মেঘ পিয়নের দেশে
সৌরভ চাকী
আশীষের গাড়ি এসে হর্ণ দিতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। নির্জন পাহাড়ি গ্রাম দাওয়াইপানির
দু’দিনের মায়া কাটিয়ে ব্রেকফাস্ট
সেরে বেরিয়ে পড়লাম লেপচাজগতের দিকে। মাঝে বাঁ-হাতি পথে কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত
মংপু ঘুরে নিলাম। জোড়বাংলো
থেকে ঘুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে ধরলাম বামহাতি পথ। ডানদিকের রাস্তা চলে গেছে ঘুম স্টেশনের
পাশ দিয়ে দার্জিলিংয়ের দিকে।
'ঘুম' নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা নস্টালজিয়া
আছে। বহুদিন
আগে যখন পাহাড়ের ছোটোখাটো অফবিট জায়গাগুলো জনপ্রিয় হয়নি, হয়নি পর্যটনের প্রসার, তখন
থেকেই ঘুম,
দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ইত্যাদি ট্র্যাডিশনাল
নামগুলো ভ্রমণপ্রিয় বাঙালিকে টানে। ঘুম মানেই যেন মেঘ কুয়াশায় ঘেরা
ছোট্ট রেল স্টেশন। যেখানে
টয় ট্রেনের কু-ঝিকঝিক্ পাহাড়তলিতে ধাক্কা
খেয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ঘুম মানেই যেন সূর্যদেবের নো এন্ট্রি। মেঘের পিছুপিছু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির হাতছানি। এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমের ঘিঞ্জি
জনপদ ছাড়িয়ে আবার মসৃণ পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়েছি। দু’দিকের পাইন, জুনিফার গাছেরা যেন অভিবাদন
জানাতে লাগল আমাদের। ঘুম থেকে লেপচাজগৎ মাত্রই ৮ কিলোমিটার পথ, মিনিট কুড়ি মতো
সময় লাগে। নিউ
জলপাইগুড়ি থেকে দূরত্ব মিরিক হয়ে ৭৫ কিলোমিটার। ৬৯৬৫ ফুট উচ্চতার নির্জন নিরিবিলি
গ্রাম লেপচাজগৎ আজ ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে তার অপরূপ সৌন্দর্যের
জন্য। রাস্তায়
কিছুটা সূর্যের মুখ দেখতে পেলেও লেপচাজগৎ ঢুকতেই মেঘ কুয়াশার দল যেন আমাদের চারিদিক
থেকে ঘিরে ফেলল। শুনেছিলাম
লেপচাজগৎ নাকি মেঘ কুয়াশারই আবাসস্থল। এখন মনে হচ্ছে একদমই খাঁটি কথা। গ্রামের শুরুতেই বাঁ দিকে সলাখা হোম-স্টে,
তার ঠিক পাশেই আমাদের কাঞ্চনকন্যা হোম-স্টে। অবস্থানের দিক দিয়ে এক কথায় অনবদ্য। আশীষ আমাদের নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল
দার্জিলিং। আগামীকাল
আবার সকালে আসবে। আমাদের
সাইট-সিয়িং করাতে করাতে নামিয়ে দেবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। নিচের রিসেপশন থেকে হোম-স্টের মালিক
পাসাংজির কন্যা আরও কয়েকজনকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন আমাদের দেখে। তারপর কয়েকজনকে ডেকে আমাদের দুটো
ফ্যামিলির লাগেজগুলো তুলে দিলেন তিনতলার ছাদ সংলগ্ন দুটো ঘরে। আমরাও খাতায় বুকিং সংক্রান্ত সইসাবুদ
সেরে উঠে এলাম উপরে। পুরো হোম-স্টের এই দুটোই বেস্ট ঘর। পুরো হোম-স্টে কেন, সমস্ত লেপচাজগতের মধ্যেই এই
দুটো বেস্ট ঘর বললেও অত্যুক্তি হবে না। দারুণ সুন্দর ডেকরেশন, কার্পেট, গিজার, টিভি - কী নেই কাঠের অপূর্ব
কাজ করা ঘর দুটোতে। আর
সবথেকে যেটা প্লাস পয়েন্ট সেটা হল সামনেই খোলা ছাদ যেন আমাদের ডেক। সেখানে দাঁড়ালেই চারিদিকে শুধুই প্রকৃতির
অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়ে। কোনোরকমে ব্যাগপত্র ঘরে রেখে ক্যামেরা
হাতে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। যেদিকে চোখ যায় শুধুই ধাপে ধাপে দাঁড়িয়ে
আছে সারিবদ্ধভাবে পাইন, গুরাস গাছ। মেঘের দল উড়ে উড়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে
তাদের মাথা। কনকনে
ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে দাঁত কপাটি লাগবার জোগাড়। খিদে তেষ্টা ভুলে সবাই মিলে শুধু প্রকৃতিকে
লেন্স বন্দি করছি। বাঁদিকে
দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণি হুড়মুড় করে ঝাঁপ দিয়েছে অতলস্পর্শী খাদে। সেইদিকেই নাকি ওয়েদার পরিষ্কার থাকলে
সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার ১৮০° ভিউ পাওয়া যায় যা দেখতে পেলে নাকি জন্ম জন্মান্তরেও ভোলা
যাবে না। মেঘ
আর হাওয়ার দাপট ক্রমশ বাড়ছে। সত্যিই মেঘ যেন গাভীর মতো চরতে বেরিয়েছে। দলে দলে মেঘ উড়ে আসছে কোথা থেকে কে
জানে! দূরের পাইন গাছ, পাহাড়শ্রেণি তো দূরের কথা,
সামনে পিছনের হোম-স্টেগুলো পর্যন্ত ঢেকে গেছে মেঘে। সবুজে মোড়া লেপচাজগৎ এক কথায় প্রকৃতির
স্বর্গরাজ্য। সামনেই
দার্জিলিং পাহাড়। ওয়েদার
ক্লিয়ার থাকলে রাতের আলো ঝলমল দার্জিলিংয়ের রূপ এখান থেকে মনোমুগ্ধকর। আরও বাঁয়ে সিকিমও দৃশ্যমান। পাসাংজির কন্যা জানিয়ে গেল লাঞ্চ
রেডি। বেলা
দুটো বাজে। খিদেও
খুব পেয়েছে। নিচের
ডাইনিংয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি বসলাম। গরমাগরম খানা চলে এল বড়ো বড়ো বোলে। ধোঁয়া ওঠা রাইস, ভেজ ডাল, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফুলকপি, ডিমের কারি, চাটনি, পাঁপড় খিদের মুখে এককথায়
অমৃত। রান্নাও
দারুণ। খাওয়া
সেরে যখন ওপরে উঠে এলাম তখন চারিদিক মেঘ কুয়াশায় মাখামাখি। ঠান্ডাও তেমনি। একহাত দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, ফ্যামিলি
নিয়ে এসেছেন, যাবেন সান্দাকফু। আসলে অনেকেই এই লেপচাজগৎকে সান্দাকফুর
গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহার করেন। কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে বিকেলে একটু
বেরোলাম আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করতে। তবে দিন, বিকেল না রাত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
একাই নিচে নেমে যে পথে এসেছিলাম তার উলটোপথে হাঁটা শুরু
করলাম। দু’দিকেই
শুধু সারি সারি হোম-স্টে। কয়েকটি বেশ ভালোই। সামনে ছোটোখাটো কয়েকটি দোকান। আমাদের হোম-স্টের সামনেই একটা উঁচু
চত্বর আছে, সেটা মোটর স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁটতে হাঁটতে অভ্যাসমতো বেশ কিছু
ভালো হোম-স্টের ফোন নম্বর সামনে দেওয়া বোর্ড থেকে টুকে নিলাম।
মিনিট পাঁচেক মেঘের মধ্যে দিয়ে রাস্তায় হাঁটার পরই
লেপচাজগৎ শেষ হয়ে গেল। আসলে খুবই ছোট্ট জনপদ, তাও এখন পর্যটনের প্রসারে বেশ কিছু
হোম-স্টে গজিয়ে উঠেছে। খান তিরিশেক তো হবেই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। পাশ দিয়ে হুস হুস করে গাড়িগুলো বেরিয়ে
যাচ্ছে। কুয়াশা
মেঘে এক হাত দূরেরও কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার হয়ে আসছে। নির্জন রাস্তার চারিদিকে পাইনের জঙ্গল। বন্যপ্রাণী থাকাও বিচিত্র নয়। ডান দিকে একটা পাকদণ্ডি পথ পাহাড়ের
গা বেয়ে উঠে গেছে পাইনবনের মধ্য দিয়ে। শেষে রয়েছে দারুণ সুন্দর এক ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার
দর্শন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। আগামীকাল ভোরে এখানেই সানরাইজ দেখতে
আসব বলে ঠিক করলাম। বৃষ্টির
ফোঁটা বড়ো হতে শুরু করেছে। পা চালিয়ে চলে এলাম হোম-স্টেতে। ঘরে এসে বসতেই বেশ ভালোই বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেল। থাকব একদিন, তার মধ্যে যদি এরকম পরিস্থিতি
হয় তা হতাশা এনে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সন্ধ্যাবেলা দুটো ফ্যামিলি আড্ডায়
বসলাম বন্ধ ঘরে। সঙ্গে
চলে এল গরম গরম চা আর মোমো। আহা অমৃত! রাত বাড়ছে, ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি বাড়ছে, বাড়ছে ঠান্ডাও। নিচে গিয়ে দুর্দান্ত দেশি চিকেনসহ
রাতের ডিনার সেরে এসে সোজা দুটো করে মোটা কম্বলের তলায়। তাতেও ঠকঠকানি বিন্দুমাত্র কমছে না। এদিকে বাইরে তখন হাওয়ার দাপটে কান
পাতা দায়। সারাক্ষণ
শোঁ শোঁ শব্দ আর হোম-স্টের কাঠের বাড়িতে দড়াম দড়াম ধাক্কা। ঝন ঝন্ করে কোথায় যেন কাচ ভেঙে পড়ল। মাঝে মাঝেই এটা ওটা খুলে উড়ে যাবার
শব্দ। বৃষ্টি
আর ঝড়ের দাপটে দিশেহারা হয়ে মনে মনে ইষ্ট নাম জপ করতে করতে কম্বলের ওমে কখন যে ঘুমিয়ে
পড়েছি তার ঠিক নেই।
ঘুম ভাঙল ভোরেই। সানরাইজ দেখার আশায় বিছানায় শুয়েই
কাচের জানলার পর্দা সরিয়ে দিলাম। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। গত রাতের ঝঞ্ঝার চিহ্নমাত্র নেই বাইরে। যদিও আকাশ একেবারই সাফসুতরো নয় তবুও
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশায় সোয়েটার, চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে আমাদের ছাদের গ্যালারিতে চলে এলাম। একরাশ ঠান্ডা হাওয়া ভেতরটা কাঁপিয়ে
দিল। অদূরের
পাইনের সারিগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পুবের আকাশ বেশ ফরসা, তবে নিচের দিকে
হালকা মেঘ আছে। আরও
কয়েকজন বোর্ডার সানরাইজ দেখার জন্য উঠে এসেছেন ছাদে। আমাদের ওঠাউঠির কোনো ঝামেলাই নেই। ঘর সংলগ্ন ছাদটা যেন আমাদেরই সম্পত্তি। হোম-স্টের একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে ছাদ
ঝাঁট দিয়ে গতকালের ঝড়ের দাপটে ভেঙে ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা কাচ পরিষ্কার করছে। সূর্যের লাল আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে
পড়েছে পুব আকাশে। কিন্তু
তিনি কোথায়?
ফাঁকফোকর দিয়ে
কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। সেটা মেঘ না বরফশৃঙ্গ তাও ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। বাইনোকুলার লাগিয়েও কাজ হল না। শৃঙ্গ না মেঘ তাই নিয়ে তর্কটা চলতেই
থাকল। অগত্যা
হতাশ হয়ে পাসাং কন্যার দিয়ে যাওয়া ধোঁয়া ওঠা বেড-টিতে চুমুক দিলাম। শরীর মন চাঙ্গা হতেই আমি আর বন্ধু
অনুপম ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম ভিউ পয়েন্টের দিকে। সেই আগের দিনের রাস্তা ধরে পাইন বনের
দিকে এগিয়ে যাওয়া। বেশ ঠান্ডা নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশে। পাকা রাস্তা ছেড়ে বনের
পাকদণ্ডি পথ
বেয়ে উঠে এলাম ভিউ পয়েন্টে। এটাই লেপচাজগতের সব থেকে উঁচু স্থান। নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ আর বেশ কিছু
নাম না জানা পাখির ডাককে নস্যাৎ করে দিয়ে কানে আসছে বেশ কিছু পর্যটকের কলরব। সবাই দেখি ক্যামেরা তাক করে আকাশের
ফটো তুলছে। ভালো
করে তাকাতেই ঠাহর হল ওই তো সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার হালকা অবয়ব। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পটাপট শাটার টিপে
গেলাম, কিন্তু ডিসপ্লেতে মেঘ ছাড়া কিছুই ধরা পড়ল না। বুঝলাম ওনাকে ফ্রেমে ধরা DSLR-এর সাধারণ লেন্সের কম্মো নয়, টেলি-লেন্স দরকার। অগত্যা ক্যামেরা ছেড়ে মনের টেলি-লেন্সে
তুলতে লাগলাম তার ফটো। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে লজে ফিরে এলাম। আজ যে ফেরার দিন। আমরা ফিরে যাচ্ছি বলে বোধহয় প্রকৃতির
আজ খুব আনন্দ। তাই
সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে। পাইনের জঙ্গল, মেঘ কুয়াশার খুনসুটি উপভোগ করছি ছাদে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ জঙ্গলের কাছে বিদ্যুতগতিতে একটা
বিশাল কালো লোমশ প্রাণী লাফিয়ে রাস্তা ক্রস করে অন্য ধারে চলে গেল। পাসাংজিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম
ওটা একটা ব্ল্যাক প্যান্থার। এ জঙ্গলে ওর ডেরা আছে। শুনে প্রাণটা ভয়ে কেঁপে উঠল।
মালপত্র বাঁধাছাঁদা শেষ করে ব্রেকফাস্ট করতে না করতেই
আশীষের গাড়ির হর্ন শুনতে পেলাম। লেপচাজগৎকে বিষণ্ণ মনে বিদায় জানিয়ে
গাড়িতে চড়ে বসলাম।
আজকের প্রথম গন্তব্য জোড়পোখরি। লেপচাজগৎ ছেড়ে
কিছুটা এগিয়ে সুখিয়াপোখরি বাজার থেকে গাড়ি বাঁ-হাতি উঁচু পথ ধরল। দু’দিকে উঁচু উঁচু সরলবর্গীয় বৃক্ষের
মাঝখান দিয়ে নির্জন ঝিঁঝিঁ ডাকা রাস্তা। লেপচা থেকে দূরত্ব মাত্রই ৫ কিলোমিটার। জোড়পোখরি আসলে এক জোড়া ছোট্ট দারুণ
সুন্দর হ্রদ। পোখরি
মানে জলাশয়। লেকের
জলে রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিঃস্তব্ধ, নির্জন চারপাশ। এখনও পর্যটকের ভিড় একে গ্রাস করেনি। লেকদুটোকে এখন কংক্রিট দিয়ে সরকার
থেকে বাঁধিয়ে দিয়েছে আর পাশে বেঞ্চে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা। বিশাল একটা সাপের ফণা তোলা মডেল রয়েছে
জলের মধ্যে, আর আছে ফোয়ারা। ভাগ্য ভালো থাকলে লুপ্তপ্রায় হিমালয়ান
স্যালামান্ডার এই লেকে দেখতে পাওয়া যায়। লেকের পিছন দিকে ধূপি আর পাইন গাছের
জঙ্গল। আসলে
জায়গাটি সেঞ্চল অরণ্যের অন্তর্গত। ওয়েদার পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে
কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। আর অন্যদিকে দেখা যায় দার্জিলিং আর
কার্শিয়াংয়ের ল্যান্ডস্কেপ।
একরাশ মুগ্ধতা ফেলে রেখে আবার এগিয়ে চলা। সুখিয়াপোখরি থেকে পাহাড়ি রাস্তায়
কিছুটা এগোতেই এসে পড়লাম সীমানা ভিউ পয়েন্টে। সার দিয়ে রাস্তার ধারে পর্যটকদের
গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর পর্যটকরা ক্যামেরায় প্রকৃতিকে ফ্রেম বন্দি করছে। এ এক অদ্ভুত জায়গা। রাস্তার বাঁ-দিকে ভারত আর ডাইনে নেপাল। রাস্তাই তার সীমারেখা। নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া, নেই কোনো সীমান্তরক্ষী বাহিনীর
নজরদারি,
চোখ রাঙানি। ভারত আর নেপাল এখানে হাত ধরাধরি করে
অবস্থান করছে। বেশ
কিছু অস্থায়ী দোকান খুলে নেপালিরা বিক্রি করছে স্যুভেনির, মোমো, চা, কফি ইত্যাদি। একটু চায়ে গলা ভেজানো হল, সঙ্গে কিছু
কেনাকাটাও। সামনেই
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে ভ্যালি, তাতে বেশ কিছু নেপালি আর ভারতীয় গ্রাম দৃশ্যমান। তার পিছনেই পাহাড়ের প্রাচীর। এক দোকানি অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখালেন
মানেভঞ্জন,
টংলু, চিত্রে সহ সান্দাকফুর যাত্রাপথ। এই ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির
সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করতে করতে নেপাল আর ভারতের বেশ কিছুটা দেখা যায়। আর ওয়েদার ক্লিয়ার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার
অসামান্য রূপ। এবার
সত্যি সত্যি নেপালে ঢুকব বলে কিছুটা এগিয়েই
দাঁড়ালাম
বর্ডারে। চেকপোস্টে আই কার্ড দেখিয়ে হেঁটে
ওপারে নেপালের পশুপতিনগরে প্রবেশ করলাম। এটা নেপালের ইলম ডিস্ট্রিক্টে পড়ে। সার দিয়ে মারুতি ওমনি দাঁড়িয়ে আছে। ৪০০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া-আসা করায়
৪ কিলোমিটার দূরের মন্দির আর মার্কেট দেখানোর জন্য। যদিও এমন কিছু আহামরি দ্রষ্টব্য
নয়, তবে পাসপোর্ট, ভিসা
ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের এমন সহজ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় নাকি! অন্য দেশের মাটিতে ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা আর পশুপতিনাথের মন্দির
দর্শন করতে বেশ রোমাঞ্চই লাগছিল। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার ফিরে
এলাম দেশের মাটিতে।
এরপর মিরিকের উদ্দেশে যাত্রা। মাঝে অসাধারণ সুন্দর গোপালধারা টি
এস্টেটে যাত্রা বিরতি। বাগান থেকে চা খেয়ে ফ্রেশ চা কেনা হল। আবার মিরিকের পথে। দু’ধারে এখন শুধু মাইলের পর মাইল ঢেউ
খেলানো চা বাগান। এই
রাস্তাটার সৌন্দর্য বর্ণনা করা কোনও কলমের সাধ্য নয়। বার বার আসা যায় শুধু এই রাস্তার
টানে। তবে
মিরিককে আর ভালো লাগল না। ২৫ বছর আগেকার প্রথম দেখা সেই সুন্দরী মিরিক আজ সৌন্দর্যায়নের
ফাঁদে পড়ে তার নিজের সৌন্দর্য হারিয়েছে। সেই নির্জন মিরিক লেক আজ জনারণ্যের
ভিড় আর কোলাহলে যেন কলকাতার ইকোপার্ক। লেক সংলগ্ন পার্কেও সেই কৃত্রিমতার
ছোঁয়া। অদূরেই
হোটেল, লজ আর রেস্তোরাঁর ভিড়ে দম
যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কোনোরকমে লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির দিকে। মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙচুয়ারির
ভিতরের পথ ধরে আশীষ যখন এনজেপি স্টেশনে নামিয়ে দিল তখন সন্ধে প্রায় হব হব। এ ক’দিনের সাথী আশীষকে বিদায় জানাতে
গিয়ে চোখটা ছলছল করে উঠল। গাড়ি ঘুরিয়ে
আশীষ ফিরে যাওয়ার
পথ ধরল। ফিরে
যাবে ওই যে দূরের আকাশের বুকে ছেড়ে আসা সেই মেঘ পিয়নের দেশে, যেখানে আমাদের
মনটা ফেলে রেখে এসেছি।
বিদায় বন্ধু, আবার দেখা হবে হারিয়ে যাওয়া সেই মন
খুঁজতে গিয়ে না হয় কোনো একদিন।
----------
ফোটো - লেখক
No comments:
Post a Comment