যেতে পারি, কিন্তু…
অনন্যা দাশ
“এই ব্যাগটা কার?” লম্বা বিশালবপু অ্যাফ্রো মার্কিনি মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলেন। মহিলা নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত জে এফ কে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি চেকারদের একজন।
কেকা শুনতে পেল বটে, কিন্তু তখন তার দেখার মতন অবস্থা ছিল না। সে নিজের ব্যাগটাকে সিকিউরিটি কনভেয়ার বেল্টে তুলে দিয়ে মেটাল ডিটেকটার দিয়ে সবে ঢুকেছে তখন। কেকাকে দেখেই মেটেল ডিটেকটার সশব্দে লাল আলো ঝলমল করে বেজে উঠল। কেকা ঘাবড়ে গেল তীক্ষ্ণ শব্দ শুনে। কীসের জন্যে শব্দ হল রে বাবা? তারপরই খেয়াল হল সে গয়নাগুলো খুলতে ভুলে গেছে! কোনটার জন্যে চিৎকার বোঝার উপায় নেই, হাতের চুড়ি না কানের দুল?
মেটেল ডিটেকটারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা কর্কশ সুরে বললেন, “কথা বুঝতে পারো না? যাও কানের দুল আর হাতের চুড়ি খুলে বেল্টে দিয়ে আবার ফিরে এসো।”
কেকা বেল্টের কাছে ফিরে গিয়ে একটা ট্রে তুলে নিয়ে তাতে কানের দুল, হাতের চুড়ি সব কিছু খুলে রেখে বেল্টে চালান দিয়ে আবার ফিরে এল। এবার মেটেল ডিটেকটার তাকে দেখে আর চিৎকার করল না, কিন্তু ততক্ষণে ‘এটা কার ব্যাগ’ প্রশ্নটা চারবার করা হয়ে গেছে! যিনি চেঁচাচ্ছিলেন তিনি এবার ব্যাগটাকে নিয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিলেন। কেকার হঠাৎ মনে হল আরে মহিলার হাতে যে ব্যাগটা রয়েছে সেটা যেন তার ব্যাগটার মতনই লাগছে! এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। নাহ, ওটা কেকারই ব্যাগ। তার মানে এতক্ষণ কেকার ব্যাগটার জন্যেই চিৎকার চলছিল, সে বুঝতেই পারেনি! সে হাতের চুড়ি আর কানের দুল খুলতে এতটাই ব্যাস্ত ছিল যে খেয়ালই করেনি! এবার কেকা পড়ি কি মরি ছুটল। ব্যাগ হারালে তার সর্বস্ব চলে যাবে। তার আই ডি, ডলার সব কিছু ওটাতেই রয়েছে! কোনো রকমে সিকিউরিটি চেক হয়ে বেরিয়ে আসা কানের দুল আর হাতের চুড়ি খামচে তুলে নিয়ে ছুট দিল কেকা। জুতোটা পড়েই রইল। সিকিউরিটি চেকিংয়ের সময় জুতো খুলিয়েছিল ওরা, কিন্তু সেটা পরার আর সময় নেই কেকার হাতে, তার ব্যাগ নিয়ে মহিলা অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন যে।
মহিলা ততক্ষণে ওর ব্যাগটা নিয়ে পাশের একটা পর্দা দিয়ে ঘেরা আলাদা করা জায়গায় ঢুকে পড়েছেন। কেকা পর্দাটা তুলে ভিতরে উঁকি দিল।
“কী চাই?” কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা দুজন বিশালাকায় সাদা রক্ষী হেঁকে উঠল।
কেকা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই যে ওঁর কাছে আমার ব্যাগ!” মা বলেছিলেন আঙুল তুলে দেখাতে নেই, কিন্তু কী আর করা যাবে। এখন আর সেই সব ভাবার সময় নেই।
“হুঁ, তোমার ব্যাগ! বেশ তাহলে এটা কী নিশ্চয়ই বলতে পারবে!” দু’জনের মধ্যে একজন কেকার জোয়ানের শিশিটা তুলে দেখিয়ে বলল।
সর্বনাশ! এবার কী করবে কেকা?
“ওটা মৌরির মতন একটা মশলা, হজমে সাহায্য করে,” সে ভয়ে ভয়ে বলল। মৌরি জানে আশা করি এরা।
এতকাল যেখানেই গেছে মা সব সময় ব্যাগ গুছিয়ে দিতেন। নিউ ইয়র্কের কলেজে ভর্তি হবার পর এই প্রথম কেকা নিজে নিজে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।
“মৌরি?” বলেই ওরা শুঁকতে শুরু করল। কেকার মাথায় বাজ। জোয়ানের গন্ধ তো আর মৌরির মতন নয়, তা এই মাথামোটাদের কী করে বোঝাবে সে?
সে বলল, “না, না, এটা মৌরি নয়। মৌরির মতন। যাক ওটা আমার লাগবে না। ফেলে দিন ওটাকে।”
জোয়ানের শিশির পিছনে ছোটার চেয়ে প্লেন ধরাটা বেশি জরুরি। বাড়িতে একবার পৌঁছোতে পারলে অনেক জোয়ান পাওয়া যাবে।
ওরা কেকাকে আপাদমস্তক জরিপ করে ফেলল। আশা করি তাকে সুইসাইড বম্বার মনে করছে না তারা। এদিকে বিশালকায় মহিলা ততক্ষণে কেকার ব্যাগটাকে উলটে ফেলে ভিতরের সব কিছু বার করে ফেলেছেন একটা টেবিলের ওপর।
“টুথপেস্ট, চলবে না,” বলে পাশে রাখা একটা প্লাস্টিকের বাক্সে দুম করে পেস্টটা ফেলে দিলেন। কেকা ভাবল উফ এরা দাঁত মাজাও পছন্দ করে না নাকি?
“সেন্ট নেওয়া চলবে না,” আবার দুম!
“ডিওডোরেন্ট” - দুম!
এক এক করে কেকার ব্যাগে যত কসমেটিক্স আর ওষুধ ছিল সব পাশের প্লাস্টিকের ‘প্লেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না’ বাক্সে দুম হল।
কেকা তারকা রাক্ষুসিকে কী করে বোঝাবে যে ওর মা এতদিন ওর জন্যে গুছিয়ে দিতেন। তাছাড়া কোভিড, সুরক্ষা ব্যবস্থার নানান কড়াকড়ির জন্যে তৈরি নতুন নতুন নিয়মের খেয়াল রাখা ওর পক্ষে সম্ভব নয়!
জলের বোতল – দুম!
নিভিয়া ক্রিম – দুম!
মুখে মাখার ফাউন্ডেশান – দুম!
শেষমেশ টাইগার বামের ছোটো কৌটোটা নিয়ে যখন ফেলে দিল মহিলা তখন কেকার হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল! মনে হচ্ছিল চিৎকার করে সে বলে, ‘আরে বাবা ওটা মাথা ধরার ওষুধ! এত লম্বা সফরে ওটা লাগবে বলেই নিয়েছি! কতই বা ওজন ওটার? আর আমি কি পাইলটকে মাথা ব্যথার ওষুধ দিয়ে কাবু করে প্লেন হাইজ্যাক করে নিয়ে যাব নাকি?’
কিন্তু রাগ দেখানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বুঝতে পেরে মুখে সে শুধু মিনমিন করে বলল, “ওটা মাথা ধরার ওষুধ!”
“নেওয়া চলবে না!” বলে সেটাকে ফেলে দিয়ে প্রায় খালি ব্যাগটা কেকাকে ধরিয়ে দিয়ে মহিলা সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
কেকা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। যা ফেলা হয়েছে সেগুলো এমন কিছু দামি জিনিস নয়, কিন্তু তাও মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কেন যে সে প্লেনে ওঠার আগে ওয়েবসাইটে কী নেওয়া যাবে আর কী যাবে না চেক করেনি।
“প্লাস্টিকের জিপার ব্যাগে করে ওগুলো নিলেই হত! তাহলেই আর ওরা কিছু বলত না!” কে একজন ফিসফিস করে পিছন থেকে কেকাকে বলল।
কেকা ফিরে তাকিয়ে দেখল সিকিউরিটি পোশাক পরা আরেকজন মহিলা মুচকি হেসে তাকে বলছে। এও কালো, কিন্তু এর চেহারা ছোটোখাটো। কেকার হঠাৎ মনে পড়ল, তাই তো, ওর রুমমেট তো বলেছিল বটে সেন্ট, ডিওডরেন্ট সব কিছু প্লাস্টিকের জিপলক ব্যাগে ভরতে! সে বোকার মতন ভুলে গিয়েছিল।
“কিন্তু এখানে প্লাস্টিকের জিপলক ব্যাগ কোথায় পাব?” কেকা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“সামনের ইনফরমেশান কাউন্টারেই পাওয়া যায়। তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি,” বলে সে কেকাকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটা জিপলক ব্যাগ নিয়ে ফিরে এল।
“নাও, তোমার জিনিস তুলে নাও। আসলে আমাদের কিছু করার নেই, আমরা রোজ রোজ নতুন নতুন আদেশ পাই, এই করতে হবে সেই করতে হবে। সিকিউরিটির ব্যাপারটা এখন এমন কড়া হয়ে গেছে। তাছাড়া এত বড়ো এয়ারপোর্ট, এখানে রোজ কিছু না কিছু হুমকি আসতে থাকে। আজ কেউ বলে বোমা ফাটাবে, কাল কেউ বলে বন্দুক নিয়ে আসবে। সেই সব সত্যি না হলেই ভালো, কিন্তু কিছু ঘটে গেলে লোকে আমাদেরই দোষ দেবে। বলবে আমরা কাজে ফাঁকি দিয়েছি!”
কেকা ভেবে দেখল কথাটা তো মোক্ষম সত্যি, তাই সে কিছু বলল না।
“আমিও মাথা ব্যথায় ভয়ানক কষ্ট পাই, তাই বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। নাও আর মন খারাপ কোরো না। প্লেনে গিয়ে বসো,” বলে মেয়েটা হাত নেড়ে মিষ্টি হাসি হেসে চলে গেল।
জিপলকে ভরা জিনিসগুলোকে ব্যাগে ভরতে ভরতে কেকার মনে হল প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে যে কী লাভ হচ্ছে এদের কে জানে! কিছু একটা বললেই হল!
কেকার জুতোটা সিকিউরিটি কনভেয়ার বেল্টের কাছেই পড়ে ছিল। হুড়োহুড়ি করে ছুটে গিয়ে জুতো পায়ে গলিয়ে সে প্লেন ধরতে গেল। প্লেনের বাকি সহযাত্রীরা সব তখন যে যার সিটে বসে পড়েছে। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে নিজের ব্যাগটাকে মাথার ওপরের জায়গায় ধরাল কেকা। নিজের জায়গায় বসে সিটবেল্ট পরতে পরতেই যেন প্লেনটা রওনা দিল। আরেকটু হলেই হয়েছিল আর-কি!
* * *
চব্বিশ ঘন্টার কঠিন সফরের পর প্লেন থেকে নেমে, কাগজপত্রের কাজ মিটিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মা-বাবার হাসি হাসি মুখ দেখে অবশ্য সব রাগ, দুঃখ, ক্লান্তি ভুলে গেল কেকা। তারকা রাক্ষুসিকেও ক্ষমা করে দিল সে। তাছাড়া তারকা যেমন আছে তেমন উপকারী বন্ধুও তো আছে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “এতটা পথ আসতে কষ্ট হয়নি তো?”
কেকা প্রথমে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে উত্তর দিল, “না, না, কোনো অসুবিধাই হয়নি!”
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment