বহুরূপী :: ক্যামেলিয়ন - আশ্চর্য এক বহুরূপী - স্বর্ণ চক্রবর্তী

ক্যামেলিয়ন - আশ্চর্য এক বহুরূপী

স্বর্ণ চক্রবর্তী

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা যারা এই ‘ম্যাজিক ল্যাম্প’ পত্রিকার পাতা উল্টে “বহুরূপী”  বিভাগে চলে এসেছো, তাদের একটা মজার কথা জানাই। আজকে আমি তোমাদের বলব ‘বহুরূপী’ নামের এক প্রাণীর কথা। তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, তাও কি হয়? বহুরূপী নিশ্চয়ই কোনো স্বপ্নরাজ্যের প্রাণী! তোমাদের এইবেলা জানিয়ে রাখি বহুরূপী নামের প্রাণীটিকে ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য অর্থা ট্রপিকাল রেন ফরেস্ট অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। ভীষণ ঘন জঙ্গল, যেমন আফ্রিকা, মাদাগাস্কার এবং এমনকী ভারতবর্ষেও এই আশ্চর্য বহুরূপীর দেখা মেলে। বহুরূপীকে সারা দুনিয়া চেনে ‘ক্যামেলিয়ন’ নামে। আর ভারতবর্ষের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, উড়িষ্যার জঙ্গল অথবা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ঘরের কাছেই বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ায় এর দেখা মেলা খুবই সম্ভব।

ক্যামেলিয়ন নামটা শুনলেই চোখের সামনে কেমন এক ধীর গতির ভাবুক ব্যক্তিত্বওয়ালা প্রাণীর কথা মনে আসে। বাস্তবেও কিন্তু বহু ভেবে ভেবে বহুরূপী মশাই গাছের ডালে এক পা এক পা করে চলেন। সবসময়ই কিছু না কিছু চিন্তা মাথায় ঘুরছেই; যেমনঃ সামনের ডালে একটা ফড়িং এসে বসলে মন্দ হয় না! কিম্বা পাতায় বসা পোকাটাকে কীভাবে খাবো এইসব দুষ্টুবুদ্ধিতেই দিনের বেলায় মগ্ন থাকেন আর কপাকপ জিভ ছুঁড়ে ধরে ফেলেন পোকা-মাকড় কীটপতঙ্গ। দিবাচর (দিনের বেলায় ঘুরে বেড়ায় যারা) এই বহুরূপী রাত্তিরে কিন্তু গাছের উপর সামনের দু’পায়ের ফাঁকে মাথা রেখে আমাদের ম্যাজিক ল্যাম্পের ছোট্ট বন্ধুদের মতনই ঘুমিয়ে পড়েন।

আফ্রিকা আর মাদাগাস্কারে বহুরূপীর অসংখ্য প্রজাতির দেখা মেলে। কিন্তু ভারতবর্ষে এর একটাই মাত্র প্রজাতি। তার নাম ‘ইন্ডিয়ান ক্যামেলিয়ন’, আর বিজ্ঞান সম্মত নাম ‘ক্যামেলিও জাইলোনিকাস্‌’এই ভারতবর্ষীয় বহুরূপীর দুটি  অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। এক, এই ক্যামেলিয়ন প্রয়োজন এবং ইচ্ছেমত গায়ের রঙ বদল করতে পারে, যার থেকে বাংলায় এর নাম হয়েছে ‘বহুরূপী’। আবার এই রঙ বদল কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই হয়না, রঙটা বদলায় আলো, তাপমাত্রার হেরফের এবং এদের মনের অবস্থার উপর নির্ভর করে। মূলত এর গায়ের রঙ সবুজ। কিন্তু ভয় পেলে বা অন্য কোনো ভাবে উত্তেজিত হলে এর গায়ে কমলা নীল হলুদ বাদামী এমন সব অসাধারণ রঙ ফুটে ওঠে।


এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল এর জিভ; ক্যামেলিয়ন নিজে খুবই ধীর গতির হলেও তার জিভের গতি সাঙ্ঘাতিক! তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছো ‘জিভের গতি’ ব্যাপারটা কি? কিন্তু হ্যাঁ এটাই সত্যি যে ক্যামেলিয়ন যখন শিকার ধরে, গায়ের রঙ বদলে পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে, ধীর গতিতে চুপিচুপি শিকারের কাছে পৌঁছে যায় আর হঠাই গুলতির মত জিভটাকে ছুঁড়ে দেয় শিকারের দিকে। এর জিভের মাথাটা একটু ফোলা মত, তাতে আবার আঠার মত এক পদার্থ লাগানো থাকে, তাই ঘাসফড়িং হোক কিম্বা মাকড়সা অথবা উচ্চিংড়ে — কখনোই এর শিকার ফসকায় না। আর শুনতে খুব আশ্চর্য লাগলেও গবেষকরা এই জিভের গতি মেপেছেন বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে; আর তাতে জানা গিয়েছে, ১ সেকেন্ডের ১২৫ ভাগের এক ভাগ সময়ে অথবা অনেকক্ষেত্রে ১ সেকেন্ডের ২০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র সময়ে ক্যামেলিয়ন তার জিভ ছুঁড়ে মারে শিকারের গায়ে। তাহলেই ভাবো কি সাঙ্ঘাতিক শিকারী এই বহুরূপী। এরা বিভিন্ন রকম মাকড়সা, ফড়িং আর বিট্‌ল জাতীয় পোকা খেতে খুব ভালোবাসে, তাছাড়াও অন্যান্য কীটপতঙ্গও বাদ পড়ে না। আর এর চোখ দুটিও ভারি অদ্ভূত। একই সময়ে দুটি চোখ দুটি আলাদা আলাদা দিকে ঘুরতে পারে। তাই চলার পথের দিকে এক চোখ রেখে বহুরূপী যখন শিকারে বেরোয়, তখন তার অন্য চোখ ব্যস্ত থাকে শিকারের খোঁজে।

   ক্রমাগত গাছপালা, বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য এই অসামান্য বহুরূপীর দল পৃথিবীর বুক থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের খাদ্য কীটপতঙ্গের দলও। আর সেই কারণেই সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এই ক্যামেলিয়ন বা বহুরূপী সংরক্ষণের জন্য তপর হয়ে উঠেছেন। শুধু বহুরূপীর জন্যই তৈরি করেছেন অভয়ারণ্য। তোমরা যদি কোনোদিন এই বিরল ব্যক্তিত্বশালী ক্যামেলিয়নের সন্ধান পাও তো দেখবে, এই রঙিন যাদুকর ‘ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়’ !!
_______________

ছবিঃ লেখক

No comments:

Post a Comment