মহাভারতের এক তেজস্বিনী মেয়ের কথা
সুমনা সাহা
(দ্বিতীয় পর্ব)
ছবির মতন গ্রামখানি। নাম
মণিপুর। মণি মানে বহুমূল্য রত্ন পাথর। গ্রামের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহেন্দ্র
পর্বত, এখন যাকে আমরা পূর্বঘাট পর্বতমালা বলি। আর দক্ষিণে তির তির করে বয়ে চলেছে
মণিপুর নদী। শঙ্খ আর কোয়েল নদীর মিলনে ঝাড়খণ্ডে যে ব্রাহ্মণী নদীর জন্ম,
সেই নদীই উড়িষ্যার এই উপকূল প্রান্তে পৌঁছে দুই ভাগে ভাগ হয়ে বইছে, একটি শাখা তার
বৈতরণি নদী, আরেকটি এই মণিপুর নদী। মাঝে সবুজ বনে ঘেরা এক উজ্জ্বল পান্নার মতোই
মণিপুর গ্রামটি পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে নদীর দিকে পা ছড়িয়ে বসে আছে। চিত্রাঙ্গদাও
আজ ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছে গ্রামের একেবারে প্রান্তে। গ্রামের নদীটি যেখানে সাহস
করে সাগরের সঙ্গে দেখা করতে যায়, তার অনতিদূরেই মণিকাপুরম বন্দর। বাবার বাণিজ্য
তরী সেখান থেকে রওনা হয় নানা পণ্য নিয়ে, আবার ফেরতও আসে বিদেশী পণ্য বোঝাই করে।
তার বাবা এ গ্রামের রাজা। নাম চিত্রবাহন। গ্রামের মধ্যে রাজগড়ে তাদের বিশাল বড়ো
প্রাসাদ। তবে বাবার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে যে তার নাম চিত্রাঙ্গদা, তা কিন্তু নয়।
আসলে চিত্রবাহনের সন্তান ছিল না। তাদের বংশে আগেও এমন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পূর্বপুরুষরা
তখন থেকেই স্কন্দদেবের পুজো করতেন। কার্তিকের মতো বীর ও সুদর্শন পুত্রলাভের বাসনা
কোন রাজার না থাকে? ছেলে হলে তবেই তো বংশরক্ষা হবে! না হলে রাজা মরে গেলে রাজত্ব
সামলাবে কে? প্রজাদের আপদে বিপদে যুদ্ধ করে রক্ষাই বা করবে কে? তাই রাজা
চিত্রবাহনও পারিবারিক প্রথা মেনেই কার্তিকের পুজো করছিলেন। কিন্তু রানি এক অতি
সুদর্শনা কন্যার জন্ম দিলেন। রাজা দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি ঠিক করলেন, ছেলে হয়নি
তো ‘কুছ পরোয়া নেহি’, আমার মেয়েই হবে একশো ছেলের সমান। স্কন্দপুরাণ ঘেঁটে মেয়ের
নাম রাখলেন চিত্রাঙ্গদা, যার আরেক কথ্য নাম মধুলিকা। মধুলিকা বা মধুকুম্ভ কার্তিক
ঠাকুরের প্রিয় ফুল। ফুলটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমন তার উজ্জ্বল মণির মতো রং আর
অন্তর মিষ্টি মধুতে পূর্ণ। মনে মনে এই পুষ্পসম কন্যাকে স্কন্দদেবের চরণে নিবেদন
করে রাজা প্রার্থনা জানালেন, “হে যোদ্ধা দেবতা! মেয়েকে যেন যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়ে
পুরুষের সমকক্ষ তৈরি করতে পারি। তবে তার অন্তরের নারীসুলভ কোমলতার মাধুর্যও যেন
কখনও নষ্ট না হয়!” কার্তিক ঠাকুর চিত্রবাহনের মনের কথা শুনেছেন। চিত্রাঙ্গদা
তীরন্দাজীতে যেমন দক্ষ, তেমনই তার মন দীন-দুঃখী মানুষের জন্য করুণায় পূর্ণ।
গ্রামের একেবারে প্রান্তে
নদীর কিনারায় এসে পিঠের তূণীর ভার নামিয়ে রেখে একটা ঝাঁকড়া গাছের ছায়ায় ঠেস দিয়ে
বসে চিত্রাঙ্গদা। তার সঙ্গে সর্বদাই থাকে দু-চারজন সশস্ত্র সঙ্গিনী। নির্ভয়ে সে
তীর-ধনুক নিয়ে গ্রামের সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, কোথাও কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে সঙ্গে
সঙ্গে সাহায্যের জন্য হাজির হয়ে যায়। আজ এই শান্ত নদীতীরে বসে তার ছোটোবেলার সইয়ের
কথা মনে পড়ছিল। ডানপিটে রাজকন্যা উলুপী তাদের বাণিজ্য তরীর সঙ্গে লুকিয়ে চলে
এসেছিল কলিঙ্গের এই মণিকাপুরম বন্দরে, আর সেদিন বায়না করে বাবার সঙ্গে তাদের
বাণিজ্য তরী রওনা হওয়া দেখতে চিত্রাঙ্গদাও এসে পড়েছিল ভাগ্যক্রমে এইখানে এই নদী
মোহনায়। তারা দু’জন সেদিন সই পাতিয়েছিল। এখনও মাঝেমধ্যে সে এইভাবে লোক মারফত সংবাদ
পাঠায় সখীকে। কিছুদিন আগেই খবর এসেছিল, তার দুঃসাহসী ডানপিটে সই নাকি এক ভিনদেশি
রাজপুত্রকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। গঙ্গাদ্বারে সে খুঁজে পেয়েছে তার মনের মতো
বীরপুরুষকে। বেশি কিছু সে জানায়নি। এসব সংবাদই সাঙ্কেতিক লিপিতে পাঠায় সে, পাছে
লোকজন জানতে পারে! নদীর মোহনা কি এমনি করেই মিলিয়ে দেয়? যেমন নদী নিজে
দেশ-দেশান্তর ভ্রমণ করে এসে মেশে সাগরের বুকে, তেমন করেই দূরদূরান্তের ভালোবাসার
মানুষদেরও কি সে মিলিয়ে দেয় এক অবর্ণনীয় উপায়ে? বড়োদের মুখে চিত্রাঙ্গদা শুনেছে যে,
যেখানে শঙ্খ আর কোয়েল নদীর মিলনে ব্রাহ্মণী নদীর জন্ম, সেইখানে নাকি অনেক বছর আগে
জেলেপাড়ার মেয়ে সত্যবতীর নৌকায় নদী পার হতে এসেছিলেন এক বিরাট পণ্ডিত ঋষি, নাম
তাঁর পরাশর। নদীর এমনই মায়া যে অমন গম্ভীর জ্ঞানী মানুষটিও নাকি সত্যবতীর
সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের ভালোবাসার বিয়ের ফলেই মহর্ষি বেদব্যাসের জন্ম,
যিনি নাকি এক বিশাল মোটা বই লিখছেন, যাতে ধরা থাকবে তাঁর নিজের বংশের আর সারা
ভারতের ইতিহাস। যদিও সারা ভারত দেশটা যে কত বড়ো, সে সম্পর্কে রাজকুমারী
চিত্রাঙ্গদার কোনো ধারণাই নেই। এসবই সে শুনেছে বাবার সঙ্গে অন্যান্য জ্ঞানী
মানুষদের আলোচনা থেকে অল্পবিস্তর। নদীর স্নিগ্ধ হাওয়া, জলের কলকল শব্দ, পাখির
কাকলি—সব মিলিয়ে পরিবেশ আজ বড়োই মধুময়। এমন সময় দূর থেকে তার অনুচরীরা হই হই করতে
করতে হাজির হয়। চিত্রাঙ্গদা অলস আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে, “কী হয়েছে? তোরা এত
চেঁচামেচি করছিস কেন?”
ভানুলেখা বলে, “বনের
মধ্যে আমরা একজন পুরুষকে দেখেছি। প্রথমে ঝোপঝাড়ের নড়াচড়া ভেবে হরিণ মনে করে তাড়া
করেছিলাম, তারপর দেখতে পাই তিনি একজন বলিষ্ঠ পুরুষ এবং কোনোমতেই আমাদের গ্রামের
নন। বাইরের শত্রু মনে করে তীর ছুঁড়েছি, সে তীর তাঁর গায়ে লেগেছে বটে, কিন্তু তাঁকে
ধরতে পারিনি, তীরবিদ্ধ অবস্থায় তিনি বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছেন। এখন কী করবে বল?”
চিত্রাঙ্গদা সোজা হয়ে
বসে। তার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, গভীর চিন্তায় কুঞ্চিত হয় সুন্দর ভ্রু-যুগল।
খানিকক্ষণ ভেবে সে বলে, “তীর যখন বিঁধেছে, বাছাধন বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করতে পারবে
না। নিশ্চয় যন্ত্রণায় কাতরাবে কোথাও পড়ে। তোমরা নজর রেখ, যেন কোনোমতে গ্রামের
ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। কোথাও তাকে দেখলেই আমাকে জানাবে। ধরতে পারলে আমরা তাকে
ধরে নিয়ে যাব পিতার কাছে। বিদেশি শত্রু হলে পিতাই স্থির করবেন, কী করণীয়। হয়তো
তিনি মন্দ উদ্দেশ্যে এই গ্রামে আসেননি, হয়তো তার তরী ডুবেছে। সাহায্য দরকার। খুব
সাবধান, দূর থেকে লক্ষ রেখ।”
এদিকে উলুপীর কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে অর্জুন এগিয়ে চললেন। হস্তিনাপুরের অনতিদূরে ইন্দ্রপ্রস্থে তাঁদের নতুন
রাজধানী থেকে রওনা হয়ে তিনি সমস্ত পবিত্র তীর্থের পথ ধরে চলেছেন। তাঁর এই
তীর্থভ্রমণ শখে নয়, এক শর্ত পালনের। আগের বছর, যখন তাঁরা বারণাবতে বেড়াতে
গিয়েছিলেন, দুর্যোধন তাদের পুড়িয়ে মেরে ফেলার জন্য লাক্ষার তৈরি ঘরে থাকার
ব্যবস্থা করেন। কাকা বিদুরের পরামর্শে পাঁচ ভাই তখন মাতা কুন্তীকে নিয়ে গোপন
সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে তারা বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যে জায়গাটি
আজকের পাঞ্জাব, তখন সেটি ছিল পাঞ্চাল রাজ্য। এই সময় পাঞ্চাল রাজ্যে দ্রুপদ
রাজার আয়োজিত স্বয়ম্বর সভার কথা তাদের কানে আসে। অর্জুন তো আগেই দ্রুপদকে যুদ্ধে
হারিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের প্রার্থিত গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন। তাই সেই রাজ্যের
স্বয়ম্বরের সংবাদ শুনে তাঁর কৌতূহল হল। ভাবলেন, ব্যাপারটা কী, দেখেই আসা যাক।
সেখানে গিয়ে দেখলেন রাজা দ্রুপদ রাজকুমারী দ্রৌপদীকে বিয়ে করবার জন্য এক কঠিন
‘লক্ষ্যভেদ’ পরীক্ষার আয়োজন করেছেন। বহু দেশের রাজা ও ক্ষত্রিয় শূরবীরদের হারিয়ে সেই
কঠিন ও সূক্ষ্ম লক্ষ্যভেদ পরীক্ষায় মাছের চোখে লক্ষ্যভেদ করে রাজকন্যা দ্রৌপদীর
কাছ থেকে বিজয়মালা পেয়েও গেলেন অর্জুন। কিন্তু ঘটনাচক্রে মাতা কুন্তীর অজান্তে বলে
ফেলা একটি কথার সত্যতা রক্ষা করতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, দ্রৌপদীকে
তাঁদের পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী হতে হল। অবশেষে কুন্তীর অস্বস্তি,
দ্রৌপদীর মানসিক টানাপোড়েন ও পঞ্চপাণ্ডবের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা সামাল দিতে
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মধ্যস্থতা করেন এবং স্থির হয়, এক এক ভাই এক বছর করে দ্রৌপদীর
সঙ্গে থাকবেন। তবে দ্রৌপদী যাতে কোনোভাবে অসম্মানিত না হন এবং ভাইদের মধ্যেও
অসদ্ভাব না আসে, সেজন্য এক ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর অবস্থান কালে, অন্য কোনো ভাই
সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। এই শর্ত লঙ্ঘন করলে শাস্তিস্বরূপ নিজের দেশের
সীমানা ছাড়িয়ে বারো বছর তীর্থভ্রমণ করে কাটাতে হবে—এমনই নিয়ম স্থির করা হয়েছিল।
ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে একজন ব্রাহ্মণকে বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য অস্ত্র নিতে শর্ত
লঙ্ঘন করে অর্জুন ঢুকে পড়েছিলেন সেই ঘরে, যেখানে তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে
একান্তে বিশ্রাম করছিলেন।
শর্ত অনুযায়ী অর্জুনকে
ইন্দ্রপ্রস্থ ছেড়ে চলে যেতে হল। তখন বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণও তীর্থদর্শনে তাঁর সঙ্গী
হলেন। সে তো অনেক কাল আগের কথা। সে সময় তো আর পথে বেরিয়ে গুগল ম্যাপ দেখে পথের
হদিশ জেনে নেওয়ার উপায় ছিল না! তবে মানুষ তীর্থে যাওয়া আসা করত আর একজনের কাছ থেকে
আরেকজন মুখে মুখে পথের সমস্ত সুলুকসন্ধান জেনে নিত। কোন পথে গেলে সময় কম লাগবে,
কোন পথে গেলে বেশি ঘুরতে হবে, কোথায় বা ভালো পানীয় জল ও রাতের বিশ্রামের ব্যবস্থা
আছে, কোন পথে আবার দস্যু বা লুটেরার ভয় আছে, এ সমস্ত জেনে নিয়ে এবং সঙ্গে অভিজ্ঞ লোক
নিয়েই লোকে তীর্থে বের হত। তা অর্জুনের সঙ্গেও সেরকম লোকজন ছিল, যারা নানা তীর্থে
ভ্রমণ করেছে। ব্যাসদেবের মহাভারতে যে সমস্ত শ্লোক আছে, সে সব থেকে ধারণা নিয়ে
মানুষের পায়ে হাঁটার গড় গতিবেগ, এক তীর্থ থেকে আরেক তীর্থের দূরত্ব, বিশ্রামের সময়
ইত্যাদি তথ্যের ভিত্তিতে পণ্ডিতরা গবেষণা করেছেন, গণনা করে তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন
যে, ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে রওনা হয়ে ফের ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসতে অর্জুনের বারো বছর
নয়, দু’বছর সময় লেগেছিল।
ইন্দ্রপ্রস্থ নগর এখনকার
দিল্লী ও লাহোরের মাঝমাঝি স্থানে ছিল। সেখান থেকে রওনা হয়ে অর্জুন সোজা চলে আসেন
গঙ্গার উৎসের কাছাকাছি, গঙ্গাদ্বার তীর্থে, খুব সম্ভবত এটাই আজকের হরিদ্বার। তাঁর
সঙ্গে যে ব্রাহ্মণরা এসেছিলেন, তাঁরা বেদজ্ঞ পণ্ডিত, কেউ কেউ সুগায়ক, সুন্দর
সুললিত সুরে তাঁরা প্রতিদিন স্তোত্রপাঠ করেন, পুজো করেন, হোম করেন, কেউ অর্জুনকে
বেদ ও পুরাণ থেকে পাঠ করে শোনান। দূরে নীল পাহাড়ের ঢেউ খেলানো সারি, কাছেই কলকল
করে বয়ে চলেছে পুণ্যতোয়া গঙ্গা, মনোরম শান্ত পরিবেশ। এখানে পৌঁছে অর্জুন কিছুদিন
থাকবেন ভেবে গঙ্গাতীরে অস্থায়ী শিবির তৈরি করার আদেশ দিলেন। এখানেই একদিন উলুপীর
সঙ্গে অর্জুনের দেখা হয়ে গিয়েছিল। উলুপী অর্জুনকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের নাগলোকে।
আজ থেকে বহুকাল আগে ‘নাগলোক’ নামে যার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, হয়তো সেই স্থানটি আজকের
নাঙ্গাল বা নাগাল, যেটি হৃষীকেশের খুব কাছেই। একে একে হিমালয়ের তীর্থগুলো দর্শন
করতে করতে তাঁরা পথ চলেছিলেন। তাঁদের কাছে অবশ্যই ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে উত্তরের তীর্থ
দর্শন করে ক্রমে পূব দিক বরাবর ভ্রমণ করে পশ্চিমে মামাবাড়ির রাজত্ব, শ্রীকৃষ্ণের
দ্বারকা নগরী ও প্রভাস তীর্থ হয়ে ফের ইন্দ্রপ্রস্থে ফেরার মতন ভ্রমণ সূচি ছিল। সেই
মতো মহাভারতের বর্ণনা থেকে জানতে পারা যায় যে, অর্জুন গঙ্গাদ্বার থেকে উত্তরে
অগস্ত্যমুনি শিখর, বশিষ্ঠ শৃঙ্গ ইত্যাদি উঁচু পাহাড়চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন। ভৃগু
পর্বতের পূর্বে, শিবলিঙ্গ শিখরের কাছেই রয়েছে তপোবন পাহাড়। এর চূড়ায় আছে সোনার
আভাযুক্ত হিরণ্যবিন্দু সরোবর। লোকের বিশ্বাস, সেখানে স্নান করলে সর্বপাপ থেকে
মুক্তি পাওয়া যায়। সেখানেও স্নান করলেন তিনি। তারপর গোমতী নদীর গতিপথ অনুসরণ করে
আরও পূর্বে বা উত্তর-পূর্বে যাত্রা করলেন। উপকূল রেখা বরাবর চলতে চলতে এসে
পৌঁছালেন কলিঙ্গ রাজ্যের সীমানায়। এখানে পুরীর দক্ষিণ সীমান্তে পাঁচটি পবিত্র নদী
এসে মিলেছে মহাসাগরে। এটি হিন্দুর পবিত্র তীর্থ গোকর্ণ। উড়িষ্যার উপকূলভাগে,
কলিঙ্গ সাম্রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে মৌনমহান পূর্বঘাট পর্বতমালা, প্রাচীন গ্রন্থে
যার নাম মহেন্দ্রগিরি। যুগ যুগ ধরে বহু মুনি ঋষি তপস্যা করেছেন এই মহেন্দ্র
পর্বতে। অর্জুনের ইচ্ছা হল ঐ পাহাড়ে যাওয়ার। কিন্তু তাহলে পেরোতে হবে বৈতরণি নদী।
নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে শ্যামল গ্রামের আভাস, পাহাড়ের পায়ের কাছেই গুটিসুটি মেরে
শুয়ে আছে শান্ত ছবির মতো একটি গ্রাম। অর্জুনের সাহসী চিত্ত নেচে ওঠে দূর দেশের
অজানা নগর দেখতে। কিন্তু বেঁকে বসলেন সঙ্গী ব্রাহ্মণরা। বৈতরণি নদী যে যমালয়ের
প্রবেশ দ্বার, নদী পার হলেই যমলোক। তাই তাঁরা আর এক পা-ও নড়তে চান না। অর্জুন
তাকালেন সঙ্গীদের মুখের দিকে, তারপর ধীর স্বরে বললেন, “আমরা যদি বৈতরণি পেরিয়ে
দেশের মধ্যে দিয়ে বরাবর না যাই, তাহলে চলে যেতে হবে আরও দক্ষিণে। গোদাবরী তট
অতিক্রম করে চলে যেতে হবে আরও দক্ষিণে কৃষ্ণা নদীর অববাহিকা বরাবর, সেখান থেকে
দক্ষিণভাগে বাঁক নিয়ে তুঙ্গভদ্রার তটভূমি ধরে চললে প্রভাসে পৌঁছাতে আমাদের অনেক
বিলম্ব হবে। আমি এই পথেই বৈতরণি পার হয়ে সোজাসুজি চলতে চাই। আপনারা কে কে আমার
সঙ্গে আসবেন, বলুন?”
অর্জুনের কণ্ঠে অনুরোধের
মিনতি নয়, সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রত্যয়। কয়েকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ ব্রাহ্মণ
এগিয়ে এলেন মহাবাহু অর্জুনের দিকে, “আমরা আপনার সঙ্গ ছাড়ছি না!”
প্রাচীন ব্রাহ্মণরা এ ওর
মুখ চাওয়া চাউয়ি করছিলেন, একজন আমতা আমতা করে বললেন, “আমরা উত্তরের লোক। দক্ষিণের
এলাকা সম্বন্ধে কিছুই জানি না। সেখানে ম্লেচ্ছ থাকার সম্ভাবনা। শুনেছি সেখানকার
মানুষ বেদ পড়েনি, মানেও না। এদের খাওয়াদাওয়া, আচার-ব্যবহার, ভাষা সবই অন্যরকম। ভিন
দেশে নিরস্ত্র অবস্থায় ভ্রমণে বিপদের সম্ভাবনা। আরেকবার ভেবে দেখবেন কি
কুন্তীপুত্র?”
মহেন্দ্রগিরি অর্জুনকে
ভিতর থেকে টানছে। এ ডাক অমোঘ। হয়তো বৈদিক ও অবৈদিক সংস্কৃতি মিলনের ক্ষণে বৈতরণির
তীরে দাঁড়িয়ে অর্জুন সাক্ষাৎ যমের দুয়ারে যেতেও প্রস্তুত। সভ্যতার ইতিহাস রচনা
করেন গুটিকয় সাহসী মানুষ, যাদের প্রাণের ভয় নেই, অজানাকে জানবার দুর্দম নেশা যাদের
রক্তে, যারা যে কোনো নতুন ভাবধারাকে উদার মনে আলিঙ্গন করে নিতে পারেন, ইতিহাসে
তাঁরাই অমর হয়ে থাকেন। আর অর্জুন যে সেই দলেই পড়েন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
(ক্রমশ)
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment