গল্পের ম্যাজিক:: রংবদল - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


রংবদল

সহেলী চট্টোপাধ্যায়

  সব কিছুরই রং বদলে যায় সময়ের সাথে সাথে। এই রংবদল কখনও ভালো ,কখনও আবার মন্দের দিকে।  বেশ কিছু দিন ধরেই  আমার মেয়ে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে। আর তার সাথে তাল মেলাচ্ছে মেয়ের মা অর্থাৎ আমার গিন্নী । মেয়েটা আজ বিগড়েছে তার মায়ের আদরেই। এমনিতে মেয়ে আমার খুব বুঝদার। পড়াশোনায় ভালো । এবার প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কখনও কোনো জিনিষের জন্য আবদার করেনি। ওর চাহিদা ছিল একটাই , গল্পের বই। পুজোর সময় জামা কাপড়ের চেয়ে পুজো সংখ্যার ওপর  বেশি আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কলেজে ঢুকেই ওর জ্ঞান চক্ষু খুলে গেছে। বুঝতে পেরেছে যে এত দিনে ও কতটা বোকা ছিল। আর কিছুই নয় চেয়েছে একটা মোবাইল ফোন। তোমরা ভাবছ বাবাটা কী কিপটে মেয়ে কে একটা মোবাইল ও কিনে দিতে পারে না। তা নয় , কিনে দিয়েছিলাম একটা মোবাইল ফোন। সেই ফোন দেখে মেয়ের মুখে হাসির বদলে বোল ফুটল। “ বাবা, এই ক্লাইভের আমলের ফোন দেখলে বন্ধুদের সামনে আমার মাথা কাটা যাবে লজ্জায়। এটা তুমি ই রাখো” ।

“কী বললি ! ক্লাইভের আমলে মোবাইল ফোন ছিল?” খুব রেগে গিয়ে প্রশ্ন করি।  
মেয়ের মা এসে আমাকে থামাল। “ কী দরকার বাপু ঝামেলা করে! চাইছে যখন কিনেই দাও না একটা ফোন”।  

ফোনটার সব ই ভালো কিন্ত অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের দামি ফোন না দেওয়াই ভালো বলে আমি মনে করিহাজার রকম সুবিধা দেওয়া ফোন নিয়ে কী করবে   ওই টুকু মেয়ে? বরং পড়াশোনা আরও লাটে উঠবে । তাই সাধারণ ফোন কিনে দিয়ে ছিলাম। শুধু কথাটাই বলতে পারবে। কিন্তু এই ফোন দেখে মেয়ে আর তার মায়ের মুখ যে এমন কালো হয়ে যাবে ভাবিনি। মেয়ের করুণ মুখ আর তার  মায়ের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে একদিন ও কে নিয়ে গেলাম ফোন কিনতে।

মেয়ে আমার দশ হাজার টাকার ফোন পছন্দ করে বসল । কী আর করা যাবে ? দিতেই হল।  একবার শুধু বলেছিলাম, “মা, টিনা এই টাকায় তোমার একটা ভালো নাকছাবি হয়ে যেত অথবা কানের দুল”। টিনা একবার ভুরু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে, উত্তর দিল না। ওই তাকানো দেখে ফোনটা না কিনে আর পারলাম না। সেই ফোন দেখে মা মেয়ে দুজনের মুখেই হাসি ফুটল। সারাক্ষণ দুজনে সেলফি তুলছে আর ফেসবুকে পোস্ট করছে। মা আর মেয়ের হাসি মুখ দেখতে সবার ই ভালো লাগে। কিন্তু যে ফোনটা কিনে দিল এত কষ্ট করে তার ফটো তুলতে কারোর ই আগ্রহ নেই।
 টিনা কে যখন ই দেখি মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে , ভয়  লাগে রেজাল্ট না খারাপ করে বসে এই ফোনের চক্করে।  কথা টথা বলেই না বিশেষ । একদিন ওকে বললাম, “ টিনা মা , ফোনের জন্য তোমার পড়াশোনার যেন কোনো রকম ক্ষতি না হয়”। পরপর তিনবার বলার পর টিনা কান থেকে হেডফোন সরিয়ে প্রশ্ন করল , “কিছু বললে বাবা”? বুঝলাম উনি গান টান কিছু একটা শুনছিলেন ! আবার বললাম, “তোমার পড়াশোনা...” কথাটা শেষ হল না। টিনার ফোন বাজতে শুরে করে দিয়েছে। বলল, “সরি , একটু পরে আসছি”। বলে ফোন কানে নিয়ে বারান্দার দিকে দৌড় মারল। টিনা খোশ মেজাজে গল্প করছে, বোঝা গেল সহজে ছাড়বে না। খানিক্ষন অপেক্ষা করে চলে এলাম। টিনার মা রান্নাঘরে ছিল। সেদিন রবিবার ছিল তাই আমারও অফিস ছিল না। টিনার মা বলল, “আমিও ফেসবুকে একটা প্রোফাইল খুলেছি”।

“ভালো করেছ। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রেখো মন ভালো থাকবে”। আমি বললাম খবরের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে ।

“হ্যাঁ । কিন্ত আমার মোবাইল থেকে ভালো ফেসবুক করা যায় না একটা যদি ল্যাপটপ বা ট্যাব থাকত খুব সুবিধা হত”।

এই কথার পর আমি আর বসলাম না । নিজের ঘরে ঢুকে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়লাম। মা আর মেয়ের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল । এরা দুজনেই নির্ঘাত আগের জন্মে রঘু ডাকাতের দলে কাজ করত। ল্যাপটপ অথবা ট্যাব এর কথা যখন একবার উঠেছে আর ও বহুবার উঠবে বুঝতে পারছি।

পরের দিন সকালে টিনা আমার জন্য চা  আর জলখাবার নিয়ে এল। জলখাবার  টিনাই বানিয়েছে শুনলাম। এক প্লেট পাস্তা। আমার খুব পছন্দের ডিস। তবে আজ চিন্তা হচ্ছে। অন্য দিন পাস্তা দেখলে ভারি আনন্দ হয়। টিনা কিন্তু দাঁড়িয়েই থাকে। চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, “খুব ভালো চা হয়েছে! কলেজ যাবি না”?  

“না বাবা, আজ ছুটি । একটা কথা ছিল বাবা”।  ওর করুণ  মুখ দেখে আমার ভেতরের মমতা জেগে ওঠে ।

“ল্যাপটপ না ট্যাব”? জিজ্ঞাসা করলাম।
“ওসব কিছু নয়, অ্যান্টিভাইরাস লাগাতে হবে ফোনে”।
“নেট কার্ড , মেমারি কার্ড, টক টাইম এর জন্য যা খরচ হয়ে তাতে একটা হাতি পোষা হয়ে যায় । এবার আবার অ্যান্টিভাইরাস!”
 “হ্যাঁ , বাবা। আর মোবাইল স্ক্রিন এর কভার কিনতে হবে । পাতলা যে কাগজটা লাগানো থাকে স্ক্রিনের ওপর। ওটা খুলে গেছে। ওটা না লাগালে স্ক্রিনটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর মোবাইলের আলাদা কভার ও লাগবে একটা”।
বাড়ি থেকে না বেরুনো পর্যন্ত এদের ফিরিস্তি চলতেই থাকবে। বেরুবার আগে  টিনার মায়ের হাতে হাজার টাকা দিয়ে বলি, “টিনা তার মোবাইলের জন্য কী সব কিনবে বলল, ও কে দিয়ে দিও” ।
“আজ তো অনেক তাড়াতাড়ি বেরুচ্ছো মনে হচ্ছে”।
“হ্যাঁ  গো অফিসে অনেক চাপ আছে আজ

অ্যান্টিভাইরাস, মোবাইল কভার, মোবাইলের স্ক্রিন এর ওপর লাগানোর কাগজ আর নতুন একটা হেডফোন কিনে টিনা বেশ খুশি । এই নিয়ে চারটে হেডফোন হল। ল্যাপটপ ও কিনিয়ে ছাড়ল টিনা আর টিনার মা। এটাকেও অ্যান্টিভাইরাস দিতে হল।  শুনলাম এটা নাকি প্রতি বছরই দিতে হবে। নেট এর লাইন নিতে হল। নেট আসার পর টিনা আর টিনার মায়ের উৎসাহের শেষ নেই। মাঝে মাঝে ল্যাপটপ খারাপ ও হতে পারে তার জন্য ফরম্যাট ও করতে হবে। নেট থেকে রান্নার রেসিপি নিয়ে মা আর মেয়ে রান্নার কম্পিটিশান শুরু করে দিল। সে গুলো গেলাবার আর লোক পেল না আমি ছাড়াতোমরা ভাবছ একটাই লাভ হয়েছে আমার, নিত্য নতুন খাবার খেতে পাচ্ছি। কিন্ত সে গুড়েও বালি। পশু পাখি তেও মুখে তুলতে পারবে না। এরা পাস্তা, চাউ, সুপ এই সামান্য কিছু জিনিষ ই পারে। তবে চেষ্টা করছে যখন নিশ্চয়ই শিখে যাবে। গবেষণা টা আমার ওপর ই চলবে এটাই যা চিন্তার কথা। যাই হোক মা আর মেয়ে তো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে । পরীক্ষায় টিনা কেমন রেজাল্ট করে সেটাই দেখার।  টিনা আর ওর মা একটা এসিও কিনিয়ে ছেড়েছে! গরমে নাকি টেকা যায় না, মানছি কথাটা সত্যি। তবে আমাদের ঘরে এসির দরকার ছিল না, পুরানো আমলের দোতলা বাড়ি। এমনিতেই যথেষ্ট ঠাণ্ডা গরমের সময়। আসলে অন্য লোকে কিনলে আমাদের ও একটা কিনতে হবে। এটাও একটা ব্যাপার।

একদিন সকালে অফিস যাব বলে তৈরি হচ্ছি টিনা আমার ঘরে এল। আবার সেই করুণ মুখ দেখেই চিন্তা হয় আমার। আমার ঘর এখন ভুলেও মারায় না। তায় আবার চা এনেছে আমার জন্য। বুঝতে পারলাম পকেট থেকে বেশ কিছু খসতে চলেছে। বললাম, “কী ব্যাপার? বাবা কে মনে পড়ল এত দিন পর?”   
“আমি ৬০ পারসেন্ট নম্বর নিয়ে পাস করেছি বাবা। অর্থাৎ ফাস্ট ক্লাস” । টিনার মুখে হাসি ফোটে ।
“ বাহ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে পড়াশোনায় তুমি ফাঁকি দাও নি”। বেশ ভালো লাগে আমার।
“বাবা তুমি খুশি তো?”
“নিশ্চয় মা। আমি খুব খুশি। উপহার তো দিতেই হবে আমার মা কে।  কী চাই তোমার?” ( এই রে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। ) আসলে বরাবর টিনা পরীক্ষায় ভালো করে পাস করলে ও কে কিছু না কিছু দিয়ে এসেছি।
আনন্দে উজ্বল হয়ে ওঠে টিনার মুখ।  
“সত্যি বলছ, বাবা ! যা চাইব তাই দেবে?”
আগে ও পুতুল গল্পের বই, ব্যাগ, পেন, হাল্কা জুয়েলারি এইসবেই খুশি থাকত । কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে চাহিদা ও বদলেছে।  
টিনা আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে বলে উঠল, “বাবা, আমার একটা সেলফি স্ট্যান্ড চাই”।
“সেটা আবার কী জিনিষ ?” ভীষণ অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করি।  
“বাবা, সেলফি স্ট্যান্ড জানো না!” আকাশ থেকে পড়ে টিনা। “ লাঠিতে মোবাইল রেখে নিজের সেলফি নিজে তোলা যায় । খবরের কাগজে দিয়েছিল যে এখন সেলফি স্ট্যান্ড পাওয়া যায় । বেশি দাম নয় বাবা। হাজারের মধ্যেই হবে”।
লাঠির মাথায় মোবাইল বসিয়ে নিজের ছবি নিজে তোলা যায় !  সত্যি কত কিছুই না বেরিয়েছে আবার বেরুবে আমাদের চাহিদা মেটাবার জন্য। চাহিদা না থাকলেও চাহিদা বানাতে হবে।  আমার মাথায় লাঠি বসালে ভালো হত এর চেয়ে ভালো হত বরং। তোমরা ভাবছ আমি কী কিপটে ! তা ভাই ঠিকই ভেবেছো তোমরা । কষ্ট করে মানুষ হয়েছি এত বিলাসিতা পোষায় না। ভালো জামাজুতো ও বাবা আমাকে দিতে পারেননি কখনও। ছেঁড়া জামা  নিজেই সেলাই করে পড়েছি।

“যা ইচ্ছা কিনগে যা”বলে একটা হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম। টাকাটা নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটল ও। মোবাইলের লাঠি কিনতে বোধ হয় এখনই বেরুবে। আমার নিজের লাঠি যাকে মনে করেছিলুম সে আমাকে এটিএম ছাড়া কিছু মনে করে না দেখে ভারী দুঃখ হল।

অফিস থেকে ফিরে দেখি টিনা হাসি মুখে আমার ঘরে বসে আছে। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল নিশ্চয়ই । বললাম , “পেলি তোর মোবাইলের লাঠি?”
“না বাবা, দেখেছিলাম কিন্তু আর কিনতে ইচ্ছা হল না”।
“সে কী! তাহলে কী কিনলি?”  
“তোমার দেওয়া টাকা থেকে ৫০০ টাকা সঞ্চয় করেছি, ওই যে তুমি বলতে না , যে টাকা হাতে রেখে দিতে হয়। জমাতে হয় , তাই ...”
“আচ্ছা বেশ করেছিস। বাকি ৫০০ কী করলি?”
“কলেজ স্ট্রীট থেকে কিছু পুরানো বই কিনেছি, অনেক ভালো বই বেশ সস্তায় পেয়ে গেছি বাবা। দেখবে?”

হে ইশ্বর! এত সেই ছোটোবেলার টিনা কে দেখছি।  যে এত দিন হারিয়ে গেছিল।  

বললাম, “ হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখব !” টিনা ওর নতুন কিনে আনা বইগুলো  আনতে ছুটল। ঠিক যেমন ছোটোবেলায় ছুটত আমাকে কোনো কিছু দেখাবার জন্য।  যাক আমার ছোট্টো মেয়েটার মনের রং তাহলে একই  আছে। বাইরে বদলালেও ভেতরটা এতটুকুও বদলায়নি ।                             
-----
ছবি –তন্ময় বিশ্বাস 

5 comments:

  1. গল্প টা মন্দ নয়। কিন্তু ছবি টা ও কম আকর্ষণীয় নয়। যদি ও মোবাইল কম টিভি ই বেশি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে তো দেখি মেয়ের ভুমিকায় স্বয়ং লেখিকা ই অবতীর্ণ! মেয়ের মা বোধহয় মহাশ্বেতা। বাবা টি কেও কি চিনি?

    (লেখিকার ঢঙটি চুরি করার লোভ সামলাতে পারলাম না :-) )

    ReplyDelete
  2. আপনি সিওর মা টি অন্য কোনো লেখিকা নন? :-D

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লেগেছে। আমাদের ছেলেবেলা অলস দুপুরগুলো অনেক পাতাছেঁড়া আশ্চর্য বইয়ের জাদু কার্পেটে চেপে সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরোনোর দিন ছিল ... এই প্রজন্ম ও সেই টানে ভাসলে আগামীর স্বপ্ন দেখাই যায়।

    ReplyDelete
  4. ভালো লিখেছেন কিন্তু! টিনারা এখন প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে বাপেদের কাছে মূর্তিমান বিপদের মতো অবস্থান করছে। টিনাদের আরও গল্প চাই। এই গল্পের অলংকরণ বিশেষ পাওনা। লেখিকা এবং আঁকিয়ে দুজনকেই আন্তরিক ধন্যবাদ!

    ReplyDelete