গল্প:: গোলুর সমুদ্র দর্শন - ঈশিতা রায় ব্যানার্জি


গোলুর সমুদ্র দর্শন
ঈশিতা রায় ব্যানার্জি

পৃথিবীটা খুব সুন্দর ছোট্ট গোলু ছোটোবেলা থেকেই মনেপ্রাণে কথাটা ‘বিশ্বাস’ করে ‘বিশ্বাস’ তো আর এমনি এমনি জন্মায় না চারাগাছের গোড়ায় নিয়মিত জল দেওয়ার জন্য, আগাছা উপড়ে বেড়া দেওয়ার জন্য কাউকে একজন খুব প্রয়োজন তেমন সাহচর্য ছাড়া চারাগাছ বাড়বে কী উপায়ে? তেমনই ছিল একজন গোলুর এক রহস্যময় কাকু কাকুর কাছেই যত কাকুতিমিনতি কাকুর কাছেই যত আবোলতাবোল আবদার
তখন বয়স ছয় কি সাড়ে ছয় গোলুরা তখন বেশ কিছুদিনের জন্য মামার বাড়ি বেড়াতে গেছিল ওখানে থাকতে বরাবরই খুব ভালো লাগে গোলুর মামার বাড়িতে প্রিয় বন্ধু গুটু বুনু আছে দিদিমা, মামা, গোল্ডেন মামি সবার সঙ্গেই গোলুর খুব ভাব গুটু বুনুর পাজেলগুলো ছিল ওর খুব পছন্দের দিনভর পাজেল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে সংখ্যার প্রতি গভীর ভালো লাগা তৈরি হল গুটু বুনুর পর সংখ্যারাই হয়ে উঠল গোলুর জীবনে দ্বিতীয় অন্যতম বন্ধু জোড় সংখ্যা, বিজোড় সংখ্যা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, স্কোয়ার ক্লাব, রেকট্যাঙ্গেল ক্লাব, পরপর জোড় সংখ্যার যোগফল, পরপর বিজোড় সংখ্যার যোগফল, সংখ্যা দিয়ে নানা রকমের প্যাটার্ন, আরও কত কী!! এমন কত কিছু নিমেষেই রপ্ত করেছিল তখনই একদিন আলাপ হল কাকদ্বীপ কাকুর সঙ্গে
বাইরে সেদিন বেজায় বৃষ্টি পুরো দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ঘোরতর নিম্নচাপ দুই-চার দিনের মধ্যে বৃষ্টি থামার কোনো সম্ভাবনাই নেই ভুলবশত পনেরো-কুড়ি মিনিট যদি বা বৃষ্টি কমল, অমনি আগের থেকে আরও জোরে রেগেমেগে ঝমঝমিয়ে নামছে চারিদিক ঝাপসা রাস্তায় দু’হাত দূরে কে আসছে বোঝা যাচ্ছে না বেলা দুটোতেই মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা ছ’টা এমন বৃষ্টি শুরু হলেই মামার বাড়ির কলিং বেলটা কাজ করে না হঠাৎ বৃষ্টির মাঝে বাড়ির বাইরের গেটে জোর ধাক্কার শব্দ সবাই তো ভেবেই খুন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন, এই দুর্যোগের মধ্যে আবার কে এল?
দুম দুম দুম দুম... দুম দুম দুম দুম...
মনে হচ্ছিল দরজাটা এবার বুঝি দুমড়ে মুচড়ে যাবে ঘরের সবাই রীতিমতো থতোমতো উপর থেকে ‘কে? কে? বলে অনেক হাঁকডাক করেও কোনো সাড়া মেলেনি কানময় বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না তখন গোল্ডেন মামি বাধ্য হয়ে নিচে নেমে দেখতে গেল দরজা খোলামাত্রই আহ্লাদে গদগদ
“আরে! কাকদ্বীপ কাকু আপনি? বাড়ি চিনলেন কীভাবে? কতদিন পর দেখা হে... হে......! একেবারে ভিজেনেয়ে একশা! আসুন আসুন ভিতরে আসুন
আগন্তুক কাকদ্বীপ কাকুও ভাইঝির ব্যবহারে বেশ নিশ্চিন্ত এতক্ষণ অবধি আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবছিলেন প্রবল ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বলা নেই কওয়া নেই, ভাইঝির শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হওয়া উচিত হবে কি? উপরন্তু, আগে একবারটিও এখানে আসেননি এই নিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর চালাচালি চলছিল সে যাই হোক, ভাইঝির আন্তরিকতা দেখে উনি বেশ আশ্বস্ত হলেন
গোলু আর গুটুও গুটিগুটি পায়ে হাজির দু’জনেই বেড়ালের মতন গোল্ডেন মামির আঁচলের তলায় ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাকদ্বীপ কাকুর দিকে গুটু কানে কানে বলল, “এ দাদাভাই! আবার কে? আমি কিন্তু চিনি না আচ্ছা, হাগি বগির সেই লোকটা নয় তো?
“চুপ চুপ! চিনিস না যখন হাবভাব অবজারভ কর! হাগি বগি হলে কপালে কষ্ট আছে মজা দেখিয়ে ছাড়ব আই উইল ডেফিনিটলি পানিস হিম
“কাকু এদিকে কোথাও কাজে এসেছিলেন বুঝি? নাকি কোনো কনফারেন্স? কতদিন পর দেখা! আপনি যে মাঝেমধ্যে কোথায় গায়েব হয়ে যান! কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন না
গোল্ডেন মামি অনুযোগের সুরে কত কথাই বলল কিন্তু কাকদ্বীপ কাকু তাঁর সাধের ভাইঝির কথা কানেই তুললেন না কাকু আবারও হারিয়ে যাচ্ছেন তবে এবার কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্রে নয়, বা অঙ্কের খাতাতেও নয় কাকু এখন গভীর দৃষ্টিতে তুলতুলে দুই বাচ্চাকে দেখতে ব্যস্ত
কাকুর এই এক স্বভাব অঙ্কের খাতা অথবা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, আর কচিকাঁচা বাচ্চা পেলে তিনি জগৎ সংসারের কথা ভুলে যান পৃথিবীতে এই তিনটি বিষয় ওনার একান্ত প্রিয় যে সব বাচ্চারা অঙ্ক কষতে তেমন একটা পছন্দ করে না, কাকুর সংস্পর্শে আসামাত্রই তাদের জীবন বদলে যায় কিছু দিনের মধ্যে অঙ্ক হয়ে যায় তাদের প্রিয়তম বন্ধু কাকুর জীবনে প্রতিটা বাচ্চা যেন নানান রং-এর এক একটা ফুল ফুলের মতন পরম যত্নে ভালোবাসেন বাচ্চাদের বাচ্চারাও তেমনি ঝোড়ো কাকের মতন সাদা-পাকা চুল, মুখময় এলোমেলো দাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চেহারায় পরিপাটির নামমাত্র নেই, এমন রোগা, লম্বা, প্যাংলা পাগল গোছের মানুষটার কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্রই বাচ্চারাও ভালোবেসে ফেলে তাঁকে গোলু, গুটুরও সেই দশাই ঘটল কয়েকদিনের মধ্যেই কাকুর সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে ক্ষীর সম্পর্কে দাদু হলেও গোলু-গুটু ওনাকে কাকু বলেই ডাকে

পড়াশোনা করতে ভালোই লাগে গোলুর সকালবেলা ওঠামাত্রই বইখাতা, স্লেট নিয়ে পড়তে বসে যায় গোলুর মা-বাবাকে এই বিষয় নিয়ে তেমন একটা ঝক্কি পোহাতে হয় না তবে অঙ্কটা একটু বেশিই ভালোবাসে কাকদ্বীপ কাকু বাচ্চা দুটোকে দেখামাত্রই ওদেরকে নিয়ে অঙ্কের ধাঁধায় ঘুরপাক খেতে লাগলেন মেঝেতে বসে খেলার ছলে দিনভর শুধু অঙ্ক আর অঙ্ক সংখ্যায় সংখ্যায় কেমন যেন ঢেউয়ের মতন নেচে নেচে ঘুরে বেড়ানো যায় সংখ্যার মাঝে যেন সমুদ্রের গভীরতা আছে
সেদিন দুপুরবেলায় খাওয়াদাওয়ার পর কাকদ্বীপ কাকু গোলু-গুটুকে নিয়ে মাতলেন সমুদ্রের গল্পে অমনি গুটু চোখ পাকিয়ে বলল, “কাকু, তুমিও সমুদ্র দেখেছ? কত বিশাল বলো? কত বড়ো বড়ো ঢেউ আমাদের গ্রামের বাড়িতে বটতলার দিঘি আছে সেই দিঘির থেকেও অনেক অনেক বড়ো জানো তো, আমি হাপুস হাপুস করে চান করলাম আর দাদাভাইটা একটা ঢ্যাঁড়স! ভয়েই নামল না
“এই বুনু! ইউ আর টেলিং লাই আই আম নট স্কেয়ারড
“না গো কাকু, দাদাভাই স্কেয়ারড ছিল এখন বলতে লজ্জা পাচ্ছে
“হোয়াট ইজ নজ্জা? সমুদ্র ভালো তবে একটু বেশি জাম্পিং করে এই বুনুর মতন
“জানো কাকু, ওদের বাড়ির ওখানে ‘মেডিটেরিয়ান সি’ আছে দাদাভাই আজ অবধি একটি বারের জন্যও সেই সমুদ্রে পা ডোবায়নি পাড়ে বসে শুধু স্যাণ্ড ক্যাসেল বানিয়েছে আমাকে ছবি পাঠিয়েছিল যে!
কাকদ্বীপ কাকু তো হেসেই গড়াগড়ি এদের ছেলেমানুষি ঝগড়া দেখে ভীষণ মজা পেলেন সমুদ্রের গল্প এদেরকে আর কী শোনাবেন! চুলোচুলি থামলে তবেই না! বরং উনি আগুনে আরও ঘি ঢাললেন
“সে কী রে গোলু ভাই, তুই এত বীরপুরুষ? আমি তো ভাবলাম, তুই বিদেশ বিভুঁয়ে থাকিস, তাহলে নিশ্চয়ই একটু অন্যরকম হবি দু’চোখ ভরে পৃথিবীকে দেখবি, ভালোবাসবি, তবেই না! অঙ্ক কষতে গেলে পৃথিবীকে যে ভালোবাসতে হবে! এই আকাশ, বাতাস, সাগর, নদী, পাহাড়, অরণ্য, গ্রহ, নক্ষত্র সবের মধ্যেই তো সংখ্যা লুকিয়ে আছে সেইসব সংখ্যা খুঁজতেই তো দুড়দাড় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া যেদিকে মন চায় ঘুরে বেড়ানো
গোলু-গুটু তখন রীতিমতো হতবাক বিস্ময়ে চোখ এক একখানা পান্তুয়া ঝগড়াঝাঁটি উধাও কাকদ্বীপ কাকুর গল্প তখন যেন একটা জলজ্যান্ত গ্যালাক্সি কোথায় যে পৌঁছাবে, কোথায় গিয়ে যে থামবে কেউ জানে না গুটু ধীর গলায় বলল, “কাকু তবে কি ভ্রমণের আর একটা নাম ‘সংখ্যা’?
সত্যি, কী অদ্ভুত একটা কথা বলল গুটু! অকল্পনীয় ব্যাপার একটা ছয় বছরের মেয়ে এমন কথাও ভাবতে পারে - ভ্রমণের আর এক নাম ‘সংখ্যা’! আসলে, শিশুমন এমনই তো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত রহস্য শিশুমনে খিলখিলিয়ে ঘুরে বেড়ায় শুধু একটা ধাক্কার অপেক্ষা একটা ভালোবাসাময় ধাক্কা পেলেই সবটা যেন ম্যাজিকের মতন সেই ধাক্কার জোরেই প্রতিঘাত স্বরূপ বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার নক্ষত্রের আলো
কাকদ্বীপ কাকু কথাটা শোনামাত্রই আবেগে আপ্লুত অমনি ঝোলা থেকে দুটো ক্যাডবেরি বের করে গোলু-গুটুর হাতে গুঁজে দিলেন
“হ্যাঁ তাই তো রে দিদি! ভ্রমণ মানেই ‘সংখ্যা খোঁজা’ বলতে পারিস, এরা ঠিক যেন সিনোনিমাস ওয়ার্ড কী রে গোলু ভাই, তুই এত চুপচাপ কেন? আমাদের গল্প কি তোর ভালো লাগছে না?

গোলু তখন অন্য জগতে এখানে থেকেও যেন নেই নিজের স্বপ্নে বুঁদ প্রিয় ক্যাডবেরির র‍্যাপারটা ছিঁড়ে খাওয়ার কথা ভুলেই গেছে ছেলেটা এমনই কথায় কথায় খেই হারিয়ে ফেলে আকাশে-বাতাসে কোথায় না কোথায় ভেসে বেড়ায় প্রতিদিন ভাবে পৃথিবীটা দেখবে নিজের মতন করে একটু চিনবে একটু চেনাশোনা হলে জানতে চাইবে, ‘ও গো তোমাদের রকমসকম কেমন? আমাকেও একটু বলো না তোমাদের গল্প!
মাঠের পাড়ে, নদীর ধারে সূর্য কেমন করে এক পা, এক পা করে ওঠে - জানতে বড়ো সাধ হয় গোলুর সূর্যটা কত শান্ত, ধীর, স্থির; অথচ কত তেজ দিনভর ওখানে নাকি কী সব ফিউশন চলছে লাভা, ম্যাগমার থেকেও বোধ হয় বেশি তেজি তবুও দিন শেষে আর সকালবেলার শুরুতে কেমন মিষ্টি লাগে আচ্ছা, পাহাড়ের ওপাশটায় কারা থাকে? তাদের দেশটাও কি এই এমনতর? ওদের দেশের আকাশটাও কি নীল? ওখানেও কি এই একইরকম গাছপালা? ওখানেও কি গাছে গাছে এই একইরকম পাখি? আচ্ছা, ওদের পথের ধারে কি আমাদের মতনই দুব্বো ঘাস গজায়? ফড়িং কি রোদে ডগমগ হয়ে ঘাসের ডগায় ডগায় বিড়বিড় করে কথা কয়? আচ্ছা, ওখানেও কি কলকল সুরে নদী বয়ে যায়? আরিয়েলে তো দুব্বো ঘাস নেই ওখানে কেমন যেন কাঁটা ঝোপঝাড় আর এদিক-ওদিক পাইন আর অলিভের জঙ্গল সে এক অন্য রকম বাঁধনহারা গাছের কাণ্ডগুলো ওখানে সাদা সাদা গোলু রঙ করতে বসলেই বুঝতে পারে না গাছের গুঁড়ির রঙ কী হবে! সাদা নাকি বাদামি? আরিয়েলে শীত আসলেই পথের ধারে হেলেদুলে একে একে হলদে রং-এর ক্যালেন্ডুলা গজিয়ে ওঠে কী মিষ্টি লাগে তখন! কত কতদিন ফুল তুলেছে, ওদেরকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছায় একদিন মা ভীষণ বকল ঠিক বকেনি কথাগুলো বকার মতন লাগেনি, তবুও গোলুর চোখে জল এসেছিল, “গোলু, অকারণে কোনোদিনও ফুল তুলতে নেই সোনা গাছের সৌন্দর্য ফুলের শোভায় তুমি যেমন আমার কোলে থাকতে ভালোবাসো, গাছ মায়েরও তো বাচ্চা ফুলগুলো ফুলকে তাই গাছ মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কি উচিত? তুমিই বলো! ওদেরও তো কষ্ট হয়! ফুলকে শুধু চোখ দিয়ে, মন দিয়ে দেখতে হয় চোখ বুলিয়ে, মন বুলিয়ে দেখে আনন্দ পেতে হয়
সেই থেকে গোলু আর কখনও ফুল তোলে না দূর থেকেই ফুল দেখে আর খুশি হয় সেই যে সেবার ‘ডেড সি’ গেল! কী আশ্চর্য জায়গা!

হঠাৎই কাকদ্বীপ কাকু আর গুটুর ডাকাডাকিতে গোলু ধুপ করে স্বপ্ন থেকে পৃথিবীতে নেমে এল ওরা দু’জনেই গোলুর হাত ধরে রীতিমতো টানাটানি করছে যেন কৈলাশে ধ্যানমগ্ন শিবঠাকুর তাঁর ঘুম ভাঙাতে গিয়ে নন্দী আর ভৃঙ্গির সে এক মস্ত সাধনা কালঘাম ছুটে গেল
“এই দাদাভাই! দাদাভাই! ওঠ না তুই তো বসে বসেই কেমন যেন ঝিমিয়ে যাস তোকে নিয়ে এক মস্ত সমস্যা! এতক্ষণ কোথায় হারিয়ে গেছিলি? তোকে কখন থেকে ডাকছি জানিস? তোর তো কোনো হুঁশই ছিল না কী ভাবলি আমাদেরকেও তো বল!!
কাকদ্বীপ কাকুও গুটুর সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, “গোলু ভাই ঠিক আছ তো? কোথায় হারিয়ে গেছিলে?
“না না, আমি ঠিক আছি সেই যে ‘ডেড সি’! ওখানে গেছিলাম জায়গাটা আমার খুব প্রিয় আচ্ছা, সমুদ্র না? আমরা সমুদ্রের কথা বলছিলাম না? আমার একমাত্র ‘ডেড সি’-টাই ভালো লাগে আই লাভ দিজ প্লেস কেউ চাইলেও ডুবতে পারবে না ওখানে
“গোলু ভাই, তুমি ‘ডেড সি’ দেখেছ? দারুণ ব্যাপার তো! তোমাদের দেশটায় আমার যাওয়া হয়নি এবার তোমাদের সঙ্গেই ইজরায়েলে একবার ঢুঁ মেরে আসব জর্ডনে গেলেও ‘ডেড সি’ দেখা যেতে পারে তবে ইজরায়েলেই যাব

গোলু এবার পাহাড়ি ঝরনার মতন তিরতির করে বইতে লাগল চোখেমুখে তখন ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ সকালের মিঠা রোদ মেখে যেন ঝিকমিক করছে
“তোমরা শুনবে ‘ডেড সি’- গল্প? জানো, ‘ডেড সি’- ওখানে একটা গাছও নেই ফুলও নেই এমনকি গুল্মলতাও চোখে পড়বে না! আমার মা বেশ সুন্দর একটা কথা বলেছিল – ‘সবুজের চিহ্ন নেই বই-কি! তবে এই যে নেই ধন, সে- তো এক প্রকারের ধন!...
“পাখি আছে তবে সে যে কোথায় থাকে কেউই হয়তো জানে না পাখিদের দেখা তেমন একটা মেলে না না থাকার মতনই পথচলতি বেড়াল, কুকুর কিচ্ছুটি নেই পশুপাখিরা বোধ হয় ভুল করেও তল্লাট মাড়ায় না ওখানে মানুষের দেখা পাওয়াও ভগবানের সমান যুগ যুগ ধরে কোনো জনবসতি আদৌ যে ওখানে গড়ে ওঠেনি, সে চোখে দেখেই বোঝা যায় মনুষ্য জনজাতির কোনো চিহ্নমাত্র নেই অবশ্য, আমি কতটুকুই বা জানি দেয়ার ইজ সামথিং দ্যাট ইজ বিয়ন্ড মাই নলেজ বাবার মুখে শুনেছি, কিছু বেদুইন প্রজাতি নাকি দেখা যায় ওখানে তবে তারা তো বেদুইন, নোমেডিক আই হ্যাভ নেভার সিন দেম বিফোর দ্যাটস হোয়াই, আই ক্যান সে - দ্যাট প্লেস ইজ ওয়ান কাইণ্ড অফ নো ম্যানস ল্যাণ্ড তবে হ্যাঁ, পাহাড় কেটে সুন্দর সুন্দর রাস্তা বানানো আছে ঐতিহাসিক শহর ‘জেরুজালেম’ থেকে ইজরায়েলের একদম দক্ষিণতম শহর ‘এইলাট’ অবধি সুন্দর রোড কানেকশন ডিসট্যান্স প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার এই সাড়ে তিনশো কিলোমিটারের রোড জার্নি এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা অনেকে অবশ্য এই জায়গাটা নিয়ে খুব অফেণ্ডেড তাদের মতে, এই বিশাল এলাকা জুড়ে কোনো জিওগ্রাফিক্যাল চেঞ্জেস নেই চোখমাথা নাকি ঝাঁ ঝাঁ করে ধূ ধূ মরুভূমি, পাহাড় আর ‘ডেড সি’ দেখতে দেখতে আমার একজন দাদু তো বিরক্ত হয়ে বলেই বসলেন ‘এ যে এক জনমনিষ্যিশূন্য নিস্তব্ধ, ধূসর, ধ্বংসপুরীর চিত্র বিধাতার রোষে কোনো বিশাল স্থাপত্য শিল্পের দিগন্ত জোড়া ধ্বংসস্তূপ বলে মনে হচ্ছে....
“এত কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ঠিকঠাক বুঝিনি ঠিকই তবে দাদু যে মোটেই খুশি নয় বেশ টের পেলাম আমার কিন্তু এমন কিছুই মনে হয়নি আমার তো বেশ লাগছিল প্রকৃতির কত রঙ্গ... শুধু দ্যাখো আর খুশি হও মনে... দিগন্ত জুড়ে রুক্ষ, শুষ্ক মরুভূমি মরুভূমির মাঝেই বিশাল বিশাল পাহাড় পাহাড়গুলো সবই যেন ভাঙছে ওদের বোধ হয় অনেক কষ্ট ভাঙতে ভাঙতে একদিন পুরো ধূলো হয়ে যাবে সেই যে গোপী দাদার পা ভেঙে গেল কী ভয়ানক ব্যথা হচ্ছিল গোপী দাদার ব্যথায় ছটফট করছিল বাচ্চাদের মতন আলুথালু হয়ে কাঁদছিল গাল বেয়ে সমানে নামছিল নোনতা জল এই পাহাড়গুলোর নিশ্চয়ই গোপী দাদার মতন কষ্ট দিক দিগন্ত জুড়ে ভাঙনের খেলা বাতাস বইছে শোঁ-শোঁ সূর্যদেব সক্কাল সক্কাল কিড়মিড়িয়ে গিলতে চাইছে সবাইকে গিলতে গিলতে মাটির বুক থেকে সমস্ত জল শুষে নিয়েছে ওখানকার মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে যদি সুদূর পাতালেও কেউ পৌঁছে যায়, তবুও এক ফোঁটা জল পাবে না ওদের প্রতি এমনই রাগ সূর্যদেবের জলের অভাবে পাথরগুলোর বুক তাই হয়তো চৌচির তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে ছাতি, তবুও জল পায় না যুগ যুগান্ত ধরে পাথরের সমস্ত রক্ত যেন নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে লড়াই করছে জলশূন্যতার অসহনীয় দুঃখ সইতে সইতে ওদের শ্বাসরোধ হওয়ার জোগাড় হয়তো তাই ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করছে নিজেকে
“শুধু শুকায়নি চোখের জল চোখের নোনতা জল জমতে জমতে ওদেরই বুকের গভীরে সমুদ্র হয়ে বইছে সূর্যদেব আপ্রাণ চাইছেন প্রতিশোধ নিতে, কিন্তু পারছেন না কেন যে ওনার এত রিভেঞ্জ নেওয়ার ইচ্ছা, অতশত জানি না ব্লটিং পেপারের মতন শুষে নিতে পারছেন না সমুদ্রটাকে পৃথিবীর বুকের গভীর থেকে গভীরে বন্দরহীন সমুদ্রটা দিনরাত জেগে রয়েছে মা বলল, এটা নাকি পৃথিবীর লোয়েস্ট পয়েন্ট সূর্যদেব চাইলেও তাই এই সমুদ্রকে কখনোই পুরোপুরি গিলতে পারবেন না আমার তাই বেশ মজা হচ্ছিল কী ভেবেছেন উনি, সবাইকে শায়েস্তা করবেন? এত সহজ নয় পাহাড়ের চোখের জল যে এত নোনতা, না ছুঁয়ে দেখলে কল্পনা করা সম্ভব নয় সাধারণ সমুদ্রের জলের চেয়ে ‘ডেড সি’- জল প্রায় আট গুণ বেশি লবণাক্ত এটা কিন্তু মোটেই গালগল্প নয় একবার যদি চোখে ঢোকে না, লঙ্কা কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে মানে চোখে লঙ্কা লেগেছে বলে মনে হবে এত্ত জ্বালা করে আমার চোখে তো ঢুকেছিল মনে হল যেন অন্ধ হয়ে যাব আত্মারাম বাবাজি যেন চোখ দিয়েই খাঁচাছাড়া হবে আমাদের ট্যুর গাইড বললেন - শরীরে কোথাও কারোর যদি রিসেন্ট কোনো উণ্ডস থাকে, তবে তারা যেন সমুদ্রে না নামে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে ‘ডেড সি’-তেও বেশ ঢেউ রীতিমতো ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে একবার যদি মুখ থুবড়ে পড়ে কেউ, তাহলে কী যে হবে! বাপ রে বাপ, ভাবতেই পারছি না পায়ের তলায় বাঘের দাঁতের মতন ফুটবে খোঁচা খোঁচা লবণ এত মোটা দানার লবণ আগে কখনও দেখিনি কোথাও কোথাও লবণ জমে জমে পাথর হয়ে গেছে অতি সন্তর্পণে বুঝেসুঝে জলে নামা এরপরেও ‘ডেড সি’ মানেই কিন্তু এণ্ডলেস প্লেজার ‘ডেড সি’ যে আমাদেরকে ভালো মনে গ্রহণ করছে, তা কিন্তু নয় আমার কানে কানে বারবার বলে গেল ‘এ তো আনন্দ অশ্রু নয় তবে আমাকে দেখে তোমাদের এত আনন্দ কীসের?
“সত্যিই তো, কারোর দুঃখ দেখে কখনও হাসতে নেই দুঃখীর দুঃখ দেখে আনন্দ পাওয়া - তো ভীষণ বেয়াদবি চাল কিন্তু এই সমুদ্র যেন নিজের হাজারো দুঃখকে ধুয়ে মুছে মনুষ্য জাতির আনন্দের কারণ হতে চাইছে আমাদের চোখের উপরে যেন রঙিন চশমা পরিয়ে দিয়েছে ওর দুঃখগুলো তাই আমাদের চোখে দুঃখ নয় শুধু আলো আর আলো আনন্দের আলো দেশ দেশান্তরের মানুষ তাই ছুটে ছুটে আসে, বিরল এই সমুদ্র দর্শনের লোভে এমন আনন্দবাজারে দুঃখ কী করে পসার সাজিয়ে বসবে বলো? এখানে কোথাও মৃত্যু নই, শুধু আনন্দ আর আনন্দ
“আমার বাবা তার বেশ কয়েকটা স্টুডেন্টকে বিজ্ঞানের পাঠ দিচ্ছিল – ‘ডেড সি- জলের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় জলের ‘প্লবতা’ বেশি হয় আর ‘প্লবতা’ এতটাই বেশি হয় যে, যদি বস্তুর ওজন বেশিও হয় তবুও তাকে জলে ডোবানো কোনোভাবেই সহজ ব্যাপার নয়
“আমি অবশ্য, কিছুই বুঝিনি ‘প্লবতা’ যে কী জিনিস, আমার মাথায় বিন্দুমাত্র ঢোকেনি আমি শুধু দেখলাম - আমি জলে ভাসছি... ভেসেই আছি... ডুবছি না... কেউ ডোবাতেও চাইলেও আমাকে ডোবাতে পারবে না...

ঘরের মধ্যে কোনো শব্দ নেই, ঘড়ির টিক টিক ছাড়া গুটু বুনু আর কাকদ্বীপ কাকু একটুও নড়ছে না, চলছে না, উঠছে না, বসছে না যেন পাথর হয়ে গেছে গোলু এখন ওদের গল্পদাদু গল্পদাদু যেমনভাবে দেখাচ্ছে, ওরা তেমনভাবেই দেখছে ‘জর্ডন রিপ ভ্যালি’- আনাচেকানাচে গল্পদাদু যেমনভাবে ঘোরালো, ওরাও ঠিক তেমনভাবেই ঘুরল গল্পদাদু গোলুর চোখেই বিরল এক পৃথিবীর স্বপ্ন বুনল গুটু বুনু আর কাকদ্বীপ কাকু
ছোটোরাও স্বপ্ন বুনতে জানে শুধু একটু স্নেহস্পর্শ চাই স্নেহস্পর্শ ফুসমন্তরের মতন মনেপ্রাণে মহৎ এক ‘বিশ্বাস’-এর শিক্ষা দেয় জগতে যা কিছু দেখছ, সবই সত্যি, সবই সুন্দর আমাদের পৃথিবী আমাদের ঘর আমাদের আশ্রয় একমাত্র অবলম্বন নিজের ঘর তো সবসময় সুন্দর- হয়, তাই না? ছোট্ট গোলু মর্মে মর্মে এটাই ‘বিশ্বাস’ করে জীবনের এক চির সত্য উপলব্ধি
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment