বিষম-এর বিস্ময়
প্রসূন কুমার দাস
পুজোর ছুটিতে অয়নরা এবার
এসেছে লে লাদাখ বেড়াতে। রাজধানীতে গতকাল দিল্লী এসে আজ সকাল ৮.৪৫-এর গো এয়ার ফ্লাইটে
একটু আগে লে এয়ারপোর্ট নেমেছে। দারুণ উত্তেজিত অয়ন। আপাতত ট্যাক্সিতে যাবে হোটেল
লুম্বিনি। ‘কুশক বাকুলা রিম্পচি’
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল কমবেশি ৫ কিমি।
অয়ন, বাড়ির আদরের টকাই, ক্লাস
সিক্সে পড়ে। গলা ভাঙতে শুরু করেছে, গতবারের জামাপ্যান্ট এবার একদমই পরা যাচ্ছে না।
পড়াশোনার বাইরে টকাই নিয়মিত খেলাধুলোও করে। বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও আছেন পেনশন পাওয়া
দাদু সুধাংশুবাবু, তার প্রিয় কাকা-কাকিমা, খুড়তুতো ভাই তোতন আর হ্যাঁ, দিদি
টুম্পা। টুম্পার এবার ক্লাস টেন। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের গার্জেনদের মতো
টুম্পার বাবা-মায়েরও মনে হয়েছে টুম্পার এবার বেড়াতে না যাওয়াটাই ঠিক। টকাইয়ের দাদু
এই ব্যাপারটায় মহা বিরক্ত হয়েছেন। স্ত্রী না থাকায় মনের বিরক্তি ছেলে তন্ময়ের উপর
উগরেছেন।
“তোর মাধ্যমে আমার যতটুকু জিন
ওর কাছে পৌঁছেছে তাতে এই দশদিনের ছুটিতে ওর শকুন্তলাদেবী হওয়া আটকাত না। ভুলে যাস না,
হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার আগে তুই আমাদের সাথে রাজস্থান বেড়াতে গেছিলি।”
তন্ময় যে এ কথাটা একেবারে
বোঝে না তা নয়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষা নামে এখানে যে প্যারানয়েড ব্যাপার সমস্ত গার্জেনকে
আক্রান্ত করে ফেলে, তন্ময় আর তার স্ত্রী তনিমাও তার থেকে বেরিয়ে আসতে না পারায়
টুম্পা বেচারা বাড়িতে থেকে গেল। এই রাগে টুম্পা টকাইয়ের পিছনে লাগল, “শোন টকাই,
যাওয়ার আগে বাবাকে বলে তোর স্কুল থেকে একটা টি.সি. নিয়ে যা।”
টকাই অবাক, “কেন, টি.সি. কেন?”
“কারণ, তোর রেজাল্টের যা হাল
হচ্ছে তাতে লাদাখের কোনও স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলে তোর এবং তার সাথে আমাদের মান বাঁচবে।
কারণ, ওখানে স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় নাকি ৫০%-এর বেশি পাশ করে না। এরকম
স্ট্যান্ডার্ডে তোর ভালো রেজাল্ট আটকায় কে?”
একটা বিকট ভেংচি কেটে টকাই ঘর
থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। টকাই কিন্তু পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো।
প্লেন নেমেছে ১০টা নাগাদ।
মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সি ধরে হোটেল পৌঁছতে প্রায় ১১টা। থ্রি-স্টার হোটেল। লিফট নেই।
বাবার সাথে সুটকেস নিয়ে তিনতলায় উঠতে হল। টকাই লক্ষ
করল যে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। খেলাধুলা করা টকাইয়ের কাছে এটা একটু অস্বাভাবিক লাগল। ঘরে
পৌঁছে টকাইয়ের জল পিপাসা পেল। গ্লাসে জল ঢেলে খেতে গিয়ে দেখল একগ্লাস জল ও একবারে
শেষ করতে পারল না। দম নেয়ার জন্য মাঝপথে থামতে হল।
বাবাকে জিগ্যেস করতে গিয়ে দেখল, বাবা হোটেলের লোকের সাথে কালকের প্রোগ্রাম নিয়ে
কথা বলছে। কাল ওদের স্পিতুক মনাস্ট্রী, ইন্দাস-যান্সকার নদীর সংগম আরও কীসব দেখতে
যাওয়ার কথা। তারপর যাবে প্যাংগং লেক, খারদুংলা পাস। সুতরাং প্রশ্নটা আর করা হল না।
লাঞ্চের সময় জলের ব্যাপারটা
আবার ঘটল। এবার বাবাকে টকাই জিজ্ঞেস করল এর কারণটা কী।
বাবা-মায়ের চোখাচোখি হল। উত্তরটা টকাইয়ের মা তনিমাই দিল, “বাবু,
তুই জানিস আমরা এখন হিমালয়ের উপর আছি। উচ্চতা দশ হাজার ফুটেরও বেশি। এত উচ্চতায়
এমনিতেই গাছপালা কমে যায়, তার উপরে হিমালয়ের এই অংশটা যাকে বলে ‘রেন শ্যাডো’ তাতে
পড়েছে। মানে বর্ষার মেঘ এখানে পৌঁছায় না। পাহাড়ই আটকে দেয়। যার ফলে এটা হল হিমালয়ের
মরুভূমি। তাই গাছ কম। গাছ কম তো অক্সিজেন কম, অক্সিজেন কম তো দম কম। তার ফলে এখানে
আমরা সবসময় একটু অক্সিজেন ঘাটতিতে ভুগি। এখন, তুই যখন জল খাস, তখন তোর প্রশ্বাস
বন্ধ থাকে। কিন্তু ওইটুকু সময়ের জন্য যে বাতাসটুকু না পাওয়া যাচ্ছে শরীর সেটাও
সইতে পারে না। কারণ, এখন আমরা সবসময়ই অক্সিজেন ঘাটতিতে ভুগছি। তাই
আমাদের জল খাওয়া বন্ধ করে মাঝপথে শ্বাস নিতে হয়।”
“এটা তো জানতাম না যে জল
খাওয়ার সময় শ্বাস বন্ধ করতে হয়!” টকাই বিস্মিত।
“হ্যাঁ, জানতি না, তা নয়। কখনও বুঝতেই পারিসনি। তার কারণ, ঐ জল খাওয়ার সময়টুকুতে শরীরের যতটুকু অক্সিজেনের প্রয়োজন তা শরীরের রক্তে
মজুত অক্সিজেনেই হয়ে যায়।”
“শুধু জল খাওয়াই নয়,
কোনও কিছু গিলবার সময়ই আমরা শ্বাস নিতে পারি না বা বলা ভালো নিই না,” বাবা বলল, “এটা
আমাদের অজান্তেই হয়। কখনও কখনও এটা গণ্ডগোল হয়ে গেলে আমরা বিষম খাই। এই কারণেই খাওয়ার
সময় চুপচাপ খাওয়াই ভালো। কারণ, কথা বলার সময় শ্বাস নেয়া-ছাড়া
দুটোই করতে হয়, যেটা খেতে খেতে করা মুস্কিল।”
টকাই নতুন তথ্যে বুঁদ হয়ে
খেতে থাকল। বাবা বলল, “আর শোন, এই বিষম খাওয়া ব্যাপারটা মানুষের একচেটিয়া ব্যাপার।
তাও আবার শিশুরা বিষম খায় না এবং খায় না কোনও জন্তু।”
এবার টকাই সত্যি বিষম খেল। মা
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বাবুর পিঠে আলতো করে থাপ্পড় দিতে শুরু করলেন। খানিকক্ষণ কেশে-টেশে
সুস্থ হয়ে টকাইয়ের প্রশ্ন, “বাবা, এরকম কেন? শুধু মানুষেরই এই অসুবিধা কেন আর
শিশুদেরই বা নয় কেন?”
বাবা রহস্য করে বলল, “তুই
বেড়াতে ট্রেন, এরোপ্লেন, গাড়ি করে যাস বলে।”
বাবু কিছুই বুঝল না। ‘বাবা বল
না, বল না’ বলতে থাকল। বাবা বললেন, “খাওয়াটা শেষ কর, পরে বলব।”
খাওয়া শেষ করে মৌরি চিবোতে
চিবোতে টকাই বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এখন কী করব আমরা?”
আসলে টকাই চাইছিল ঐ প্রশ্নটার
উত্তর এখনই পেতে।
বাবা বলল, “চল, একটু লনে গিয়ে
বসি। খেয়ে উঠে শীত শীত লাগছে।”
তনিমা বলল, “তোমরা যাও। আমাকে
ঘরের চাবিটা দাও। আমি একটু ঘরে যাব।”
হোটেলের লনটা সুন্দর। চারপাশে
হেজ করা বেঁটে গাছ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু বেতের চেয়ার। তন্ময় একটা চেয়ার নিয়ে
রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসল। মুখোমুখি আর একটায় বসল টকাই। অল্প দূরে দুই যুবক বসে গল্প
করছিল। শোনা গেল, একজন আরেকজনকে বলছে, “কী ব্যাপার বলুন তো।
এখানে সিগারেটগুলো কি নকল?”
“কেন?” অন্যজনের পালটা
প্রশ্ন।
“আরে কলকাতায় সিগারেট ধরাতে
না ধরাতে শেষ হয়ে যায়, আর এখানে তখন থেকে টেনেই চলেছি, ফুরোয় না দেখছি।”
উত্তরে অন্যজন কাঁধ ঝাঁকিয়ে
বলল, “নো আইডিয়া, বস। আমি তো খাই না।”
কথাটা শেষ করতে করতে দৃষ্টি
তন্ময়দের দিকে।
“আপনারা বোধহয় এদিকে এই
প্রথম?” তন্ময় প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”
“কিছু মনে করবেন না। ঐ ওনার
সিগারেট দেরিতে শেষ হওয়ার প্রশ্নটা শুনে মনে হল এদিকে আগে আসেননি,” তন্ময় বলে, “আসলে
ব্যাপারটা হল, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে এখানে তাড়াতাড়ি হাঁফ ধরে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কী?”
“এখানের বাতাসে অক্সিজেনের
পরিমাণ কম, তাই হাঁফ ধরে যায়। আর ঐ একই কারণে শুধু সিগারেট নয়, সবকিছুই ধীরে ধীরে
পোড়ে। কাজেই আমার মনে হয় না আপনার সিগারেটে কোনও ভেজাল আছে।”
“বলছেন? আচ্ছা, তাহলে
নিশ্চিন্তে খাই।”
দু’জন আবার নিজেদের
আলাপচারিতায় ফিরে যায়। ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গিতে টকাইয়ের হাসি পেয়ে যায়। ফিসফিস করে
বাবাকে বলে, “জটায়ু।”
বাবা চোখ পাকায়।
বাবা পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল
বার করতে টকাই প্রমাদ গুনল। তাড়াতাড়ি
বাবাকে বলল, “বাবা, এবার ওইটা বল।”
“ও হ্যাঁ,” তন্ময় মোবাইলের
স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখল, “শোন তাহলে। অল্প কিছু সংখ্যক
মানুষ আছে যারা দুর্ভাগ্যবশত বোবা হয়ে জন্মায়। বাকি সব মানুষ কথা বলতে পারে। এই
কথা বলার ক্ষমতাটা মানুষের একান্ত নিজস্ব। বিবর্তনের
ইতিহাস নানা চমৎকারিত্বে ভরা। আমাদের, মানে মানুষের আদি পূর্বপুরুষেরা যখন থেকে
মাটিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু করল, ফলমূল, শাক-পাতা, শস্য-দানার
সাথে আমিষ খাওয়া শুরু করল তখন থেকে শুরু হয়ে গেল বিবর্তনের নতুন মোড়। মাংস তো আর
গাছগাছালিতে পাওয়া যায় না। সবসময় মৃত পশুও পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে শিকার করতে হবে।
শিকার করতে গেলে অস্ত্র লাগে। সুতরাং বানাও অস্ত্র। অস্ত্র বানানো বুদ্ধিহীনদের
পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং শুরু হল বুদ্ধির বিকাশ। শিকার করতে গেলে একার বদলে দলবদ্ধ
হওয়া ভালো। আরও ভালো হয় যদি একটা নির্দিষ্ট
পরিকল্পনা করে শিকারকে আক্রমণ করা যায়। এবার দেখ, তুই ঘরে একা থাকলে যেমন তোর কথা
না বললেও চলে, তেমনই আবার একদল মানুষ একসাথে থাকলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তারা কথা
বলবেই। সুতরাং সেই সুদূর অতীতে মানুষের পূর্বপুরুষ যখন দলবেঁধে থাকা শুরু করল তখন
থেকেই শুরু হল নিজেদের মধ্যে ভাবের বা বার্তার আদানপ্রদান। আর
জন্ম নিল ভাষা। তবে ভাবিস না যে দু-দশ বা শত খানেক বছরের মধ্যেই এই অগ্রগতি হয়ে
গেল মানুষের। বিবর্তন একটা অতি ধীর পদ্ধতি। এত বড়ো ক্ষমতাটা অর্জন করতে মানুষকে
লক্ষ লক্ষ বছর পার করতে হয়েছে। মুখ দিয়ে শব্দ বার করার জন্য লাগে ফুসফুস, গলা,
গলায় অবস্থিত শব্দযন্ত্র যেটাকে ভয়েস-বক্স বলে। এছাড়াও জিভ আর ঠোঁট, এমনকি দাঁতও।
কিন্তু শুধু এতগুলো যন্ত্রপাতি থাকলেই হয় না। আমরা যখন কথা বলি তখন আমাদের
মস্তিষ্ক দুর্দান্ত গতিতে সেই ভাষাকে একটা প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায় এবং
আমাদের শরীরের ঐ যন্ত্রপাতিগুলোকে চালনা করে। এ ব্যাপারে এখন বৈজ্ঞানিকেরা একমত যে
মানুষের বুদ্ধি আর মৌখিক ভাষা হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। মানে বুদ্ধির বিকাশ সাহায্য
করেছে মুখে কথা ফোটাতে, ভাষার বিকাশ ঘটাতে। আবার যত
ভাষা এগিয়েছে ততই তা উন্নততর করে তুলেছে বুদ্ধিকে।
“আচ্ছা, এবার একটু আমাদের এই
কথা বলার যন্ত্রপাতিগুলোর গঠনতন্ত্র বা অ্যানাটমিটা বুঝে নে। জিভ, ঠোঁট, দাঁত
এগুলো নিয়ে বলার কিছু নেই। আমাদের মুখের ভিতর জিভের পিছন দিকটায় যে গহ্বর থাকে
তাকে বলে গলবিল বা ফ্যারিংকস। এই ফ্যারিংকস থেকে দুটো নালী নেমেছে একটা শ্বাস নিয়ে
ছাড়ার জন্য, শ্বাসনালী বা ট্র্যাকিয়া। অন্যটা অন্ননালী বা ঈসফ্যাগ্যাস। এই
ট্র্যাকিয়ার উপরের অংশটাকে বলে স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংকস। গন্ডগোলটা শুরু হয়ে গেল
এখানেই। আমরা নাক দিয়ে শ্বাস নিই আবার মুখ দিয়েও নিতে পারি। অর্থাৎ নাকের পিছন
দিকটা গিয়ে ফ্যারিংকস-এ পড়েছে। এবার খাবার
সময় ফ্যারিংকস হয়ে খাবারটা নীচে গিয়ে কোন নালীতে ঢুকবে তার কী স্থিরতা? পেটে না
গিয়ে খাবার যদি ফুসফুসে চলে যায়? বা শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাস শ্বাসনালীতে না গিয়ে
যদি অন্ননালী দিয়ে পেটে যায়? এর জন্য রয়েছে আলজিভ বা এপিগ্লটিস। এটা একটা ভালভের
কাজ করে। আমরা যখন খাবার গিলি তখন ল্যারিংকসটা একটু উপর দিকে উঠে আসে আর আলজিভ ঠিক
একটা দরজার মতো ল্যারিংকসের প্রবেশপথটা একদম বন্ধ করে দেয়। এটা নিজে নিজেই হয়। এর
জন্য আমাদের সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হয় না। কোনও কারণে যদি এপিগ্লটিস-এর পাশ দিয়ে
সামান্য খাবারও শ্বাসনালীতে ঢুকে যায় তাহলেই আমরা বিষম খাই। তুই তোর গলার উপর হাত
রেখে ঢোঁক গেল, এ ব্যাপারটা অনুভব করতে পারবি।”
টকাই দেখল, সত্যিই তো! ঢোঁক
গিললে গলার ভিতরে কিছু একটা উপরে উঠছে আবার নেমে যাচ্ছে।
“টের পেলি?” বাবার প্রশ্ন।
“হ্যাঁ, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”
“আচ্ছা, এবার বল, এখন পর্যন্ত
নতুন কী কী শব্দ জানলি।”
“ওই তো ফ্যারিংকস,
ট্র্যাকিয়া, ঈসফ্যাগ্যাস, এপিগ্লটিস।”
“ল্যারিংকস বাদ দিলি কেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ল্যারিংকস।
ওটাই তো শব্দযন্ত্র, তাই না?”
“হ্যাঁ। আর ঐ ল্যারিংকস-এর
মুখে আছে কতগুলো পেশী যার নাম স্বরতন্ত্রী বা ভোকাল কর্ড। এছাড়াও থাকে একধরনের
তরুনাস্থি বা কর্টিলেজ। মুখ দিয়ে শব্দ করার সময় আমাদের ফুসফুস থেকে হাওয়া
ট্র্যাকিয়া দিয়ে উঠে ল্যারিংকস-এ পৌঁছায় এবং সেখান দিয়ে বেরোনোর সময় ভোকাল কর্ড-এ
আঘাত করে। আমরা কীভাবে কী কথা বলতে চাইছি তার উপর নির্ভর করে আমাদের মস্তিস্ক দিয়ে
পাঠানো সঙ্কেত অনুযায়ী কর্ডগুলো ছোটোবড়ো আকার নেয়। ওদিকে ঐ তরুনাস্থিও তার আকার
বদল করে। এই কর্ড আর তরুনাস্থির আকারের উপর নির্ভর করে শব্দ। লক্ষ করেছিস যে
সেতার, গীটার জাতীয় বাদ্যযন্ত্রগুলো শিল্পী যখন বাজায় তখন তারা আঙুল দিয়ে তারের
কার্যকারী অংশটা ছোটোবড়ো করে আর আওয়াজটাও পালটে যায়। যত
মোটা তারে আঘাত করবি তত ভারী আওয়াজ আর সরু তারে সরু আওয়াজ। শুধু তাই নয়, তারের
কার্যকারী দৈর্ঘ্য যত লম্বা তত ভারী আর যত কম তত সরু আওয়াজ বের হয়। এখন দেখ,
প্রাণীজগতে আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জি বা অন্যান্য বানরশ্রেণীর প্রাণীদের
সবারই এই শব্দ তৈরির যন্ত্রপাতিগুলো থাকে। কিন্তু কেউ তো আমাদের মতো কথা বলতে পারে
না! অবশ্য সত্যি কথা বলতে কী, কথা যদি হয় ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যম, তাহলে ওরাও
ওদের মতোই কিছু শব্দ বলে যেটা আমাদের মতো জটিল নয়। ঐ প্রাণীরা উ, আ, ই এইধরনের
শব্দই করতে পারে।
“এবার আমরা তোর প্রশ্নটার যে
উত্তর, তার মূল জায়গায় পৌঁছে গেছি। অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষ এত বেশি রকমের
শব্দ মুখ দিয়ে করতে পারে যার ফলে সেই বিভিন্ন শব্দের মিশ্রণে হাজার হাজার কথা
বানাতে পারে? ঐ যে অ্যানাটমিটা তোকে বললাম, এর মধ্যে মানুষের ল্যারিংকস-এর মুখটা
ফ্যারিংকস-এর মধ্যে ঈসফ্যাগ্যাস-এর যে মুখ তার থেকে কিছুটা নীচে। এর ফলে কী লাভ
হল? লাভ হল এই যে ফ্যারিংকস-এর যে গহ্বর যেখানে শব্দটা অর্থাৎ আওয়াজটা তৈরি হয় তার
আয়তন গেল বেড়ে। আর এর ফলে নানারকমের আওয়াজ তৈরি করা যেতে লাগল। কিন্তু দেখ, তোকে
আগেই বলেছি যে ফ্যারিংকস-এর শেষ দিকটায় দুটো নালী ট্র্যাকিয়া আর ঈসফ্যাগ্যাস। ট্র্যাকিয়ার
শুরুর অংশটাকে আমরা বলছি ল্যারিংকস। অর্থাৎ ঐ দুটো নালীতে পৌঁছানোর রাস্তা একটাই।
বানর জাতীয় প্রাণীদের এই নালী দুটোর প্রবেশপথ কিন্তু পাশাপাশি।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ল্যারিংকস-এর মুখটা কিছু নীচে।
এখন তুই খাওয়ার সময় শক্ত বস্তু চিবোনোর পরে আর তরল বস্তু সরাসরি যখন গেলার চেষ্টা
করিস তখন আমাদের ফ্যারিংকস-এর পেশীগুলো ঐ খাবারকে ঠেলে দেয় নীচের দিকে। এবার খাবার
যখন অন্ননালীর দিকে যাচ্ছে তখন এটা খুবই স্বাভাবিক যে কিছু অংশ অন্ননালীর পাশ দিয়ে
আরও খানিক নীচে ল্যারিংকস-এর মুখে গিয়ে হাজির হবে। তাই খাদ্যবস্তু তার যাত্রাপথে
যাতে ল্যারিংকসে না ঢুকে পড়ে সেজন্য এপিগ্লটিসকে পাহারা দিতে হয়। অন্য প্রাণীদের
এই সমস্যাটা নেই বলে তারা খেতে খেতে দিব্যি শ্বাস নেয়া ছাড়া চালাতে পারে। আবার দেখ,
মানুষের নবজাত শিশুকে মায়ের দুধ খেতেই হবে। আর তারা ঘন ঘন খাওয়া ছেড়ে শ্বাস নেবে
ছাড়বে, এটা তো হতে পারে না। তাই জন্মের সময় মানবশিশুর ল্যারিংকস থাকে অনেক উপরে। যাতে
তার দুধ খাওয়া আর শ্বাস নেয়া-ছাড়া একই সাথে চলতে পারে। এবং আঠেরো মাস বয়েসের সময়
থেকে এই ল্যারিংকস নীচে নামতে থাকে এবং প্রায় চোদ্দ বছর বয়েস নাগাদ এই নীচে নামাটা
সম্পূর্ণ হয়। সুতরাং ইহাই হইল সেই কারণ যাহার জন্য শিশুরা বিষম খায় না কিন্তু
টকাইবাবু খায়। পরিষ্কার?”
“উরেব্বাস! কী দারুণ সব
ব্যাপার! বিস্মিত অয়নের প্রতিক্রিয়া।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
Superb article. Got lot of knowledge about the body components. Excellent presentation. Reading the article was a great pleasure. Kudos to the writer.
ReplyDeleteMy regards.
DeleteAmit nijei anek Kichu jene gelam. Darun likhechis.
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ।
DeleteBigyaner chhatri howar subade bishoygulo alpo bistor jadio Jana, tobuo tomar ai lekhata Porte giye besh bhalo laglo....akta Sundar golper madhyame bishoy ta Tumi komon jolobot tolorong kore bujhiye bole file .....sorbopori boli kamon jano Mone holo feludar songe akta Safar a cholechhi....chaliye jao darun.....
ReplyDeleteEasy presentation. Plot creation fantastic.
ReplyDeleteSikar korte didha nei, prothome jokhon mukhabondho aar chobi ta dekhlam, bhablam amar bondhu bodhoy khub bore korbe. Kintu jei pora suru korlam, lekhar badhuni ta eto sundar aar galpo bolar kayda eto bhalo lagte suru korlo, je taratari porte suru korlam. keno jani na khali mone hote laglo je ashapurna debir kono golpo porchi.Tarpor seher dike golper more ghure gelo, manab sarirer bigyan vidytic tathya gulo aker por ek aste suru korlo, ki rokom jeno ekta bhalolagay boond hoye gelam. Satti golper chole koto ajana tathya jnte parlam, ek kothay anabadya. Aro anek anek bhalo kichu jiniser ashay roilam. Thanks my friend- Santanu Banerjee.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteদারুণ লিখেছিস। মানুষের শরীরের এই জটিল কিন্তু অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়ার এত মনোগ্রাহী ও প্রাঞ্জল বিবরণ সত্যি আগে পড়িনি। লেখা ছাড়িসনা। এমন আরো অনেক লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteIts a masterly lucid presentation of the anatomy and phisiology of nose,mouth,pharynx, larynx, oesophagus etc,for novices like me and young ones. Very educative.Sucessful attempt by Mr.Das. I highly appreciate his endeavour and wait for some more talents from Prasun.
ReplyDeleteKhub bhalo laglo pore.
ReplyDeleteDaroon lekha hoeche. Lucid, easily digestible, chalio jao bondhu. Aro lekha chai
ReplyDeleteBhalo hoyeche lekhata kaku
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteউৎসাহিত হলাম। ধন্যবাদ।
Deleteবেশ ভাল লাগলো
ReplyDeleteউৎসাহিত হলাম। ধন্যবাদ।
DeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteভাল লাগল।নতুন আঙ্গিকে অজানাকে জানা হল।
ReplyDeleteলেখাটা তাহলে সার্থক হল।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete