গল্প:: প্রতিদ্বন্দ্বী - রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস


প্রতিদ্বন্দ্বী
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস

“কী হল? রিমলি আজ এত গম্ভীর কেন? মুখটা কেমন থমথমে লাগছে যেন!”
বুটুদাদুর কথা শুনে তুতুন কিছু একটা বলতে যেতেই রিমলি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুই কিন্তু আমাকে প্রমিস করেছিলি, তুতুন! তুই কাউকে বলবি না!”
বুটুদাদু বলল, “তাহলে তুমি কিছু বোলো না, তুতুন। প্রমিস ব্রেক করতে নেই।”
গোগোল বলল, “তুতুন কাউকে না বললেও কেউ জানতে পারবে না নাকি? যা ঘটেছে, তা তো সকলের সামনেই ঘটেছে। বুটুদাদুই যা শুধু জানে না।”
টুকাই বলল, “একদম ঠিক বলেছিস, গোগোল। জানো বুটুদাদু, আজ রিমলি স্কুল স্পোর্টসে না...”
বুটুদাদু টুকাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা চুপ করো সবাই। আমাকে যা বলবার, রিমলি নিজেই বলবে। কী রিমলি, তাই তো?”
মাথা নীচু করে বসে রইল রিমলি। চোখভরা জল। যেন একটা টোকা দিলেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রিমলি বলল, “আমার বলতে খুব লজ্জা করছে, বুটুদাদু।”
গম্ভীর হয়ে গেল বুটুদাদু। তারপর বলল, “এমন কাজ কেন করো যা বলতে লজ্জা করে!”
টোকা দিতে হল না। রিমলির গাল বেয়ে নিজে থেকেই গড়িয়ে পড়ল চোখের জল। দু-হাতে চোখটা রগড়ে নিল সে।
বুটুদাদু বলল, “তুমি কাঁদছ, লজ্জা পাচ্ছ - তার মানে তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছ। তাই মনখারাপ না করে নিজের ভুলটা শুধরে নিতে হবে সবার আগে।”
রিমলি বলল, “আসলে কী জানো তো বুটুদাদু, আমি শুধু বুবলিকে হারাতে চেয়েছিলাম। যেভাবেই হোক। ও ছিল আমার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ইচ্ছে করে আমি ওর পা মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যাতে ও জোরে ছুটতে না পারে। আমি সবাইকে হারাতে পারি রানে, কিন্তু বুবলিকে পারি না। এবার আমি ফার্স্ট হতে চেয়েছিলাম। বুবলি পড়াশোনায়ও ফার্স্ট হবে, আবার রানেও ফার্স্ট হবে - কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই...”
ঝিকাই রিমলিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানো বুটুদাদু, বুবলি ম্যামকে নালিশ করে দিলে রিমলি বাদ হয়ে গেছিল স্পোর্টস থেকে। কী লাভ হল তোর রিমলি এমনটা করে! মাঝখান থেকে তোরা দুজনের কেউই খেলতে পারলি না। তিতির ফার্স্ট হয়ে গেল…”
বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকল বুটুদাদু। তারপর বলল, “আচ্ছা বেশ। যা হয়েছে তা তো আর বদলানো যাবে নাকিন্তু বদলানো যাবে নিজেকে। যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না হয়। মনখারাপ কোরো না। বরং একটা গল্প বলি, শোনো।”

রিমলি, গোগোল, ঝিকাই, টুকাই, নিন্নি, তুতুন রোজ স্কুল থেকে ফিরে বুটুদাদুর কাছে অঙ্ক করতে যায়। অঙ্ক শেষে বুটুদাদু রোজ একটা করে গল্প বলে। ভূত-পেতনি, শাঁখচুন্নি, ব্রহ্মদত্যি, এলিয়েন, রূপকথা, পশুপাখি -  এক-এক দিন এক-এক রকম গল্প। আজ রিমলির মনখারাপ থাকায় আগে গল্প, পরে অঙ্ক -  এমনটাই বলল বুটুদাদু। গল্পের কথা শুনে সবাই বুটুদাদুকে গোল হয়ে ঘিরে বসল। বুটুদাদু শুরু করল তার গল্প।

সবুজ ঘন বনের গাছের ডালে থাকত টুপাই নামে ছোট্ট একটা পাখি। সে ঠিকমতো উড়তে পারত না। একটু উড়েই ক্লান্ত হয়ে যেত। গাছের ডালে বসে সে শুধুই হা-হুতাশ করত। আর বন্ধুদের ওড়া দেখত। তারই বন্ধু মুক্তা, নীল, চিকু কিন্তু দারুণভাবে উড়তে পারত। কেউ উড়তে উড়তে ডানদিকে ঘুরতে চেষ্টা করত, কেউ বাঁদিকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করত, কেউ আবার নেচে নেচে মেঘের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করত। গাছের ডালে বসে টুপাই শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলত আর বলত, “ইশ্‌! আমি যদি ওদের মতো একটু হতে পারতাম! যদি ওদের মতো একটু উড়তে পারতাম! আমি কিছুই পারি না! কেন আমি এমন?”
পাশের গাছে এক বৃদ্ধ পাখি বসে রোজ ওর হা-হুতাশ শুনত। একদিন বৃদ্ধ পাখি বলল, “এত হা-হুতাশ কীসের তোর? তুই কি উড়তে পারিস না? তুইও তো উড়তে পারিস!”
টুপাই একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “উড়তে পারি। কিন্তু আমার বন্ধুদের মতো পারি না। আমার ডানাগুলো যেন কেমন কাগজের মতোখুব মনখারাপ হয় তাই আমার। একটুও ভালো লাগে না।”
বৃদ্ধ পাখি বলল, “যতদিন তুই অন্যদের মতো হতে চাইবি, ততদিন তুই কিছুতেই ভালো থাকতে পারবি না। ভালো করে ভেবে দেখ তো টুপাই, তুই কি ওদের মতো উড়তে চাস?”
টুপাই বলল, “আমি ওদের থেকেও ভালো উড়তে চাই।”
বৃদ্ধ পাখি বলল, “তুই ভালো উড়তে চাস - এইটুকুই যথেষ্ট। অন্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করিস না। বরং নিজের সঙ্গে নিজের তুলনা কর। আর নিজের সেরা রূপটা পাওয়ার চেষ্টা কর।”
ছোট্ট টুপাই বৃদ্ধ পাখির কথা কিছুই প্রায় বুঝতে পারল না। বলল, “নিজের সঙ্গে নিজের তুলনা! সেটা আবার কেমন?”
বৃদ্ধ পাখি বলল, “প্রত্যেকদিন একটু-একটু করে তুই আরও জোরে আরও ওপরে ওড়ার চেষ্টা কর। আজ যতটা পারলি, চেষ্টা করে দেখ কাল তার থেকেও বেশি পারিস কিনা। যদি পারিস, তবে সেটাই তোর জিত
টুপাই সেই মতো রোজ ওড়ার গতিবেগ বাড়াতে থাকল। সাহস বাড়াতে থাকল। প্রথম দিন মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সে ভেসে রইল আকাশে। দ্বিতীয় দিন দশ সেকেন্ড। তারপর ছোটো ডাল থেকে একটু ঝাঁপ দিয়ে আবার ওপরে ওঠা। এমনি করে চেষ্টা করতে করতে ধীরে ধীরে তার ডানাগুলো শক্ত হল। সাহসও বেড়ে গেল। ওপরে, আরও অনেক ওপরে সে এলোমেলো নিজের খুশিমতো উড়তে শিখল। বন্ধুদের সঙ্গে আর সে নিজের তুলনা করল না। একদিন সে দেখল, সে তার বন্ধুদের থেকেও আরও অনেক ভালো উড়তে শিখেছে। আরও অনেক বেশি সাহসী হয়েছে।

বেশ কিছুদিন পর। একদিন গভীর জঙ্গলে ঝড় উঠল। সব পাখিরা যে যার বাসায় ফিরে এল। কিন্তু চিকু বাসায় ফিরল না। সব পাখিরা চিন্তিত। কোথায় গেল চিকু! সে কি অনেক দূরে উড়তে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলল? চিন্তা সবাই করল বটে, কিন্তু সাহস করে কেউ ঝড়ের মাথায় চিকুকে খুঁজতে বেরোল না। টুপাই জানে, চিকু আকাশে উড়তে উড়তে অনেক দূর উড়ে যায়। কিছুই খেয়াল থাকে না। এটাই তার স্বভাব। তার মানে অনেক দূরের কোনো রাস্তায় ঝড়-জলে সে আটকে পড়েছে নিশ্চয়ই। সবাই যখন ভয়ে জড়োসড়ো, টুপাই তখন সাহস আনল মনে। সে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল দূর আকাশে। তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রবল বেগে হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়ায় গাছেরা এদিক-ওদিক আছড়ে পড়ছে কেউ কেউ এর-ওর ঘাড়ে। সব পাখিরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ভাবছে, চিকুর সঙ্গে টুপাইও বুঝি হারিয়ে গেল। এদিকে টুপাই এগিয়ে চলে নিজের সাহসের বলে। বন্ধুত্বের টানে। চিৎকার করে ডাকতে থাকে, চিকু, বন্ধু আমার! কোথায় তুই?”
কোনো সাড়া পায় না। ধীরে ধীরে কমে আসে হাওয়ার বেগ। থেমে যায় ঝড়-বৃষ্টি। মনখারাপ হয়ে যায় টুপাই-এর। কোথায় গেল চিকু? অবশেষে সে শুনতে পায় একটা কান্নার আওয়াজ। এ কী? এ তো চিকুর গলা মনে হচ্ছে! উড়তে উড়তে থেমে যায় টুপাই। একটা গাছের ডালে বসে বোঝার চেষ্টা করে কান্নার শব্দ কোত্থেকে আসছে। তারপর আবার চিৎকার করে ডাকে, “চিকু... কোথায় তুই?”
টুপাই-এর গলা শুনে চিকু মনে সাহস পায়। আশ্বস্ত হয়ে বলে, “আমি এখানে। জলে ভিজে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর বাসায় ফেরার শক্তি নেই আমার।”
টুপাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, তার পাশের গাছের ছোটো একটা ডালে বসে চিকু ঠান্ডায় কাঁপছে। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ডানা ঝাপটিয়ে চিকুর কাছে উড়ে গেল টুপাই। আনন্দে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। টুপাই চিকুকে জিজ্ঞেস করল, “তুই এখানে এত দূরে কী করছিস? নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়ে গেছিস!”
চিকু বলল, “ঝড়ের দাপটে পাশের ওই ছোটো খালে পড়ে গেছিলাম আমি। কোনোরকমে উঠে বসেছি এই গাছের ডালে। কিন্তু বাসায় ফেরার শক্তি যেন আর কিছুতেই পাচ্ছি না।”
টুপাই বলল, “ভাবিস না। আমি এসে গেছি। আমি তোকে আমার পিঠে বসিয়ে বাসায় নিয়ে যাব। কেমন?”
ছোট্ট চিকু আবার জড়িয়ে ধরল টুপাইকে।

এদিকে ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। তবুও টুপাই আর চিকু ফিরছে না। সব পাখিরা যখন আশাহত, তখন টুপাই চিকুকে তার পিঠে বসিয়ে নিয়ে ফিরে এল নিরাপদ আশ্রয়ে। সব পাখিরা এগিয়ে গেল ওদের দিকে। তারপর বলল, “আমাদের সবার সেরা টুপাই। সবচেয়ে সাহসী।”
বৃদ্ধ পাখি টুপাইকে দেখে মুচকি হাসল শুধু। টুপাই চিকুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বৃদ্ধ পাখির কাছে গিয়ে বলল, আমি আমার আগের আমিকে হারিয়ে এমনভাবে যে জিততে পারব, সত্যি ভাবিনি। কী যে ভালো লাগছে আজ!”
বৃদ্ধ পাখি মুচকি হেসে বলল, নিজের কাছে নিজে জিতে যাওয়াটাই তো সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার।”

গল্প শেষ করে বুটুদাদু বলল, “আসলে কী জানো তো, অন্যদের মতো না হয়ে নিজের চেয়ে ভালো হওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো উড়ান। সাহস, ধৈর্য আর চেষ্টায় আমরা প্রতিদিন নিজেদের জয় করতে পারি। আর সেই জয়ই আমাদের সেরা হবার পথে এগিয়ে দেয়।”
গোগোল বলল, কী সুন্দর গল্প, বুটুদাদু!
তুতুন বলল, “বন্ধুর ক্ষতি করে কখনও জেতা যায় না। তাই না, বুটুদাদু? বরং নিজে সেরা হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করা উচিত।”
রিমলি বলল, “আমি আর কোনোদিন কারও ক্ষতি করে ফার্স্ট হবার চেষ্টা করব না। বরং রোজ রান প্র্যাকটিস করব। নিজের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করব। ঠিক টুপাই-এর মতো হব।”
ঝিকাই বলল, “কারোর মতো নয় রে, পাগলি। তুই নিজের মতো হবার চেষ্টা করবি। বুঝলি?”
বুটুদাদু মুচকি হেসে বলল, “আমরা ভুলে যাই, আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী।”
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment