ভ্রমণ:: ঝুমু্র মেলা দেখা - অনন্যা সাহা


ঝুমু্র মেলা দেখা
অনন্যা সাহা

শীত পড়েছে জাঁকিয়ে এমনি এক শীতে মেলা বসেছিল ঝুমুদের মফস্বল শহরে গান্ধী পার্কের মাঠে, ‘আনন্দ মেলা’ মেলা বসার খবরটা স্কুলের বন্ধুদের কাছেই পেয়েছিল বাড়ি ফিরেই উৎপাত শুরু বাবা বলে সামনের রোববার নিয়ে যাবে সেদিন মঙ্গলবার, রোববার আসতে ঢের দেরি, তাই ‘প্ল্যান বি’ বাড়িতে না বলে একলা একলা যাবে মেলায় যেমন ভাবা তেমন কাজ! ওর তখন ক্লাস ফাইভ পাড়ার এক দিদির কাছে রোজ বিকেল চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত পড়তে যায় সঙ্গে পড়ে অপু আর টুকি দু’জনেই পাড়ার বন্ধুটুকি মামাবাড়িতে থাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে, অপুর বাবার মস্ত বড়ো হোটেল পড়তে গিয়ে কথাটা পাড়ল ঝুমু এক কথায় বাকিরা রাজি
পরদিন চারটে বাজার বেশ কিছুক্ষণ আগেই সোয়েটার টুপি পরে তিনজন হাজির অন্যদিনের মতো গল্প নেই, বসার জায়গা নিয়ে ঝামেলা নেই, পেনসিল ছোলা নেই, হাসাহাসি নেই, চটপট পড়া তৈরি... দিদিমণি অবাক! বকার কোনো সুযোগ না দিয়ে পৌনে পাঁচটায় পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাত ধরাধরি করে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে সোজা মেলার মাঠ
দু’জনের পেনসিল বক্সে আট আনা আর একজনের ষোলো আনা মেলার গেটে টিকিট লাগে না এক ছুটে মেলার ভেতর, স্বপ্নের দুনিয়ায়! চারদিকটা দেখে নেওয়ার পালা গোল মাঠটায় সার সার দিয়ে দোকান! হরেক মাল সাড়ে ছ’টাকা, চিনামাটির বাসন, কাঠের খেলনা, লোহার খুন্তি-কড়াই, মাটির সবজি ফল, হাতের চুড়ি, গলার হার, কানের দুল! লম্বা লাঠিতে রংবেরং-এর বেলুন, বাঁশি, ভেঁপু, চরকি! হারুন কাকা লাঠিতে ভর দিয়ে বাঁশিতে সুর তোলে! ছেলেমেয়েরা ছুটে ছুটে যায়! মাটির উপর বস্তা পেতে রংবেরং-এর টুপি! ঝুমু মন দিয়ে সব দ্যাখে আর মনে মনে ঠিক করে বাবার সঙ্গে এসে সবুজ পাথর দেওয়া টিনের আংটিটা, চরকি, মাটির পেয়ারা আর একটা পুতুল কিনবে মাটির পেয়ারাটা একদম আসল যেন! ‘জিনা মরনা ইস কে নাম... কর দিয়া জিন্দেগি কুরবান...’ – বড়ো করে ঘেরা ‘মউত কা কুয়া’-র অস্থায়ী পাঁচিলের উপর বসে হাতে চোঙা নিয়ে একজন ছোকরা খুব চেঁচায়! বাইরে থেকেই মোটর সাইকেলের গোঁ গোঁ শব্দ শোনা যায় বাবার সঙ্গে এসে ঢুকে দেখতে হবে ‘ইয়ে হ্যায় ঈশ্বর কা লীলা, কুদরত কা খেল... আইয়ে দেখিয়ে অউর মজা লিজিয়ে... এক শরীর অউর দো দো চ্যহরে... গঙ্গা-যমুনা... খাতে হ্যায়, পিতে হ্যায়, বোলতি ভি হ্যায়... টিকেট সির্ফ পাঁচ রূপেয়া।’ ঝুমু এদের গতবছর দেখেছিল বড়ো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে - ছবি তুলুন, মেলা দেখুন/ খাওয়াদাওয়া শেষ হলে, ছবি নিয়ে যান চলে খুব ইচ্ছে হয় তিনজনে মিলে একখানা ছবি তুলতে ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই চোখ চলে যায় নাগরদোলার দিকে আকাশছোঁয়া ইলেকট্রিক নাগরদোলা, ঘুরছে আর ঘুরছে! ঝুমু ভয় পায় ইলেকট্রিক নাগরদোলায় উপর থেকে নামার সময় পেটটা যেন খালি হয়ে যায় হাতে ঘোরানো কাঠের ছোটো নাগরদোলায় ভয় করে না ওগুলো নিচু, আস্তে আস্তে ঘোরে, বসার জায়গাগুলোও ভালো মাঠের মাঝে গোল নাগরদোলা, ওতে ছোটোরা চড়ে রঙিন ঘোড়া, সাজানো বসার জায়গা দেখে চড়তে মন করে ঝুমু ছোটো নয়, একা একা মেলা এসেছে ছেলেগুলো বন্দুক কাঁধে বেলুন ফাটায়কতরকমের খাবার! গুড়ঝুড়ি, পাঁপড়, জিলিপি! স্টোভের অল্প আঁচে বসানো অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে গরম ঘুগনি, লাল শুকনো ডিমের কারি। চেয়ার টেবিল পাতা বড়ো দোকানে টাঙানো কাগজে ঘুগনি, ভেজ চপ, ডিমের চপ, মাংসের চপ, এগ রোল, মোগলাই! ওরা বড়ো দোকানে ঘুগনি খাবে আট আনাতে ঘুগনি ছাড়া কিছুই হয় না! কুপন দিয়ে কর্মচারী ভিতরে চলে যায়দোকানের ভিতরে চোখ পড়তেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে অপুর বাবা বসে! বাবা যে মেলায় দোকান করেছে, সে খবর পৌঁছোয়নি অপুর কাছে পয়সা দেওয়া, কুপন নেওয়া দুইই সারা... অগত্যা টেবিলের তলায় কর্মচারী ঘুগনি আর জল নিয়ে আসে টেবিলের তলা থেকেই তিনজন পাজামা ধরে টানাটানি করে অবাক হয়ে টেবিলের তলাতেই ঘুগনি দেয় নতুন কর্মচারী ঠোঁট পুড়ে যাওয়া ঘুগনি অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক জামায় ফেলে মেলার বাইরে চারদিকটা বেশ অন্ধকার, সন্ধে নেমেছে! মেলার আলোয় টের পাওয়া যায়নি! হনহন করে হেঁটে বাড়ি
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment