গল্প:: কাতু যখন রুমানিয়ায় - সুতপা ব‍্যানার্জী (রায়)

  
কাতু যখন রুমানিয়ায়
সুতপা ব‍্যানার্জী (রায়)
  
কাতু আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ষোলো আনা। মরতে মরতে মায়ের সেবায় বেঁচে ওঠা এক দেশি কুকুরছানা। বিদেশি দামি কুকুর নয় বলে সকলের উপেক্ষায় যখন রাস্তায় মরতে বসেছিল তখন আমিই ওকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। এখন অবশ্য নেহাত ছানাটি নেই। একবছর বয়স হয়েছে, গায়ে-গতরে বেড়েছে। আওয়াজেও কম যায় না। বাড়ির আশপাশে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। ওকে নিয়ে আমরা বেড়াতেও যাই। বেড়াতে বেরোলে বেশি বেগড়বাই করে না। তবে এবার ব‍্যাপারটা অন‍্যরকম। রুমানিয়ায় থাকা আমার একমাত্র দিদি আর জামাইবাবু ওখানে যাওয়ার জন্য একেবারে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। হ‍্যাঁ, কাতুর টিকিটও পাঠিয়েছে। তবু আমরা কাতুর কথা চিন্তা করে কাতুকে রেখে যাওয়ার জন্য আমাদের বড়ো মাসিমার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু কথা বলে বিশেষ সুবিধে হল না। বড়ো মাসিমার এক কথা, “আমার বাতের ব‍্যথা নিয়ে ও তোমাদের কাতুর সঙ্গে আমি পেরে উঠব না।”
বড়ো মেসো আবার এককাঠি সরেস, মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের কাতু যদি আমাদের বাড়িতে আসা কাউকে কামড়ে দেয় তো বিপদে পড়ে যাব।”
মেসোকে কে বোঝাবে যে আমাদের কাতুর ট্র‍্যাক রেকর্ড মোটেই এতটা খারাপ নয়। ওকে চেঁচাতে শোনা গেছে, কিন্তু কাউকে কামড়েছে তা অতি বড়ো শত্রুতেও বলবে না। লোকের ছেলের দায়িত্বই যেখানে কেউ নিতে চায় না সেখানে দেশি সারমেয় কাতু তো অতি তুচ্ছ। তবু সকলের কাছে এই তুচ্ছ কাতুই আমাদের কাছে মহার্ঘ‍্য। তাই বিদেশ যাত্রার জন্য আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওর কাগজপত্রও তৈরি করা হল। এখন দেখার বিষয় আমাদের কাতু এই যাত্রা কতটা উপভোগ করে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কাতুর জিনিসও গুছিয়ে নেওয়া হল। ড্রাই ফুড, ডায়াপার যা যা ওর লাগে চলল আমাদের সঙ্গে। শুনেছি রুমানিয়ার সরকার ও নাগরিকরা পোষ‍্যদের বিষয়ে খুব সংবেদনশীল। তাই আমাদের মনে আশা যে ওদেশে আমাদের কাতুর কোনো অনাদর হবে না।
সরাসরি বিমান না থাকায় আমাদের গন্তব্য ছিল ইস্তাম্বুল হয়ে বুখারেস্ট হেনরি কোয়ান্ডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্লেনে উঠে কাতুকে কিছুটা বিচলিত দেখালেও প্লেন ছাড়তে জানলার ধারে ওর ভাবুক দৃষ্টি দেখে বেশ বোঝা গেল ও প্লেনযাত্রা উপভোগ করছে। প্রথমে সিট বেল্ট বাঁধাতে আপত্তি থাকলেও আমার বেল্ট দেখে আশ্বস্ত হল। পেট ভর্তি থাকায় ঘণ্টা পাঁচেকের টানা ঘুমও দিল।
বুখারেস্ট এয়ারপোর্টে নেমে কাতু একটু দুষ্টুমি করছিল। জামাইবাবুর গায়ের চেনা গন্ধে ও ঠান্ডা হল। জামাইবাবু বুখারেস্টের মেডিটারেনিয়ান শিপিং কোম্পানিতে বছর দশেক হল কাজ করছে। দিদি এখানে বছর পাঁচেকের মতো আছে। আমেরিকায় জামাইবাবু একটা স্পেশাল ট্রেনিংয়ে যাবে। তাই দিদিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য কাতুসহ আমাদের ডাক পড়েছে। মালপত্র জামাইবাবুর গাড়ির ডিকিতে রেখে আমরা যখন গাড়িতে উঠলাম তখন কাতুর চোখেমুখে অপার বিস্ময়। আমরা একটা নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কাতু উল্লাসে একটা দীর্ঘ ভৌ শব্দ করতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী নদী জামাইবাবু।”
রাস্তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জামাইবাবু উত্তর দিল, “এটা নদী নয়, উপনদী। ডানিউবের উপনদী ডাম্বোভিটা।”
ছোটো বড়ো নৌকা, স্টিমার দেখে আমি বললাম, “অপূর্ব।”
জামাইবাবু হাসতে হাসতে বলল, “ভাইকিং রাজাদের হাত ধরেই তো এই দেশের উত্থান।”
আমি বললাম, “হ‍্যাঁ ইতিহাস সব জেনেই এসেছি।”
জামাইবাবু বলল, “স্ন‍্যাগভে যাবে? ঐখানে হ্রদের মাঝে দ্বীপের স্ন‍্যাগভ চার্চ দেখতে পর্যটকরা আসে। আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে থাকব ঐ দ্বীপ থেকে। যদি তোমরা ক্লান্তি অনুভব না কর তো চল।”
আমাদের বলার আগে কাতুই লেজ নেড়ে হ‍্যাঁ দিয়ে দিল। ওখানে যাওয়ার পথটা গ্রামীণ সৌন্দর্যে ভরপুর। সুন্দর দেখতে সব পাথরের বাড়ি। ঘোড়ায় টানা মালবাহী গাড়ি দেখে কাতু কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তবে আমরা যখন ঐ দ্বীপে পৌঁছোলাম তখন কাতু অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল। যেন আমরা ওর কোনো পূর্বজন্মের জায়গায় এসেছি। স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শনের এই চার্চ দেখে আমরা সকলেই বিমোহিত।
ফিরলাম বুখারেস্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে। প্রাচীনত্বের সঙ্গে আধুনিকতার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে বুখারেস্ট শহরে। ঘরে ঢুকে কাতু দিদির গলা অবধি উঠে চাটতে শুরু করল। তার মানে দিদির শরীরের গন্ধও ওর মনে আছে। যখন মানুষ চেনা লোককে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নেয় তখন এই অবলা প্রাণীদের ভালোবাসা অনেক কঠিন প্রাণকেও গলিয়ে দেয়।
এখন কাতুকে বেশ চনমনে দেখাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না কোন দূরের দেশ থেকে ও একটা অচেনা দেশে এসে পড়েছে। দরজায় ‘মিউ’ শব্দ শুনে আমি আর কাতু ঘুরে তাকাতেই দিদি বলল, “পাশের বাড়ির পোষা বেড়াল, ললি। আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। আজ নতুন কেউ এসেছে সেটা ও ঠিক বুঝেছে।”
দরজা খুলতেই কাতু ললিকে শুঁকতে শুরু করল। ললির এক থাবা কাতুর গালে পড়তেও কাতু রেগে গেল না। উলটে ছোটো ভাইবোনেদের দৌরাত্ম্য যেমন বড়োরা মেনে নেয় তেমন কাতুও ললির সব অত‍্যাচার সয়ে নিল। যখন তখন ললি কাতুর পিঠে উঠে পড়ছে। কাতুর খাবার খেয়ে নিচ্ছে। অথচ কাতু অগাধ প্রশ্রয় দিচ্ছে, টুঁ শব্দটা করছে না। এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। মনে হচ্ছে শেষপর্যন্ত রুমানিয়াতে কাতুর জিগরি দোস্ত জুটল। মানুষেরও তো এমনই হয়। যেখানে মনের মিল হয় সেখানে প্রাণের টান তৈরি হয়।
দিদি জামাইবাবুর কাছে বায়না জুড়ল, “তুমি ট্রেনিংয়ে চলে গেলে মা আর বুনুকে কে ঘোরাবে? তুমি থাকতে থাকতেই ঘোরা হবে বলে তো ওরা তোমার চলে যাওয়ার ক’দিন আগেই এল
আমি বাধা দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, জামাইবাবুর সুবিধে হলে তবেই যাব।”
আমার কথা কাতুর ঠিক পছন্দ হল না, তাই কুঁই কুঁই করে কাঁদতে শুরু করল। যাহোক শেষপর্যন্ত সপ্তাহান্তে যাওয়া হল ওল্ড টাউনে। এমনিতে কাতুর গলায় কলার থাকে না। অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে বলে কাতুর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গলায় বকলশ ও চেন পরানো হয়েছে। কাতুর গলার চেন আমার হাতে। আমরা গাড়ির থেকে নেমে ওল্ড টাউনে হাঁটছি। এমন সময়ে রাস্তায় একটা লোমশ কুকুর উঠে এলকাতু তো চেঁচিয়ে লাফিয়ে একাকার করছে। অচেনা সারমেয় বেচারি ভয় পেয়ে দিল এক দৌড়।
সব বাড়িগুলোই খুব পুরোনো আর একই দেখতে। এই অঞ্চলটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। প্রত‍্যেক বাড়িতেই সুন্দর করে সাজানো ফুলের বাগান। আমরা একটা ছোটো ক্যাফেটারিয়াতে স্ন‍্যাক্স আর কফি নিলাম। কাতু গন্ধ শুঁকে শুঁকে নিজের জন্য পর্ক স্টিক পছন্দ করল। আমরা কাছাকাছি একটা জঙ্গলে হাইকিং করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেই কাতু বাঁধাল গণ্ডগোলটা। কী গণ্ডগোল, সেই কথাতেই আসি।
সবে আমরা পাইনের জঙ্গলটা পেরিয়েছি অমনি ‘মিউ’, ঐ ডাক শুনে আমরা তাকাতে না তাকাতেই ঐ শব্দের উৎসের দিকে কাতু ছুটে গেল। এমন ছুটল যে আমার হাতের চেন হাতেই রইল আর কাতু ফসকে গেল। বেড়ালটা হুবহু ললির মতো দেখতে। গায়ের রং ধবধবে সাদা আর ললির লেজের মতোই সেখানে একটা ছোট্ট কালো দাগ। ওদের সঙ্গে কি আমরা পেরে উঠি? ওরা দুজনেই এমন ভ‍্যানিশ হল যে বেড়ানো মাথায় তুলে আমরা স্থানীয় পুলিশের শরণাপন্ন হলাম। ওদের নির্দেশে ও খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমরা কাঁদতে কাঁদতে দিদির বাড়িতে ফিরলাম।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমরা কাতুর গলার আওয়াজ পেলাম। পাশের বাড়ির মিসেস মরিসন আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসে যা বললেন তাতে আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। আমাদের যাওয়ার সময় থেকে ললি ঘরছাড়া ছিল। মানে ওল্ড টাউন যাওয়ার পুরো ৩৫ কিমি রাস্তায় ললি আমাদের অনুসরণ করেছে। কাতুকে পেয়ে ও ওর আদুরে ডাকে ডেকে নেয়। কাতু বন্ধুকে চিনতে ভুল করেনি। এরপর আমাদের ওখানে না পেয়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে বাড়ি পৌঁছেছে দুজনে।
আমি কাতুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “সত্যি কাতু তুই রিয়েল হিরো, তোর কোনো তুলনা নেই।”
আদরের পুরোটা কাতুর ভাগে চলে যাচ্ছে দেখে ললি ডেকে উঠল, “মিউ
----------
ছবি - মেটা এআই

No comments:

Post a Comment