গল্প:: ড্যানি’স @ কার্সিয়াং - পূর্বা মুখোপাধ্যায়


ড্যানি @ কার্সিয়াং
পূর্বা মুখোপাধ্যায়

তিন্নিরা জয়েন্ট ফ্যামিলি। আর তিন্নিদের বেড়াতে যাওয়া মানেই দশ-বারো জনের টিম। বাবা, মা, দাদুভাই। মাম্মাম, মানে তিন্নির ঠাকুমা, কাকাই, ছোক্কাকি, রাতুল, রিমিল, পিকলু , মুন্নিদিদি, পুতুলপিসি আর তাদের ‘পুরাতন ভৃত্য’ সনাতন দাদা। পুরাতন ভৃত্য কথাটা বাবা বলে, কবিতাটাও। আসলে তিন্নিদের বাগবাজারের বাড়িতে এত লোক, এত কাকা, দাদা, ভাই-বোন যে তিন্নিরা একা একা, কেবল বাবা-মায়ের সঙ্গে কোথাও যায়নি কখনওসে নিয়ে ওদের কোনো দুঃখও নেই অবশ্য বরং একজনও যদি কোনো কারণে যেতে না পারে, পুরো দলেরই সাঙ্ঘাতিক মন খারাপ হয়
তিন্নি, রিমিল খুব মজায় থাকে। ওদের কক্ষনো একা লাগে না। আর ওদের সবচেয়ে প্রিয় পুতুলপিসি আছে না! পুতুলপিসি তিনতলার ছোটো বারান্দাটার লাগোয়া ঘরটায় থাকে। এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘর সেটা। সুন্দর পর্দা, জানলায় গ্রিলে আটকানো রঙিন টবে নাইন ও ক্লক, আর মানিপ্ল্যান্ট। একটা এরিকা পাম। দেয়াল জোড়া বইয়ের তাক। মেঝেতে মোটা গদি পাতা, তাতে খাদির চাদর। পর্দাও খাদির। খুব রঙিন। উজ্জ্বল। ঘর থেকে বেরোলেই গাড়িবারান্দার ছাদ। সেখানে বেতের মোড়া, আর ঘাছগাছালির সংসার। বড়ো পাথরের গামলায় পদ্মও ফোটে। যদি এই জয়েন্ট ফ্যামিলি না হত পুতুলপিসিকে তারা পেত কোথায়। তার ওপর পুতুলপিসি কলেজে পড়ায় আর খুব বই পড়ে বলে অনেক কিছু জানে। ল্যাপটপেও ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে প্রচুর জিকে সংগ্রহ করে। রিমিল তো পুতুলপিসির জন্যেই ইস্কুলের কুইজ টিমে ফার্স্ট। বাবা বলেন, পুতুল আছে, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা নেই।
পুতুলপিসি যেবার ওদের সঙ্গে কাশ্মীর যেতে পারল না, তিন্নিদের একদমই ভালো লাগেনি। পরে পুতুলপিসি অবশ্য কাশ্মীরের অনেক ইতিহাস বলেছিল আর এও বলেছিল যে তারা আর একবার যাবে ‘খন। এত মহিমামণ্ডিত জায়গা একবার দেখে হয়?
এবার তারা চলেছে কার্সিয়াং। সেখানে একটা পুরোনো বাংলো আছে, ব্রিটিশ আমলের সেটাই এখন হোম-স্টে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রৌঢ়ার মাত্র তিনটে ঘর বিশেষ ভিড় হয় না তিন্নিদেরও এবার দলে লোকজন কম। লকডাউনের পর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হচ্ছে, কিন্তু নিয়মকানুন সব গোলমাল হয়ে গেছে। পরীক্ষার ডেট, আপিসের ছুটি সব। তা তিনটে ঘরে ওদের সাতজনের ভালোই চলে যাবেবাবা-মা, দাদুভাই-মাম্মাম, তিন্নি-রিমিল আর পুতুলপিসি, এই সাতজন। পুতুলপিসি যাচ্ছে এতেই রিমিল আর তিন্নি খুশ। আসলে তারা বেশি ঘোরাঘুরি করে না একগাদা জায়গাতেও যায় না। একটা জায়গাতেই থাকে আশেপাশে পায়ে হেঁটে ঘোরা, স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে গল্পগাছা করা আর বাকি সময়টা বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখা, খাওয়া-দাওয়া নির্ভেজাল বিশ্রাম। পুতুলপিসি অবশ্য গিয়েই ঘরের টেবিলে ল্যাপটপটা রাখে। টেবিলটা জানলার ধারে হওয়া চাই বিকেলবেলা আর ভোরবেলা নিয়ম করে এক ঘন্টা হাঁটতে বেরোয় বাকি সময় লেখেগল্প
এবারও কেবল কার্সিয়াং। এমন কি দু’পা দূরে দার্জিলিং-এও যাবে না। রিমিল অবশ্য তাল তুলেছিল। পুতুলপিসি বলল, তোর ইচ্ছে হলে দাদা-বৌদির সঙ্গে দার্জিলিং নামক রথের মেলায় ঘুরে আসিস। পাড়ার অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে, ইস্কুলের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও। তোর মনেও হবে না যে কলকাতা ছেড়ে এসেছিস, পুরো ফিল অ্যাট হোম। লাইন দিয়ে কেভেন্টার্সে সসেজ খাবি আর সেলফি তুলবি।
রিমিল আর কিছু বলার আগেই মা ঘরে ঢুকল বেশ কয়েকটা সোয়েটার আর জ্যাকেট নিয়ে। পুতুলপিসি বলল, অত গরম জামা নিয়ে কী করবে বৌদি? পাহাড়ে এখন আর তেমন ঠান্ডা পড়ে না গো। আমরা মূর্খের দল প্রকৃতির দফারফা করে দিয়েছি। পাহাড় আর কুয়াশাটাই টিঁকে আছে কেবল, এই রক্ষে। তবে ছাতা নিও, আর পারলে রেনকোট, বাচ্চাগুলোর জন্যে।
এন জে পিতে বেশ গরম। রাস্তায় বৃষ্টিও ছিল না। তবে শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা পাকদণ্ডিতে পড়তে ঠান্ডা থার্মোমিটারে মালুম না হলেও, মন আর চোখ দুইই শীতল হল। মাঝে থামা মার্গারেটস ডেক-এ। অর্ডার করা হল কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট আর মাসকাটেল চা। রিমিল অবশ্য একবার তাল তুলেছিল মোমো খাওয়ার। পুতুলপিসি বলল, “মোমো তো কলকাতায় বসে ওয়াও মোমোতেও খেতে পারিস। এই যে মার্গারেটস ডেক, এর ইতিহাস কিন্তু পড়ে আছে আঠেরোশ’ বাষট্টি সালে। মার্গারেটস হোপ টি গার্ডেন। এখন যে জাহাজের মতো শেপের টি লাউঞ্জে আমরা বসে আছি, এটা গুডরিক কম্পানির” সবাই গল্পের গন্ধ পায়। পুতুলপিসি নিরাশ করে না। “ছোটা রিংটং। আবার কেউ বলে বড়া রিংটং। চা বাগানটা চালাতেন মিস্টার ক্রুইকশ্যাংক। তখন বেশির ভাগ চা বাগানই সাহেবদের ছিল। সেই সাহেবের মেয়ে ছিল মার্গারেট। এই পাহাড়, সবুজ চা বাগান, মাঝে সরু পায়ে হাঁটা পথ, মার্গারেট খুব ভালোবেসে ফেলে এই জায়গাটাকে। কিছুদিন পরে অবশ্য তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হয়। যাবার আগে এই পাহাড়, সবুজ চা বাগানকে সে মনে মনে বলে যায়, আমি শিগগিরই ফিরব, আবার। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। দেশে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়, জাহাজেই। শোকাতুর বাবা, তার প্রিয় কন্যার নামে চা বাগানের নামকরণ করেন – মার্গারেটস হোপ। গুডরিক কম্পানি এই ইতিহাসকে একটা ছোট্টো ট্রিবিউট দিয়ে রেখেছে, টি লাউঞ্জের নামটিতে
খেয়েদেয়ে মার্গারেটের কথা ভাবতে ভাবতে গাড়িতে চেপে সিধে মিসেস ও’নীলের হোম-স্টে – ড্যানি’স
পরের দিন বেশ বৃষ্টি শুরু হল। সারাদিন সবাই বাড়িতে। মালকিন মিসেস ও’নীলের সঙ্গে বেশ আলাপ হল তিন্নিদের। আর আছে রিঞ্চেন আর তার বউ মিসেস ও’নীলের সহায়ক। রিমিলকেই কেবল ঘরে রাখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি থামলেই সে পেছনের বাগানে খেলতে চলে যাচ্ছে। মা-বাবা চিন্তা করেন। দাদুভাই আর মাম্মামও। পুতুলপিসিই উদ্ধার করে – আহ, ওকে ওর মতো উপভোগ করতে দাও। সব সময় আতুপুতু কোরো না। পেছনেই তো রিঞ্চেনরা থাকে, ভয় কী?
ঘরে জমে ওঠে পুতুলপিসির গল্পের সেশন।
কার্সিয়াং নাম কেন জানিস? তিন্নি জানে না। গুগল ঘাঁটলেই জানা যেত অবশ্য। কিন্তু ও সে সব করে না। পুতুলপিসির মতো করে বলতে পারবে, গুগল? বাবা বললেন, “হিমালয়ের সাদা অর্কিড, লেপচাদের ভাষায় সেটাই কার্সিয়াং বোধহয়, এরকমই পড়েছিলাম
“হ্যাঁ, লেপচারাই এখানের অধিবাসী। আসল নামটা হল, কার্সেন রিপ অর্কিড। কেউ কেউ আবার বলে এক সাহেব ইঞ্জিনিয়ার এই নাম দেয়, যেহেতু এই সাদা অর্কিড বসন্তকালে গোটা কার্সিয়াং ছেয়ে ফেলে
একসময় ইংরেজদের ফেভারিট জায়গা ছিল এই কার্সিয়াং। তবে যাতায়াতের অসুবিধে ছিল। রাস্তা বলতে এক মিলিটারি রোড ছিল, তার পরে তৈরি হল হিল কার্ট রোড। বেশ কিছু ইংরেজ কার্সিয়াংকে ভালোবেসে এখানে সামার হোম করেন। কেউ কেউ পাকাপাকি থাকতেও শুরু করেন। তারপরে দার্জিলিং তাদের অনেক বেশি মনোমতো হয়ে ওঠে। কাজেই কার্সিয়াং তার সৌন্দর্য নিয়ে একান্তে নিরালায় থেকে যায়। এখনও অনেকেই বড়ো জোর এক বেলা এখানে থেকে দার্জিলিং চলে যায়। এভাবেই পুতুলপিসির গল্পে গল্পে রিমিলের হুটহাট একা একা বাইরে খেলতে যাওয়ার প্রসঙ্গটা আপাতত চাপা পড়ে যায়
দুপুরবেলা স্টিমড রাইস আর চাইনিজ চিকেন স্ট্যু খেয়ে দিব্যি লম্বা একটা ঘুম দিয়ে যখন উঠল সকলে, তখনও মেঘলা আশেপাশেই একটু হেঁটে এল সবাই রিমিলই কেবল পেছনের বাগানে খেলবে বলে রয়ে গেল।
পড়ন্ত বিকেল তখন পুতুলপিসির গল্পের অপেক্ষায়। পুতুলপিসি বলছিল, কাল ডাউহিলটা দেখতে যাবমিসেস ও’নীল চা আর কুকিজ সার্ভ করছিলেন, বললেন, “ডাউহিল হল সবচেয়ে ভূতুড়ে জায়গা। গেলেই বুঝবে এক গা ছমছমে ভাব রয়েছে জায়গাটায়। একটা জায়গা আছে যার নাম ডেথ রোড। লোকাল কাঠুরেরা ওখানে নাকি একটা মুণ্ডুকাটা বাচ্চা ছেলেকে দেখেছে অনেকেই। ভীতু গঙ্গারামেরা তাই এড়িয়েই চলে ওই পথআরও গল্প রয়েছে, যেমন একজন গ্রে গাউন পরা ব্রিটিশ মেয়ে ভূতের। অনেকেই নাকি নানারকম ভূতুড়ে আওয়াজ, এবং অশরীরি ছায়া ইত্যাদি দেখেছে একশ’ বছরের পুরোনো ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলেআর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যত ভূতুড়ে কাণ্ড সব ঐ স্কুল যখন ডিসেম্বর থেকে মার্চ অবধি বন্ধ থাকে তখন
মিসেস ও’নীল ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন। তারপর রিটায়ার করে এই হোম-স্টে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায়। মা’কে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তিনি পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে যাবেন না। ওর বাবা-মায়ের সমাধি আছে এখানেই। স্বামী অ্যালেনেরও।
আর এক রাউন্ড চা আর ড্যানিশ কুকিজ নিয়ে ঘরে ঢোকে রিঞ্চেন। “ওয়ান্ডারফুল কুকিজ মিসেস ও’নীল, ইউ মেড দেম?” পুতুলপিসি বলে। মিষ্টি হাসেন প্রৌঢ়া। - “ড্যানিজ কুকিজ, ইউ নো! দে ওয়ার মাই ব্রাদারস ফেভারিট! আমার ভাই ড্যানি ওর নামেই এই হোম-স্টে
“ছিল? এখন?”
লিভিং রুমের জানলার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি ধোয়া কার্সিয়াং পাহাড়ের আবছা সবুজের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলেন – “ছিল। আমাদের সব্বার চোখের মণিখেলতে খেলতে খাদের ধারে চলে যায়। এরকমই বৃষ্টি আর পা পিছলে... এখানে সেও শুয়ে আছে মা আর পাপার মাঝখানটিতে, যেমন ছোট্টোবেলায় নিজের ঘর ছেড়ে ‘ভয় করছে’ বলে বাবা-মায়ের মাঝে গিয়ে শুত
ঠিক তখনই ঘরের নীরবতা ভেঙে ঘরে ঢোকে রিমিল, “মা, দেখো, আমার ফ্রেন্ড, ওর সঙ্গেই খেলি রোজ...” বলেই পেছন ফিরে দেখে কেউ নেই। অবাক রিমিল “ড্যানি, ড্যানিইইই” বলে ডাকতে ডাকতে আবার বেরিয়ে যাবার উপক্রম করে।
ড্যানি!” আঁতকে উঠে মা দৌড়ে গিয়ে ধরে ওকে - “না, বাইরে যাবে না তুমি, ঘরেই থাকবে” তারপরেই আবার ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ে। মিসেস ও’নীল যেন পাথরের মূর্তি। রিঞ্চেনও বাইরে ঠিক তখনই ঝুপ করে সন্ধে নেমে এল আর আবার বৃষ্টি শুরু হল
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment