বাঙালির রাজস্থান ভ্রমণ
স্নেহা অধিকারী কর
‘ভ্রমণ’ কথাটির
সঙ্গে জুড়ে আছে অনেক অভিজ্ঞতা। ভ্রমণ মানে কিন্তু শুধুই ঘুরে বেড়ানো নয়,
সঙ্গে নিয়ে চলা অনেক স্মৃতি আর গল্প। আমরা ভ্রমণ করি ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে জুড়ে থাকা ইমোশনগুলোকে উপলব্ধি করি না।
এমনই এক ভ্রমণের গল্প আজ বলব যেটা আমাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে অনেক কিছু। অদ্ভুত
সব ঘটনা ঘটে জানেন। সে সব ঘটনা যেন এক একটা জ্যান্ত জীবনী। জায়গাটার সঙ্গেই
মিলেমিশে আছে গল্পগুলি।
ঘুরতে
বেড়াতে কে না ভালোবাসে। আমরাও খুবই ভালোবাসি। তবে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ভ্রমণ কিন্তু
আজ ব্যস্ত প্রফেসন বলা চলে। বহু জায়গায় আমি আর সৌম্য, মানে আমার হাসব্যান্ড
ঘুরেছি, কারণ এটা আমাদের কাজের একটা পার্ট। তবে আমাদের ঘোরাঘুরি একটু অন্যরকম।
সবাই যেখানে হোটেল বুকিং করে, আমরা সেখানে হোস্টেল বুকিং করি। গাড়ি ভাড়া না করে
পায়ে হেঁটে জায়গাগুলো চিনি। আর গল্প করি মানুষের সঙ্গে।
এমনই
আগের বছর গেছিলাম রাজস্থান। আসলে রাজস্থান কিন্তু লোকে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমেই
যায় বেশি। সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, থাকা সবকিছুর ব্যবস্থা নিয়েই যায় এরা। আর ঐদিকের
লোকেরা সেরকম আমিষভোজী নয়। মাছ মাংস তো পাওয়া যায় না ঠিকই, ভাতও পাওয়া ভাগ্যের
ব্যাপার। রুটি পাওয়া যায়, কিন্তু একটু শক্ত। আর বেশিরভাগই ঘি দিয়ে ভাজা। এত
কিছু তো জানতাম না আমরা। শুধু ঘোরার নেশায় বেরিয়ে পড়েছিলাম।
যাওয়ার
সময় সেরকম খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে না হলেও, ওখানে পৌঁছে ভালোই টের পাচ্ছিলাম আমরা
ভেতো বাঙালি। হোটেলের খাবার খাচ্ছি, কিন্তু মন ভরছে না। খিদে খিদে ভাবটা কিন্তু
রয়েই গেছে আমাদের।
যোধপুর,
জয়সালমের আর বিকানের এই তিনটি জায়গায় প্রচুর মিষ্টি খেয়েছিলাম। ঘটুয়া কি
লাড্ডু, ক্ষীর, ঘেওয়ার আরও অনেক কিছুই চেখেছিলাম, কিন্তু বাঙালির মন তো। ভাতের
কথা মনে হতেই মনটা আমার কেমন কেমন করে উঠছিল।
যোধপুরে
আমরা একদিন বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। সেই বিরিয়ানি মুখে রোচে না। একটুও ভালো খেতে
তো নয়ই, উলটে শরীর খারাপ করে গেল একটু। মনটা কী যে খারাপ ছিল বলে বোঝানো যাবে না।
জয়সালমেরে একটা দিনের কথা ভুলব না। সোনার কেল্লার পাস দিয়ে রাস্তাটা একটা
বাজারের ভেতরে ঢুকে গেছে। রকমারি রাজস্থানি জিনিস বিক্রি হয় সেখানে। আমরা হাঁটতে
হাঁটতে একদিন অনেকটাই ভেতরে চলে গেছিলাম। গিয়ে দেখি একটা বাঙালি খাবারের দোকান।
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতন ভেতরে ঢুকে দেখি একজন বাঙালি ভদ্রলোক মালিক। উনি আমাদের সাদরে
আমন্ত্রণ জানিয়ে পেটপুরে ভাত আর ডিমের কারি খাইয়েছিলেন সেইবার।
এবারে
আসি আসল ঘটনায়। সেদিন আমাদের মরুভূমি যাওয়ার প্ল্যান করা হয়েছে। যথারীতি গাড়ি নিয়ে
আমরা থর মরুভূমির উদ্দেশে যাত্রা করলাম। বিশাল মরুভূমির প্রান্তে শুধুই বালি আর
বালি। গাড়ি এক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিলে দেখলাম উট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
উটে চড়ে যাওয়ার সময় কিন্তু একটু একটু ভয় করছিল। তবে
ভালোই লাগছিল নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। দুলে দুলে উট বাবাজি আমাদের নিয়ে গেল
গন্তব্যে। দেখলাম খাটিয়া পাতা রয়েছে আমাদের জন্যে। ক্যাম্পিং হবে।
আমাদের
যারা নিয়ে যাচ্ছিল তারা হল সেলিম আর রহিম। সর্বদা হাসিমুখ দু’ভাই আমাদের কত যে
গল্প বলছিল তার ঠিক নেই। বাড়ির গল্প, ছেলেমেয়েদের গল্প। শুনছিলাম বিভোর হয়ে।
অপরূপ
সুন্দর সূর্যাস্তের পরে উটের দুধের চা খেলাম প্রাণ ভরে। তারপর হাঁটু গেড়ে গল্প
করতে বসলাম ওদের সঙ্গে। ওরা তো অবাক। বলে এরকম নাকি কাউকে দেখেনি তারা, যারা ওদের
সঙ্গে এত সহজে মিশে যেতে পারে। লোকে তো আসে, মজা করে, ঘুরে বেড়ায় আর ফিরে যায়।
কেউ তো ওদের কথা জানতে চায় না।
আসলে
সব শহরেই মানুষের ভিন্ন গল্প জুড়ে আছে। মানুষের মনের কথা শহরগুলোর আনাচে কানাচে
ঘুরে বেড়ায়। ওরাও প্রথমে বলতে চাইছিল না। তারপর ভাতের জল ফুটতে ফুটতেই তারা বলতে
থাকে তাদের গল্প।
মাছ
খাওয়া নাকি তাদের স্বপ্ন। মাছ ঠিক কেমন দেখতে হয় ওরা জানে না। মাঝেসাঝে
বাচ্চাগুলোর মুখে শক্ত একটা বাজরার রুটি তুলে দেয়। না, কোনো তরকারি করার সাধ্য
তাদের নেই। সবজি কেনার টাকাই নেই যে। যখন কোনো কিছুই জোটে না, তখন আদ্দেক রুটি লাল
লঙ্কা গুঁড়োর জলে গুলে তাই খায়! ওটাই সারাদিনের খাওয়া।
চুপ
করে গেছিলাম এমন মর্মান্তিক সত্য জানার পর। মানুষ এভাবেও বাঁচে! আর আমরা ক’দিন ভাত
না পেয়ে থাকতেই পারছিলাম না, কত নালিশ করছিলাম। এদের তো কাউকেই বলার নেই, কোথাও
বলার নেই।
আমাদের
সঙ্গে লাড্ডুর একটা বাক্স ছিল। সৌম্য বলল পুরো বাক্সটাই ওদের দিয়ে দিতে, বাড়ি
ফিরে যাতে ছেলেমেয়েদের দিতে পারে।
দিয়ে
দিয়েছিলাম ওটা। প্রথমে নিতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের
ছেলেমেয়েগুলো খেয়ে বাঁচুক। চোখ ভর্তি জল নিয়ে সেলিম ওদের ভাষায় কী বলেছিল জানি
না। তবে আশীর্বাদ করেছিল এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম।
এখানেই
সমাপ্তি হতে পারত গল্পটার, কিন্তু এর পরেও অবাক করা ঘটনা আছে যেটা কর্মফল বলব কি
অন্য কিছু, জানি না।
আরও
দু-তিনদিন কাটিয়ে, বিকানের ঘুরে সেদিন আমাদের ফেরার ট্রেন। ওয়েটিং রুমে অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করে অবশেষে কলকাতা যাওয়ার ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকতেই এমন আনন্দ হয়েছিল - কী
বলি! নিজের বাড়ি, নিজের জায়গা একটা ভালোবাসাই হয়তো। রাত্রে
কী খাব কী খাব যখন ভাবছি, দেখি একজন ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে এদিক ওদিক ঘুরছেন।
ট্রেনের স্টাফ হবেন, পোশাক দেখে তাই ভেবেছিলাম। ট্রেন তখনও ধোয়া মোছা চলছে। আরও
দশ মিনিট পর দরজাগুলো খুলবে।
এতই
আমাদের কলকাতা যাওয়ার ইচ্ছে যে ট্রেনের দরজার কাছে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, খুলে দিলেই
ঢুকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসব। মার্চ মাস, ভালোই গরম লাগছিল আমাদের।
ভদ্রলোক
আমাদের দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন বাঙালি কিনা। মুখ দেখেই নাকি বুঝেছিলেন।
উনিও বাঙালি, নাম বাপি চক্রবর্তী, ট্রেনের ইঞ্জিনিয়র। আমাদের সঙ্গে গল্পে মশগুল
হয়ে কত কথা যে বললেন। তারপর যখন খাওয়ার অসুবিধের কথা জানলেন তখন হাসতে হাসতে
বললেন, “আরে হাম হ্যায় তো ক্যায়া গম হ্যায়।”
কী
অদ্ভুত জানেন, সঙ্গে সঙ্গে সৌম্যকে সঙ্গে করে ওনার একটা চেনা দোকানে নিয়ে গেলেন।
রুটি আর একটু ডিমের কারি পাওয়া গেল। পরের দিন
ভাতের ব্যবস্থাও ট্রেনে করে দিলেন। তবে একটি পয়সা নিলেন না। পেট ভরে ট্রেনে আমরা
ভাত, ডাল তরকারি খেয়েছিলাম। সে কী তৃপ্তি! কী করে উনি ব্যবস্থা করেছিলেন আজও আমার
জানা নেই। তবে সেই খিদের মুখে উনিই আমাদের ভগবান।
কলকাতা
নেমে হাত ধরে মন ভরে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম ওনাকে। লজ্জা পেয়ে হেসে বলেছিলেন, “মানুষ
তো মানুষেরই জন্য, তাই না?”
একে
কর্মফল বলব না কপাল, না নিছকই coincidence, আমি জানি
না।
এই
অভিজ্ঞতা ভুলব না আমরা। মনে দাগ কেটে আছে যেমন সেলিম ও রহিম,
সেরকম মন জুড়ে রয়েছেন বাপি বাবু। মানুষের এ হেন রূপ দেখে উপলব্ধি করেছিলাম
ভ্রমণের মানে। ভ্রমণ মানে মানুষের গল্প, জীবনের গল্প যা জুড়ে থাকে একটি জায়গার
আনাচে কানাচে। এমন পাগল ভ্রমণ প্রেমিক মানুষের প্রেমে পড়তে চায় যেন। প্রাণ
ফিরে পেতে চায় গল্পগুলো, মানুষগুলো।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment