চন্দ্র-বংশী
সোহিনী দেবরায়
২০১১-এর ডিসেম্বরে মা আর আমার
বান্ধবী সোনালি বাস্কের সঙ্গে গিয়েছিলাম সোনালির গ্রামের বাড়ি বাঁকুড়ার গেঁড়েদহ
গ্রামে। সোনালির মায়ের ছোটোবেলা আমাদের শহর ব্যারাকপুরে কাটলেও তিনি ভালোবেসে বিয়ে
করেছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এক পুরুষকে। তারপর থেকে তাঁরা বাঁকুড়ার গেঁড়েদহ
গ্রামেই থাকেন। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই সোনালির জন্ম। ছোটোবেলায় বেশ কয়েকবার
মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ায় গ্রামে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে সোনালিকে ব্যারাকপুরে ওর
মামারবাড়িতে চলে আসতে হয়েছিল। সেই থেকেই ও এখানেই আছে। দিদাকে ছেড়ে যেতে ওর আর
ইচ্ছে হয়নি। দিদার কাছেই মানুষ হয়েছে ও। ওর সঙ্গে আমার আলাপ স্কুলে। ব্যারাকপুর
মিশন থেকে এসে ব্যারাকপুর গার্লস স্কুলে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম তখন
থেকেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম সোনালিকে। কয়েকবছরে বন্ধুত্ব এতটাই বেড়েছিল যে
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা দু’জন একে অপরের বাড়িতে যখন খুশি যাই, আসি, থাকি, খাই।
সোনালির মুখে ওর গ্রামের বাড়ির গল্প শুনে আর না গিয়ে পারিনি। যাওয়ার কথা ছিল
আমাদের দু’জনের। কিন্তু আমাদের বাড়ির লোক এভাবে আমাদের একা ছাড়তে রাজি না হওয়ায়
সঙ্গে গেলেন আমার মা-ও। তবে মা যাওয়ায় মজা মোটেই কম হয়নি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই
আমরা গিয়েছিলাম। যাওয়ার সপ্তাহদুয়েক আগে থেকেই আমাদের দু’জনের মধ্যে ছিল এক প্রবল
উত্তেজনা। আমি যেহেতু আগে কখনও গ্রামে যাইনি, গ্রামের ব্যাপারে যেহেতু আমার
অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই এবং এই ব্যাপারে সোনালি বেশ ভালোরকম অভিজ্ঞ, তাই ওদের
গ্রামটা পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের ঠিক কোন জেলার কোন জায়গায় অবস্থিত, সেখানে আমরা
কীভাবে যাব, যেতে
কতক্ষণ লাগবে, যাওয়ার
পথে কোন কোন যানবাহনের সাহায্য নিতে হবে, গ্রামে ওদের মাটির বাড়ি কেমন দেখতে, ওদের বাড়ির
ঠিক কোথায় থাকব, গ্রামে
গিয়ে কী কী করব তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সারাদিন ধরে সোনালি আমাকে দিতেই থাকত।
আমিও অবাক হয়ে শুনতাম। তখন তো আর গুগল ম্যাপের যুগ ছিল না (বা থাকলেও তা আমাদের
হাতের নাগালের মধ্যে ছিল না), ফোন হাতে নিয়ে খুব সহজে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবটুকু
দেখে নেওয়ার উপায় ছিল না। ওর সঙ্গে গল্প করে বাড়ি ফেরার পরেই বুক-শেলফের এক কোণে
থাকা মানচিত্রের বইটা নিয়ে বসতাম। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে খুঁজে নিতাম ‘বাঁকুড়া’ নামের
জেলাটাকে। মানচিত্রর মধ্যে দিয়েই দেখতে চাইতাম ওদের ‘গেড়েদহ’ নামের
গ্রামটাকে। কিন্তু কিছুতেই সেই নামটুকু দেখতে পেতাম না। কেন যে গ্রামের নামগুলো
মানচিত্রে থাকে না কে জানে! না দেখতে পেলেও প্রতিদিন ওর বর্ণনা শুনেই সে না-দেখা
সাঁওতালি গ্রামের রূপ আমার ড্রয়িং খাতার পাতায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম।
ডিসেম্বরের এক কুয়াশা-মাখা
ভোরে ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে অটো ধরে প্রথমে পৌঁছেছিলাম দু-পয়সার ঘাট, দু-পয়সার
ঘাট থেকে ফেরি করে গঙ্গা পেরিয়ে শ্যাওড়াফুলি ঘাট, শ্যাওড়াফুলি ঘাট থেকে ট্রেন ধরে
তারকেশ্বর স্টেশন, তারকেশ্বর
স্টেশন থেকে বাস ধরে আরামবাগ, আরামবাগ থেকে বাস পালটে বিষ্ণুপুর, বিষ্ণুপুর
থেকে আবার বাস পালটে বাঁকুড়ার তালডাংরা বাজার। তালডাংরার বাজারে সোনালির বাবা তাঁর
নিজের ট্রেকার গাড়িটি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কাকুর ট্রেকারে করেই আমরা চললাম গেড়েদহ
গ্রামের দিকে। সামান্য উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম গেড়েদহ
গ্রামে।
সেই আমার প্রথম গ্রাম দেখা।
মাটির বাড়ি, সরষের
খেত, ধানের
খেত, ধানের
গোলা, মাছভর্তি
পুকুর, গোয়ালঘর, উঠোনে অবাধে
ঘুরে বেড়ানো হাঁস-মুরগি-খরগোশ-ছাগলছানা সবটাই আমি প্রথম দেখেছিলাম। প্রথমবার
শ্যালোর জলে স্নান করেছিলাম। বাঁধের জলে হাত-পা ছুড়ে সাঁতারের নিষ্ফল চেষ্টাতেও
ত্রুটি ছিল না। মাটির ঘরের দালানে বসে থালার মতো বড়ো চাঁদ আর তারা ভরা আকাশ
দেখেছিলাম। গ্রামের পথে পথে সোনালিকে পেছনে বসিয়ে সাইকেল চালিয়েছিলাম। আলাপ হয়েছিল
ওদের পোষা দুই মোরগ চন্দ্র ও বংশীর সঙ্গে। চন্দ্র ও বংশী দু’জনেই খুব শক্তিশালী, সাধারণ
মোরগদের থেকে অনেকটাই লম্বা, বড়ো। ওরা মোরগ
লড়াইয়ে নামে। মোরগ লড়াই যে গ্রামদেশের মস্ত বড়ো খেলা তা সেবারেই জানতে পেরেছিলাম।
চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছিল আরও পরে। চন্দ্র ও বংশী প্রতি ভোরে 'কুকুরকুক্কুকু' ডাকে আমাদের
ঘুম ভাঙাত।
এক সকালে চন্দ্রকে পেলেও
বংশীকে আর খুঁজে পাইনি। পরে খোঁজ করে জেনেছিলাম বংশী আগের রাতেই আমাদের পেটে চলে
গিয়েছে। ভাবতেও পারিনি ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে মহাতৃপ্তিতে খালপোষ করা দেশি মোরগের
ঝোল খেতে খেতে বংশীকেই খেয়ে ফেলেছি! বিষয়টা কিশোরী মনে এক মারাত্মক প্রভাব
ফেলেছিল। বেশ কিছুদিন অদ্ভুত একটা মনঃকষ্টেও ভুগেছিলাম। পরবর্তীতে আবার মাংস খাওয়া
ধরতে অনেকটাই সময় লেগেছিল।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment