ভ্রমণ:: দলগাঁও ভিউ পয়েন্টে একবেলা - হিমি মিত্র রায়


দলগাঁও ভিউ পয়েন্টে একবেলা
হিমি মিত্র রায়

এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে সুকুমার রায়ের অবাক জলপানের কথা মনে পড়ছিল, ছোটোবেলায় এই নাটকের একটি চরিত্রে আমি অভিনয় করেছিলাম পথিক বারে বারে বিভিন্ন মানুষের দোরে দোরে ঘুরছে আর বলছে,একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? কিন্তু কেউই জল দিতে পারছিল না আমাদের অবস্থাটা হল অনেকটা সেরকমই বিশুদ্ধ অক্সিজেন কোথায় পাব বল তো এই পরিস্থিতিতে? চারিদিকে শুধু অক্সিজেনের হাহাকার, দমবন্ধ পরিস্থিতি। উত্তরবঙ্গে থাকার অনেকগুলো অসুবিধের মধ্যে একটাই সুবিধে আছে, চাইলেই প্রকৃতিকে জাপটে ধরে মনের কথা বলা যায়, তার কাছে নিজের অভাব অভিযোগ সব খুলে বলা যায় যে গান বাকি সকলের কাছে গাইলে হাসির পাত্র বা পাত্রী হতে হয় সেটা দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মাঝে চিৎকার করলেও কেউ বকা দিতে আসে না বা মুখ টিপে হাসে না
টিভির খবরে ভয়, ঠিক করলাম এই ভিড় থেকে দূরে পালিয়ে যাব, উদ্দেশ্য, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো এদিক-সেদিকনিজেরাই বাড়ি থেকে খাবার প্যাক করে নিলাম, ফ্রাইড রাইস আর ডিম কষা, সঙ্গে এক গ্লাস ভর্তি আদা দেওয়া লিকার চা। আপাতত নিশ্চিন্ত তারপর চললাম এগিয়ে ডুয়ার্সের দিকে যাযাবরের জীবনযাপন হওয়ায় উত্তরবঙ্গে ফিরলাম তিন বছর পর। সেজন্য একটা অন্যরকম ভালোলাগা ভেতরে ছিলই, বাড়িতে ফিরে আসার ভালোবাসা আবার সেই সবুজ প্রকৃতি, খাল-বিল, জঙ্গল পাহাড়, বিভিন্ন পাখিদের নানান ডাক, কোনোটা জানা কোনোটা অজানা!
লাটাগুড়ি ফরেস্ট-এর ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় চিরপরিচিত সেই ঘণ্টা পোকার আওয়াজ যেখানে গাড়ির এসি বন্ধ করে দিতে হয়, তার বদলে খুলে দিতে হয় কাচ সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকবে এক ঝাঁক ঠান্ডা সবুজ অক্সিজেন ভরা বাতাস এই ঘণ্টা পোকাকে অনেকেই ঝিঁঝিঁপোকা বলে ভুল করে, তা কিন্তু নয় আসলে ঘণ্টা পোকার নাম হয়েছে কারণ - মন্দিরে যখন একসঙ্গে অনেকগুলো ঘণ্টা বাজে তখন যে আওয়াজটি হয় এর আওয়াজ ঠিক তেমন।
মুখ বাড়িয়ে কিছুক্ষণ প্রাণভরে বাতাস নিলাম, তারপর সোজা চলে গেলাম চাপরামারি ফরেস্ট-এর ভেতর দিয়ে আরও দূরে শিবচু বিএসএফ ক্যাম্প ছাড়িয়ে ঝালং পার করে আরও অনেকটা ওই রাস্তার প্রতিটি বাড়িঘর দেখে মনে হয় ফুলের রাজ্যে এসে পৌঁছেছি ডান দিক দিয়ে বয়ে চলেছে পাথুরে নদী তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আমরা চললাম কুমানির দিকে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা ভালো, কুমারি আর কুমাই কিন্তু আলাদা



অন্ধকার ঝুপ করে নেমে এল, এটা বলাই বাহুল্য এমনিতেই সে দিনের আবহাওয়া মনমুগ্ধকর ছিল, একদম রোদ নেই, আর জঙ্গলে ঢোকামাত্রই আবহাওয়াটা আর বেশি অন্ধকার হয়ে এল আমরা সোজা চলে গেলাম যাচ্ছি তো যাচ্ছি, তবুও মনে হয় এ পথ যেন না শেষ হয় দুপাশে শুধুই মনোরম দৃশ্য তবে এখানে হাতি আসার সম্ভাবনা রয়েছে আমার ছোট্ট কন্যাটিও মায়ের এই উত্তেজিত ভাব দেখে খানিক অবাক
এতদিন পরে সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, নদী সকলকে কাছ থেকে দেখতে পেরে যে উচ্ছ্বাস মনের মধ্যে ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় নাএক অদ্ভুত আরাম আমাদের সবাইকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, বলছিল একদিনের জন্য তোদের ছুটি দিলাম এই মুখোশের বৃত্ত থেকে প্রকৃতিতে ঘুরে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো, আবার তো সেই ভয়।
এবার বেশ কিছুটা রাস্তা পাহাড়ে উঠতে হল জিজ্ঞেস করে করে আমরা অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট প্রচণ্ড বৃষ্টি তখন পাহাড়ে, আমরা গাড়ি থেকে নামতে পারছি না গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে গাড়ির মধ্যে বৃষ্টির শব্দ শুনছি আর গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি, সঙ্গে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট তারপর বহুক্ষণ আটকে ছিলাম গাড়িতে, আস্তে আস্তে সূর্য উদয় হলেন হঠাৎ দেখি কালো মেঘ সরে গিয়ে তিনি বেরোচ্ছেন হিরের দ্যুতি সঙ্গে নিয়ে! কী অপূর্ব দৃশ্য! জানলার কাচ ভেদ করে সূর্যালোক ভেতরে এসে ঢুকছিল, আমরা জানলার কাচ খুললাম গাড়ি থেকে দেখতে পাচ্ছি ভুটান পাহাড়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে অনেক নিচে বয়ে চলেছে পাথুরে নদী নানান রঙের ফুলের প্রাচীর সর্বত্র অপূর্ব দৃশ্য! কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা, প্রত্যেকেই চুপচাপ বসে রইলাম, গাড়ি থেকে নামতে হবে সে কথা ভুলে গেছি।



সামনে দেখা যাচ্ছে ভুটান পাহাড় পুরো এলাকাটাকে ঘিরে রেখেছে, মেঘগুলো আমাদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে অপূর্ব!! স্বপ্নপুরী যেন! ফুলে ফুলে ছেয়ে রয়েছে দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, সেখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায় অপরূপ প্রকৃতির দিকে, চুপচাপ শান্ত নিঝুম রয়েছে কতগুলি কটেজ এখানে থাকা যায়শহরের ভিড়ভাট্টা পলিউশন থেকে দূরে রঙ্গো ফরেস্ট এলাকার এই দলগাঁও পয়েন্ট যেন এক রূপকথার রাজ্য, যেখানে থাকলে মন ও শরীর দুয়েরই আরাম হবে
সাধারণত জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে একদিন ডে আউটিংয়ের জন্য ঘুরে আসা যায় দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট যারা থাকতে চাও তাদের জন্য রয়েছে কটেজ বা নানান ধরনের হোম স্টে করোনাকালে এখন রাত্রিবাস বন্ধ রয়েছে।



কীভাবে যাবে - শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি থেকে মোটামুটি এক দূরত্বযেতে দু-আড়াই ঘণ্টা মতো লাগে
কোথায় থাকবে - হোম স্টে, রিসর্ট সবই রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, সুবিধেমতো খুঁজে নিতে হবে


----------
ফোটো - লেখক

No comments:

Post a Comment