গল্প:: আচমকা অরণ্যে - শেলী ভট্টাচার্য


আচমকা অরণ্যে
শেলী ভট্টাচার্য

ফরেস্ট গেট পেরিয়ে অটোটা যখন সবুজাভ বন্য অন্দরমহলে প্রবেশ করল, তখন পশ্চিমাকাশে বিকালের রোদ মরে এসেছিল অরিত্রার উত্তেজনা তুঙ্গে টানটান হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল ও, “ইতনা গহেরা ফরেস্ট ইহা পে শের নাহি হ্যায়?
অটোরিকশার ড্রাইভার সামনের দিকে চেয়ে মারাঠি হিন্দিতে উত্তর দিল আমরা বুঝতে পারলাম, বলতে চাইছে, ‘এটা বাফার জোন হলেও মাঝেমধ্যেই এই রাস্তায় বাঘ এসে পড়ে তবে খুবই কম
অরিত্রা মনে হয় উত্তরটা শুনে কিছুটা হতাশ হল৷ পরক্ষণেই ড্রাইভার বিষয়টা ভেঙে বোঝাল আমাদেরকে ওর ভাষায়, এই সময়টা মানে বর্ষার পরবর্তী সময়ে ওদের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কারণ, বাঘিনীকে খাবার জোগাড় করতে বের হতে হয় ঘরে ছোটো বাচ্চা-কাচ্চা থাকে
আমি দীপার দিকে চেয়ে চোখ মটকে মৃদু হেসে বললাম, “বাঘেদের সমাজে অন্তত পুরুষরা নিস্তার পায়

দু’দিকের বড়ো ঘাসে ছাওয়া বন্যভূমি মাঝেমধ্যেই বাঁশঝাড়ের প্রাবল্যে ঘন হয়ে উঠছিল বড়ো গাছের ছায়াঘেরা পথে সূর্যের মলিন আলো এসে আবছায়া আঁকিবুঁকি কাটছিল আপনমনে সবুজের যে কতরকম ঘনত্ব হতে পারে, তা বোধ হয় অরণ্যে না এলে আন্দাজই করা যায় না বনের বুকে মাঝেমধ্যে ডোবার মতো ছোটো ছোটো জলাশয় আছে টলটল করছে তার সবুজাভ অগভীর জলের স্তর ঘরফেরতা পাখিদের কোলাহলে অপূর্ব একটা প্রাকৃতিক মেলোডি সৃষ্টি হয়েছে চতুর্দিকে ড্রাইভার বলছিল, ওর ঘর আগারজারি গ্রামে বলেই এই সময় নির্দ্বিধায় আমাদের নিয়ে চলে এল নইলে অন্য ড্রাইভার হলে নির্ঘাত মানা করে দিত কারণ আমাদের নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে অন্ধকার নেমে আসত প্রাণের ভয় সবারই কম বেশি আছে কখনও বাঘের দেখা পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে মুচকি হাসল হাবভাব এমন, প্রতিবেশীদের দেখতে পাব না আবার! যেন নিতান্তই সাদামাটা একটা ব্যাপার
ঠিক তখনই কীসের যেন একটা বন্য তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে এল দূর থেকে সন্দিগ্ধ গলায় বললাম আমি, “এলার্ম কল নয়তো!
অরিত্রা উত্তেজনায় আবার সোজা হয়ে বসল অপলক দৃষ্টিতে জরিপ করছে চতুর্দিক কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছোটো থেকেই আমার মতোই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় দীপা মাঝেমধ্যে বলেই বসে, বাপ বেটি তো সময় পেলেই ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যায় আর কী! তারপরে আশপাশে যতরকম দুঃসাধ্য জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে হাজির হয় অবশ্য খুব একটা ভুল বলে না দীপা আমরা দু’জনে অনেকবারই পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়েছিলাম আমার তো ট্রেকিংয়ের নেশা ছিলই, তার চেয়েও মেয়ের মনে ট্রেকিংয়ের নেশা গেঁথে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যেতাম অরিত্রার এসবে ভীষণ উৎসাহ আমায় চুপিচুপি জানিয়েছিল, ওর ববকাট চুল আর চলন বলন দেখে বন্ধুদের অনেকেই নাকি আড়ালে ওকে টমবয় বলে আমি হেসে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলাম তখন, বয় কি গার্ল হলি, সেটা বড়ো কথা নয় বুকের ধক জমিয়ে রেখে জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারাটাই আসল চ্যালেঞ্জ
আমি নিজেও খুব ছোটো বয়স থেকে এই উপলব্ধিকে বহুবার অনুভব করেছিলাম কেন জানি আমার মনে হয়, সরল সহজলভ্য প্রাপ্তিতে সেই রোমাঞ্চকর আনন্দের স্বাদটাই থাকে না ঘন দুধের উপরের মোটা সরের মতো স্বাদ তার সেই স্বাদকে চেটেপুটে নেওয়ার টানে আমি বহুবার কর্মস্থল থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে একাই বেড়িয়ে যেতাম ধীরে ধীরে এও বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা যাকে অ্যাডভেঞ্চার বলে মনে করি, সেই অভিজ্ঞতা কিছু মানুষের জীবনে মৃত্যুর আগের ভয়াবহ পরিস্থিতির যন্ত্রণার সমান দু’বছর আগে আমার এক বন্ধু কাজের সূত্রে সুন্দরবনে গিয়েছিল আমিও ওর লেজুড় হয়েছিলাম সুযোগ বুঝে তখন এই সত্যিটা গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল আমায় কী সহজ সরল ওখানকার মানুষেরা আমার ডাক্তার পরিচয় পেয়ে অকপটে নিজেদের কত সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল মৌলেদের জীবন সংগ্রাম আর বাঘ বিধবাদের সংখ্যা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম আমি মনে হয়েছিল, ট্যুরিস্টদের কাছে হয়তো কাব্যিক অনুভূতি ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’, কিন্তু ওদের কাছে বন্যেরা বনে ভয়ঙ্কর

মোহারলি গেটে পৌঁছানোর আগেই যে পাকা রাস্তাটা সরকারি ট্যুরিস্ট লজের দিকে ডানহাতে ঢুকে গিয়েছিল, সেদিকেই মোড় ঘুরল অটোটা পথ ধরে কিছুটা এগোতেই বাঁ দিকে পড়ল আকাশ হোম-স্টে এক পরিচিত সূত্রে এই হোম-স্টের ছবি দেখে আমি ঠিকই করেছিলাম, ট্যাডোবা গেলে ওখানে গিয়েই উঠব অটো থেকে নেমে আমরা তিনজনই মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিলাম বাড়িটার দিকে প্রকৃতিকে যে এত সুন্দর করে স্বল্প পরিসরে সাজিয়ে রাখা যায়, তা যেন না দেখলে বিশ্বাসই হত না কোথায় কলকাতার অভিজাত ফ্ল্যাটের বদ্ধক্ষেত্রের ইনটিরিয়র সাজসজ্জা, আর কোথায় মুক্ত বাতাসে দোলা দিয়ে যাওয়া সবুজের অনাবিল সমারোহ বাড়ির স্বল্প চত্বর, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথ, এমনকি ঝুলন্ত রংবেরং-এর টব... সর্বত্র অদ্ভুত আকর্ষণীয় ফুলের গাছে ভরপুর গেট পার হতেই ডানদিকের কিছুটা জুড়ে সবজির সযত্ন খেতি জমি অফিসিয়াল কাজ সেরে ব্যাগপত্তর নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম আমরা বাইরের অন্ধকার যত ঘন হচ্ছিল, আশপাশে বুনো গন্ধের মাদকতা যেন ততই জাঁকিয়ে বসছিল কফির কাপ শেষ করেও পেছনের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো একটা শব্দ মাদকের মতো ঝিম ধরিয়ে দিচ্ছিল একনাগাড়ে অরিত্রা একটা বই নিয়ে এসে বলল, “এই দেখ বাবা, এখানে ট্যাডোবা বা তাড়োবার সব ইতিহাস লেখা আছে তাড়ু নামের একজন উদারমনস্ক প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ নাকি বন আর পশুপাখিকে জানপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করতেন সেই সময় গোণ্ড রাজাদের অধীনে ছিল এই জঙ্গলের বেশিরভাগ অংশ সেই রাজারাও তাড়ুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন বাঘের কবলে পড়ে তাঁর মৃত্যু হওয়ার পরেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল তাড়োবা বা উচ্চারণের ভিন্নতায় ট্যাডোবা আবার অনেকে বলেন, তাড়ু বন্য দেবতা ছিলেন
“এই বই পেলি কোথায়?” আমি বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে প্রশ্ন করলাম
“ডাইনিং হলের যেখানে টিভি ওয়াল মাউন্ট করা আছে, তার পাশেই একটা ছোট্ট বুক শেলফে কিছু বই আছে ডক্টর প্রকাশ আপটের সম্বন্ধেও বই আছে সেখানে
মুহূর্তে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল ভদ্রলোকের সম্বন্ধে আগেই শুনেছিলাম ইচ্ছা আছে ফেরার পথে একবার ওঁর আদরের পশুশালা ঘুরে যাব

“ডিনার দিয়ে গেছে, খেয়ে নাও কাল ভোরে উঠতে হবে তো
দীপার ডাকে আমরা বাপ বেটি ডাইনিং হলের দিকে হাঁটা লাগালাম রান্নার গন্ধে - করছিল মুক্ত ডাইনিং হলটা খাবারগুলোকে অদ্ভুত সুন্দর কায়দায় পরিবেশন করে রেখেছিলেন হোটেল মালিক সনিউলে টেবিলের উপরে একটা ছ্যাতরানো কাচের বাটির জলে ভাসছিল বাসন্তি রঙের অজস্র ফুল হঠাৎ দেখলে অলকানন্দা বলে ভ্রম হয় হালকা রং-এর নেটের পর্দাগুলো উড়ছিল বাতাসের মৃদু লয়ে ঝুলন্ত লন্ঠনের আলোতে পরিবেশটাকে মায়াবী জগতের প্রতিভূ বলে মনে হচ্ছিল
দীপা খেতে খেতে মেয়েকে বলল, “এখান থেকেও কোনো পোষ্য জোগাড় করবি নাকি তুই?
কথাটার পেছনের সূক্ষ্ম খোঁচাকে আমি টের পেয়েছিলাম গত বছর কলেজ এক্সকারশনে ভাইজ্যাগ গিয়েছিল অরিত্রা সেই প্রথম মা-বাবার নজরের বাইরে বহুদূরে বন্ধুদের সঙ্গে ওর দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া হাওড়া স্টেশনে ওর চোখমুখ দেখেই বুঝেছিলাম, এই মেয়ে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার না করে ফিরবে না হয়েওছিল তাই কোনো এক দুঃসাহসিক বুদ্ধির মদতে সমুদ্রের রকি বিচ থেকে একটা প্রমাণ সাইজের কেম্রিজ বলের মতো সি আর্চিন তুলে নিয়ে এসেছিল হোটেলে তাও আবার স্যারেদের চোখের আড়ালে৷ ওর নাকি ওটাকে পোষার ইচ্ছা হয়েছিল কথাটা শোনার পরে আমারও হেঁচকি উঠেছিল এটুকু বুঝেছিলাম, অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সামুদ্রিক প্রাণীটাকে বাঁচিয়ে রাখার শর্তগুলো ভুলে গিয়েছিল বিপদ ঘনিয়েছিল হোটেলের রুমেই যে কাচের টি টেবিলের উপর প্রাণীটিকে রাখা হয়েছিল, তাতে সামান্য ধাক্কা লাগতেই সেই সাধের সি আর্চিন মেয়ের ডান পায়ের উপর পড়ে গিয়ে মুহূর্তে বিষ ঢেলে দিয়েছিল তারপর যথারীতি অরিত্রা ওখানে স্যারেদের কাছে আর আমি ঘরে দীপার কাছে যথেচ্ছ গরম কথা শুনেছিলাম অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমিই ছোটো থেকে অরিত্রার যাবতীয় দুঃসাহসী কাজের পেছনে প্রকৃত মদতদাতা ছিলাম
“আমার তো অনেক কিছুই পোষার ইচ্ছা হয় চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?” ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল অরিত্রা
“তা তোর বাবাকে বল, সরকার থেকে পারমিশন জোগাড় করতে তাহলে একটা বাঘের ছানা নিয়ে যেতে পারবি তুই এখান থেকে একান্ত সেটা সম্ভব না হলেও, একটা হরিণ শাবককে ঠিক ম্যানেজ করে দেবে তোর বাবা

দীপার কথার আড়ালের কৌতুকটাকে উপলব্ধি করার আগেই, নিচের ঘর থেকে আচমকা কান্নার শব্দ ভেসে এল শিশুদের নয়, প্রাপ্তবয়স্ক একাধিক মহিলার রাতের নিঝুম বন্য পরিবেশে যেন হঠাৎই দোলা লাগল তাতে এমনিতেই এইসব দিকে রাত ন’টা মানেই অনেক রাত কিছুক্ষণ আগে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম, দূরে দূরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা জোনাকির আলোর মতো বিন্দুগুলো এক এক করে নিভে যাচ্ছিল অন্ধকারের আধিপত্য বেড়ে যাচ্ছিল দ্রুত মনে হচ্ছিল যেন বন্যভূমি নিদ্রাদেবীর কোলে সুখে ঢলে পড়ছে সেখানে এখন প্রায় রাত দশটা বাজে নিস্তব্ধতার পর্দাগুলো যেন আচমকাই ঝাঁকিয়ে দিল বিষাদের সমবেত সুর বিপদের আচমকা আভাস পেলাম আমরা অরিত্রা ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল আমি বললাম, “দাঁড়া, নিচে গিয়ে একটু দেখে আসি
নিচের ঘটনাটুকু জানার পর আমার হাতে তেমন সময় ছিল না কোনোরকমে মেয়েকে ইশারা দিয়ে ডেকে জানালাম বিষয়টা পাশাপাশি নিজের সিদ্ধান্তটাও বললাম অরিত্রা লাফিয়ে উঠল উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এত রাতে তোমায় কিছুতেই একা ছাড়ব না আমি আমিও যাব
“তা হয় না আমি সনিউলের স্কুটির পেছনে চেপে চলে যাব তাছাড়া আরেকটা স্থানীয় ছেলেও স্কুটি নিয়ে আমাদের পাশাপাশি যাবে গ্রামটা বেশি দূরে তো নয় তুই তো জানিস, আমার পেশার ধর্ম... আগে ডিউটি, পরে সব ভয় পাস না মায়ের কাছে থাক ফোন সঙ্গে রইল আমার

কথাগুলো বলার পরে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম আমি মেয়ের পাংশুটে মুখের দিকে চেয়ে হাত নেড়ে দোতলায় ওঠার ইশারা করলাম সারাটা রাস্তায় আমার মনের মধ্যে আঁচড় কাটছিল অতীত কানে বাজছিল ‘সোড়ুন দেনে’ শব্দ দুটো মারাঠি ভাষার এই শব্দ দুটোর অর্থ একঘরে ওদের আলোচনা থেকে বুঝেছিলাম, কয়েক মাস আগে রাজরোগে ভুগেছিল বলে সনিউলের ছোটো বোন ওই গ্রামে একঘরে অবস্থায় অসহায় দিন কাটাচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দু’দিন আগেই, তবে আজ সন্ধ্যার পরে বাড়াবাড়ি হয়েছে কিন্তু আশপাশের লোক সেভাবে এগিয়ে আসেনি আমার চোখের সামনে মায়ের ক্লান্ত অবসন্ন মুখটা হঠাৎই ভেসে উঠল অনেক ছোটোবেলার টুকরো টুকরো স্মৃতি কাদাজলের মতো ঘোলাটে অস্বচ্ছতায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল আমায় আমার মামাবাড়ির দাদুর শেষ বয়সে যক্ষ্মারোগে হয়েছিল সে সময়কার মানুষজনও অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখতেন রোগটিকে সঙ্গে রোগীর বাড়ির লোকেদেরকেও রোগী স্পেশাল হাসপাতালে মাসের পর মাস থেকে সুস্থ হয়ে উঠে বাড়িতে ফিরলেও, সকলে অস্পৃশ্য করে রাখতেন দাদু সেই রোগের কবল থেকে বের হতে পেরেছিলেন বটে, তবে ধকলটা নিতে পারেননি শেষ সময়েও মাকেই তাঁর সেবা করতে দেখেছিলাম মায়ের সেই সময়ের কষ্টটা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আমায় আরও বেপরোয়া করে গড়ে তুলেছিল আজ এই গ্রাম্য মেয়েটির কথা শুনে নতুন করে চমকে উঠিনি আমি বুঝেছিলাম, বাপের বাড়ির এরাও তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখেনি আজ মেয়ের হঠাৎ বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতার খবর পেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে মা আর জেঠি এসব শুনে চুপ করে বসে থাকাটা আর সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে জানি না কদ্দূর কী করতে পারব, তবু একবার গিয়ে দেখি তো এই ভেবেই কতকটা হঠকারিতা করেই বেরিয়ে এলাম
বন্য কোনো এক প্রাণীর অস্পষ্ট ডাকে, চমকে উঠলাম আমি চেয়ে দেখলাম, চারপাশটা অন্ধকারের গুহার মতো ঘন স্কুটির আলোটা সেই অন্ধকারের বুক চিরে খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে আমি রীতিমতো তাড়া লাগালাম সনিউলেকে ফিসফিসিয়ে বোঝাল আমায়, “বন এই সময় ঘুমায় বন্যরা নামে শিকারে তাই এই গতিটাই ঠিক আছে নইলে আওয়াজ হবে
অনুভব করলাম, এরা এখনও নিজের স্বার্থের কথা ভেবে বনকে ভুলে যায়নি তবে আসল কারণ বুঝতে পারলাম তার মিনিট দশেক পরে আমাদের সামনে হাত দুয়েক আগে প্রতিবেশি ছেলেটার স্কুটিটা এগোচ্ছিল হঠাৎই অস্বাভাবিকভাবে নিজের গতি কমিয়ে দিল ঠিক তখনই সনিউলে ভয়ার্ত গলায় ওদের ভাষায় কী যেন বলল সামনের ছেলেটাকে আমি এটুকুই বুঝলাম, বন্য পরিবেশে বিপদ ঘনিয়েছে তবে তা ঠিক কতখানি তার ধারণা করতে আমাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল আমি হিন্দিতে জানতে চাইলাম, ব্যাপার কী?
সনিউলের ‘শ--শ’ শব্দটার ইঙ্গিত আমার সারা শরীরকে শিহরিত করে তুলল এতক্ষণ কিসের যেন নেশায় আমি আমার কর্তব্যপালনের তাগিদে ছুটে যাচ্ছিলাম এবার ভয় হল, যাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আমি ছুটে যাচ্ছি, তার কাছে যাওয়ার আগেই বিপদ আমায় গিলে ফেলবে না তো! ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল কোনোভাবে ঢোঁক গিলে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “শের হ্যায় ক্যায়া?” তুমুল কাঁপছিল আমার কণ্ঠস্বর
ঠিক তখনই খচমচ শব্দে আমাদের খুব কাছেই কী যেন দৌড়ে পালাল ভয়ে হাড় হিম হয়ে গেল আমার নিজের নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা, নিজেই বুঝতে পারছিলাম না সামনের স্কুটির ছেলেটাকে হঠাৎ মুখটা ঘোরাতে দেখে আমিও তাকালাম ডানদিকে স্কুটির আলোর রেখা যেখানে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দেখা গেল হীরক কুচির মতো দুটো উজ্জ্বল চোখ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল অরিত্রা আর দীপার মুখ এই জীবনে ওদের সঙ্গে পুনরায় দেখা হওয়ার সামান্যতম আশাও দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি এবার সামনের ছেলেটা রাস্তায় পা ঘষটে ঘষটে স্কুটিটাকে পেছতে লাগল ওর দেখাদেখি আমাদের স্কুটিটাও পিছোচ্ছিল আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, বিপদ একেবারে দুয়ারে এসে কড়া নাড়াচ্ছে সেই মুহূর্তে সুন্দরবনের হাজার একটা গল্প আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে রীতিমতো অবশ করে দিচ্ছিল আমার সমস্ত শরীরকে চারপাশের নিটোল অন্ধকার দেখে এটুকু বুঝেছিলাম, এই জায়গাটা আর যাই হোক গ্রামের কাছাকাছি নয় এখানে আসার টিকিট কাটার দিন থেকে আজ অবধি, এমনকি ডিনার টেবিলে বসেও বাঘ দেখব বলে আমরা পুলকে শিহরিত হচ্ছিলাম পরিস্থিতির পরিবর্তন মুহূর্তে আমায় হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, বনের কাছাকাছি যে সব মানুষ থাকে, সময়ে অসময়ে তাদের ঠিক কতখানি শিহরিত হতে হয় ভয়ে রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি ঠিক তখনই আবার শুকনো পাতার উপর মচমচ শব্দের আলোড়ন উঠল তবে একটু দূরে সামনের ছেলেটা তৎক্ষনাৎ স্কুটির আলো নিভিয়ে দিল দেখাদেখি আমাদের স্কুটিও ডুব দিল অন্ধকারের সমুদ্রে আমি বুঝতেই পারছিলাম না, এরা কেন এমন করছে মনে হচ্ছিল বলি, চলো জোর স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে যাই কিন্তু ওদের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করতে হচ্ছিল আমায় আমার শহুরে বুদ্ধি রাস্তার নেড়ি কুকুরের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট এর বেশি নয় বনের বাঘের গতিবিধিকে ধোঁকা দেওয়ার মতো ধুরন্ধর বুদ্ধি এবং কৌশল বনের প্রতিবেশীরাই জানবে যে বুনো গন্ধটা সন্ধের কফির কাপে আমায় আমেজ দিচ্ছিল, সেটাই এখন শ্বাসরুদ্ধকর লাগছিল যেন আমার বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা সব শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল দ্রুত এটুকুই বুঝতে পারছিলাম, জীবন মৃত্যুর মধ্যস্থ সূক্ষ্মরেখাটাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার জন্য এভাবে আলো আর শব্দহীন অবস্থায় আমাদের থাকতে হবে ঠিক তখনই একসঙ্গে প্রায় তিনজনই কেঁপে উঠলাম আমার পকেটের ফোনটা নিস্তব্ধতাকে খানখান করে বেজে উঠল আমি ভয়ে পকেট হাতড়ে বের করার আগেই স্কুটি দুটোতে স্টার্ট দিল দু’জনে যতটা সম্ভব দ্রুতবেগে ছুটে চলল স্কুটি ততক্ষণে আমি ফোন বন্ধ করে দিয়েছি সনিউলে আমায় রাগত স্বরে রীতিমতো খেঁকিয়ে উঠল বুঝলাম, বনে যাতায়াতের সময় ফোনকে মিউট রাখতে হয় রাতের দিকে বন্ধ রাখাটাই শ্রেয় যদিও কারণ সূক্ষ্ম আলোর প্রভাবও তখন সুদূরের বিপদকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে আসতে পারে প্রায় মিনিট দশেকের দুরন্ত গতিতে আমরা সম্ভবত একটা গ্রামে এসে ঢুকলাম কারণ একফালি চাঁদের আলোতে আশেপাশে কয়েকটা বাড়িকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখছিলাম তখনও আমার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না

এরপরের মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটা আটচালা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল স্কুটি দুটো একে একে নামলাম আমরা ঘরের ভেতরের মৃদু আলো চুঁইয়ে বারান্দার স্বল্প দৈর্ঘ্য পেরিয়ে উঠোনে এসে পড়ছিল আমি সম্ভবত কতকটা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম পাশের ছেলেটি আমায় ঠেলা দিয়ে বলল, “ডক্টর সাব, আজ আপকো নয়া জিন্দেগি মিলা অর দো মিনিট পেহেলে আপকা ফোন রিং হোতা তো!” বলে ডানহাতটাকে গলার কাছে দ্রুত চালিয়ে খতম হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল মুহূর্তে শিউরে উঠলাম আমি তারপর ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম, বাঘটা আজ একটা শিকারের পিছু নিতে নিতেই এইদিকে চলে এসেছিল তবে স্কুটির আলো দেখে থেমে গিয়েছিল শিকার সম্ভবত ওর হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল তাতে হয়তো কতকটা রেগেও গিয়েছিল তাই বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় ওত পেতে বসেছিল এবার বাঘের মনে কী ছিল, তা ওই জানে কিন্তু ছেলেগুলো ঠিকই করেছিল, একটু অপেক্ষা করার পর আচমকা স্পিড নিয়ে বেরিয়ে যাবে ওরা আমার ফোন আসায় ওদেরকে তড়িঘড়ি সেটাই করতে হয়েছিল আরও শুনলাম সপ্তাহ খানেক আগে খুব ভোরে খেতের পাশের নাবাল জমিতে এক চাষীকে তাড়া করেছিল একটা বাঘ সেই স্থানটা আজকের লোকেশনের থেকে বেশি দূরে ছিল না এও বুঝলাম, এখানকার মানুষেরা বাঘের আচার আচরণ এমনকি গায়ের গন্ধও দূর থেকে টের পায়
বারান্দা পেরিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটির স্বামী ওর মাথায় ক্রমাগত জলপট্টি দিয়ে চলেছে মেয়েটি নেতিয়ে শুয়ে রয়েছে খাটিয়ায় গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওদের ভাষায় কী যেন বিড়বিড় করে বলছে ওই ছোট্ট ঘরের মলিন আলোতে মেয়েটির স্বামীর চোখের তুমুল উদ্বেগ আমার চোখে পড়ল আমার মনে হল, কিছুক্ষণ আগে আমি জীবন মৃত্যুর মধ্যস্থ যে চোখ রাঙানিকে ভয় পাচ্ছিলাম, ওর চোখেও সেই ভয়ার্ত ছায়া লেপটে রয়েছে ভয়ার্ত শিহরণে কেঁপে উঠছে মুহুর্মুহু অল্পবয়সের ছেলেটি উষ্কখুষ্ক চুল আর এলোমেলো চাউনিতে একবার আমাদের দিকে মুখ তুলে চাইল আশার আলোর লেশমাত্র নেই সেই নজরে আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে রোগীর দিকে এগিয়ে গেলাম
প্রায় দেড় ঘন্টার চেষ্টায় মেয়েটির জ্বর কিছুটা কমল বেড়াতে যাওয়ার জন্য যে মেডিকেল বক্সটা সঙ্গে রাখি আমি, সেটাকে নিয়ে এসেছিলাম ভীষণ কাজে লাগল সেই ওষুধ মেয়েটির গায়ের ছ্যাঁকা লাগা তাপটা যেন কিঞ্চিৎ শীতলতা পেল তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল, ডেঙ্গু হয়েছে বলে রক্ত পরীক্ষার প্রসঙ্গ তুলতেই ঘরে উপস্থিত বাকিদের মুখটা কেমন যেন নির্লিপ্ত লাগছিল এর মধ্যে একবার ফোনটা অন করে আমি বহুবার কল করার চেষ্টা করেছিলাম অরিত্রার বা দীপার ফোন, কোনোটাতেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না সনিউলে বিষণ্ণতা মাখানো হাসি ছুঁড়ে দিয়েছিল আমার দিকে নিজেকে অথবা নিজেদের অবস্থানকে হয়তো ব্যঙ্গ করে বলেছিল, “ডক্টর সাব, ইয়ে ফরেস্টবালী গাঁও হ্যায় ইহাপে শের দৌড়তা হ্যায়, নেটওয়ার্ক নেহি

সারাটা রাত নিদ্রাহীন কাটালাম সবাই বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম আমি, এখানে ঘুরতে আসা আর বসবাস করার মধ্যে কত বিস্তর তফাত আমরা শহুরে সুযোগ সুবিধাভোগী মানুষেরা শখে নিরাপদ শিহরণ উপভোগ করার জন্য এখানে এসে হাজির হই অকৃপণ হাতে অর্থ ব্যয় করি অন্যদিকে, এখানকার মানুষদেরকে এই শিহরণগুলোর আঁচ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক হয়ে চলতে হয়, সুস্থভাবে বাঁচতে হয়, বাঁচার রসদ জোগাড় করতে হয় বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের দৈনন্দিন জৈবিক কাজের মধ্যেও ওদের ঠিক কীভাবে কতটা সতর্ক থাকতে হয়, তার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম সকালে ফেরার পথে এসব ভাবনাতেই ডুবে ছিলাম আমি ঘুম ভাঙা অরণ্যের কোনায় কোনায় তখন সবুজেরা আড়মোড়া ভাঙছিল রাতের হাড় হিম করা অভিজ্ঞতাটা তখনও শিহরণ জাগাচ্ছিল আমার মধ্যে তবে সনিউলে মৃদু হেসে বলেছিল, “সব আভি সো রহা হ্যায়

স্কুটিটা শব্দ করে রাস্তার মোড় ঘুরতেই আমি দেখলাম সমুদ্রের ঢেউয়ের উন্মত্ত তরঙ্গের মতো ছুটে আসছে আমার আত্মজা উপরের বারান্দায় দীপা ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর দু’চোখে লেপটে রয়েছে রাত জাগার ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা ঘেরা অজস্র প্রশ্ন মনে মনে ভাবছিলাম, আজ জমিয়ে বসে ওদেরকে সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি বলব
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment