক হয়। পর পর ম্যাক্সিমাম 3 খানা ট্রাই করলে একটা বাধবেই। আগের তুলনায় সময় কম লাগবে, যেহেতু 3, 7-এর চেয়ে ছোটো।
x | 8/3 | 1/3 | -6/3=-2 | -13/3 | -20/3 | 15/3=5 | 22/3 | 29/3 | 36/3=12 |
y | 0 | 1 | 2 | 3 | 4 | -1 | -2 | -3 | -4 |
একই পরিশ্রমে তিনজোড়া পূর্ণসংখ্যা বেরিয়ে গেল তো!
তাহলে ফটাফট বিন্দু বের করার নিয়ম কী দাঁড়ালো? প্রথম বিন্দু বের করার জন্যে ইকুয়েশন রি-অ্যারেঞ্জ এমনভাবে করবে, যাতে এক্স আর ওয়াই-এর মধ্যে যার কোয়েফিশিয়েন্টের মান ছোটো, সেটা বাঁদিকে থাকে (কেননা সেটাই ডানদিকে ডিনোমিনেশনে আসবে)। তাতে প্রথম পয়েন্ট বের করতে পঞ্চাশ সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। আর পরের আরো দুটো পয়েন্ট, যেমন শেখালাম সেই ভাবে বের করতে বড়োজোর আর দশ সেকেন্ড।
শুধুমাত্র কঠিন এক্সপ্রেশনের জন্যেই (মানে যাতে কোয়েফিশিয়েন্টগুলো 5–এর চেয়ে বড়) এই এক মিনিট। সহজ এক্সপ্রেশন থাকলে তো এসব ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না।
শিখে গেলে তো? এবার তাহলে এই নিয়ম কেন কাজ করছে, পরবর্তী অংশটা পড়ার আগেই তার হদিশ বের করো দেখি। তবেই বুঝবো তুমি বুদ্ধিমান।
না পারলে তবেই পড়ো এটা।
যে কোনো সরলরেখাকে প্রকাশ করা যায় ax + by = c সমীকরণ দিয়ে। লক্ষ করে দেখো, এখানে x এবং y দুটোরই পাওয়ার এক, মানে x2 বা y3 জাতীয় এক্সপ্রেশন সরলরেখার সমীকরণে থাকবে না।
মনে করা যাক, আমাদের আলোচ্য সরলরেখার সমীকরণও ax + by = c, আর তুমি খেটেখুটে বের করে ফেলেছো একটা পয়েন্ট, ধরা যাক সেটা (p, q)। সমীকরণটার x আর y ইকুয়াল চিহ্নের দুপাশে লিখলে হয়ঃ ax = c – by
সুতরাং আমার নিয়ম অনুযায়ী p-এর সঙ্গে y-এর কোয়েফিশিয়েন্ট (-b) আর q-এর সঙ্গে x-এর কোয়েফিশিয়েন্ট (a) যোগ দিতে থাকলে এই লাইনের ওপর অন্য বিন্দুগুলো হবে(p-b, q+a), (p-2b, q+2a), (p-3b, q+3a) ইত্যাদি এবং p-এর সঙ্গে y-এর কোয়েফিশিয়েন্ট আর q-এর সঙ্গে x-এর কোয়েফিশিয়েন্ট বিয়োগ দিতে থাকলে (p+b, q-a), (p+2b, q-2a), (p+3b, q-3a) ইত্যাদি।
যেহেতু ax + by = c লাইনটা (p, q) বিন্দু দিয়ে যায়, এই সমীকরণে x আর y-এর জায়গায় এদের মান যথাক্রমে p আর q বসিয়ে দিলে তুমি পেয়ে যাবে
pa + qb = c...(1)
1. pa + ab - ab + qb = c
2. a(p + b) + b(q – a) = c
দেখো, এটাও ax + by = c ফর্মেই আছে, যেখানে x আর y–এর মান যথাক্রমে (p+b) আর(q-a) অর্থাৎ (p+b, q-a) বিন্দুটি ax + by = c সরলরেখার ওপরে আছে।
(1)সমীকরণটাকে এ ভাবেও বদলানো যেত –
pa + qb = c
1. pa - ab + ab + qb = c
2. a(p - b) + b(q + a) = c
এটাও ax + by = c ফর্মে, যেখানে x আর y–এর মান যথাক্রমে (p-b) আর (q+a) অর্থাৎ (p-b, q+a) বিন্দুটি ax + by = c সরলরেখার ওপরে আছে।
(1)নং সমীকরণটার নীচে (+ ab – ab)-র বদলে + 2ab – 2ab বা + 3ab – 3ab ইত্যাদি এক্সপ্রেশন যোগ করলে বাকি বিন্দুগুলোও যে এই সরলরেখার ওপরে, তার ব্যাখ্যাও বেরিয়ে আসত।
__________
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment