বায়োস্কোপ:: ফিরে এলো ডাইনোসর - সুগত ব্যানার্জি


ফিরে এলো ডাইনোসর
সুগত ব্যানার্জি

এ বছর জুলাই মাসে মুক্তি পেয়েছে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড: রিবার্থ নামে একটি ইংরেজি ছবিএই ছবিটি ডাইনোসর-ভিত্তিক জুরাসিক সিরিজের সপ্তম সিনেমা। আজকাল আমরা আর পর্দায় ডাইনোসরদের দাপাদাপি দেখে অবাক হই না, কিন্তু আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে যখন এই সিরিজের প্রথম ছবি জুরাসিক পার্ক তৈরি হয়েছিল, তখন ব্যাপারটা এরকম ছিল না। কীভাবে তৈরি হয়েছিল সেই ছবি? অন্তত সাড়ে ছকোটি বছর আগে বিলুপ্ত সেই প্রাণীগুলিকে কীভাবে আবার ফিরিয়ে আনা হল সিনেমার পর্দায়? আজ সেই গল্পই বলব তোমাদের।
অবশ্য এ গল্পটা বলতে গেলে আমাদের ১৯৯৩-এর থেকে আরও অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে, ১৯৩৩ সালে। সে বছর মেরিয়ান কুপার ও আর্নেস্ট শুডস্যাকের নির্দেশনায় মুক্তি পায় সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাডভেঞ্চার আর ভয়ের ছবি কিং কংএক অজানা দ্বীপ থেকে একটা ৫০ ফুট লম্বা অতিকায় গোরিলাকে নিউ ইয়র্ক শহরে নিয়ে আসার গল্পটা আজ অনেকেরই জানা, কারণ এই ছবির অন্তত দুটো রিমেক হয়েছে, আর অনেকগুলো সিক্যুয়েলওকিন্তু ১৯৩৩ সালে এই দৈত্যাকার প্রাণীটিকে পর্দায় দেখানো মোটেই সহজ ছিল না। সে সময়ের স্পেশ্যাল এফেক্টস-এর জাদুকর উইলিস হ্যারল্ড ওব্রায়েন স্টপ-মোশন বলে এক পদ্ধতিতে এই ছবির শুটিং করেন। পর্দায় অতিকায় কং-কে দেখানোর জন্য ছোটো মাপের একটি কং মডেল বা পুতুল ব্যবহার করা হয়, আর তার হাতে নায়িকা ফে রে-র বদলে রাখা হয় আরও ছোট্ট একটি পুতুল। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, গাছপালা, নিউ ইয়র্ক শহর - সব কিছুরই ছোটো ছোটো মডেল বানানো হয়। সিনেমার ফিল্মে প্রতিটি ছবি তুলে এই পুতুলগুলোকে একটু নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেওয়া হতপরে সেই ফিল্মটাকে দ্রুত চালালে মনে হত পুতুলগুলো নড়ছে। যেহেতু সিনেমায় প্রতি সেকেন্ডে ২৪-টা ছবি দেখাতে হয়, তাই এই পদ্ধতিতে সিনেমা বানাতে অনেক সময় লাগত। এত ছোটো মডেলে সবরকম ডিটেল ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় বলে একটা আসল কং-এর মাপের হাত আর মাথাও বানানো হয়েছিল। মাথাটার ভেতর কলকবজা ছিল, যা দিয়ে মুখে নানারকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা যেত, আর হাতটাকেও কলকবজা দিয়ে নাড়ানো যেত। হাতটার মধ্যে স্বয়ং নায়িকা ফে রে শুয়ে বসে অভিনয় করতেন। তারপর ক্যামেরার কারসাজি আর এডিটিং-এর কেরামতি দিয়ে ফিল্ম কেটে-জুড়ে এমনভাবে সিনেমা বানানো হয়, যে কেউ আর ধরতেই পারত না যে এর মধ্যে মস্ত একটা ফাঁকি আছে

কিং কং ছবির একটি দৃশ্য (১৯৩৩)

তারপর প্রায় ৬০ বছর কেটে গেলেও, মোটামুটি এইভাবেই পর্দায় অতিকায় জন্তুজানোয়ার দেখানো হত। অবশ্য এত বছরে মডেল তৈরি, রোবট তৈরি আর ক্যামেরার ডিজাইনে অনেক উন্নতি হয়েছে। ছবি রঙিন হয়েছে, পশুপাখিদের নড়াচড়া এখন অনেক সাবলীল হয় দর্শকেরাও এখন অনেক চালাক হয়ে গেছে, ১৯৩৩ সালের কিং কং দেখলে হয়তো তাদের হাসিই পাবে। এই সময়ে পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ মাইকেল ক্রিকটনের জুরাসিক পার্ক উপন্যাসটা পড়ে ঠিক করেন এই ছবিটা তিনি করতে চান। এর আগে এক অতিকায় হাঙরের গল্প নিয়ে জ্যস আর এক বুদ্ধিমান ভিনগ্রহের প্রাণীকে নিয়ে ই টি: দি এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়ালছবি দুটি বানিয়ে স্পিলবার্গ প্রচুর নাম করেছেন। এই দুটি ছবির ক্ষেত্রেই যন্ত্রচালিত মডেল, বা অ্যানিমেট্রনিক্স নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তিনি ঠিক করলেন জুরাসিক পার্ক সিনেমাটা তিনি করবেন খানিকটা অ্যানিমেট্রনিক্স দিয়ে, আর বাকিটা স্টপ-মোশনের আধুনিক রূপ গো-মোশন দিয়ে। কিন্তু ছবি বানাতে গিয়ে দেখা গেল এতে বেশ কিছু অসুবিধে আছে
প্রথমত, স্টপ-মোশন বা গো-মোশন দিয়ে সব রকম দৃশ্য দেখানো যায় না। সিনেমায় একপাল ডাইনোসরের হুড়মুড় করে ছুটে পালানোর দৃশ্যটা এভাবে তোলা প্রায় অসম্ভব দ্বিতীয়ত, গো-মোশন ছোটো ছোটো মডেলের ওপর করা হয়ে থাকে, কিন্তু ছোটো ছোটো মডেলে বৃষ্টির দৃশ্য খুব ভালো তোলা যায় না, কারণ জলের ফোঁটা খুব ছোটো করা যায় না। আর এই ছবির প্রধান দৃশ্যটাই ঘটছে বৃষ্টির মধ্যে, তাই বড়ো মাপের অ্যানিমেট্রনিক্স রোবট লাগবেঅথচ, অ্যানিমেট্রনিক্স রোবোটগুলোর সম্পূর্ণ শরীরটা থাকে না, কারণ তার একটা দিক তার দিয়ে কম্পিউটারের সঙ্গে জোড়া থাকেতাই সেগুলো দিয়ে সম্পূর্ণ দৃশ্য তোলা সম্ভব নয়, শুধু শরীরের খানিকটা অংশের নড়াচড়াই দেখানো সম্ভব। তাছাড়া, পুতুলের নড়াচড়া কখনোই ঠিক আসল প্রাণীর মতন হয় না, কারণ আসল প্রাণীটা যখন ঘাড় ঘোরায়, তখন তার শরীরে চামড়া, মাংসপেশী আর হাড় মিলিয়ে একটা ঢেউ খেলে যাওয়ার ব্যাপার থাকে যেটা পুতুল বা মডেলের ক্ষেত্রে হয় না। পুতুল বা মডেল ঘাড় ঘোরালে শুধু ঘাড়টাই ঘোরে। তাই স্পিলবার্গ খোঁজ নিতে লাগলেন আর কীভাবে সিনেমাটা তোলা যায়
এর কিছুদিন আগেই টার্মিনেটর টু: জাজমেন্ট ডে নামে একটা ছবি হলিউডে আলোড়ন তুলেছিল। এই ছবিতে একটা রোবট চরিত্র আছে যাকে দেখতে একটা তরল ধাতুর তৈরি মানুষের মতন। এই চরিত্রটিকে তৈরি করতে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি (সি জি আই) নামে একটা নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। ঠিক কী জিনিস এই সি জি আই? খুব সহজ করে বলতে গেলে বলা যায়, অ্যানিমেশন বা কার্টুন সিনেমা বানানোর জন্য শিল্পীরা পর পর ফ্রেমের ছবি আঁকেন, আর প্রতিটি ছবি আগের ছবিটার থেকে সামান্য একটু পালটে আঁকা হয়। পর্দায় পর পর এই ফ্রেমগুলো দেখালে মনে হয় ছবির চরিত্রগুলো নড়াচড়া করছে। সি জি আই-তেও ঠিক এইটাই করা হয়, কিন্তু ছবিগুলো আঁকে কম্পিউটার, নড়াচড়াও করায় কম্পিউটার, আর গোটা ব্যাপারটা হয় ত্রিমাত্রিক বা থ্রি-ডি। কম্পিউটারে করার ফলে ছবি আর নড়াচড়া দুইই হাতে আঁকার থেকে অনেক বেশি বাস্তব করে করা যায়। পরে সে ছবিটা ফিল্মে তোলা দৃশ্যের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়। টার্মিনেটর টু-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু সহজ ছিল, কারণ রোবট চরিত্রটাকে প্রাকৃতিক কোনো কিছুর মতন দেখতে নয়। কিন্তু জুরাসিক পার্কের ক্ষেত্রে কি এই পদ্ধতিতে এমন ডাইনোসর তৈরি করা সম্ভব, যেগুলোকে দেখে ঠিক আসল জানোয়ার মনে হবে?
সে যুগে সি জি আই খুব একটা উন্নত ছিল না, কারণ মাত্র একটা-দুটো সিনেমায় তা ব্যবহার হয়েছে। তাই স্পিলবার্গ জানতেন, খুব বেশি দৃশ্য কম্পিউটারে এঁকে করলে তা ঠিক দর্শকদের চোখে ধরা পড়ে যাবে। আর সব কিছু তো কম্পিউটারে আঁকা সম্ভব নয়, কারণ মানুষ অভিনেতারা যেখানে ডাইনোসরদের স্পর্শ করবেন সেখানে একটা আসল কিছু দরকার। তাই স্পিলবার্গ খোঁজ করতে লাগলেন কীভাবে কম্পিউটার গ্রাফিক্স আর অ্যানিমেট্রনিক্স মেশানো যায়। এর ফলে যে টিম তৈরি হল, তাতে সে সময়কার স্পেশ্যাল এফেক্টস-এর  তিনজন বড়ো বড়ো মানুষ একসঙ্গে কাজ করলেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট এন্ড ম্যাজিক কোম্পানির প্রধান স্পেশ্যাল এফেক্ট বিশেষজ্ঞ ডেভিড মুরেন রইলেন সি জি আই ডাইনোসর তৈরির জন্য। অ্যানিমেট্রনিক্স বিশেষজ্ঞ স্ট্যান উইনস্টন রইলেন প্রমাণ মাপের ডাইনোসর রোবট বানাবার দায়িত্বে। ছবিতে গো মোশন ব্যবহার না করা হলেও গো মোশন বিশেষজ্ঞ ফিল টিপেট রইলেন, তাঁর অ্যানিমেশন তোলার বিপুল অভিজ্ঞতা দিয়ে সিনেমা তোলার কাজে সাহায্য করতে। এ ছাড়াও মাইকেল ল্যান্টিয়েরি রইলেন অন্যান্য স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর জন্য, কারণ ডাইনোসর ছাড়াও তো অনেক কিছু আছে ছবিটায়

স্ট্যান উইনস্টনের তৈরি টি-রেক্স অ্যানিমেট্রনিক্স

চারজন মানে অবশ্য শুধু চারজন মানুষ নয়, চারটে টিম। কত অসংখ্য মানুষ যে এতে জড়িত ছিলেন সে আর কী বলব। স্ট্যান উইনস্টনের অ্যানিমেট্রনিক্স মডেলের কথাই ধরা যাক। এঁদের তৈরি সব মডেলের মধ্যে সবথেকে বড়ো ছিল টিরানোসরাস রেক্স বা টি-রেক্স মডেলটি। চার টনেরও বেশি ওজনের এই মডেলটি কুড়ি ফুট উঁচু আর নাক থেকে লেজ অবধি চল্লিশ ফুট লম্বা। এক দল মানুষের কাজ ছিল এর ভিতরের কলকবজা-ওলা কাঠামোটা বানানো, আর এক দল মানুষ ছিলেন ফোম আর রাবার দিয়ে এর গায়ের চামড়া বানানোর জন্য। ডাইনোসর বিশেষজ্ঞ জ্যাক হর্নার ছিলেন পরামর্শদাতা হিসেবে। এই ডাইনোসরগুলোর আবার আরেকটু ছোটো ছোটো কিন্তু নিখুঁত মডেলও বানানো হয়েছিল। সেগুলোকে লেজার দিয়ে স্ক্যান করে তাদের ছবিগুলো কম্পিটারের সি জি আই মডেলের গায়ে লাগানো হয়। তার আগে অবধি সি জি আই মডেলগুলো তারের জালের খাঁচার মতন দেখতে লাগে। কিন্তু স্ক্যান করা মডেলের চামড়া পরানোর পর পর্দার ডাইনোসরগুলোকে ঠিক আসল মনে হতে থাকে।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট এন্ড ম্যাজিক-এর তৈরি টি-রেক্সের সি জি আই মডেল

তারপর আসে এডিটিং-এর ভেলকিযখন এই টি-রেক্স হাত দিয়ে লোহার তারের বেড়া ভেঙে দেয়, তখন আমরা দেখি অ্যানিমেট্রনিক্স মডেলটার হাত আর মাথা। তারপর একটা রক্ত জল করা হুঙ্কার দিয়ে রাস্তায় পা রাখে যে টি-রেক্স, সেটি সি জি আই। এর পর গোটা দৃশ্যে যখনই আমরা শুধু টি-রেক্সের হাত আর মাথা দেখি, সেগুলো আসল মডেল দিয়ে করা, আর যখনই আমরা গোটা জানোয়ারটাকে পর্দায় দেখি সেটা সি জি আই। কিন্তু এডিটিং-এর গুণে, এমনটা কখনওই মনে হয় না যে আমরা দুটো আলাদা আলাদা জিনিস দেখছি। এই দৃশ্যের একটা মজার ঘটনা বলি। যারা ছবিটা দেখেছ তারা জানো, এই দৃশ্যে টি-রেক্স একটা গাড়িকে আক্রমণ করবে, আর সেই গাড়ির মধ্যে সেই সময়ে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে থাকবেটি-রেক্স মাথা দিয়ে গাড়ির কাচের ছাদটা খসিয়ে দেবে, আর বাচ্চা দুটো ভেতরে প্রচণ্ড ভয়ে আর্তনাদ করতে থাকবে। এই দৃশ্যের শুটিং করার সময়ে, অ্যানিমেট্রনিক্স মডেলের ফোমের চামড়া নকল বৃষ্টির জল শুষে এমন ভারী হয়ে গিয়েছিল যে অপারেটর সেটাকে ঠিক করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। মাথাটা গাড়ির ছাদের কাচে এত জোরে আঘাত করে যে কাচটা খসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-টুকরো হয়ে ভেঙেও যায়। শিশুশিল্পী আরিয়ানা রিচার্ডস আর জোসেফ মাজেলো এতে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে আর্তনাদ করেছিল, তাই দৃশ্যটা বহুগুণ বেশি ভালো হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য টি-রেক্স মডেলের একটা দাঁতও এই সময় ভেঙে যায়, আর সে বেচারাকে ফোকলা দাঁত নিয়েই বাকি ছবিটায় অভিনয় করতে হয়।
এ তো গেল শুধু একটা দৃশ্যের কথা। জুরাসিক পার্কে আরও অনেকগুলো দৃশ্য আছে যেগুলোতে কম বেশি ডাইনোসর দেখানো হয়েছে। শুরুর দিকে বিশাল তৃণভোজী ব্র্যাকিওসরাস থেকে শুরু করে শেষের দিকে সবথেকে ভয়ঙ্কর ভেলসিরেপ্টরদের সঙ্গে মোকাবিলা, সব দৃশ্যই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি। কোনো কোনো দৃশ্যে ভেলসিরেপ্টরদের অভিনয় ডাইনোসরের পোশাক পরা মানুষরাও করেছেনসি জি আই বললে যেন ভেবো না কম্পিউটারে করা বলে সেই দৃশ্যগুলো বানানো সহজ ছিল। ডাইনোসরদের নড়াচড়া, হাঁটাচলা কেমন হবে সেটা বুঝতে অ্যানিমেশন শিল্পীরা চিড়িয়াখানায় হাতি, গন্ডার, জিরাফ আর কুমিরের হাঁটাচলা দেখতে যেতেন। সে সময়কার কম্পিউটার এখনকার মতন এত শক্তিশালী হত না, তাই জুরাসিক পার্ক ছবির এক একটা ফ্রেম আঁকতে কম্পিটারের ছয় থেকে বারো ঘণ্টা সময় লাগত। এক সেকেন্ডের সিনেমায় এরকম চব্বিশটা ফ্রেম থাকে। তাই এই ছবির কাজ চলেছিল সাধারণ ছবির দ্বিগুণ সময় ধরে। আর যদি দৃশ্যে মানুষ অভিনেতারাও থাকে তাহলে তো কথাই নেই, তাদের অংশটা আবার আলাদা করে শুটিং করে সি জি আই ছবির সঙ্গে জুড়তে হবে। এই ছবির অভিনেতাদের কাজটাও বড়ো সহজ ছিল না। কাউকে হয়তো ডাইনোসর দেখে ভয় বা অবাক হওয়ার অভিনয় করতে হবে, কিন্তু তার সামনে তখন কিছুই নেই, ডাইনোসরের ছবিটা পরে যোগ করা হবে। এঁদের প্রত্যেকের অভিনয় নিখুঁত হওয়ার ফলেই ডাইনোসররা পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর এর সঙ্গে অবশ্যই ছিল ডাইনোসরের ডাক। সাউন্ড ডিজাইনার গ্যারি রিডস্ট্রম হাড় হিম করা ডাইনোসরের ডাক তৈরি করেছিলেন হাতি, কচ্ছপ, তিমি মাছ, ডলফিন, সিন্ধুঘোটক, গাধা, রাজহাঁস, পেঙ্গুইন ইত্যাদি অনেকরকম প্রাণীর ডাক মিলিয়েমিশিয়ে। আর স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালনার এমনই গুণ যে দর্শকরা উত্তেজনায় খেয়ালই করেন না দু-ঘণ্টার সিনেমায় মাত্র পনেরো মিনিট ডাইনোসরদের দেখা পাওয়া যায়। এই পনেরো মিনিটের মধ্যে আবার নয় মিনিট অ্যানিমেট্রনিক্স আর ছয় মিনিট সি জি আই-এর কাজ। এই ছবিটা সে বছর সাউন্ড আর ছবির স্পেশ্যাল এফেক্টস দুইয়ের জন্যই অস্কার পুরস্কার পায়।

সিনেমার পর্দায় সি জি আই টি-রেক্স

জুরাসিক পার্ক ছবিটা ভারতে মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৪ সালে। সেই প্রথম একটা হলিউডের ছবিকে হিন্দিতে ডাব করা হয়, যা পরে আরও অনেক ছবির ক্ষেত্রে করা হয়েছিল, এখনও করা হয়সারা পৃথিবীতে জুরাসিক পার্ক স্পিলবার্গেরই আরেকটি ছোটোদের ছবি ই টি: দি এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল-এর রেকর্ড ভেঙে সর্বাধিক ব্যাবসা করে। স্পিলবার্গের ছবির বার বার এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ, স্পিলবার্গ ছোটোদের ছবি বলে কোনোদিন এই ছবিগুলিকে অবজ্ঞা করেননি, এতটাই যত্ন নিয়ে বানিয়েছেন যে এসব ছবি বড়োদেরও সমান ভালো লাগবে। এর তিন বছর পর ১৯৯৭ সালে স্পিলবার্গ দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড: জুরাসিক পার্ক নামে এই ছবির একটি সিক্যুয়েল বানান। তার পরে এক এক করে আরও পাঁচটি ছবি বেরিয়েছে এই সিরিজে, যদিও তার কোনোটাই আর স্পিলবার্গ পরিচালনা করেননি। জুরাসিক পার্ক তারপরে আরও কয়েকবার সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৩ সালে কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া থ্রি-ডি বা ত্রিমাত্রিক সংস্করণপ্রতিবারই নানান বয়েসের দর্শকরা ভালোবেসে ছবিটা দেখতে গেছেন।
জুরাসিক পার্কের সিক্যুয়েল ছাড়াও সি জি আই জন্তু-জানোয়ার নিয়ে অনেক ছবিই হয়েছে তার পর থেকে – ১৯৯৮-এর গডজিলা আর ২০০৫ সালের কিং কং’-এর রিমেক তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আজকাল উন্নত প্রযুক্তি এসে যাওয়ার ফলে আর অ্যানিমেট্রনিক্স মডেলেরও দরকার হয় না, সবটাই কম্পিউটারে বানানো যায়। আজকের যুগের সি জি আই নিঃসন্দেহে সেই যুগের সি জি আই-এর থেকে অনেক বেশি নিখুঁত – গত কয়েক বছরে তৈরি জাঙ্গল বুক আর লায়ন কিং ছবি দুটিই তার প্রমাণকিন্তু সেই নব্বইয়ের দশকের প্রযুক্তি দিয়ে স্পিলবার্গ প্রথম জুরাসিক পার্কে জ্যান্ত ডাইনোসরদের সিনেমার পর্দায় ফিরিয়ে এনে ছোটো-বড়ো সব্বাইকে যেমন একটা চমক দিয়েছিলেন, তেমন চমক আর কেউ কোনোদিন দিতে পারবে কিনা সন্দেহ।
----------
ছবি - লেখক

2 comments:

  1. বাহ্, কিছু জানতাম, কিছু জানলাম। পড়ে ভালো লাগলো। সাবলিল গদ্য।

    ReplyDelete
  2. অনবদ্য লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম দুবার। এত কিছুর খবর সত্যিই জানতাম না।

    ReplyDelete