গল্প:: সত্যবাদী রুটি - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


সত্যবাদী রুটি
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

আমাদের নীলু যে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে সে কথা সবাই জানে
নীলু বাসের পেছনের সিটে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল
গজার কথায় তড়াক করে উঠে বসল, গজা, মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দেব আমি মিথ্যে কথা বলি?
আর সি ম্যামের কাছে আমাদের নামে নালিশ কে করেছিল? তুই ছাড়া আর কে জানত যে আমরা ক্লাস বাঙ্ক করে ফুটপাথে জামা বিলি করতে গেছি তার পর তো নিজেই ম্যামের কাছে ঝাড় খেলি
বরুণ মোবাইলের স্ক্রিনের থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,গজা তো সত্যি কথাই বলছে তুই গত বছরে সিনেমা দেখার জন্য গজার কাছে পাঁচশো টাকা নিলি, আর নতুন মোবাইল কিনবি বলে আমার কাছে হাজার টাকা নিলি পরে একেবারে অস্বীকার করে গেলি তারপর সেদিন স্পষ্ট তোকে আমরা আরসালানে বিরিয়ানি খেতে দেখলাম তুই বললি আমরা নাকি ভুল দেখেছি একই রকম দেখতে পৃথিবীতে সাত জন থাকে জন্মদিনের ট্রিট দেওয়ার ভয়ে একেবারে চিনতেই পারলি না
ইন্দ্র এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে একটা বই পড়ছিল হঠাৎ মুখ তুলে বলল, নীলু যে মিথ্যে কথা বলে কথাটা মোটেই মিথ্যে নয় কিন্তু এর দাওয়াই আছে আমাদের বাখরগঞ্জের সর্দারজির হাতের সত্যবাদী রুটি খেলে কখনোই মিথ্যে বলত না
সত্যবাদী রুটি! খিক খিক খিকনীলু আরেকটু হলে সিট থেকে গড়িয়েই পড়ে যাচ্ছিলপ্লিজ ইন্দ্র, মিথ্যে কথা বলা একরকম, সেটা নিজেকে বাঁচানোর জন্য সবাই কোনো কোনো সময় বলে থাকে কিন্তু এইরকম গাঁজাখুরি ঢপ দেওয়ার কোনো মানে হয় না
ইন্দ্র বইটা সজোরে বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে বলল, বেশ, বাখরগঞ্জ তো রাস্তাতেই পড়বে আর রাতে কোথাও খেতেও হবে চল সবাই মিলে সর্দারজির ধাবাতেই যাই তাহলেই সবটুকু পরিষ্কার হবে
নীলু ছাড়া বাকি সবাই একযোগে হ্যাঁ বলল নীলুও শেষে চ্যালেঞ্জটা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ দেখাই যাক কে মিথ্যে বলছে আর কে সত্যি বলছে
বাখরগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে একটা টোটো নেওয়া হল একটু দূরেই সর্দারজির ধাবা বেশ বড়ো ধাবা রাত দশটাতেও বেশ ভিড় সামনে চারটে টেবিল, তার চারদিকে লাল নীল চেয়ার রাখা রয়েছে টুনি দিয়ে জায়গাটাকে সুন্দর করে সাজানো আছে
ইন্দ্র হাত দেখিয়ে বলল, “সর্দারজি! চারটে জায়গায় রুটি আর ডিম তড়কা
সর্দারজি পুরু গোঁফের তলায় চওড়া হেসে হাত দেখিয়ে বসতে বললেনবললেন, “দশ মিনিট বসতে হবে
সর্দারজির মনে হয় ষাটের মতো বয়স তবে স্বাস্থ্য খুব ভালো লম্বা, চওড়া ছাতি, পেশীবহুল হাত চার-পাঁচজনকে এক হাতেই ছুঁড়ে ফেলতে পারেন মনে হয় দেখে
পিতলের জগ থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে গজা বলল, “বাপরে সর্দারজির স্বাস্থ্য দেখেছিস?”
ইন্দ্র হেসে বলল, “কুস্তি লড়তেন একসময়বাখরগঞ্জ থেকে অনেক মেডেল-টেডেল পেয়েছেন
বরুণ অধৈর্য হয়ে বলল, “আহা আসল কথাটাই বল না সত্যবাদী রুটির কথাটা
ইন্দ্র আবার গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, এই জায়গাটা যে কারণে বিখ্যাত সেটা হচ্ছে এই সত্যবাদী রুটি আর এটা বাখরগঞ্জের সবাই জানে এটা বাখরগঞ্জের একরকম সিক্রেট বলতে পারিস বাইরে জানাজানি হলে বিপদ এখানে পুলিশ চোরকে পিটিয়ে জেরা করে না এই ধাবায় নিয়ে এসে সত্যবাদী রুটি খাওয়ালেই চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজ কেঁদেকেটে সত্যি কথাটা বলে দেয়বিভিন্ন জন তাই বিভিন্ন প্রয়োজনে এই ধাবায় আসে উকিল, নাপিত, ডাক্তার, মোক্তার এমনকি নেতারাও কিন্তু ওই যে বললাম ব্যাপারটা ভীষণ গোপনীয় আমার বাবাও বিয়ের আগে মা-কে সত্যবাদী রুটি খাইয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সত্যি সত্যি বাবাকে পছন্দ কিনা তা মা বলেছিল একদম পছন্দ নয় এখনও তাই বলেসত্যবাদী রুটির কথা নিউজপেপারেও বেরিয়েছিল একবার
নীলু চোখ সরু করে বলল, “কই দেখিনি তো?”
১৯৮৪ সালে, আমাদের জন্মের আগে ইন্টারনেটের যুগ হলে আর দেখতে হত না খবরটা ভাইরাল হয়ে যেততারপর বাখরগঞ্জের লোকেরা অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ওই পেপারের বিক্রি বন্ধ করিয়ে দেয় সেদিনের মতোসুরভী প্রোগ্রাম থেকে লোক এসেছিল খোঁজখবর নিতে সর্দারজি একটা কথাও বলেননি সর্দারজি এমনিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ এইসব রিপোর্টারদের হইচই মোটেই সহ্য করতে পারতেন না আর তাছাড়া ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন হত
কাদের অস্তিত্ব?”
ইন্দ্র মুখটা একটু কাছে সরিয়ে নিয়ে এসে বলল, “ওই যে যারা এই রুটির সাপ্লাই দেয় এই রুটি তো আর সাধারণ রুটি নয় আর সাধারণভাবে তৈরিও হয় না আমি একদিন অনেক চেষ্টায় সর্দারজির কাছ থেকে রহস্যটা জেনেছিলাম আসলে সর্দারজি সেদিন রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছিলেন তাই সত্যিটা বলতেই হয়েছিল
এই ধাবার নীচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে যেটা সোজা পাতালে যায় ওই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ওরা উঠে আসে আগে আসত না প্রচণ্ড খাদ্য আর জলকষ্টে থাকতে না পেরে উঠে এসেছিল একবার সত্যযুগের মানুষ তাদের বংশধরেরাউচ্চতায় সবাই ছয় ফুট-এর বেশি রোগা তালসিড়িঙ্গে চেহারা, কম কথা বলে আর সত্যি ছাড়া কখনও মিথ্যে বলে না সত্য যুগ থেকে ত্রেতা, দ্বাপর পেরিয়ে এসে কলি যুগে মানুষের উচ্চতা শুধু নয়, মানুষের সততাও যে কমছে সেটা আমরা সবাই জানি
সত্যযুগে বিষ্ণুর মৎস্য অবতারের গল্পটা তো আমরা সবাই পড়েছি বিশাল এক বন্যায় যখন জগৎ সংসার ভেসে যায় তখন এক বিশাল মাছ হয়ে এসেছিলেন বিষ্ণু আর তার শিঙে মনু নিজের নৌকো বেঁধে সত্যযুগের লোকেদের বাঁচিয়েছিলেন
কিন্তু যাদের মনু বাঁচাতে পারেননি তারা আশ্রয় নিয়েছিল পাতালে এরা সেইসময় কিছু বিশেষ শস্যের বীজ সংগ্রহ করে রেখেছিল যা আর এখন পাওয়া যায় না এই চমৎকার রুটি তারই ফসল
সর্দারজি আমাকে বলেছেন এই সত্যবাদী রুটি খেয়ে মিথ্যে কথা বললে খুব তাড়াতাড়ি মানুষের মৃত্যু হয় এখানেই মৃত্যু হলে উনি ওই মৃতদেহ পাতালে পাঠিয়ে দেন ওরা খেয়ে বাঁচে ভয়ঙ্কর কষ্ট ওদের ওদের উদ্দেশ্য কিন্তু খারাপ নয় ওরা কলিযুগ শেষ করে আবার সত্যযুগের প্রতিষ্ঠা করতে চায় পৃথিবীতে, যখন আবার সবাই সত্যি কথা বলবেএমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে ওরা
নীলু এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল, বলল, “লেভেল, ভাই লেভেল তুই গল্প লেখ নোবেল না হলেও কতবেল পুরস্কার পাবিই
ততক্ষণে গরম গরম রুটি তড়কা চলে এসেছে
জয় বাবা সত্যবাদী রুটি,বলে নীলু রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরল তারপর হাত-পা ছুঁড়ে খিল খিল করে হেসে অঙ্গভঙ্গি করে বলতে লাগল, “উফফ, আর পারা যাচ্ছে না সত্যি কথাগুলো আমার পেটে বুড়বুড়ি কেটে চোয়াল ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে এই গজা আমাকে একটু ধর ভাই
ততক্ষণে একদম ফাঁকা হয়ে গেছে ধাবার সামনেটা
হঠাৎ নীলু চোখগুলো গোলগোল করে স্থির হয়ে গেল মুখের খাবার মুখের মধ্যে আর নড়ছে না সবাই নীলুর চোখ অনুসরণ করে পেছনে ফিরে তাকাল
তিন জন লোক এসে অন্য টেবিলের প্লেটগুলো তুলে নিয়ে জড়ো করে বাসন মাজতে বসেছে তাদের তাল সিড়িঙ্গে চেহারা পরনে খাটো ধুতি, ফ্যাকাশে চেহারা প্রত্যেকেই উচ্চতায় প্রায় ছয় ফুট
নীলু কোনোমতে মুখের খাবার গিলে বলল, “আমি গজা আর বরুণের টাকা কালকেই দিয়ে দেবআরসালানে তোদের ট্রিটও দিয়ে দেব, আর সেদিন ম্যামের কাছে নালিশ করার জন্য প্লিজ ক্ষমা করে দিস ভাই আমার মাথাটা ঘুরছে
বলে নীলু টোটো-তে গিয়ে বসল
গজা আস্তে আস্তে ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, সত্যি নাকি?”
ইন্দ্র আবার গম্ভীর হয়ে বলল, “সত্যবাদী রুটি খাওয়ার পর বেশি কথা বলা উচিত নয়
----------
ছবি - মেটা এআই

No comments:

Post a Comment