ম্যাজিক পেনসিল: গল্প:: জয়ং দেহি - অদ্রিজা মণ্ডল


জয়ং দেহি
অদ্রিজা মণ্ডল
নবম শ্রেণী, সেণ্ট মেরিজ কনভেণ্ট স্কুল

“কী রে শমী? কী করছিস?”
শমী বসে বই পড়ছিল, ডাক শুনে সে মুখ তুলে চাইল দেখে, সামনে তার দুই বন্ধু, আরশি আর মৈনাক দাঁড়িয়ে আছে
“এই তো, বসে বই পড়ছি,” বলে সে বইখানা তাদের দেখাল
মৈনাক বইটাকে দেখে বলল, “কাকাবাবু সমগ্র হুমম্, তা কবে থেকে পড়া হচ্ছে?”
শমী বলল, “যবে থেকে কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ সিনেমাটা দেখলাম” এই বলে সে আবার বই খুলে বসে পড়ল
“এই, বই রেখে আমার কথাটা শোন,” বলে আরশি শমীর হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে তার পাশে বসে পড়ল
শমী এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বল, কী হয়েছে?”
মৈনাক বলল, “পরের মাসে স্কুলে মহালয়ার অনুষ্ঠান হবে সেখানে এক বিশেষ অংশ হল মহিষাসুরমর্দিনী’আমি আর আরশি তাতে নাম দিচ্ছি তুই দিবি?”
অমনি শমীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল সে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না, না, না, আমি ওসব পারব না! তোরা ভালোভাবেই জানিস যে স্টেজে উঠলে আমার কীরকম হতে থাকে আমার দ্বারা হবে না!”
আরশি আর মৈনাক এ ওর দিকে তাকাল যেন বলতে চাইছে, জানি তো, এটাই বলবে
মৈনাক মাথা নেড়ে বলল, “না, এবারে ঐ অজুহাত আমরা কোনোমতেই শুনছি না
“ব্যাপার কী তোর?” আরশি জিজ্ঞাসা করল, “তোর এত সুন্দর গলা, অথচ তুই কোনো অনুষ্ঠানে নাম দিতে চাস না... কী হয়েছে কী?”
“আসলে,” মিনমিন করে শমী বলল, “মানে সাহসটা ঠিক পাই না, তাই...”
“বুঝেছি, এই ব্যাপার,” মৈনাক বলল, “তা, এবার তো এই ভয় কাটাতে হবে তার জন্য একে একে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হবে আমরাও এভাবেই তৈরি হয়েছি তাহলে মহিষাসুরমর্দিনী’ দিয়ে শুরু কর
শমী মুখ ব্যাজার করে বলল, “তথাস্তু যা পারিস কর” বলে সে বইটা আরশির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আবার পড়া শুরু করল

সেদিনই মহড়া শুরু হল প্রথমেই অক্ষয় স্যার বললেন, “দাঁড়াও, শুরু করবার আগে তিনজন অধিনায়ক বেছে দিই
মৈনাক সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, “কাকে বাছবেন, স্যার?”
অক্ষয় স্যার একটু ভেবে বললেন, “অধিনায়ক হবে শমী দেবনাথ, আরশি মিশ্র আর মৈনাক সোরেন কারণ তারা এই দলে সবচেয়ে বড়ো
আরশি আনন্দে লাফিয়ে উঠল মৈনাকের মুখে হাসি কিন্তু শমী ভয়ে সিঁটিয়ে গেল কোনোরকমে মিনমিন করে বলল, “স্যার, আমি আমি পারব না মানে, আমি তো কখনও...”
“তোমার ওপর আমার আস্থা আছে, শমী,” স্যার হেসে বললেন, “তাছাড়া মৈনাক আর আরশিও তো তোমার সঙ্গে আছে, তারাই তোমাকে সাহায্য করবে ভয় নেই
আরশি একবার মাথা নাড়ল তাতে শমীর মনে কিছুটা ভয় উবে গেল

এর পরের সপ্তাহগুলো যে কীভাবে কেটে গেল, তা বোঝাই গেল না সকালবেলা ক্লাসে পড়াশোনা, বেলার দিকে স্কুলের সভাঘর সাজানোর ধুম আর দুপুরবেলা মহড়া দিনগুলো যেন শরতের তুলোর মেঘের মতো ভেসে চলে গেল শমী, আরশি আর মৈনাক তাদের দলকে খুব ভালোভাবে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে বার বার করে অভ্যাস করায় ফাঁক পেলে তিনজনে বসে গানগুলোর বিষয়ে আলোচনা করে
একদিন এরকম আলোচনার শেষে শমী জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী মনে হয়? কেমন কাজ করছি আমি?”
প্রশ্ন শুনে আরশি আর মৈনাক দুজনেই হেসে ফেলেছিল
আরশি জিজ্ঞাসা করেছিল, “তোর কী মনে হয়?”
শমী এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল, “আমি কী করে বলব? তোরাই বল
মৈনাক বলেছিল, “সত্যি কথা বলতে গেলে, আমরা যা ভেবেছিলাম, তা হয়নি
“তবে কী?” শমী প্রশ্ন করেছিল, “আরও খারাপ, তাই তো?”
আরশি মাথা নেড়ে বলেছিল, “না, আরও ভালো হচ্ছে
শমী একবার ভ্রূ তুলে তারপর হেসে ফেলেছিল

অবশেষে মহালয়া এল ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতে শুনতে শমী লাল পাড় দেওয়া সাদা শাড়ি পড়ে সেজেগুজে নিল তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনে গানগুলো গেয়ে নিয়ে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ল স্কুলের উদ্দেশে
তখন দশটা বাজে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু হতে আর কিছুক্ষণ বাকি শমীর সেই ভয়টা আবার ফিরে এসেছেওদিকে আরশি আর মৈনাক উত্তেজিতভাবে দলকে সবকিছু বলে দিচ্ছে, আর এদিকে শমী এক কোণে বসে রয়েছে
উপদেশ দেওয়া শেষ করে আরশি শমীর কাছে এসে বলল, “কী রে, কেমন লাগছে?”
শমী কোনোমতে বলল, “জানি না” তারপর ধীরে ধীরে নীচু গলায় বলল, “যদি ভুল হয়ে যায়?”
“কথা দিচ্ছি, ভুল হবে না,” আরশি বলল, “যদি হয়, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই মনে রাখিস, মানুষমাত্রেই ভুল হয়
শমী মুখ খুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মৈনাক ডাকল, “সময় হয়ে গেছে, চলে আয়!”
তখনই শমীর মুখ পুরো সাদা হয়ে গেল, যেন রক্তশূন্য কাঁপতে কাঁপতে সে আরশির পিছন পিছন মঞ্চের দিকে দুরুদুরু বুকে চলল

‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শেষ দলের সকলে আনন্দে নাচানাচি করছে অনুষ্ঠানটি শেষ হবার পরমুহূর্তে সভাঘর হাততালির আওয়াজে ফেটে পড়েছিল মঞ্চ থেকে নামতে নামতে সকলে শমী দেবনাথ, মৈনাক সোরেন ও আরশি মিশ্রকে শত শত অভিবাদন জানিয়েছিল অক্ষয় স্যার আনন্দে উত্তেজনায় তাদের কাছে গিয়ে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন
তখনও অনুষ্ঠান চলছে শমী, মৈনাক আর আরশি নিজেদের ক্লাসে বসে আছে
“কী বলেছিলাম তাহলে?” মৈনাক বলল
আরশি বলল, “সত্যি বলতে গেলে তোর গলাটাই সবচেয়ে ভালো লাগছিল
শমী ফিক্ করে হেসে বলল, “যাহ্, বাজে বকিসনি
“দেখ, এখন মানতে চায় না,” আরশি মাথা নেড়ে বলল, “তোর মতো আজব লোক আমি কখনও দেখিনি!”
কিছুক্ষণ শমী চুপ করে থেকে বলল, “বড়োদিনের অনুষ্ঠানে সুযোগ পাব তো?”
আরশি আর মৈনাক হেসে ফেলল, “ওরে বাবা, আমাদের সেই লাজুক শমী গেল কোথায়?”
“কথার উত্তর দে না,” শমী খ্যাঁক করে উঠল
“পাবি, কোনো চিন্তা নেই,” মৈনাক বলল, “তা, সাহস এসে গেছে তো?”
“কোনো চিন্তা নেই, এসে গেছে,” শমী হেসে বলল
আরশি বলল, “বলেছিলাম না?”
তিনজনেই হেসে ফেলল আর দূর থেকে শোনা গেল
“রূপং দেহি, জয়ং দেহি
যশো দেহি, দ্বিষো জহি।।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment