
অন্ডাল দেবী এবং শ্রীরঙ্গনাথজি
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
দক্ষিণ ভারতের মীরা কাকে বলা হয় জানো? যদিও মীরার অনেক
আগেই তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর কথা আলোচনা করতে বসলে মীরাকেই বার বার মনে পড়ে। দেবী
গোধা বা অন্ডাল ছিলেন ভূদেবীর অবতার। মানে মা লক্ষ্মীর অংশ। মীরাবাঈ যেমন শ্রীগিরিধারী
লাল-কে নিজের পতি বলে মনে করতেন, ঠিক
তেমনভাবেই অন্ডাল দেবীও শ্রী রঙ্গনাথ-কে নিজের পতি ভাবে ভজনা
করতেন। দক্ষিণ ভারতের বারো জন আলভার-এর মধ্যে একমাত্র মহিলা
আলভার। তিনি মীরার মতোই পদ রচনা করতেন শ্রীরঙ্গনাথের উদ্দেশে। গান রচনা করতেন, নিজেই সুর দিতেন আবার গাইতেনও।
অন্ডাল দেবীর জন্ম হয় অষ্টম বা সপ্তম শতাব্দীতে
তামিলনাড়ুর শ্রীভিলিপুথুর শহরে। তিনি ছিলেন, রঙ্গনাথজির পরম ভক্ত পুরোহিত পেরিয়ালভারের
বা বিষ্ণুচিত্তের পালিতা কন্যা। পুরোহিত দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। তাঁরা
ঠাকুরের কাছে খুব প্রার্থনা করতেন। রঙ্গনাথজি পুরোহিত দম্পতিকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন
তোমাদের ঘরে ভূদেবীর অবতার আসবেন। তোমরা তাকে লালন পালন কোরো। কিছুদিন পর দেখা গেল
তুলসী বনের মধ্যে এক সদ্যোজাত কন্যা খেলা করছে। আশেপাশে কেউ নেই। পেরিয়ালভার বা
বিষ্ণুচিত্ত সেই শিশুটিকে নিজের ঘরে নিয়ে আসলেন। শিশুর নাম রাখলেন গোধা। গোধা দেবীর
অনেক নাম। গোধা মানে মালা। আরও দুটি নাম হল কোথাই এবং নাচিয়ার। এই শিশুকে রঙ্গনাথজির
কথামতো যত্ন করে বড়ো করতে লাগলেন পুরোহিত দম্পতি।
শিশুটি আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। রঙ্গনাথজি তার খুব
প্রিয়। সময় পেরিয়ে যায়। অন্ডাল বা গোধা দেবী এখন কিশোরী। তিনি রঙ্গনাথজির জন্য
প্রতিদিন ফুল তুলে মালা গাঁথতেন। একদিন কি খেয়াল হল, সেই গাঁথা মালা নিজে গলায় পরে
নিলেন। তারপর আবার খুলে রেখে দিলেন থালায়। মালা প্রতিদিন তাঁর বাবা ঠাকুরের গলায়
পরাতেন। অন্ডাল রোজ রোজ এমন করতে লাগলেন। মালাটা গলায় পরে একটা কূপের জলে নিজের
ছায়া দেখতেন। দেখতেন কেমন লাগছে তাঁকে মালা পরে। একদিন রঙ্গনাথজিরও রঙ্গ করতে
ইচ্ছা হল। তিনি মালায় এক দলা চুল জড়িয়ে রেখে দিলেন। পুরোহিত রঙ্গনাথজির শ্রী
বিগ্রহে মালা পরাতে গিয়ে দেখলেন সেই ফুলের মালায় এক দলা চুল জড়িয়ে! মেয়েদের লম্বা
চুল! দেখে তিনি খুব রেগে গেলেন। এই মালা তো গোধা তৈরি করে, তাহলে
এটা নিশ্চয় ওরই চুল! তিনি প্রথমেই মেয়েকে বকাবকি করলেন না। ঠিক করলেন ব্যাপারটা কী
আগে ভালো করে জানতে হবে। পরের দিন তিনি লুকিয়ে থেকে দেখে নিলেন যে গোধা দেবীই মালা
আগে পরেন, এই দেখে তিনি খুব রেগে গিয়ে মেয়েকে তিরস্কার
করলেন। নিজের ব্যবহার করা কোনো জিনিস তো ঠাকুরকে দিতে নেই। সেবাপরাধ হয়। আমরা
নিজেদের ব্যবহার করা জিনিস ঠাকুরকে দিই না। নতুন জিনিস দিই। তা সে ফুল হোক বা অন্য
কোনো জিনিস হোক। কিন্তু গোধা দেবী বললেন রঙ্গনাথজিই তাঁর পতি। তাই তিনি কোনো ভুল
করেননি। পত্নীর মালা তো পতি পরতেই পারে। পুরোহিত মশাই খুব অবাক হলেন। চিন্তিতও
হলেন। কেউ কেউ তাঁকে বোঝাল বাচ্চা মেয়ে! কী বলতে কী বলেছে! রঙ্গনাথজিকে তো সে
নিজের সখাই মনে করে! ওতে দোষ হয় না! বিষ্ণুচিত্ত এবার গোধা দেবীকে মালা তৈরির দায়িত্ব
থেকে মুক্তি দিলেন। বললেন, তোমাকে আর মালা বানাতে হবে না। কিছুদিন
পরে রঙ্গনাথজিই স্বপ্নে তাঁকে বোঝালেন যে গোধা আসলে লক্ষ্মী বা ভূদেবীর অবতার। তাই
বিষ্ণুচিত্ত যেন মেয়ের ওপর রাগ না করেন। গোধা দেবীর তৈরি করা মালাই তিনি পরবেন।
গোধা দেবী ধরিত্রীতে আসার আগেও তিনি বলেছিলেন যে গোধা আসলে লক্ষ্মী বা ভূদেবীর
অবতার হবেন, কিন্তু বিষ্ণুচিত্তের আর সে সব কথা মনে নেই।
স্বপ্ন ভেবে ভুলে গেছেন।
সুলতানি আমলে শক্তিশালী হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের
রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের নাম আমরা অনেকেই জানি। তিনি এই মালার ঘটনা লিখেছেন তাঁর
আমুক্তমাল্যদা নামক কাব্যগ্রন্থে। গোধা দেবীর ঘটনা নিয়ে অনেক কাব্য রচিত হয়েছে।
অনেক রকম উৎসব পালন করা হয়। এই মালা পরানোর উৎসব তো আছেই। এক সময় গোধা দেবীর বিবাহের
উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বিবাহ করলেন না। তিনি বলে দিলেন ভগবান রঙ্গনাথই তাঁর
পতি, সখা
- জীবনের সব কিছু। অনেক বাধা বিপত্তি এলেও নিজের সিদ্ধান্তে তিনি
অটল থাকলেন। তিনি সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। লেখা নিয়ে গান নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন।
বড়ো বড়ো সভায় অংশ নিতেন। তিনি চেয়েছিলেন, মেয়েরা স্বাধীনভাবে
থাকবে, স্বাধীনভাবে ভাবনাচিন্তা করবে। তাদের ইচ্ছামতন তারা
সৎভাবে জীবন কাটাবে। কিন্তু বড়োই আপশোশের বিষয় তাঁর সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি।
ভগবানের সঙ্গে ভক্ত নানারকম সম্পর্ক তৈরি করেন।
শ্রীরঙ্গনাথজিকে তিনি পতি ভাবে ভজনা করতেন। ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের এমন নিবিড় ভালোবাসার
সম্পর্ক বেশি দেখা যায় না। তিনি শ্রীকৃষ্ণের অষ্ট সখী এবং রাধারানির লীলা চিন্তা
করতেন। শোনা যায় তিনি রাধারানি এবং সখীদের ন্যায় ক্যাতায়ণী ব্রতও করেছিলেন। নিজেকে
তিনি একজন গোপী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন স্বরচিত কাব্যগ্রন্থ তিরুপ্পাভাইতে। আরেকটি
বিখ্যাত রচনা নাচিয়ার তিরুমোই। তিনি ছিলেন নারী স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। দক্ষিণ
ভারতের রক্ষণশীল সমাজের কঠিন শাসনকে তিনি মানতেন না। নিজের ইচ্ছামতন জীবন কাটিয়ে
গেছেন, যা এ যুগেও আমরা পেরে উঠি না। তিনি মনে করতেন, জীবনের
চূড়ান্ত লক্ষ্য ঈশ্বরের চরণে আত্মসমর্পণ। শ্রীরঙ্গনাথের সঙ্গে গোধা দেবী বা অন্ডালের
বিবাহ হয়। তাঁকে বধূবেশে সজ্জিত করে ঠাকুরের সামনে নিয়ে আসা হয়। শ্রীরঙ্গনাথজি
তাঁকে গ্রহণ করেন। বিষ্ণুচিত্তকে শ্রীরঙ্গনাথজি গোধা দেবীর একটি মূর্তি উপহার দেন, কিন্তু গোধা দেবীকে আর শরীরে দেখা যায়নি। তিনি ভগবানের মূর্তির সঙ্গে
মিশে যান। অনেকে মনে করেন গোধা দেবী যেভাবে চুল বাঁধতেন মাথার এক দিকে চূড়া করে, ঠিক সেইভাবে দক্ষিণী মেয়েরা চুল বাঁধে। দক্ষিণ ভারতের অনেক মন্দিরে শ্রী
রঙ্গনাথের পাশে গোধা দেবীর মূর্তি বিরাজ করে। জুঁই ফুল দিয়ে মালা করে তাঁর খোঁপায়
বেঁধে দেওয়া হয়, আর সঙ্গে থাকে টিয়া পাখি। তিনি যে মালা
পরিয়েছিলেন সেই ঘটনা স্মরণে রেখে এখনও এই উৎসব পালন করা হয়। শ্রীভিলিপুথুর অন্ডাল
মন্দির থেকে অন্ডালের মালা তামিল মাস পুরতাসি-র (সেপ্টেম্বর
-অক্টোবর) সময় গারুড়োৎসবমের তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে প্রেরণ করা হয়।
শ্রীভিলিপুথুর অন্ডালের হাতে তৈরি তোতাপাখি
প্রতিদিন তাজা সবুজ পাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। অন্ডালের বাম হাতে রাখা হয় এই
তোতাপাখি। চঞ্চু ও মুখের জন্য একটি ডালিম ফুল, পায়ের জন্য বাঁশের লাঠি, কলা গাছ, গোলাপি করবীর পাপড়ি এবং নান্দিয়াভট্টাই
এই তোতাপাখি প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়।
দেবীকে নাচিয়ার বা আন্দাল নাচিয়ার নামেও ডাকা
হয়। তাঁকে চুডিকোডুথা সুদারকোডি-ও বলা হয়, মানে ভগবানকে যিনি মালা
পরিয়েছিলেন। শুরুতেই বলেছি অন্ডাল দেবীর অনেক নাম আছে। তাঁর এবং শ্রীরঙ্গনাথজির এই
কাহিনিকে নিয়ে অনেক রকম উৎসব পালন করা হয়। অন্ডাল দেবীর কথা এখানেই শেষ করলাম। তোমরা
কি কেউ গেছ অন্ডাল দেবীর মন্দিরে? গিয়ে থাকলে অবশ্যই জানিও
কেমন লেগেছে।
----------
ফোটো - লেখক
No comments:
Post a Comment