গল্প:: সত্যিই কি বাঘ এসেছিল! - অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


সত্যিই কি বাঘ এসেছিল!
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

দীঘার সেই ঘটনার পরে পরেই সন্দেশ আর চমচমের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়েছিল প্রায় মাসখানেক দু’জনের সঙ্গে দু’জনের কোনো যোগাযোগ ছিল না কেবল স্কুলে যাওয়ার সময়টুকুতে যেটুকু কথাবার্তা, আলোচনাওইটুকুই চমচমের মা যেমনটা রেগে গিয়েছিলেন, শেষ অবধি সন্দেশের বাবা আর অনিমেষকাকু (লালবাজারের বড়ো গোয়েন্দা অফিসার), দু’জনে একসঙ্গে এসে চমচমের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা না বলা অবধি সন্দেশ বা চমচম কেউই কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিল না শেষমেশ দুর্গাপুজো কাটিয়ে লক্ষ্মীপুজোর আগের, আগের দিন দু’জনে তাদের মোবাইল ফেরত পেয়েছিল এমন কড়া শাস্তি দু’জনের কেউই আগে কখনও ভোগ করেনি হবে নাই বা কেন, দুই বন্ধুতে (বিশেষ করে সন্দেশ) যেমনটা দুঃসাহস দেখিয়ে রাজ্যপালের অনুষ্ঠানে হামলা করতে আসা জঙ্গি লোকগুলোকে ধরে ফেলেছিল, সে কথা শুনলে পরে যে কোনো মায়েরই রাগ বা চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক রহড়া ভবনাথ ইনস্টিটিউশনের ক্লাস টুয়েলভের এই দুই ছাত্রীর নাম সেদিন সোনার অক্ষরে খবরের কাগজে উঠেছিল কিন্তু কেবল দু-একটি পুরষ্কার অনুষ্ঠানে যাওয়া বাদে দু’জনকেই তাদের মায়েরা ঘাড় ধরে পড়তে বসিয়ে দিয়েছিলেন সেই কড়া শাসনের রাজত্ব শেষ হয়েছিল একেবারে হায়ার সেকেণ্ডারি পেরিয়ে তিনমাস ছুটিতে সন্দেশ আর চমচমের এই ছিল দ্বিতীয় অভিযান

[এখন, সন্দেশ আর চমচম যেখানেই যাক না কেন, একটা না একটা ঘটনা তারা ঠিকই ঘটিয়ে ফেলবে; আর আমিও চুপিসারে সেই সব গল্পগুলোকে জেনে ফেলি বলেই না এখানে-ওখানে সেই সব কীর্তিকলাপের বৃত্তান্ত ফাঁস করে বেড়াই এজন্য সন্দেশ আর চমচমের মায়েরাও আমার উপরে খুবই চটে রয়েছেন বলে শুনেছি এসব ব্যাপারে আমারও যে ভিতরে ভিতরে কোনো হাত রয়েছে, তাঁরা বোধহয় এমনটাই সন্দেহ করেন]

হায়ার সেকেণ্ডারির পর মাস তিনেকের বিশ্রাম যদিও কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলো মিটতে মিটতে আরও মাসখানেক গড়িয়ে যায় সময়টা মে মাসের মাঝামাঝি পরীক্ষার ফল বেরুতে তখনও সপ্তাহদুয়েক বাকি রয়েছে এমন সময় একদিন সন্দেশের বাবা এসেই সুখবরটা ওদেরকে দিলেন চমচমের বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই সেদিন হুঙ্কার ছেড়ে তিনি বলে উঠেছিলেন, “কই গো বউদি, কড়া করে এক কাপ চা বানাও তো দেখি! আর শুভময় কি এখনও অফিস থেকে ফেরেনি, তার কোনো সাড়া পাচ্ছিনে যে!” এই অবধি বলতে না বলতেই চমচমের মা-বাবা দু’জনেই তখন ব্যস্ত হয়ে উঠে দরজার কাছে ছুটে এসেছিলেন দরাজ এই মানুষটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতে এই দুই পরিবারের বন্ধুত্ব যে কখন সমস্ত গতানুগতিক নিয়মকানুন, ফর্ম্যালিটিকে ছাপিয়ে আন্তরিকের চেয়েও আন্তরিক হয়ে পড়েছে, টের পাওয়া যায়নি
গৌতমবাবু, সন্দেশের বাবার নাম, তিনিই প্রথম কথাটা পেড়ে বসলেন সেদিন, “আমার বন্ধু তনুময়, গ্র্যাজুয়েশনের পরে সে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়াতে অফিসার হিসেবে কাজ করতে করতে এখন বেশ অনেকটা উঁচু পোস্টে উঠেছে সেই অনেক করে ধরেছে আমায়, একবার তার কাছে যাওয়ার জন্য মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আশি কিলোমিটার মতো দূরত্বে একটা জায়গা রয়েছে, খয়েরওয়াড়া নাম সেখানে নাকি গোণ্ড আদিবাসী সভ্যতার নানারকম নিদর্শন পাওয়া গেছে এছাড়াও মনোলিথিক যুগের বেশ কিছু জীবাশ্ম ইত্যাদিও নাকি পাওয়া গেছে তনুময় এখন সেখানেই ক্যাম্প করে রয়েছে আমাকে অনেকবার করেই বলেছে, যখনই যেখানে ক্যাম্প হয়েছে সেখান থেকে ঘুরে আসার জন্য কখনোই আর সময় হয়ে ওঠেনি এবারে ভাবছি সন্দেশ আর আমি, বাপ-বেটিতে মিলে দু’জনে একবার ঘুরেই আসব খয়েরওয়াড়া থেকে ওকেও জানিয়ে দিয়েছি সে কথা মেয়েটারও একটু হাওয়া বদল হবে এখন...সন্দেশের বাবা চায়ের কাপটাকে টেবলের উপরে নামিয়ে রাখেন, একটু যেন ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতেই চমচমের মায়ের দিকে তাকান, “চমচমও যদি...চমচমের মাকে দেখে তখন আর কোনোকিছুই বোঝার উপায় নেই কনকনে শীতল একটা দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে আছেন চমচমের বাবাও কেমন যেন একটা ভয়ের নজরেই ঘরের আর দু’জনের দিকে তাকিয়েছেন, এক চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা তখন চমচমের মা শেষ অবধি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই ঘরে যেন একইসঙ্গে দুটো শ্বাস পড়ার একটা শব্দ শোনা গেল আরও বেশ একটু ভীতসন্ত্রস্ত ভঙ্গিতেই সন্দেশের বাবা তখন তাঁর ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা বড়ো খাম বের করে আনেন চমচমের বাবা এবারে আর হাসি চাপতে না পেরে সজোরে বলে ওঠেন, “যত ভয় তোমার বউদিকেই, এদিকে টিকিটটা অবধি কেটে নিয়ে এসেছ কিছু হলে তো সেই আমাকেই সামলাতে হতদুজনেই এবারে হো হো করে হেসে ওঠেন পরক্ষণেই চমচমের মায়ের কড়া দৃষ্টির দিকে নজর পড়তেই ঘরে আবারও নিস্তব্ধতা নেমে আসে চমচমও ততক্ষণে ভিডিও কলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সকালেই সন্দেশ টেক্সট মেসেজে ওকে সবকিছুই জানিয়ে দিয়েছিল কিনা, আনন্দ আর ওদের দেখে কে তখন!

নাগপুরে নামতে না নামতেই ঝরঝর করে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল তারপর থেকেই অবশ্য আকাশ পরিষ্কার সন্দেশের বাবার বন্ধু তনুময়কাকু নিজেই ওদেরকে নিতে স্টেশনে এসেছিলেন হাওড়া মুম্বাই গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস একেবারে সঠিক সময়েই ওদেরকে নাগপুর পৌঁছিয়ে দিয়েছে নাগপুর শহর থেকে খয়েরওয়াড়ার দূরত্ব কমবেশি আশি কিলোমিটার গাড়িতে যেতে যেতেই, দুঃসংবাদটা তনুময়কাকুর মুখ থেকেই প্রথম শোনা গেল সামনের সিট থেকে মুখ ঘুরিয়ে সন্দেশের বাবার দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠলেন, “আমিই বড়োমুখ করে মেয়েদুটোকে নিয়ে আসতে বললাম বটে - তবে এখন যা পরিস্থিতি, ক্যাম্পের আশেপাশে খুব বেশি দূর অবধি বোধহয় আর একা একা ঘুরে বেড়ানো যাবে না অবশ্য তোরা এলিই তো এই মাত্র কয়েকদিনের জন্য এতেই বা আর কতটুকুনিই ঘোরার সুযোগ হয়!”
তনুময়কাকুকে থামিয়ে দিয়ে সন্দেশের বাবা বলে ওঠেন, “কয়েকদিন মানে, কাল থেকে পাক্কা তিন দিন থাকছি এর বেশি আর ছুটি পাব নাকি? কিন্তু ক্যাম্পের আশেপাশে ছাড়া একা একা আর কোথাও ঘুরে বেড়ানো যাবে না কেন?” তিনি জিজ্ঞেস করেন
টাইগার,” এবার সন্দেশ আর চমচমের দিকে তাকিয়েই চোখ গোলগোল করে তনুময়কাকু বলে ওঠেন, “বাঘ বেরুনোর খবর পাওয়া গেছে!”
চমচম কথাটা শুনেই জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে সটান প্রায় চিৎকার করে উঠল, “এখানে বাঘ রয়েছে নাকি তনুময়কাকু! দারুণ ব্যাপার তো তাহলে!”
তনুময়কাকু হেসে জবাব দেন, “জায়গাটা মহারাষ্ট্র, একটু দূরেই পশ্চিমঘাট প্রতিবেশী রাজ্য বলতে মধ্যপ্রদেশ বাঘের আর দোষ কোথায়? জঙ্গলকে জঙ্গল আমরা কেটে সাফ করে দিচ্ছি তাই আশ্রয়ের খোঁজ পেতে তারাই বা আর যায় কোথায়
সন্দেশও চোখ বড়ো বড়ো করে কথাগুলোকে যেন গিলে নিচ্ছিল এবারে সন্দেশের বাবাই তনুময়কাকুর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “কিন্তু বাঘ এসেছে ব্যাপারে তোরা কি নিশ্চিত হতে পেরেছিস? কেউ দেখেছে নাকি সেই বাঘটাকে কোথাও?”
স্বচক্ষে এখনও কেউ দেখেনি ঠিকই, তবে প্রচুর পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, তারও সঙ্গে পাওয়া গেছে বিভিন্ন গাছের গুঁড়িতে, গাছের গোড়ায় ফেরোমনের অস্তিত্ব বাঘের ডাকও শুনেছে অনেকে কাজেই, সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে এবার এছাড়া আর কোনো উপায় নেই
সন্দেশ ঠিক এই সময়েই ফিসফিস করে চমচমকে জিজ্ঞেস করে, “এই ফেরোমন ব্যাপারটা কী ব্যাপার রে?”
চমচম একটু কায়দা করে তাকায়, “এজন্যই বলেছিলাম স্ট্যাটিসটিক্স না পড়ে বায়োলজি এ্যাডিশনাল নিতে প্রকৃতি, মানুষ, জীবজন্তু এদেরকে তো আর চিনলি না
আরও কিছু বলতে যেতেই চমচম কোঁক করে একটা অস্ফুট শব্দ করে চুপ করে যায় হঠাৎ সন্দেশ হাত ঝাড়ে জানালার দিকে তাকায় আবারও জিজ্ঞেস করে, “জানিস যদি তাহলে স্পষ্ট করে একটু বলেই ফেল না রে বাবা এত কথা কিসের!”
চমচম আগুনের দৃষ্টি হেনে আবারও বলতে শুরু করে, “এই ফেরোমন হল বাঘজাতীয় প্রাণীদের এলাকা চিহ্নিতকরণের উপায় রেচনপ্রক্রিয়ার সময়, রেচন মানে আমরা বাথরুমে যা করে থাকি, সেই সময় তারা বিশেষ একটি রাসায়নিক তরল পদার্থ এলাকার চারপাশে ছড়িয়ে দেয় প্রতিটি জানোয়ারেরই ফেরোমন-সিগনেচার আলাদা এই থেকেই তারা নিজেদের এলাকাকে চিহ্নিত করে দেয়, যাতে কিনা অন্য কোনো বাঘ বা জানোয়ার এসে সেই এলাকাতে দাদাগিরি না ফলায়
বুঝলাম,” সন্দেশ মাথা নাড়ে এবার, “তাহলে বাঘ যে সত্যিই এসেছে, তার বোধহয় এর চেয়ে বড়ো কোনো প্রমাণ হয় না
চমচম সায় দিয়ে জানালার দিকে তাকায়, তারপরেই অস্ফুটে চিৎকার করে ওঠে তনুময়কাকুও সেই শুনে পিছনের দিকে তাকিয়ে এইবারে বলে ওঠেন, “ঠিক ঠিক, ঘাটস শুরু হল এবার
ওরা এবারে পাকদণ্ডি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে অনেকদূর অবধি ঢেউখেলানো একের পর এক পাহাড়, আর ঘন সবুজ বন ঝকঝকে নীল আকাশ সাদা মেঘেরা সব দল বেঁধে ভেসে যাচ্ছে ভারী ভালো লাগছিল ওদের

তনুময়কাকুদের ক্যাম্পটা একটা ছোটো পাহাড়ের উপর টিলাই বলা চলে আশেপাশে খান সাত-আট তাঁবু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা রয়েছে জায়গাটা খয়েরওয়াড়া জনপদ থেকে কিছুটা দূরত্বে হাইওয়ে থেকে বাঁদিকে টিলার ঢাল বেয়ে উঠে যেতে হয় আশপাশে খুব ঘন না হলেও একটা জঙ্গুলে ভাব প্রচুর গাছ, একটু দূর থেকে ঘাসবন এখানে নাকি গোণ্ড আদিবাসীদের বহু প্রাচীন এক সমাধিক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ক্যাম্পে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেশ বেলা হয়ে গেল পথে একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে গরম গরম শিঙাড়া আর জিলিপি খাওয়া হয়েছিল, তাই সন্দেশ-চমচমের ততটা খিদে পায়নি অস্থায়ী কয়েকটা বায়ো-টয়লেটের ব্যবস্থা আছে, আর স্নানের জায়গাও রয়েছে তনুময়কাকু যথেষ্টই উপরের দিককার অফিসার বলে আয়োজনে কোনো খামতি নেই ঝটপট স্নান সেরে সকলে মিলে খেতে বসা হল এখানেই ওদের দেখা হয়ে গেল ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা সুরেশ পানসারের সঙ্গে তনুময়কাকুই আলাপ করিয়ে দিলেন, “ইনি সুরেশ পানসারে অর্নিথোলজিস্ট কনজার্ভেশনিস্ট আমরা ক্যাম্প করেছি শুনে উনিও এই চত্বরেই আস্তানা গেড়েছেন এখানকার পাখি আর কীটপতঙ্গদের নিয়ে উনি কিছু কিছু ডকুমেন্টেশন করতে আগ্রহী
সুরেশবাবু হাতজোড় করে সকলকে নমস্কার করেন, “আপলোগ ভি কলকাতা সে এসেছেন? আমি পাঁচসাল ওখানে ছিলাম, ইসি লিয়ে অল্প অল্প বাংলা বুঝতে পারি বলতে ভি কোশিশ করি!”
চমচম আর হাসি চাপতে না পেরে প্যাঁট করে টেবলের তলায় সন্দেশের হাঁটুতে একটা চিমটি কেটে দেয় মুখ লাল হয়ে ওঠে সন্দেশের সন্দেশের বাবা দরাজ গলায় সার্টিফিকেট দেন, “খুবই পরিষ্কার বাংলা তো মশাই আপনার এখানে এসেও এমন একজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি
তনুময়কাকুও হাসতে হাসতে চিকেনের বাটিটা আর সকলের দিকে এগিয়ে দেন, “খেয়ে দেখো দেখি এবার এখানকার মুরগির যা স্বাদ, একবার খেলে আর কলকাতা ফিরতে ইচ্ছে করবে না
চমচম সুড়ুত করে জিভের তলায় ঝোল টানে বোধহয়খেয়ে নিয়ে সকলে একটু বিশ্রাম করে নিও রোদটা একটু পড়লে পরে না হয় তোমাদেরকে ঝোরার কাছে নিয়ে যাব,” তনুময়কাকু ভাত ভাঙতে ভাঙতে বলেন, “আপনার কোনদিকে যাওয়ার মতলব মশাই আজ?”
সুরেশবাবু এবারে স্পষ্ট হিন্দিতে জবাব দেন, “আজ তেমন কাজ নেই আমার আপনাদের সঙ্গেই না হয় বেরুব কিন্তু এই বাঘের খবরটা তো রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছে
তা যা বলেছেন, দেখাই যাক কী হয় এবার,” তনুময়কাকু গ্রাস মুখে পোরেন সকলেই খাবারে মন দেয় মুরগির স্বাদ সত্যিই অতুলনীয় খোলা আকাশের নিচে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে চারপাশে এখন কেবল খাওয়ার শব্দ সন্দেশের মন ততক্ষণে ঝরনার কাছে চলে গিয়েছে

ঝরনা বলতে ছোটোই মেরেকেটে তিরিশ ফুট হবে বোধহয় কিন্তু চারপাশ ঘিরে বেশ ঘন জঙ্গল সবুজ গাছ আর কালো পাথরের ব্যাকড্রপে দিব্যি একটা গা ছমছমে অনুভূতি ঝরনার কাছটায় অবশ্য গাছপালা কমে এসেছে ওরা পাঁচজন, সন্দেশ-চমচম, সন্দেশের বাবা আর তনুময়কাকু, তারও সঙ্গে সুরেশ পানসারে, এঁরা ক’জনে মিলে সেই ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ান
জায়গাটা আহামরি কিছু নয় হয়তো, কিন্তু একটা অদ্ভুত শান্তি আছে বসে বসে কান পেতে শুনলে পরে ঝরনার আওয়াজেই দিব্যি সময় কেটে যায়,” তনুময়কাকু বলেন, “আমি তো এতদিন একা একাই চলে আসতাম এখানে মাঝে মাঝে এখন আর কতদিন সেটা পারব বোঝা যাচ্ছে না
সন্দেশের বাবা জিজ্ঞেস করেন, “বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছে বলছিলিস, সে কি এই চত্বরেই?”
ক্যাম্প থেকে একটু দূরে, একটা আদিবাসী গ্রাম আছে, তার চারপাশেই গ্রামের লোকজন বেশ ভয় পেয়ে গেছে সুরেশবাবুই আবার সেখানকার গাছপালা থেকে ওই ফেরোমন কালেকশন করেছেন তারপর থেকেই ভয়টা আরও চেপে বসেছে
তাই নাকি, আপনি তো অনেক কিছু জানেন তাহলে মশাই,” সন্দেশের বাবা সপ্রশংস দৃষ্টিতে সুরেশবাবুর দিকে তাকান, “কিন্তু তাহলে কি এভাবে আমাদের এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোটা ঠিক হচ্ছে?”
সুরেশবাবুই এবারে জবাব দেন, “ বাঘ ক্যাম্পের দিকে বিশেষ আসে না গৌতমবাবু মেনলি আদিবাসী গ্রামটাই বোধহয় টার্গেট করতে চাইছে, গরুছাগল এই সবের জন্য শিকার করবে আর এই ক্যাম্প তো দু’দিন পরে এমনিই উঠে যাবে বাঘেরা খুবই বুদ্ধিমান হয়, ইন্টেলিজেন্ট এ্যানিমাল!”
সন্দেশের বাবা মাথা নেড়ে সায় দিলেন ততক্ষণে চমচম আর সন্দেশ হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ঝরনাটার মাথায় গিয়ে পৌঁছেছে তনুময়কাকু চিৎকার করে ওঠেন, “আর বেশি এগিও না তোমরা পাথর কিন্তু পিছল খুবসেইসময়েই ওরা দু’জন লোকটাকে দেখল

পরনে হাঁটুর উপরে তোলা একটা ময়লা ধুতি আর ফাটা গেঞ্জি কালো পাথরের মতোই গায়ের রং, ঝরনার গায়ে যেন মিলিয়েই বসেছিল এতক্ষণ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা মাথার চুল কোঁকড়ানো, একটু কুতকুতে দুটো চোখ চমচম আরেকটু হলেই চিৎকার করে ফেলত লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে, মুখে একটা বিরক্তিমিশ্রিত প্রশ্নের ভাব কিছু বলতে যাচ্ছিল বোধহয়, কিন্তু তার আগেই তনুময়কাকুরা উঠে আসেনকী ব্যাপার শিবম! তুমি এখানে,” তনুময়কাকুর গলায় রাগের সুর, “অমন করে লুকিয়ে বসে আছ কেন!”
লোকটা সকলের দিকে এগিয়ে আসে গলায় একটা পাথরের আর একটা হাড়ের মালা ঝুলছে অস্ফুট ভাঙা ভাঙা মারাঠিতে কিছু একটা বলে তনুময়কাকু কতটা বুঝলেন সেটা বোঝা গেল না কড়া গলায় তিনি বলে ওঠেন, “এখন এখান থেকে যাও জানো না এই চত্বরে বাঘের আনাগোনার খবর শোনা যাচ্ছে!”
এইটা শুনেই লোকটা আবারও যেন বিড়বিড় করে কী বলে উঠল সন্দেশ লক্ষ করল সুরেশ পানসারের মুখটাও কেমন যেন এক অজানা বিরক্তিতে কুঁচকিয়ে উঠেছে যদিও তিনি কিছু বলবার আগেই তনুময়কাকুই আবারও ধমক দিয়ে ওঠেন, “বিড়বিড় করছ কেন? কিছু বলার থাকলে কাল সকালে ক্যাম্পে এসে বোলো যাও এখন!”
লোকটা মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে চলে যায় এবার সন্দেশের বাবা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন, “কে রে লোকটা তনুময়?”
আরে কেউই না,” তনুময়কাকু বিরক্তি ভরে জবাব দেন, “ওই যে আদিবাসী গ্রামটার কথা বলছিলাম না তখন, ওরই ওঝা বলতে পারিস উইচ ডক্টর টাইপ নেশার দোষ আছে তাই ভাগিয়ে দিলাম তাড়াতাড়ি ওর বাবাও নাকি ওঝা ছিল তার হাতযশেরও খবর শুনেছি কিন্তু নেশা আর বদমেজাজের জন্য শিবমকে ওর গাঁয়ের লোকেরাও একটু সমঝিয়ে চলে
সন্দেশ আর চমচম তখনও লোকটার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়েছিল কিছু কি বলতে চাইছিল সে? বাঘটার বিষয়?

রাত্তিরে চমচমের ঘুম আসছিল না নতুন জায়গাতে এলে পরে এই এক সমস্যা হয় তার পাশে তাকিয়ে দেখল অকাতরে ঘুমোচ্ছে সন্দেশ চমচম তাঁবুর দরজাটার দিকে তাকাল পাশের তাঁবুতেই সন্দেশের বাবা আর তনুময়কাকুর থাকার ব্যবস্থা তার থেকে এতক্ষণ গল্পের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল এখন সব চুপ চমচম বিছানার উপরে উঠে বসল একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এখানে দরজাটা খুলে একবার কি সে বাইরেটায় গিয়ে দাঁড়াবে? মনে মনে ভাবছিল চমচম শেষমেশ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠেই পড়ল চমচম দরজা খুলে একটু মুখ বের করতে যেতেই সে দেখল ওপাশে একটা আগুনের ধুনি-মতো জ্বলছে কোনো তাঁবু থেকেই কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তনুময়কাকু বলেছিলেন বাঘ একবার বেরুলে পরে একটা রাতপাহারার ব্যবস্থা করতে হবে সে ব্যবস্থা এখনও হয়নি বোঝা যাচ্ছে কিন্তু হঠাৎ চমচমের নজর পড়ল একটা অবয়বের উপর ভীষণ চেনা লাগছে আরও একটা অচেনা অবয়ব অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে এসেছে খানিক দূর বলে স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না দু’জনে কিছু কথা বলছে অচেনা অবয়বটা চলে যাচ্ছে এবার অন্ধকার মিলিয়ে গেল চমচম নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে চেনা লোকটিও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কোথায় সন্দেশকে ডাকবে? একটু ভেবে চমচম ঠিক করল কাল সকালেই ঘটনাটা সন্দেশকে বলবে না হয় দু’জনে মিলে একটা মতলব কষতে হবে কে এই অচেনা ব্যক্তি যে এই মাঝরাত্তিরে ক্যাম্পের ভিতরে আসে? কিন্তু ভোর হওয়ার বেশ কিছু আগেই কানফাটানো বাঘের গর্জনে সকলের ঘুম ভেঙে গেল! সত্যিই কি তাহলে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে?

সেই ঝরনার তলাতেই মুখ থুবড়ে দেহটা পড়েছিল উঁচু থেকে পড়ার জন্য থেঁতলে, গুঁড়িয়ে গিয়েছে সন্দেশ আর চমচম একবার দেখেই পিছন দিকে সরে এল এই দৃশ্য দেখা যায় না আদিবাসী গ্রাম থেকেও কয়েকজন মানুষ, কয়েকটা ছোটো বাচ্চা এসে দাঁড়িয়েছে তনুময়কাকু বললেন, “পুলিশ এল বলে তাহলেই জানা যাবে কীভাবে মৃত্যু একে তো নেশাড়ু লোক, তারপর ওই বাঘের ডাকেই হয়তো...
সুরেশ পানসারে ঘাড় নাড়েন, “তাই তো মনে হচ্ছে
শিবমের দেহটা দেখে আর মনেই হচ্ছিল না যে কাল রাতেও লোকটা এই চত্বরে এসে কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সকলের সঙ্গে কথা বলেছিল হোক না নেশাগ্রস্ত, তবুও তো মানুষ দুই বন্ধুতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল আদিবাসী লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল চমচম ওদের মুখগুলো দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই ভাবলেশহীন একেকটা চোখ, মুখ, অবয়ব পরিবেশটা ভারী হয়ে এসেছে তারই মধ্যে একটা লোকের দিকে নজর পড়ল চমচমের সঙ্গে একটা ছোটো বাচ্চা, হাঁটুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো সে সন্দেশকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকল না সন্দেশকে এখনও কাল রাতের ঘটনাটা বলা হয়নি এই সময়েই জঙ্গলের পথ বেয়ে একজন পুলিশ অফিসার, আরও কয়েকজন কনস্টেবলকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল তনুময়বাবুকে এখন এইখানেই থাকতে হবে সুরেশ পানসারেও থেকে গেলেন সন্দেশরা তিনজন ক্যাম্পে ফিরে এল

একটা বড়ো পাথরের উপর ওরা বসেছিল ক্যাম্পের চৌহদ্দির ঠিক পাশেই ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাওয়া এখন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ডাক্তার যা বলেছে, তার থেকে বোঝা যাচ্ছে শিবমের মৃত্যু হয়েছে ওই বাঘ ডেকে ওঠার সময়ের আশেপাশেই কাজেই বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে আর প্রশ্ন তোলা চলে না আদিবাসীরাও নাকি ভয় পেয়ে গিয়েছে এই পাথরের উপর বসে বসেই চমচম সন্দেশকে গত রাত্তিরের ঘটনাটা বলল সন্দেশেরও ভুরু কুঁচকিয়ে উঠল তখন
তুই ঠিক দেখেছিলিস?” সে জিজ্ঞেস করে
হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট, স্যাঙ্গুইন!” জবাব দেয় চমচম
ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হচ্ছে তো তাহলে আজ রাত্তিরেও কি লোকটা আসবে বলে মনে হয়?” সন্দেশ জিজ্ঞেস করে
তাহলে তো জেগে থাকতে হয়,” চমচম বলে, “অবশ্য আজ রাত্তিরে তো ক্যাম্পে পাহারা বসবে আজকেই আর লোকটা আসবে বলে মনে হয় না তাহলেও জেগে থাকা দরকার
সন্দেশ মাথা নাড়ে এই সময়েই ওরা ছেলেটাকে দেখতে পায় সেই বাচ্চাটা যার উপর সকালে চমচমেরও নজর পড়েছিল একটু দূরে এসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে
সন্দেশ হাত নেড়ে ডাকে, “এই, ইধার আও না কেয়া মাংতা?”
ছেলেটা নড়ে না
মেরে পাস চকলেট হ্যায়
ছেলেটার কোনো ভাবান্তর হয় না একটু পরে জিজ্ঞেস করে, “বডি কব আয়েগা? শিবমচাচা কা বডি?”
ওরা একে অপরের দিকে তাকায় সন্দেশ বলে, “হামলোগোঁ কে পাস তো কোই খবর নহি হ্যায় ইসি বারেমে তুম একবার ক্যাম্প কে অন্দর যাকে কিসি সে পুছ লো
ছেলেটা নড়ে না বিড়বিড় করে কী যেন বলে চমচম এবারে জিজ্ঞেস করে, “তুম বহৌৎ পিয়ার করতে থে, শিবম চাচা কো?”
ছেলেটা ঘাড় নাড়েবহৌৎ শিবম চাচা নে মুঝে জঙ্গল কে হর বাত বতাতে থে পেড় কে বারে মে, শের কে বারে মে, ভালু কে বারে মে বহৌৎ সারে বাত
বেশ বোঝা যায় ছেলেটা শিবমের মৃত্যুতে বড়ো ধাক্কা খেয়েছে আরও অনেক কথা বলে ছেলেটা শিবম ওকে জঙ্গলের গাছ চিনতে শিখিয়েছিল মাটি চিনতে শিখিয়েছিল এমনকি জানোয়ারদের পায়ের ছাপ চিনতে শিখিয়েছিল এসব নাকি শিবমেরও, ওর বাবার থেকে শেখা এখন তো ওদের গ্রামে আর কেউই জঙ্গলে যায় না সবাই কেবল দূরে দূরে জনমজুরি খেটে বেড়ায় জঙ্গল থেকে আদিবাসীরা এখন সরে এসেছে বাঘের ভয় আরও বাড়লে ওরা নাকি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবে ছেলেটা বলে ওদের গ্রামের বড়োরা নাকি নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা করেছে সন্দেশ আর চমচমের মনটা আরও ভারী হয়ে আসে সূর্য ডুবে এসেছে ক্যাম্পের ভিতর থেকে সন্দেশের বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, “এবারে সব ভিতরে চলে এসো তোমরা সন্ধে হয়ে গেছে
ওরা বাচ্চাটাকে হাত নেড়ে বিদায় দেয় চমচম এগিয়ে আসে সন্দেশ আবার তখন কি মনে করে যেন ছুট্টে গিয়ে বাচ্চাটার হাতে জোর করে একটা চকলেট গুঁজে দেয় আকাশটা গাঢ় নীল অনেক দূরের জঙ্গলে ইতিমধ্যেই ছায়া নেমে আসতে শুরু করেছে অজানা দেশ, আরওই আশ্চর্য তার রূপ, কিন্তু তারই মধ্যে গাঢ় অন্ধকার ওরা দু’জনে তাঁবুর দিকে পা বাড়ায়

রাত্তিরে খেতে যাওয়ার একটু আগেই হঠাৎ বসে বসে ফোনে নেট ঘাঁটছিল চমচম তখনই খবরটা নজরে পড়ল তার সন্দেশকে দেখাতেই তারও চক্ষু চড়কগাছ রহস্যের পরে রহস্য যে বেড়েই চলেছেতুই এখানেই থাক, আমি এখনই আসছি একবার,” চমচমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সন্দেশ ছুটে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায় মিনিট দশেক পরেই ফিরে আসে আবারঅনিমেষকাকুকেও ফোনে পেয়ে গেলাম তাই আর অসুবিধে হল না নয়তো এই গ্রামদেশের পুলিশকে বোঝানো কি চাট্টিখানি কথা,” সন্দেশ এবারে ধপ করে বসে পড়ে, “রাত জাগতে হবে কিন্তু, সে খেয়াল আছে তো?” চমচম মাথা নাড়ে বাঘের রহস্য ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে
সেই রাত্তিরেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লোকটা আজও এসেছে সন্দেশ চমচম দু’জনেই তাঁবুর ফাঁক দিয়ে অবাক হয়ে তাকায় কোনো কারণে আজও ক্যাম্পে পাহারা শুরু করা যায়নি ফিসফিস করে দু’জনে কীসব যেন কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে চেনা আর অচেনা দুটি অবয়ব এই সময়ে সন্দেশও চমচমের কাঁধে হাত রাখে ফিসফিস করে বলে, “একটু নজর রাখ লোকদুটোর ওপর আমি এখুনি আসছিচমচমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে যায় চমচমের বিরক্ত লাগে এবার এত সাহস দেখানোরই বা কী প্রয়োজন ছিল? লোকদুটো এখনও কথা বলছে প্রথম লোকটাকে বেশ উৎসাহিত মনে হয় সময় চলে যাচ্ছে এই সময় খুট করে একটা আওয়াজ হতেই লোকদুটো সচেতন হয়ে ওঠে ওরা ফিরে যাচ্ছে চমচম ঠোঁট কামড়ে সন্দেশের জন্য অপেক্ষা করে লোকদুটোকে আর দেখা যাচ্ছে না ওই তো সন্দেশ! যাক এতক্ষণে একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস পড়ে চমচমের

সকাল রাত কেটে গিয়ে আলো ফুটলেই চারদিকটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায় অনেকটা স্নিগ্ধতা, অনেকটা সাহস ফিরে আসতে শুরু করে তবুও, রাতও যে মায়াবী তাঁবুর দরজা খুলতেই বিস্তীর্ণ একটা মাঠ তার ওপাশ থেকেই শুরু হচ্ছে জঙ্গল বেড়ানোর জন্য, বা ক্যাম্প করে থাকার জন্যও কতখানি সুন্দর এই জায়গাটা চমচম মনে মনে ভাবছিল সন্দেশ দু’হাতে দুটো চায়ের মাগ নিয়ে এগিয়ে আসে পাথরের উপর ওরা বসেছে
মানুষের লোভ কী অদ্ভুত তাই না সব কিছু থেকেও মানুষ কেবলই প্রকৃতিকে লুঠ করতে চায়, অন্য মানুষের ক্ষতি করতে চায়,চমচম বলে ওঠে হঠাৎ,আর সেটা করেও কেমন নির্লজ্জভাবে, সকলের সামনে, বোকার মতো নিজের এবং অপরের সর্বনাশকে ডেকে আনতে চায়
সন্দেশের বাবাও উঠে পড়েছেনকী খবর,” চায়ের কাপ নিয়ে তিনিও মেয়েদের দিকে এগিয়ে আসেন, “মন খারাপ বুঝি তোমাদের? এবারের বেড়ানোটা আর তেমন জমল না বলো?”
দু’জনেই অল্প করে মাথা নাড়েআর কী বলব বলো দিকিনি কালকেই আমাদের ফেরার ট্রেন ফেরার পথে না হয় পথে একটা নদী পড়বে তার উপরে একটা ছোট্ট সুন্দর ড্যাম রয়েছে সেটাই দেখিয়ে নিয়ে যাব তোমাদের তনুময় বলছিল গতকালএকটু দূরে পাথরের উপর নাম না জানা একটা ছোট্ট সুন্দর পাখি এসে বসেছে সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ

দুপুরে জম্পেশ করে মুরগির ঝোল আর ভাত খাওয়া হল এখানকার যে রাঁধুনি, তার রান্নার হাত সত্যিই চমৎকার বেড়ানোটা মাঠে মারা গেলেও অন্তত খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে কিছু কমতি হয়নি দুপুরের খাওয়া শেষ হলে পরে সন্দেশ আর চমচম দু’জনেই ক্যাম্পের ঠিক বাইরেটায় সেই পাথরটার উপর বসে গল্প করছিল মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল সন্দেশ সময় কেটে যাচ্ছে দু’জনেরই টেনশন বাড়ছে খুব সুরেশ পানসারে দুপরের খাওয়াদাওয়ার ঠিক পরে পরেই একটু হাঁটতে বেরোন আজ বেরোননি তিনিও তাঁবুতেই রয়েছেন সাড়ে চারটে নাগাদ একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল পুলিশের জিপ ওরা দু’জনেই পাথরের উপর থেকে নেমে দাঁড়ায় জিপটা ওদের সামনে এসে পড়েছে তিনজন কনস্টেবল আর একজন উচ্চপদস্থ অফিসার জিপ থেকে নেমে এলেন সুঠাম চেহারার সেই অফিসারটি ওদের সামনে জিপের দরজা খুলে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নেমে এসেই, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অবাক করে দিয়ে ঝরঝরে বাংলাতে পরিষ্কার উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলেন, “এই তো! তোমরাই কি তাহলে সেই বিখ্যাত সন্দেশ আর চমচম? কলকাতার গোয়েন্দা দপ্তর থেকে যাদের কথা আমাকে আজই সকালে জানানো হল?”
ওরা দু’জনেই ঢোঁক গিলে ঘাড় নাড়ে অনিমেষকাকু যে মাঝে মাঝে ওদের প্রেস্টিজটা এমনভাবে সকলের সামনে খানখান করে দেনআমার নাম রাজর্ষি রায় এখানকার ডিএসপি সে যা হোক, আর সকলে কোথায় সব? ডাকা হোক তাদের,” পুলিশ অফিসারটি দাপটের সঙ্গে বলেনদু’জন তোমরা এখানে থাকো কেউ যেন ক্যাম্প থেকে বেরুতে না পারে, আর তুমি আমার সঙ্গে এস,” তিন কনস্টেবলের কাছেও নির্দেশ চলে যায় এদিকে আওয়াজ শুনে তনুময়কাকুও তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন পিছন পিছন সন্দেশের বাবা, আর ওদিক থেকে সুরেশ পানসারেসবাই

একটা টেবল পেতে সকলে বসেছেশুরুটা আমিই করি,” রাজর্ষি রায় বলেন, “সন্দেহটা যে আমাদেরও একেবারে হয়নি এমনটা নয় এতদিন ধরে যে বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছে, ফেরোমন ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে, অথচ বাঘের দেখা নেই এরকমটা হয় কী করে? সেই সন্দেহটা অনেকদিন ধরেই আমাদের অবচেতনে ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা বনদপ্তরের আওতাতে পড়ে আর সেরকম কোনো এ্যাণ্ড অর্ডার সিচুয়েশনেরও কোনো খবর আমাদের কাছে ছিল না, আমরাও তাই আর গা করিনি ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু মুশকিল হলো এই শিবমের খুনের পরে পরেই
সকলে অবাক হয়ে রাজর্ষির দিকে তাকায়হ্যাঁ শিবমের ব্যাপারটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা নয় ওকে খুনই করা হয়েছে একটা সহজ ব্যাপার থেকেই সেটা পরিষ্কার, শিবম জঙ্গলে ঘোরাফেরা করা মানুষ যতই নেশাগ্রস্ত হোক না কেন, জঙ্গলকে শিবম হাতের তালুর মতো চিনত বাঘের ডাক শুনে সেই বাঘ কোনদিকে, কতদূরে আছে, বয়স্ক না অল্পবয়সিএই সবকিছুই সে বলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত কাজেই সামান্য একটা বাঘের ডাক শুনে সে পা হড়কে পড়ে যাবে এমন ভাবাটা একটু অস্বাভাবিক তাহলে কি সে এই বাঘের ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলেছিল? কাউকে কি সে কিছু বলতে গিয়েছিল? সেই কি তাকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে? এই সন্দেহটাই আসা স্বাভাবিক কিন্তু এখানকার স্থানীয় ডাক্তারও রিপোর্ট দিয়ে দিলেন ভয় পেয়ে বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পা হড়কে মৃত্যু একটা গাঁ-খেপানো ওঝার জন্য আজকের দিনে আর কেই বা সময় নষ্ট করতে চায় বলুন? তার উপরে যদি সামান্য কাঞ্চনদক্ষিণারও সম্ভাবনা থাকে? কি মিস্টার পানসারে, আমি ঠিক বলছি তো?” রাজর্ষি হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন
সুরেশ পানসারে চমকিয়ে ওঠেন, “আমি, আমি এর মধ্যে কী করে আসছি মিস্টার রায়? আমি তো একজন সামান্য পক্ষীবিদ, সামান্য...
থামুন,” রাজর্ষি রায় এক দাবড়ানিতে তাঁকে থামিয়ে দেন, “খুনের আগের দিন বিকেলে আপনাকে, আপনাদেরকে ভাঙা ভাঙা গোণ্ড আর মারাঠি মিশিয়ে কী বলতে চেয়েছিল শিবম? কেনই বা আপনি সেই সব শুনে বিরক্ত হয়েছিলেন? আদিবাসী বিলাসকেই বা আপনি জঙ্গলে টেপরেকর্ডার রেখে এসে কী বাজাতে হুকুম দিয়েছিলেন? আপনার সব রহস্য ধরা পড়ে গিয়েছে মিস্টার পানসারে, আর সেটা ধরা পড়েছে এই বাচ্চা মেয়ে দুটির বুদ্ধির ব্যবহারেই
এইসময়েই চমচম লক্ষ করে সন্দেশ কখন যেন ওর পাশ থেকে উঠে গিয়েছে রাজর্ষি রায় বলে চলেন, “আদিবাসী বিলাস এখন আমাদের হেফাজতে স্বীকার করেছে যে আপনিই ওকে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গিয়ে টেপরেকর্ডারে বাঘের ডাক বাজিয়ে শোনাতে বলতেন এও স্বীকার করেছে যে শিবমের খুনের রাত্তিরে আপনিই ওকে বলেছিলেন শিবমের উপর নজর রাখতে, এবং ভোররাত্তিরে নেশা কেটে গেলে পরে শিবম যখন জঙ্গলে বেড়াতে যায় সেই সময় আপনাকে খবর দিতে আপনিই শিবমকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে ঝরনার উপর থেকে ফেলে দেন বিলাসও সেই সময় আপনার সঙ্গেই ছিল বিলাসের বাড়ি থেকে আমরা বাঘের নকল পায়ের ছাপ বসানো দুটি ছাঁচকেও উদ্ধার করেছি, আর খুব সম্ভবত,” রাজর্ষি একটু থামেন, “ফেরোমনের চোরাই শিশিটাও আপনারই তাঁবু থেকে পাওয়া যাবে,” তিনি সুরেশ পানসারের দিকে তাকান
কীসের চোরাই ফেরোমন! কীসের,” সুরেশ প্রায় চিৎকার করে ওঠেন
ওই যে, নাসিকের রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে গত মাসে আপনি যে শিশিটা চুরি করেছিলেন ভাগ্যিস চমচম,” রাজর্ষি তার দিকে তাকান, “গুগল ঘাঁটতে ঘাঁটতে নাসিকের জুলজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে এই অদ্ভুত চুরির খবরটা পড়ে ফেলেছিল আর সন্দেশ-চমচম দুইজনে মিলে দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে চেষ্টা করেছিল চমচম অবশ্য তার আগেই রাত্তিরে আপনাকে আর বিলাসকে কথা বলতে দেখে ফেলে; তাই ওদের সন্দেহটা খুব সহজেই আপনার উপরে গিয়ে পড়েছিল আই মাস্ট সে, ওদের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা আমাকে অবাক করে দিয়েছে
কিন্তু কেনই বা আমি হঠাৎ শিবমকে খুন করতে যাব, হোয়াই?” সুরেশ পানসারের চোখদুটো লাল হয়ে উঠে কেমন যেন পাগলের মতো দেখাচ্ছে
সেটা আপনিই বলুন না হয় মিস্টার পানসারে সেদিন বিকেলে শিবম আপনাকে ঠিক কী বলতে চেষ্টা করেছিল? আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন তনুময়বাবু?” রাজর্ষি তনুময়ের দিকে তাকান
তনুময় দু’পাশে মাথা নাড়েন, “উঁহু, আমি কি আর মারাঠি বুঝব নাকি মশাই!”
এখানেও সন্দেশেরই জিত, ছোটোবেলায় সামান্য কিছুদিন মহারাষ্ট্রে কাটিয়েছিলেন আপনারা, তাই না মিস্টার?” রাজর্ষি এবারে সন্দেশের বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন
সন্দেশের বাবা চমকিয়ে উঠে উত্তর দেন, “দাশ, মিস্টার দাশ হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অনেক ছোটোবেলায় এখনও -”
এখনও যে দু-চারটি মারাঠি কথা সন্দেশের মনে আছে তার মধ্যে একটির অর্থ হল জাল বা নকল সেদিন শিবমের মুখে এই কথাটিই শুনে ফেলেছিল সে, আর শুনেছিল শের বা বাঘের বিষয় উল্লেখ এরপরই শিবমের হত্যা, রাত্তিরে চমচমের মাধ্যমে বিলাস আর সুরেশের কথোপকথনকে দেখে ফেলা আর সবশেষে,” রাজর্ষি বিষাদগ্রস্ত একটা হাসি হাসেন, “বিলাসেরই ছেলের মাধ্যমে শিবমের অরণ্যপ্রেম অরণ্য-জ্ঞানের বিষয়ে অবহিত হওয়া, এই সবকিছুকেই একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিল ওরা দু’জন যেটুকু সামান্য ফেরোমন আপনি কালেক্ট করে এখানকার বনদপ্তরকে দিয়েছিলেন, নাসিকের ল্যাবরেটরিতে ওরা মিলিয়ে দেখেছে ওদের চুরি যাওয়া স্যাম্পলের সঙ্গে সেটা হুবহু মিলে গিয়েছে কী করে যে শিবম সেটা ধরতে পেরেছিল এই রহস্যটাই অন্তিম হয়ে থেকে যাবে বোধহয়,” রাজর্ষি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন
কিন্তু কেন? কেনই বা আমি এসব করতে যাব?” এখনও সুরেশ পানসারে হাল ছাড়তে রাজি নন বোঝা যাচ্ছে কিন্তু তাঁর ভীতসন্ত্রস্ত চোখদুটো কেবলই চারপাশে ঘুরে চলেছে পালাবার পথ খুঁজে চলেছে
উত্তরটা আমি দিচ্ছি,” মৃদুস্বরে চমচম বলে ওঠে এবার, “আজ সকালেই ইন্টারনেটে কাগজ পড়তে পড়তে দেখছিলাম এই খয়েরওয়াড়া অঞ্চলেই নাকি মাটির তলায় প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ আর বক্সাইটের হদিস পাওয়া গেছে বিরাট এক বহুজাতিক কোম্পানি সেই কারণে এই অঞ্চলে খনন চালাতে বদ্ধপরিকর কিন্তু স্থানীয় আদিবাসী গ্রামগুলিই এই লাগামছাড়া খননের পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদেরকে কোনোভাবে ভয় দেখিয়ে অথবা টাকার লোভ দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়াটাই এখন সেই কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে এদিকে আপনার পাখি দেখার প্রজেক্টটাও তো তারাই স্পনসর করেছে বলে মনে হয় মিস্টার পানসারে আপনার তাঁবুর উপরেও তো তাদেরই লোগো লাগানো এই কথা অস্বীকার করতে পারেন?”
এইসব কিছুর মধ্যেই সুরেশ পানসারে হঠাৎ লাফ দিয়ে রাজর্ষির গায়ে গিয়ে পড়েন একসঙ্গে রাজর্ষি আর তাঁর পিছনে দাঁড়ানো কনস্টেবল দু’জনেই মাটিতে পড়ে যায় এক ছুটে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন সুরেশ ঠিক সেই সময়েই হাওয়াতে ভেসে আসে কালো টিশার্ট আর নীল জিনস পরা একটা অবয়ব সন্দেশ ক্লাস নাইনেই ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই তথ্যটা জানা ছিল না পানসারের চোয়ালের উপর সজোরে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়েন সুরেশ জমিতে পড়েই চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে সন্দেশ চিৎকার করে ওঠে, “এই যে সেই ফেরোমনের কনটেনার ওর তাঁবু থেকেই খুঁজে পেলামসন্দেশের হাতে একটা শিশি ধরা রয়েছে
প্রমাণ সমেত গ্রেপ্তার,” উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে পিস্তলটা বের করতে করতে বলে ওঠেন ডিএসপি রাজর্ষি রায় সুরেশ তখনও জমি থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেননি ওর ঠোঁটের কোণটা লাল হয়ে উঠেছে

সত্যিই কী বিচিত্র দেশ আমাদের একদিকে নির্বিচারে অরণ্যনিধনআর অন্যদিকে শিবমের মতো অরণ্যপ্রেমী মানুষদেরকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি না,” গাড়ি চালাতে চালাতে তনুময়কাকু বলে ওঠেন ওদের ফেরবার ট্রেন আজ তনুময়কাকুই তাই ওদেরকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে চলেছেন
আর কী বলবি বল,” সন্দেশের বাবা একটা শ্বাস ফেলেন, “বড্ড অন্ধকারের দিকে পথ হেঁটে চলেছি আমরা
তাও তোর মেয়ে দুটো ছিল বলেই,” তনুময়কাকু হাসেন, “যেখানে যাবে তোমরা, এমন একেকটা করে কীর্তি কি রেখেই আসবে বলে ঠিক করে ফেলেছ?”
সন্দেশ চমচম দু’জন দু’জনের দিকে তাকায় হঠাৎ চমচম বলে ওঠে, “মাকে কেউ কিছু বলোনি তো এখনও?” ওর স্বরে ভয়
তা না জানিয়েই বা আর কী হবে এখন!” সন্দেশের বাবা কপট ভয়মিশ্রিত একটা হাসির সুরে বলে ওঠেন, “খবরের কাগজে আর টিভিতে তো এতক্ষণে দেখিয়েই দিয়েছে তবু ভালো তোদের ছবি ওঠেনি কিন্তু জায়গাটার নাম আর বর্ণনা শুনলে পরে তোর মা কি আর আমাকে জেরা না করে ছাড়বে!” তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন
তনুময়কাকু হঠাৎই এবার গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দেন, “আচ্ছা আচ্ছা, অনেক এই সব আলোচনা হয়েছে এখন নেমে পড়ো তো দেখি সবাই কিছুই তো ঘোরা হল না এই নকল বাঘ-বিভীষিকার ঠেলায় অন্তত এইটুকুকে না হয় উপভোগ করে নাও!”

ছোট্ট একটা নদী, পাকদণ্ডি-বাওয়া রাস্তা আর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, উপত্যকার বুক চিরে চলে গিয়েছে ঠিক তার মাঝখানটিতেই দিনমণি পাটে বসেছেন জলের রং লাল হয়ে উঠেছে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের লাল রং আর সবুজ বনের দিগন্তরেখাটুকু মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গিয়েছে অনেকদূরে দেখা যাচ্ছে পাকদণ্ডি পথ, দূরে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে এখানে মাটির রং হালকা লাল অদ্ভুত এক সুন্দর পরিবেশ
এই জায়গাটার কোনো নাম নেই,” তনুময়কাকু বলে ওঠেন, “তাই জন্যই বোধহয় এই জায়গাটাকে আরও বেশি করে ভালো লাগে আমার
সন্দেশ চমচম হাত ধরাধরি করে রাস্তার ওইপাশটাতে গিয়ে দাঁড়ায় অসামান্য এই সূর্যাস্তকে উপভোগ করে কে জানে বিলাসের ছেলেটাই বা কেমন আছে এখন সন্দেশ আর চমচম কান পেতে শোনে, কুলকুল স্বরে নদী বয়ে চলেছে একটু দূরে দু’জন মাঝবয়সি ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যেই পুরোনো গল্পে আবারও মেতে উঠেছেন হঠাত পৃথিবী এখনও সুন্দর সন্দেশ চমচমের কাঁধে হাত রাখে আরও একটু রাস্তার কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়
এখানে আর বাঘের ভয় নেই কোথাও!
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment