ধূসর চাঁদ
দিলীপ রায়চৌধুরী
শ্রাবণ পূর্ণিমার রাত্তির। চারিদিক
জ্যোৎস্নায় একেবারে থৈ থৈ করছে। কোথায় যেন কে গান ধরেছে
– “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।” শুধু, ৭
নং প্রফুল্লচন্দ্র ষ্ট্রীটে তেতালার ছাদের ওপর অধ্যাপক সুশোভনবাবুর মনে এই ফুটফুটে
আলোতেও কোন কবিতা জাগছে না। অপলক নয়নে তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর ভাবছেন,
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঐ যে উপগ্রহটি পাক খাচ্ছে ওখানে গিয়ে কি ক’রে একটা মস্ত বড়ো টেলিস্কোপ বসিয়ে ওর ওপর থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পর্যবেক্ষণ
করা যায়।
কোলকাতা শহর - পাশের বাড়ির উনান থেকে ধোঁয়ার
কুণ্ডলী উঠছে। মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা করে। বিরক্তি
ভরে সুশোভনবাবুর হঠাৎ মনে হলো, চাঁদের থেকে গ্রহতারা
দেখবার সময় মানুষকে নিশ্চয়ই এই অস্বস্তি পোয়াতে হবে না। মাথার
ভিতর চিন্তার জাল বুনে চলেছে এক অদৃশ্য মাকড়সা। চাঁদের
চারিদিকে এক অস্বাভাবিক দ্যুতি - কাল কি বৃষ্টি হবে?
অবশ্য সুশোভনবাবু বৈজ্ঞানিক! এক জোয়ার ভাঁটার সঙ্গে
চাঁদের যোগাযোগ ছাড়া, ঐসব মানুষের লেখা ‘খনার বচন’ কি জ্যোতিষঠাকুরদের ‘চন্দ্র লগ্নের’ ব্যাখ্যা তিনি কানেই তোলেন না। তবু
মনটা যেন কি রকম চঞ্চল হচ্ছে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। আজ
রাত্তিরে যে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে তা যেন অন্য রাত্তিরগুলোর চেয়ে একটু আলাদা।
সুশোভনবাবুর চিন্তা আর থৈ
পায় না।
এ যদি অরিয়ন নীহারিকা হোত তবে গ্যাসীয় রাজ্যে এরকম দুর্ঘটনা ঘটা আশ্চর্য
ছিল না।
অথবা জুপিটার গ্রহের চৌহদ্দিতে এ রকম বিস্ফোরণ বিরল নয়। এমন
কি অমন যে চেনা পৃথিবী বাইরে থেকে ক্রিসমাস আইল্যাণ্ডের হাইড্রোজেন বোমা ফাটানোর পরীক্ষা
দেখলে যে কোনও অন্য গ্রহবাসী এক মারাত্মক ব্যাপার বলে ভুল করতে পারে। কিন্তু
ধূসর চাঁদ যে একেবারে মৃত প্রেতপুরী। সেই বন্ধ্যা মাটির ঘুম ভাঙালে কে?
চাঁদের জগতের হাঁড়ি-হদ্দ নাড়ি-নক্ষত্র বৈজ্ঞানিকদের জানতে আর বাকি নেই। পৃথিবীর
উত্তর মেরুর পুরো খবর পাবার আগেই চাঁদের উত্তর মেরুর সব খবর মানুষ পেয়ে গেছে। অষ্ট্রেলিয়া
কি আফ্রিকার দুর্গম রাজ্যের সব খবর মানুষ এখনও না যোগাড় ক’রে থাকলেও সেই কেপলারের আমল থেকেই চাঁদের গিরি গুহা কন্দরের ইতিবৃত্ত পাতার
পর পাতা লেখা হ’য়ে গেছে। তখন
কি-ই বা সম্বল ছিল মানুষের? কেবল গোটাকতক
টেলিস্কোপ।
আর আজ! মহাকাশ ভ্রমণের কতো সুবন্দোবস্ত
করা হয়েছে।
এই তো সেদিন খবরের কাগজে
বেরিয়েছিল রাশিয়ানরা ৮৬০ পাউণ্ড ওজনের একটা ক্যাপসুল চাঁদের উপর নামিয়েছে। তারপর
ওদের তিন নম্বর ল্যুনিক চাঁদের লুকানো ওপিঠের সব ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তবে
কি ওরা চাঁদে এর মধ্যেই লোকলস্কর নামিয়ে ফেলেছে? এখানে না হয় আমেরিকানদের সঙ্গে পারমাণবিক বিস্ফোরণ বন্ধ রাখার চুক্তি হয়েছে
তা ব’লে কি সে চুক্তি অন্য গ্রহ উপগ্রহেও বলবৎ থাকবে। ঐ
যে অস্বাভাবিক জ্যোতি - ওটা কি চাঁদে রাশিয়ানদের পারমাণবিক
বিস্ফোরণের ফল! যদি নেমেই থাকে তবে এতক্ষণে ওরা টেলিভিসন ক্যামেরা
লাগিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের যা ছবি নিয়ে ফেলেছে তাতে কাল সকালে কোলকাতায় বৃষ্টি হবে
কিনা এখন হয়তো মস্কো বেতারের রাত্রিকালীন অনুষ্ঠান শেষ হবার আগে ঘোষণা করতে আরম্ভ করবে। রাত
অনেক হলো।
দূরে কোথায় পাড়ার একটা কুকুর একবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর
আবার নিশুতি নিস্তব্ধ রাত্তির, গলির মোড়ের গ্যাসের
বাতিগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। কোথায় যেন ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে ঝিঁ
....ঝিঁ ….সুশোভনবাবুর একবার মনে হোল উঠে ঘরে গিয়ে
শোবেন।
কিন্তু কানের কাছে ভেসে আসছে একটানা টার্বো জেটের শিঁ-ই-ই-ই …
আর তারপরেই শোনা গেল কে
যেন তাকে বলছে মৃদুস্বরে,- “স্যার উঠতে পারবেন ত,
আমরা পৌঁছে গেছি এখন।”
স্পেস স্যুটের গা থেকে ধূলো
ঝাড়তে ঝাড়তে সুশোভনবাবু বললেন - “আই অ্যাম অলরাইট অমরেশ!
আমাদের যন্ত্রপাতির প্যারাসুটটা এখনও পৌঁছায়নি দেখছি। এ্যাণ্টিগ্রাভিটি
সিগ্মাটা তবে কি ফাংশান করছে না?”
অমরেশ সুশোভনবাবুর অতি প্রিয়
ছাত্র এবং সেই সঙ্গে মহাকাশ বিজ্ঞানের একজন নামকরা স্কলার। অক্সিজেন
মাস্কটা ঠিক করে নিতে নিতে সে বললে, “স্যার,
আমাদের আয়েঙ্গারের কষা অঙ্ক শিকাগোর ভ্যারিয়াক ইনস্টিট্যুট মিলিয়ে দেখা
হয়েছে।
ও ভুল হবার নয়। ঐ তো ওখানে ধুলোর মধ্যে কি যেন উঁকি মারছে!”
অতি অল্প ক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রপাতি সব উদ্ধার হলো। চারিদিকে
ধুলো আর ধুলো - একেবারে সমুদ্রের মতো। ফাঁকা,
নিস্তব্ধ যেন মৃতের রাজ্য। হাওয়া
নেই একেবারেই।
অমরেশ পকেট থেকে পিস্তল বার করে ট্রিগার টিপ্লে - কোনও শব্দ হোল না। বাতাস
না থাকলে শব্দতরঙ্গ আসবে কোথা থেকে। অক্সিজেন-প্রেসার
দেওয়া নলের মধ্য দিয়ে ট্রানজিস্টার সেটের মারফত কথা না বললে ওঁদের এখানে বোবা কালা
হয়ে থাকতেই হোত।
এখন দিনের বেলা অসহ্য গরম
প্রায় একশো ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড অর্থাৎ ২১২ ফারেনহাইট।
সুশোভনবাবু বল্লেন
- “পৃথিবীর হিসাবে দু’ সপ্তাহ এইরকম রোদে পোড়া
দিন থাকে।
তবে ভাগ্যক্রমে আমাদের রোদ্দুরে পুড়তে হবে আর চব্বিশটি ঘণ্টা। তারপর
রাত নামলে অসহ্য শীত ; শূন্যের তলায় পারা নেমে যাবে
২৪৩ ডিগ্রী।
এই অবস্থায় কাটবে আরও দু সপ্তাহ। যদি ধুলোর তলায় ঢোকা যায়
তাহলে এই শীত কি গ্রীষ্মের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। তবে
চিন্তা করার কিছু নেই। আমাদের স্পেস-স্যুটের
এসব সহ্য করবার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে হে!”
হঠাৎ অমরেশ চেঁচিয়ে উঠলো
- “স’রে আসুন, শিগ্গীর স’রে আসুন স্যার। কোথা
থেকে কারা যেন আমাদের দিকে গুলি করছে। অজস্র অগ্নিবর্ষী বুলেট ছুটে আসছে।”
হো হো করে হেসে উঠলেন সুশোভনবাবু
- “আরে, এগুলো ছুটন্ত উল্কাপিণ্ড মাত্র। আমাদের
স্পেস স্যুটের ভেতরে সিলিকা লাইনিং দেওয়া আছে এগুলো থেকে বাঁচাবার জন্য।”
ধীরে ধীরে সুশোভনবাবু যন্ত্রপাতির
ব্যাগ থেকে চাঁদের ধুলোর ওপর দিয়ে চলবার উপযোগী ভাঁজ করা বিশেষ ধরণের গাড়ি
‘হোভার-ক্রাফট’ খানা বার
করে লাগিয়ে ফেললেন। গাড়িখানা বেশ ভাল
- ডাঙায় চলে, জলেও চলে তবে ডিজাইন অনুযায়ী চাঁদের
ধুলোর ওপরই সব চেয়ে ভাল চলবে। গতি ঘণ্টায় প্রায় পাঁচশো মাইল। সুশোভন
বাবু হিসেব করে দেখেছেন আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চাঁদে সন্ধ্যা নামবে কারণ দিনের শেষভাগে
ওঁরা এসে নেমেছেন এখানে। বিকেল বেলাটায় গরম বেশি লাগছে। সন্ধ্যা
নামলেই ঠাণ্ডা পড়লে ওঁরা বেরিয়ে পড়বেন চাঁদের আগ্নেয়গিরির দিকে এবং তারপর হয়তো উদ্ঘাটিত হবে ঐ বিস্ফোরণের রহস্য ….
অচেনা অজানা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে
বেশিক্ষণ দিবাস্বপ্ন দেখা চলে না। খুব তাড়াতাড়ি ম্যাপের সঙ্গে গোটাকতক জায়গা মিলিয়ে
নিতে হবে বেরিয়ে পড়বার আগে। কারণ তা না হ’লে
ফিরে আসার সময় মুশকিল হবে। অবশ্য এই সব পাহাড় পর্বত,
উপত্যকা আগে এতবার করে ম্যাপে ওঁরা দেখেছেন যে পথঘাট সবই চেনা। কতবার
টেলিস্কোপে দূরের ঐ পাহাড়টার কোলের ছায়াখানি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখেছেন দুজনে। যদিও
ত্রিশ মাইল লম্বা ঐ উপত্যকাটা পৃথিবী থেকে সব চেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপেও দেখায় একটা
বিন্দুর মত।
দিগন্তে অসংখ্য আগ্নেয়গিরির চূড়া দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীতে
কিছু মৃত আগ্নেয়গিরি দেখেছেন সুশোভনবাবু। কিন্তু এরকম বিরাটকায় শত
শত নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত দেখলে কি বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। কে
জানে কি ভাবে ওদের জন্ম হয়েছিল। উঁচু উঁচু গির্জা-ক্যাথিড্রালের মতো দেওয়ালগুলো খাড়া উঠে গেছে।
চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ নেই বললেই
চলে।
অতবড় গাড়িখানা পাহাড় পেরিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে অমরেশের কোনই কষ্ট হচ্ছে না এছাড়া
অন্যান্য ভারি যন্ত্রপাতিগুলো সুশোভনবাবুর কাঁধে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এসে পড়লেন একটি ছোট আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি। ভেতরে
তাকালে দেখা যায় কবে কোন সুদূর অতীতে ফাটলের মধ্য দিয়ে লাভার স্রোত বেরিয়ে শতাব্দীর
পর শতাব্দী ধ’রে জমে অতিকায় স্তম্ভের সৃষ্টি
করেছিল।
খুব ভাল ক’রে লক্ষ ক’রে সুশোভনবাবু বুঝতে পারলেন দেখতে ছোট হলেও চাঁদের এই আগ্নেয়গিরি নিঃসন্দেহে
পৃথিবীর যে কোন বড় আগ্নেয়গিরির চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ছিল।
যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে
সুশোভনবাবু চেরেনকভ কাউণ্টারটা বার করলেন। গহ্বরের ভেতরে যন্ত্রের
এই গণনা থেকে হয়তো বোঝা যাবে কোনও দূরাগত উল্কাপিণ্ডের আঘাতে এই আগ্নেয়গিরিটির সৃষ্টি
হয়েছিল কিনা।
ঠিক তাই! স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সহস্র সহস্র
বছর আগে কবে যেন মহাকাশ থেকে একটা উল্কাপিণ্ড ঢুকে গিয়েছিল চাঁদের বুকে। তারপর
সেই উত্তপ্ত পিণ্ড ভেতরকার মাটিকে গ্যাস করে দিল। সেই
সঙ্গে শুরু হয়েছিল বিস্ফোরণ প্রচণ্ড বেগে।
কালিঢালা রাত্রি নামলো ধূসর
ঠাণ্ডা চাঁদের বুকে। এখন হোভার-ক্রাফ্টে চড়ে ওঁরা বেরোলেন মূল রহস্যের সন্ধানে। চাঁদের
ব্যাস ২১৬২ মাইল।
পুরো রাজ্যটা ঘুরতে পৃথিবীর সময়ে ঘণ্টা আটেকের বেশী লাগা উচিত নয়। গাড়ির
পাশ দিয়ে অন্ধকার ভেদ ক’রে জোনাকির মতো ছুটে চলেছে অসংখ্য
ছোট ছোট উল্কাপিণ্ড। তলায় অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে সহস্র সহস্র
আগ্নেয়গিরির গহ্বর।
কোথাও কোথাও দেখা যায় সরু ফিতের মত রশ্মিরেখা। হঠাৎ
রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সুশোভন বাবু বললেন “বুঝলে হে
অমরেশ, ওগুলো প্রায় নিভন্ত আগ্নেয়গিরির তেজস্ক্রিয় ছাইএর স্তুপ। অবশ্য
গত বছর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার বন্ধু জাপানী বৈজ্ঞানিক নিশিহারা বলেছিলেন,
ওগুলো আকরিক উল্কার অবশেষ মাত্র।” অমরেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে তখন তীব্র
সুদূরপ্রসারী আলো ফেলে চাঁদের পর্বতমালার সঙ্গে পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপে তোলা কতগুলো
ফটো মিলিয়ে দেখছিল। দূরে দেখা যাচ্ছে মাউন্ট হুইগেন্স - যেন বিশ্বাস হ’তে চায় না এত
কাছে।
সুশোভনবাবুর কথায় ওর সম্বিৎ ফিরলো। লজ্জিতভাবে
বল্লে, “হ্যাঁ স্যার, আমি কিন্তু বরাবরই
ভাবতাম গুঁড়ো ধূলোর আলোক প্রতিফলনের ক্ষমতা খুব বেশী। কাজেই
তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে আলো পড়লে তা ওভাবেই দেখা দেবে।”
পথ যেন আর ফুরোয় না। হোভারক্রাফ্টের তলা দিয়ে স’রে গেল কত অসংখ্য পাহাড়ের শ্রেণী
- পৃথিবীর চেনা পর্বতগোষ্ঠীর নামেই তাদের নাম - পিরেনীজ, আল্পস, এপেনাইন,
কার্পেথিয়ান এবং সবশেষে ককেশাস। অন্ধকার
ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো; চেনা ম্যাপের রাজ্য ফুরিয়ে গেল। মনে
হচ্ছে যেন ওঁরা এসে পড়েছেন রাশিয়ানদের ফটোতোলা চাঁদের অদেখা পাশটিতে। আমেরিকান
বৈজ্ঞানিকরা এই সেদিন পর্যন্তও জোর গলায় বলেছেন থিওরী অনুযায়ী এদিকটাতে নিশ্চয়ই অনেক
বেশী গিরি-গুহা-কন্দর-আগ্নেয়গিরি
আছে-কতকটা মানুষের মুখের বসন্তের দাগের মত ঘন। কারণ,
ছুটন্ত উল্কার ঝাপটা ওপাশেই বেশী। এই
নিয়ে গত বছর সান্ফ্রান্সিকোর আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে
মার্কিনী প্রফেসার খারাশের সঙ্গে কত তর্কই না করেছেন। আমেরিকানরা
গলাবাজি করে নিজেদের কথা প্রমাণ করতে চাইছিল। সুশোভনবাবু
কিন্তু বরাবর বলে এসেছেন যে চাঁদের যে দিকটা পৃথিবীর দিকে ফেরানো সেদিকটাতে মাধ্যাকর্ষণ
বেশী আছে।
তাই পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে গুহা উপত্যকা। উলটো
দিকটা তাই নিশ্চয়ই মসৃণ হবে। রাশিয়ান অধ্যাপক মিখাইলভ তিন নম্বর ল্যুনিকের তোলা
টেলিভিসনের ছবি দিয়ে যখন সুশোভনবাবুকে সমর্থন করলেন খবরের কাগজে বাঙালী বৈজ্ঞানিকের
প্রশংসার ঢেউ উঠেছিল। আর আজ প্রফেসার খারাশ যদি সঙ্গে থাকতো।
“স্যার, ঐ মিখাইলভের নাম দেওয়া মেছ্তা সাগরের দিকটাতে তাকিয়ে
দেখুন তো কিছু কি দেখা যাচ্ছে” - অমরেশের কথায় ওঁর চিন্তার জালে
ছেদ পড়ল।
ভাল করে তাকিয়ে দেখলে মনে হচ্ছে যেন ছোট ছোট তারার বিন্দু। হোভারক্রাফটের
গতি বাড়িয়ে দিলেন সুশোভনবাবু। খুব তাড়াতাড়ি মস্কো সাগর পাড়ি দিয়ে মেছ্তা সাগরের আরো কাছাকাছি এসে মনে হোল যেন অসংখ্য স্ফটিকের স্তম্ভ। তারপর
আরো কাছে….
“মাই গড, প্লুটোয়ানস!” নিমেষে অমরেশের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে
গেল।
গ্রহান্তরবাসীদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায়, বৈজ্ঞানিক কৌশলে এবং সেই সঙ্গে হিংস্রতায় যে এদের আর জুড়ি নেই মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের এ সম্বন্ধে সন্দেহ ও বিতর্কের অবসান ঘটেছে। আগে
মার্শিয়ানদের সম্বন্ধে ভয় ছিল কিন্তু প্লুটোয়ানদের বিভীষিকায় এয়ারকণ্ডিশন-করা স্পেস স্যুটের মধ্যকার দুঃসাহসীদের মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা ঘামের স্রোত বইতে
লাগল।
“শিগ্গীর রেডিওএ্যাক্টিভ ব্যারিয়ার শীল্ডটা বার করবার বন্দোবস্ত
করো।
বোঝাই যাচ্ছে, ওরা নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশানের
জন্য রেডি হচ্ছে। কুইক, দেরী হ’লে চাঁদের ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।” - উত্তেজনায় সুশোভনবাবুর গলা থর
থর করে কাঁপছে। নিমেষে হোভার ক্রাফ্টখানা পুবমুখো ঘুরিয়ে নিলেন। রেয়ারভিউ আয়নাখানায় তখনও
ভাসছে স্পষ্ট ছায়া - উজ্জ্বল ছুটতারার মত ক্ষিপ্র,
চঞ্চল অসংখ্য চলমান স্ফটিক স্তম্ভ।
বিশগজ যেতে না যেতেই চোখধাঁধানো
আলোয় চারিদিক ভেসে গেল। কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল কোটি সহস্র আগ্নেয়গিরির লাভা। ফুল
স্পীডে চলছে হোভারক্রাফট।
- “ফল-আউট শুরু হবার আগে আমাদের পালাতেই হবে স্যার! এভাবে জতুগৃহে
পুড়ে মরতে পারবো না। ফুল থ্রটল চালান”
- “তুমি কন্ট্রোলটা নাও
অমরেশ, আমি রেট্রোরকেটগুলো রেডি করি। আমাদের
সময় আর নেই।
এখন তৈরি না হ’লে এখান থেকে পাড়ি দেওয়া যাবে না।”
কিন্তু একি!
থরথর করে কেঁপে হোভারক্রাফট খানা মন্থর হ’য়ে এল। কন্ট্রোল
- না কন্ট্রোল ত’ ঠিকই আছে। ফিউএল
- না যথেষ্টই আছে। তবে,
তবে কি! হঠাৎ বিদ্যুতের মতো মনে পড়ে গেল
-
“আমরা প্লুটোয়ানদের ম্যাগনেটিক
ফিল্ডে বন্দী অমরেশ! শিগগীর অঙ্ক কষে বার করতে হবে কীভাবে ডিগাউসিং
করা যাবে।
কিন্তু, কিন্তু পেছনে ওটা কি।”
আয়নায় ছায়া পড়েছে। সেই
স্ফটিক।
প্রথমে ২০০ গজ দূরে, তারপর তড়িৎগতিতে ছুটে
আসছে ওদের ক্রাফটের দিকে। সেকেণ্ড, মিনিটগুলো
যেন মাস ও বছর। ক্যালকুলেটিং মেশিন যেন আর চলে না। এ
রাতও বুঝি ফুরোবে না। এদিকে স্ফটিক এগোচ্ছে যেন আলোর গতিতে। হোভারক্রাফট
ছোঁয় ছোঁয়।
লাফিয়ে উঠ্লেন সুশোভনবাবু।
- “কুইক অমরেশ। স্টার্ট ডিগাউসিং। আই
হ্যাভ গট দি ফরমুলা।”
ঊর্ধ্বশ্বাসে হোভারক্রাফট
ছুটলো।
পাহাড়গুলো পেরোতে পারলেই লঞ্চিং প্যাড বসানোর জায়গা পাওয়া যাবে। আর
একবার পৃথিবীমুখো রকেটে চড়ে বসতে পারলেই….কিন্তু
সে চেষ্টা করতে ওরা দেবে কি?
চাঁদের মরা রাত্তিরে রকেটের
চোখ-ঝলসানো আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই স্ফটিকের মধ্য থেকে
প্লুটোয়ানদের গামা-রে চোখ মাত্র তিন গজ দূরে।
এক্স-মাইনাস টু, এক্স-মাইনাস ওয়ান
- টেক্ অফ্ - শিঁ-ই-ই….
….“বাবু, ও বাবু বৃষ্টি পড়ছে যে ঘরে গিয়ে শোবেন চলুন”।
একি!
সুশোভনবাবু ভাবলেন - ও কে? চাকর মহেশ না ছদ্মবেশী প্লুটোয়ান।
চোখ রগড়ে হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত
আড়াইটে।
কখন জ্যোৎস্না হারিয়ে গেছে মেঘে। এখন বৃষ্টির নূপুর বাজে
- টুপ্-টাপ্।
_____
(শারদীয় তরুণতীর্থঃ ১৩৭০
ও জয়ঢাক চতুর্বিংশ সংখ্যায় প্রকাশিত, প্রুফ সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত)
লেখকের কন্যা শ্রীমতী
যশোধরা রায়চৌধুরীর অনুমতি ক্রমে প্রকাশিত
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment