
দ্য এম্পটি পট
(চিনের একটি লোককাহিনি অবলম্বনে)
ভাষান্তর:
নাহার তৃণা
এ গল্পটা সেই তখনকার, যখন চিন নামের দেশটিতে রাজার শাসন অর্থাৎ রাজতন্ত্র বহাল ছিল।
রাজতন্ত্র কী বুঝেছ নিশ্চয়ই? হ্যাঁ ঠিক বুঝেছ, একজন রাজা তখন চিন শাসন করতেন।
এখন নানা দেশে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার
দায়িত্ব পালন করেন সেভাবে রাজাও তার দায়িত্ব পালন করতেন। চিনে
এখন আর রাজার শাসন নেই, একজন প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে
সে দায়িত্ব পালনের রীতি চালু রয়েছে। বড়ো
হয়ে তোমরা রাজতন্ত্র এবং বর্তমান প্রেসিডেন্টের রীতিনীতি বিষয়ে আরও বিশদে জেনে নিও,
কেমন! ভারী ভারী কথা রেখে এবার বরং গল্পে ফেরা যাক।
সেই সময় চেন নামের এক ছেলে আর তার মা বাস করত চিনের বুড়ো এক রাজার
রাজত্বে। চেনদের বাড়িতে ছিল ভারি চমৎকার
একটা বাগান। সেখানে রঙবেরঙের নানা ফুল আর
অন্যান্য অনেক সতেজ গাছপালায় বাগানটা ঝলমল করত। গাছ
আর ফুলেদের রং, রূপ, সুগন্ধের টানে বাগানে এসে জুটত নানা জাতের পাখি, কীটপতঙ্গ
আর প্রজাপতির দল। চেন আর তার মা বাগানের সব গাছেদের
খুব যত্ন করত। সময় মতো জল দিত,
সার দিত। গাছেরা
যেন ঠিকমতো আলোবাতাস পায় সেদিকে নজর রাখত। পাড়া
প্রতিবেশীরা প্রশংসা করত ওদের বাগানের। পথচলতি
পথিকেরাও বাগান দেখে মুগ্ধ হত।
আগেই বলেছি, এক বুড়ো রাজা
তখন রাজ্য চালাতেন। সেই
রাজার নিজের কোনো সন্তান ছিল না। এদিকে
তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। মৃত্যুচিন্তার পাশাপাশি তিনি
এ ভাবনাতেও অস্থির হলেন যে, তার মৃত্যুর পর এই রাজ্য
কে চালাবে? অনেক ভেবেচিন্তে রাজা ঠিক করলেন রাজ্যে যত বাচ্চা
ছেলে আছে তাদের ভেতর থেকেই তিনি রাজা নির্বাচন করবেন। কিন্তু
কীভাবে? ভেবেচিন্তে তিনি সেটাও ঠিক করে ফেললেন।
রাজা জনগণের উদ্দেশে ঘোষণা করলেন,
“রাজ্যের যত বাচ্চা ছেলে আছে তারা যেন তাদের নিজের নিজের পট (টব) নিয়ে রাজদরবারে হাজির হয়।
তিনি তাদের সবাইকে ফুলের বীজ দেবেন। একবছর
পর যার টবের গাছে ফুল ফুটবে, তাকেই তিনি
রাজা হিসেবে নির্বাচন করবেন।”
ঘোষণা শুনে চেনও মায়ের সঙ্গে রাজদরবারে গিয়ে উপস্থিত হল।
রাজার কাছ থেকে পাওয়া ফুলের বীজটা সে খুব যত্নের সঙ্গে তার ছোট্ট
মাটির টবে পুঁতে দিল। তাতে জল দিতে ভুলল না।
প্রতিদিন নিয়ম করে টবে জল দিতে লাগল চেন। দিন
কেটে চলল এভাবেই। কিন্তু টবের বীজ ফুঁড়ে কোনো
গাছকে মাথা তুলতে দেখা গেল না। চিন্তায়
পড়ে গেল চেন। সে ভাবল হয়তো তার টবটা ছোট্ট
বলে বীজটা ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। তখন
সে ছোট্ট টবটা বদলে দেখতে চমৎকার আর বড়োসড়ো আরেকটা টবে ফুলের বীজটা রাখল।
কুয়ো থেকে টাটকা জল এনে তাতে দিল। ভালোভাবে
যেন সূর্যের আলো পায়, সেজন্য চেন টবটাকে বাগানের
কাছাকাছি নিয়ে রাখল। কয়েক
সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু গাছের নামগন্ধ নেই।
একে একে ঋতু বদলের পালা চলল। একবছর
পূর্ণ হতে আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি! তখনও চেনের টবে গাছই হল না, ফুল ফোটা তো দূরের কথা।
এত যত্নআত্তির ফলাফলে চেন বেচারা খুব ভেঙে পড়ল।
বাগানের এককোণে বসে সে কাঁদতে লাগল। মা
দেখলেন, ছেলে তার কেমন হাপুস নয়নে কাঁদছে। তিনি
কষ্ট পেলেও ছেলেকে বোঝানোর জন্য সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
“তোমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তুমি তার সবই করেছ।
গাছ না জন্মানোর ওপর তোমার কোনো হাত নেই। কেঁদো
না বাবা। খালি টবটাই রাজার কাছে নিয়ে
যেও। এতদিন গাছের যত্নে তুমি যা
যা করেছ সবই রাজাকে খুলে বলবে।” মায়ের কথামতো চেন তাই করবে ঠিক করল।
দু-দিন পর মায়ের সঙ্গে খালি টবটা নিয়ে সে রাজদরবারে উপস্হিত হল।
গিয়ে দেখে সবাই নানা রঙের বাহারি ফুলশুদ্ধ টব নিয়ে এসেছে।
কেবল তার টবই খালি। বেচারার
মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে তার খালি টবটা নিয়ে বিষণ্ণ
হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে রইল। যথাসময়ে রাজা এলেন।
সবার হাতে ফুল সমেত টব দেখে খুশি হওয়ার বদলে তার মুখটা কেমন থমথমে
হয়ে উঠল। সভাসদেরা মনে মনে প্রমাদ গোনা
শুরু করলেন। রাজা সবার দিকে আরেকবার তাকিয়ে,
এককোণে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা চেনের কাছে এগিয়ে গেলেন।
তার সামনে গিয়ে জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপার,
তোমার টব খালি কেন? গাছ বা ফুল কিছুই দেখছি না?”
চেন বলল, “আমি দুঃখিত
রাজামশাই। আপনার দেওয়া বীজটা আমি প্রথমে
ছোট্ট একটা টবে রোপণ করেছিলাম। কিন্তু
ছোট্ট টবে বীজের কষ্ট হচ্ছে ভেবে টব বদলে এই বড়োটায় রেখেছিলাম।
টবের বীজ যেন সূর্যের আলো আর বাতাস ঠিকমতো পায় সেদিকে খেয়াল রেখেছিলাম।
চারা গজানোর জন্য কুয়োর টাটকা জল দিয়েছি প্রতিদিন।
এমনকি রাতের বেলা আমার পোষা বোতল ভর্তি ঝিঁঝি পোকাদের টবের পাশে
রেখেছি, যেন সে নিজেকে একলা না ভাবে।
তাদের গান শুনতে পায়। কিন্তু
কিছুতেই কিছু হল না। বীজ থেকে গাছ জন্মানোর জন্য
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। আমি
দুঃখিত মহারাজ।”
চেনের কথাগুলো শোনার পর হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে রাজামশাই চিৎকার করে উঠলেন, “ভবিষ্যৎ রাজা পেয়ে গেছি!
আমি জানি না এই ছেলেটি বাদে বাকি সবার টবে কীভাবে গাছ জন্মাল।
যে বীজ সবাইকে দিয়েছিলাম তা থেকে কোনোভাবেই গাছ জন্মানো সম্ভব
না। কারণ বীজগুলো ছিল সিদ্ধ করা।
এই ছেলেটি অত্যন্ত সৎ, এবং সে গাছটা যেন জন্মায় তার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে।
এই রাজ্যের জন্য এরকম সৎ এবং পরিশ্রমী একজনকেই রাজা হিসেবে মনোনীত
করলাম।”
এরপর চেন এবং তার মা তাদের বাড়ি ছেড়ে রাজপ্রাসাদে গিয়ে থাকতে শুরু
করল। রাজপ্রাসাদের বাগানে চেন খুব
মন দিয়ে রাজামশাইয়ের সঙ্গে গাছেদের দেখাশোনার কাজ করত। একসময়
বৃদ্ধ রাজা মারা গেলেন। চেন হল চিনের নতুন রাজা।
যেভাবে সে যত্ন আর ভালোবাসার সঙ্গে বাগানের দেখাশোনা করত,
ঠিক সেভাবে সে তার রাজ্যের দিকেও নজর রাখত।
দেশের মানুষেরা নতুন রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল এবং সুখে শান্তিতে
বসবাস করতে লাগল।
----------
ছবি - মেটা এআই
No comments:
Post a Comment