ভ্রমণ:: দোল ও ডুয়ার্সের দিনরাত্রি - সেমিমা হাকিম


দোল ও ডুয়ার্সের দিনরাত্রি
সেমিমা হাকিম

2022-এর মার্চ মাসে আবার ডুয়ার্সের উদ্দেশে রওনা হলুম আমরা। তবে এবার আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করে টিকিট কাটা হল, কারণ আমার অনেকদিনের ইচ্ছে পূর্ণিমার অপার্থিব থই থই জ‍্যোৎস্নায় জঙ্গল দেখব। পাহাড়ি নদী দেখব। দূরের বন থেকে এক নাগাড়ে ভেসে আসবে বন‍্য ঝিঁঝিঁ পোকার অননুকরণীয় শব্দ আর মাঝে মাঝে সমস্ত নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে কর্কশ গলায় ডেকে উঠবে ময়ূর। বনবাংলোর বারান্দায় একা বসে থাকব মাঝরাত্রি অবধি, পাশে একেবারে নিচু স্বরে বাজতে থাকবে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া এবং শিবকুমার শর্মার যুগলবন্দিতাই দোল পূর্ণিমার আগের এবং পরের দুইদিন ডুয়ার্সে থাকব এই হিসেব কষে 15ই মার্চ কাঞ্চনকন্যা ট্রেনে চেপে বসলুম আমরা মানে আমি, মোহরের আব্বু এবং মোহর। সঙ্গে লাগেজ বলতে একটা ছোটো ট্রলি ব্যাগ, আমার ব্যাকপ্যাক, মোহরের আব্বুর একটা সাইড ব্যাগ ও মোহরের স্কুলব্যাগে তার চিপস, চকোলেট, টফি, বিস্কিটসহ আর কী কী আছে তা আমি জানি না বাপু। জিজ্ঞেস করলে বা ভাগ চাইলে কিছু বলতে পারব না, এখনি বলে দিলুম কিন্তু। ওটি সম্পূর্ণ তার এক্তিয়ারে। ওহ! একটা ছোট্ট বিগ শপারও ছিল আমার হাতে, তাতে আছে চিলি চিকেন, হাতে গড়া রুটি সাতটা, খানিকটা স্যালাড, ছোট্ট এক কৌটো আচার আর জর্দা সিমুই এক ধাবড়া, পেপার প্লেট, এক লিটারের জলের বোতল দুটো। ট্রেনে উঠে প্রথমে নিজের নিজের সিট দেখে নিলুম আমরা। এবার টিকিট কাটার সময় অপশন দেওয়া হয়েছিল সাইড বার্থ। জানালা নিশ্চিত। ডুয়ার্সে যাব অথচ ট্রেনের জানালা দিয়ে জঙ্গল, নদী, খোলা, চা-বাগান দেখব না - এ আবার কোন্ দেশি কথা? তো তিনটেই সাইড বার্থ পাওয়া গেছে। মোহর-আমার উপর নীচে বার্থ, মোহরের আব্বুর ঠিক পাশের কুপে সাইড আপার বার্থ। তিনটে জানালা। কেউ আর মারামারি করবে না। যাক বাবা, নিশ্চিন্ত। ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে যাত্রা শুরু করল সঠিক সময়ে। দমদমে ট্রেনে উঠল আমাদের কুপের সহযাত্রীরা। তিনটে বাচ্ছাসহ তিন জোড়া দম্পতি। ট্রেনে উঠেই তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল বাধিয়ে দিলেন সকলে। আমার একটুও শব্দ ভালো লাগত না ওইসময়। ভীষণ চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করত, ডুবে থাকতাম একাকীত্বে। বস্তুতঃ 2021-এর অক্টোবর থেকে আমার এই অবস্থা চলছিল। ভীষণ বিরক্ত লাগছিল সহযাত্রীদের হইচই, যদিও বুঝতে পারছিলুম ওঁরা অনেক দিন পরে নয়তো প্রথমবার বেড়াতে যাচ্ছেন তাই একটু বেশিই উত্তেজিত, ইগনোর করার চেষ্টা করলুম প্রাণপণ। ডানকুনির পর ট্রেন ছুটতে শুরু করল রুদ্ধশ্বাসে। হালকা গরম পড়ে গেছে, সুতরাং জানালা বন্ধ করার দরকার নেই। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলুম পিছন দিকে ছুটতে থাকা অন্ধকারের চালচিত্র। দূরে কোথাও আলো জ্বলছে টিমটিমিয়ে, হাইরোডের ধারের ধাবাগুলোয় সার সার আলোর মালা, চলন্ত চার চাকার ছুটে চলা আলোর রেশ। বর্ধমান ঢোকার একটু আগে মোহরকে বল্লুম হাত ধুয়ে আসতে। ও বেসিনে যেতেই সিট নামিয়ে জোড়া দিয়ে দিলুম। কাগজ বিছিয়ে খাবার ব্যবস্থা করে ফেললুম ঝটপট। সে আর তার বাবা মহা আনন্দে নিজের নিজের প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করল রুটি তরকারি। চিলি চিকেনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই দেখি হালুচালু হয়ে উঠলেন অন্য সহযাত্রীরাও। তাঁরা বার করলেন লুচি, আলুর দম, আলু পোস্ত, মিষ্টি আর দুটো একদম কুচো ছানার জন্য খিচুড়ি। রাত দশটার মধ্যে সবার খাওয়া শেষ। কুপ থেকে সরানো হয়ে গেল কাগজের প্লেট, খবরের কাগজ, প্লাসটিক হ্যানত্যান। বেড়াতে গেলে কিছু সহজ হিসেব থাকে আমার। প্রত্যেকের জামাকাপড় ভাঁজ করে আলাদা আলাদা বালিশের ওয়াড়ে ঢুকিয়ে, বালিশ বানিয়ে, প্যাক করে দিই তার তার ব্যাগে। সঙ্গে একটা করে বিছানার চাদর। নিজের নিজের ব্যাগ খোল, চাদর বালিশ বার করো, শুয়ে পড়ো। নো ঝঞ্ঝাট। আর লাগেজ ব্যাগ হয়ে যাবে পাশবালিশ। আর কী চাই? যাই হোক, আমি, মোহর শুয়ে পড়লুম লাইট অফ করে। পুরো কামরা শুয়ে পড়েছে। ওমা! সহযাত্রীরা তখনও কথা বলে যাচ্ছেন জোরে জোরে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। আর সহ্য হল না। এক ধমক দিয়ে বলে উঠলুম, “হচ্ছেটা কী! ঘুমাতে দেবেন তো অন্যদের ব্যস, সব চুপচাপ। আমিও ঘুমিয়ে পড়লুম পাশ ফিরে।

ট্রেনে বরাবরই ঘুম ভালোই হয় আমার। তবে বাড়িতেও ‘টুক’ শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, সেখানে এ তো ট্রেন, তায় ইঞ্জিনের পরের কম্পার্টমেন্ট, শব্দ একটু না খুব বেশিই। কী আর করা যাবে! এই লকডাউনের পর থেকে মোহরের আব্বু কিছু নিয়ম মেনে চলে খুব দৃঢ়ভাবে। তারমধ্যে একটা বদ্ধ এসি কুপ না। হাওয়া খেলবে তাই স্লিপার কোচ। তাই, তাই সই। বেড়াতে পেলেই হল আমার। সাড়ে সাতটায় নিউ শিলিগুড়ি জংশনে। সহযাত্রীরা নেমে গেলেন। আধাঘণ্টা পর ইঞ্জিন বদলে ট্রেন চলল ডুয়ার্সের মধ্যে দিয়ে। আমাদের নিয়ে যাবে হাসিমারা স্টেশনে। সেখান থেকে গরুমারা ট্যুরিস্ট লজ। আদতে তিনমাস আগে থেকে আমাদের বুকিং করা হয়েছিল হাসিমারা ফরেস্ট বাংলোয়। আসার মাসখানেক আগে জানানো হয় রাজ্যপাল আসবেন তাই সাধারণ ট্যুরিস্টদের সমস্ত বুকিং ক্যানসেল করা হল। তথৈবচ অবস্থা তখন আমাদের। সমস্ত ট্যুর প্রোগ্ৰাম ভেস্তে গেছে। একদিনের বুকিং পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের হাসিমারা ট্যুরিস্ট লজে। টিলাবাড়ি ট্যুরিস্ট লজ একটা কম্বো অফার দেয় - নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্পে নাইট স্টে ও পরদিন টিলাবাড়িতে সাইট ভিউ। সেই বুকিংও গণ্ডগোল হয়ে গেল। নতুন করে সব বুকিং করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু দোলের টানা ছুটিতে সব সরকারি ট্যুরিস্ট লজ এবং বাংলো আগে থেকেই বুকড হয়ে আছে, তাহলে উপায়? অগত্যার গতি মোহরের আব্বু ফোন করল ডুয়ার্সকে যিনি হাতের তালুর মতন চেনেন সেই রসিদুল ভাইকে। আগের অক্টোবরে যখন গরুমারা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছিলুম ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয় গরুমারা নেচার্স কটেজে এবং সেবার গাড়ি থেকে সাফারি সব কিছু উনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এবারও ফোন পেয়ে বললেন, “হাসিমারায় যে ক’দিনের রুম পাওয়া যাচ্ছে থেকে চলে আসুন মূর্তিতে। আমার পরিচিত লজে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। হয়তো একটু অসুবিধা হবে, তবে খুব খারাপ লাগবে না। রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে সামনে মূর্তি নদী
মূর্তিতে আমরা 2021-এর মার্চে গিয়েছিলুম। থেকেছিলুম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বনানী লজে। রুম থেকে বেরোলেই মূর্তি নদীর খাত। বড়ো মায়াময় নদী সে। সেই যখন ডাকছে, ‘চলো তবে’ বলে বেরিয়ে পড়লুম আমরা। 16ই মার্চ সকালে ডুয়ার্সের গুলমা, সেবক, বাগরাকোট, নিউ মাল, চলসা, কেরন, বানরহাট, বিন্নাগুড়ি, দলগাঁও, মুজনাই পেরিয়ে কাঞ্চনকন্যা এসে দাঁড়াল মাদারিহাট স্টেশনে। সিগন্যাল পায়নি। মোহরের আব্বু বললেন, “নেমে পড়ি চলো। এখান থেকে টোটো করে দু’কিলোমিটার গেলেই আমাদের ট্যুরিস্ট লজ
কাঁইমাই শুরু করে দিয়েছি আমি। আমার বাম কাঁধের টেন্ডনে সমস্যা চলছে তখন। মুঠো মুঠো পেইনকিলার, ফিজিও এবং ইলেকট্রিক শক রোজের সঙ্গী। কিন্তু তেনার জেদমোহরকে কোলে করে নামিয়ে দিলেন একজন হকার আর আমাকে খুব সাবধানে ধরে ধরে নামাল তার আব্বু। এদিকে সমস্যা হয়েছে শিলিগুড়ি জংশনে ইঞ্জিন বদলের পর আমাদের কম্পার্টমেন্ট হয়ে গেছে একেবারে শেষ কামরা। ঐ অত বড়ো ট্রেনের ন্যাজা থেকে হেঁটে হেঁটে আমাদের উঠতে হল স্টেশনে। তারপর স্টেশন পেরিয়ে টোটো। তারপর মাত্র মিনিট পাঁচ লাগল আমাদের লজে পৌঁছাতে। হাই রোড ক্রশ করে হাসিমারা রিজার্ভ ফরেস্ট আর আমাদের লজ সেই জঙ্গলের কিনারায় দাঁড়িয়ে। পুরোনো বিল্ডিং, পুরো কাঠের তিনতলা বাড়ি। সংযোজনগুলো যদিও ইট, পাথর, সিমেন্টের নিষ্প্রাণ ইমারতযাই হোক, আমাদের রুমটি খুব সুন্দর। দেয়াল জোড়া স্লাইডিং দরজা, খুললেই চওড়া ব‍্যালকনি, সঙ্গে সাজানো সেন্টার টেবিল-চেয়ার আর সামনে ঝরাপাতার হাসিমারার রুক্ষ জঙ্গল।
আমরা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে খেতে চলে গেলুম রিসেপশন লাগোয়া কমন ডাইনিং রুমে। স্থানীয় নদীর ছোটো মাছের মাখা মাখা তরকারি এক প্লেট, রুই কালিয়া একপ্লেট, সঙ্গে ভাত, ডাল, সবজি, চাটনি দিয়ে তৃপ্তি করে ‘মধ্যাহ্ন ভোজন’ সারতে সারতে আমার চোখ গেল সাফারির জিপগুলোর দিকে। হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের লজের সামনে দিয়েবেয়ারাকে জিজ্ঞেস করতে খবর দিল, “পাশেই বিট অফিস। ওখান থেকে গাড়ি ছাড়ে সাফারির। চেষ্টা করলে সাড়ে চারটের লাস্ট স্লটে জঙ্গল সাফারির টিকিট পাওয়া যেতে পারে আমার আর মোহরের তখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে। “দেখো, টিকিট পাও নাকি” - বলে আমরা মা বেটা শুতে চলে গেলুম। মোহর অবশ্য পিছনের বাগানে একটা বিশাল স্লিপ দেখে আর ঘুমাতে গেল না। বাগানের সি-স, দোলনা, স্লিপে মস্তি করতে শুরু করল, এক এক পোজে দাঁড়িয়ে, ‘মা, আমাকে কেমন লাগছে? বলে চিৎকার করছে, আমি দোতলার ম্যাজেনাইনের জানালা দিয়ে ওর ছবি তুলছি, ও নিজের মনে হাসছে খেলছে, আমি দুপুরের হা-ক্লান্ত জঙ্গল দেখছি। মিনিট কুড়ি কাটিয়ে ঘরে চলে গেলুম ওকে ডেকে নিয়ে। রেস্ট দরকার। নয়তো আবার কাঁধের যন্ত্রণা শুরু হলে সমস্যা। ঘণ্টাখানেক শুয়েছি, ফোন, “তোমরা রেডি হয়ে চলে এসো। সাফারির টিকিট কাটা হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে মোহর আর আমি ফুল স্লিভ জামা কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লুম বায়নাকুলার, জলের বোতল আর মোবাইল নিয়ে। জঙ্গলের অধিবাসীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হবে না?
 
 

গেলবার গরুমারা সাফারিতে একটা ধনেশ, একটা ময়ূর আর একটা নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া কিচ্ছুটি দেখতে পাইনি আমরা। এবার জঙ্গলে ঢুকতে না ঢুকতেই নদীর ঘাসবন থেকে টুকি দিয়ে গেল এক বয়স্ক গণ্ডার। গাইড বললেন, “আমাদের গাড়ি প্রথম যাচ্ছে। আজ প্রচুর জন্তু দেখতে পাবেন আপনারা সত্যিই জঙ্গল যেন ঘোমটা খুলে ফেলেছে। কোনো রাখঢাক নেই। পরিচিত গারো রমণীর মতন সংকেত পাঠাচ্ছে মিনিটে মিনিটে আর সেদিকে ফিরে তাকালে এক একজন দলপতি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে দেখা করে যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে - সম্বর, চিতল, গউর দেখলুম বেশ কয়েকটি দলে। গাছে গাছে বানররা সংকেত চালাচালি করছে, কেরদানিও দেখাচ্ছে ইচ্ছে হলে। পথের ধারে, গাছের ডালে ময়ূর ডেকে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ময়ূরীর সঙ্গে তাদের খুনসুটি, সংসার যাপন। রাস্তার পাশে এক বিশাল গুঁড়ি পড়ে আছে, হঠাৎ দেখি তার পাশে এক পূর্ণবয়স্ক ময়ূর। চোখের পাতা ফেলার আগে দু’বার ডেকে উঠে মেলে ধরল তার পেখম, সঙ্গে চলল কিছু কসরত, সঙ্গে কেঁও কেঁও ডাক। জিপ দাঁড়িয়ে গেল, আমরা ভিডিও করে, মুগ্ধ হয়ে দেখলুম তার নাচ। সে কিন্তু আমাদের পাত্তাও দিল না। নিজের মনে নাচ দেখিয়ে, গান শুনিয়ে, মন ভোলাল কোনো সুকুমারী ময়ূরীর। ইচ্ছে ছিল আরও একটু দাঁড়াই, কিন্তু গাইড তাড়া দিচ্ছেন ‘নুনির কাছে’ যাওয়ার। এখন নাকি গউর, গণ্ডার, হাতি, হরিণ এবং পাখপাখালিরা নুন খেতে আসবে ওখানে। আমরা বাধ্য দর্শকের মতন চললুম সেদিকে। পৌঁছে দেখি ওয়াচ টাওয়ারে, নিচের বাগানে থিক থিক করছে উৎসাহে ডগমগ দর্শক, আগের স্লটের সাফারির মানুষজন। নুনি বলতে ফুটবল মাঠের মতন খানিকটা খোলা জায়গা, মাঝখানে একটা বহু পুরোনো মরা সেগুনগাছ। চারিদিকের সাদা মোটাদানার বালি। এই বালিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নুন। জঙ্গলের না-মানুষরা ওই চেটে খেয়ে নিজের জিভের ‘তার’ বাড়ায়, মিনারেল ঘাটতি মেটায়।


এর পাশ দিয়ে, ওর হাতের ফাঁক গলে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বুনো তুলসির পাশে টুক খানিক জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়লুম আমি। সামনেই এক ভীমদর্শন গউর - পায়ে পরিপাটি সাদা মোজা, কপালের চুল যত্ন করে সিঁথি কেটে আঁচড়ানো, কান দুটো র‍্যাডারের মতন নড়ছে চড়ছে, চাবুকের মতন লেজখানা পিঠে বোলাচ্ছে খোশমেজাজে। আমাকে দেখে কী যেন সন্দেহ হল। দু’পা এগিয়ে এল বেড়ার দিকে, তারপর নাক দিয়ে ফোঁৎ করে এক শব্দ করে বুঝিয়ে দিল ঘোর অপছন্দ আমার মতন দু’ঠেঙে জীবজন্তু। টুকটুক করে চলে গেল নুনির দূরতম প্রান্তে। মাঠ জুড়ে তখন নেমে এসেছে অসাধারণ রঙিন পাখির দল - গ্ৰীন ইম্পেরিয়াল পিজিয়ন, স্কারলেট মিনিভেট, স্মল প্র‍্যাটিনকোল। আমি একমনে ছবি তুলছি তাদের, হঠাৎ শুনি সবাই চঞ্চল হয়ে উঠেছেন - দূরে এক সদ্য যুবা গণ্ডার নুনির দিকে এগিয়ে আসছেন আর আমাদের সেই পুরোনো গউর তাঁর সামনে এসে গেছেন। দু’জনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন চিত্রার্পিতের মতন। তারপর কী হল কে জানে, গণ্ডার পথ ছেড়ে অনেক দূরের ঘুরপথে চলে গেলেন, গউরও গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে কেমন ক‍্যাবলা হয়ে গেলেন। আমাদের গাইড বললেন, “এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। নয়তো ফিরতে রাত হয়ে যাবে অগত্যা ফেরার পথ। তখনও অনেক বনবাসী ঘর ছেড়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন, চারিদিকে তাঁদের হাঁকডাকে সরগরম জঙ্গল। আমরা চুপ করে বসে শোনার বা বোঝার চেষ্টা করলুম সেই পরিভাষা। মার্চের ডুয়ার্স বড়ো রুক্ষ। পাতা ঝরে গেছে সব গাছের। হঠাৎ দেখি এমনি এক পাতাশূন্য গাছের কাঠামোর ফাঁক গলে সূর্য টুপ করে খসে পড়ল আকাশের কোল থেকে। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল যেন সেদিকে। উলটোদিকে তখন বগি থালার মতন চাঁদ সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়েছে অনেকটা পথ, তবু তার গায়ে তখনও আঁচল জড়ানো, ফিনকি ছোটেনি জ্যোৎস্নার। ড্রাইভার একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, “ঐ গ্ৰামে আদিবাসী নাচ হবে। দেখে আসুন গেলাম নাচ দেখতে। কিন্তু জঙ্গলের অকৃত্রিম আনন্দ আয়োজনের পর এই সাজানো নাচের আসর আর ভালো লাগছিল না। কিন্তু ট‍্যুরিস্ট যেহেতু এই মানুষগুলোর জীবনধারণের অন্যতম আয়ের উৎস তাই তাতে বাধা দিতেও মন চাইল না। আদিবাসীদের বানানো চা, টুকিটাকি খাবার, নাচ দেখে আমরা ট‍্যুরিস্ট লজে ফিরলুম প্রায় সাতটায়। ডাইনিংয়ে চা, কফি, পকোড়া, ব্রেড টোস্ট খেয়ে এবং ডিনারের জন্য রুটি সবজি, স্যালাড, মিষ্টির অর্ডার দিয়ে ঘরে ফিরলুম বিশ্রাম নিতে।


রাত্রে অনেকক্ষণ বসেছিলুম ব্যালকনিতে। হালকা ঠান্ডা ভাব ছিল, তবে এতটাও নয় যে চাদর দিতে হবে গায়ে। আমাদের ব্যালকনি উত্তরমুখী, তাই চাঁদ দেখতে পাইনি। কিন্তু চাঁদের আলোয় জঙ্গল দেখতে অসুবিধা হয়নি। সারাদিনের ধকলে ঘুম পাচ্ছিল, রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই শুয়ে পড়েছি আর কখন যে ভোর হয়ে গেছে তা বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ পাখিদের ডাকে সজাগ হয়ে উঠে পর্দা সরিয়ে দিলুম ব্যালকনির। ঘন কুয়াশার প্রলেপ কাচের গায়ে। একটা স্টোল গায়ে বেরিয়ে এলুম ঘর থেকে। ঘাসের বুকে বৃষ্টির মতন বড়ো বড়ো ফোঁটার কুয়াশা জমে আছে কয়ারি করা বেড়ায়, মাকড়সার জালে মুক্তোর সারি, শীতশেষের ম্রিয়মান সিজন ফ্লাওয়ারদের গায়ে মোটা পরত বাষ্পের। দেখি মোহরের আব্বুও আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে বাগানে। দু’জনে মিলে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলুম। বেশ কিছু কটেজ রয়েছে, কটেজগুলোর নাম রাখা হয়েছে জঙ্গলের গাছ এবং পাখীদের নামে - মেহগনি, শাল, দোয়েল, তিতির ইত্যাদি। ভালো লাগল। অন্য পাশের লনে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জঙ্গলের জীবজন্তুদের মডেল, পরিচিতিও লেখা রয়েছে, তবে অযত্নের ছাপ পরিষ্কার। রান্নাঘরের পাশে একটা বিশাল পীচগাছ। কচি পীচ ফলে আছে গাছ ভর্তি। আমরা আগে পীচগাছ দেখিনি। বিশেষ করে নতুনপাতার রঙ দেখে আমরা মোহিত। তবে বেশিক্ষণ এই ঘোরাঘুরি করা যাবে না, দশটায় বেরিয়ে পড়তে হবে। হাসিমারা থেকে ট্রেন ধরে নিউ মাল স্টেশনে যাব আমরা। ওখানে আমাদের জন্য গাড়িসহ অপেক্ষা করছে রসিদুল ভাইয়ের দূত সমীর। গাড়িতে বসেই ঠিক করে নিলুম আমরা পরদিন যাব গজলডোবা, আজ বিশ্রাম।


বিশ্রাম আর কোথায় হল। লজে পৌঁছে স্নান-খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নিলুম ঘন্টা দুই। সত্যিই ঘরের সামনেই মূর্তি নদী। ওপার থেকে ভেসে আসছে ময়ূরের ডাক। আগের মার্চে আমরা কোনো ময়ূরের ডাক শুনিনি এখানে। এবারে এত কাছে এবং এত স্পষ্ট কেকা শুনে অবাক হয়ে গেলুম। রোদ পড়ে আসতেই বেরিয়ে পড়লুম তিনজনে। আগেরবার মূর্তির পাড় ধরে আঁতিপাতি ঘুরে গিয়েছিল মোহরের আব্বু, বলল, “এইখান দিয়ে চলো, পুলের পাশ দিয়ে রোডে উঠব বেশ, ভালো কথা। এমনিতে তো মূর্তি নদীতে জল নেই এখন, থাকার কথাও না। শুখা মাস চলছে। ছোট্ট সোঁতা পেরিয়ে চরে পৌঁছালুম আমরা। কটা ময়ূর-ময়ূরী ওপাড়ে চরছে। মোবাইলে জুম করেও ওদের ছবি তোলা সম্ভব না। তাই খালি চোখেই দেখছি। হঠাৎ খোঁচা খেলুম কোমরে, “এই মানা, ওদিকে তাকাও। ওটা গণ্ডার না? হ্যাঁ। ঠিক তাই। এই ঝোপ ওই ঝোপের আড়ালে আড়ালে দুলকি চালে বিশাল এক গণ্ডার চলেছে নদীর তীর বরাবর। দূরে দু’জন স্নান করছিল। মোহরের আব্বু গণ্ডার দেখতে দেখতে ওদের দিকে এগিয়ে গেল আর আমি ক্যামেরা বাগিয়ে ভিডিও করছি গণ্ডার বাবাজির। হঠাৎ দেখি তিনি মানে সেই এক সিঙা গণ্ডার নদীতে নেমে পড়লেন, জল ছিটিয়ে, উদাসীন ভাবে নদী পেরোলেন এবং আবারও হাঁটা দিলেন দূরে ভুট্টা খেতের দিকে। এপারের বেশ কিছু মানুষ দৌড় দিলো সেইদিকে, আমি ভাবলুম আমার মতন উজবুক দর্শক নিশ্চয়। অতি উৎসাহে কাছ থেকে গণ্ডার দেখবে বলে ছুটছে। আমিও মোহরের হাতটা জাপটে ধরে উলটোবাগে ছুটতে শুরু কল্লুম - কোথায় যেন পড়েছিলুম যে গণ্ডার চোখে তেমন দেখে না কিন্তু কানে শোনে পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে। তাছাড়া ব্যাটারা আমার মতোই মাথা গরম পাবলিক। রেগে গেলে সোজা তাড়া করে ডাইনে বামে না তাকিয়েই। কে বাপু রিস্ক নেয়। তাই আগেভাগে সতর্ক হওয়াই ভালো। নদীর চর ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আধা কিলোমিটার চলে এসেছি, মোহরের আব্বু এসে পড়ল কোথা থেকে, “বুঝলে, ওই গণ্ডারটা রোজই এমনি চলে আসে এইদিকে। আর ওই যে লোকগুলো ছুটল, ওরা সিভিক বনকর্মী। পটকা ফাটিয়ে, হই হই করে গণ্ডারটাকে বনে পাঠানোর চেষ্টা করছে
“সে তো খুব ভালো খবর। কিন্তু এখন এখানে না থাকাই ভালো। সে ব্যাটা মোটা চামড়া তাড়া করলে আমি কিন্তু দৌড়াতে পারব না। আগে ভাগে কেটে পড়ি চলো
“চলে যাবে? ওইখানে সেই নেপালি বউদির চা, মোমো খাবে না?
“বউদির হাতের মোমো খাব না, তা আবার কখন বল্লুম? খাবো তো বটেই। কিন্তু আগে পাড়ে ওঠো
আমার খেঁচানিতে ছেলে আর ছেলের বাবা ফেরার পথ ধরল তবে আর শুকনো বালির ওপর দিয়ে না। মূর্তির জলে পা ডুবিয়ে হাঁটা। স্বচ্ছ জলের নিচে ছোটো বড়ো বিভিন্ন মাপের রংবেরং-এর পাথর। খরস্রোতা নয় বলে পাথরের গায়ে শ্যাওলা জমে ভালোই, তাই ভীষণ পিচ্ছিল। আমরা পাথরের খাঁজে পা রেখে রেখে, জল ছিটিয়ে, আগের দু’বারের দেখা মূর্তির কথা বলতে বলতে পাড়ে উঠলুম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। পরিচিত বউদির স্টলে চা, মোমো খেয়ে দু-চারটে খোসগল্প করে রুমে ফিরলুম তখন রাত আটটা। নেড়াপোড়ার চাঁদ উঠেছে আকাশে। ব্যালকনিতে এসে বসলুম একা। নদীচর দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। টিট্টিভ পাখির ডাক ভেসে আসছে পরিষ্কার। মাঝেমধ্যে কেঁও কেঁও করছে ময়ূরের সতর্ক ডাক। আর কিছু নেই। বুক ঠেলে কান্না উঠে আসে এমনি সব রাত্রে - কেন কে জানে। মোবাইলে লো ভলিউমে চালিয়ে দিলুম বিক্রম সিংহ খাঙ্গুরার রবীন্দ্র সংগীতএমনি রাত্রে আমার একান্ত সহচর।


পরদিন খুব ভোরে মোহরের আব্বুর ঘুরতে বেরিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়। ও একা একা নদীর পাড় ধরে চলে গিয়েছিল কিলোমিটার দুই। সেখানে দু’জন বনকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয়। জিজ্ঞেস করে, “কাল যে গণ্ডারটা নদী পেরিয়ে চলে এসেছিল এদিকে, তার কী হল? তারাও সটান জবাব দেয়, “গতকাল বিকেলের গণ্ডারটা? ওকে তো কালকেই বনে খেদিয়ে দিয়েছি আমরা মোহরের আব্বু পরে বলে, “জানো, ঠিক তখনই ফুট দশেক দূরে ঝোপের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো গণ্ডার। আমি ওদের দেখিয়ে বললাম, ওই দেখুন গণ্ডার। ওরা বলল, আপনি চলে যান। এক্ষুনি অফিসার চলে আসবেন। আপনাকে দেখতে পেলে আমাদের ঝামেলা হয়ে যাবে
এত কাছ থেকে গণ্ডার দেখার উত্তেজনা তখনও তার চোখে মুখে। আমিও খুব অবাক হয়ে গেছি। একটু আফসোসও হচ্ছে। সঙ্গে গেলে আমিও দেখতে পেতুম, কিন্তু ঘুম ভাঙতেই চাইল না ভোরে। তো কী করব?

আজ দোল। লজের সব ঘর ভর্তি ট্যুরিস্ট অথচ কেউ রং খেললেন না এতটুকু। নিজের নিজের রুমে বা কটেজে বসে সময় কাটালেন সবাই। পাশের গেস্টহাউস থেকে ভেসে আসছে, ‘রঙ বরসে ভিজে চুনরওয়ালি
দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আমরা সমীরকে ডেকে নিলুম গজলডোবা যাব বলে। অনেকটা পথ, আর যতটা বেশিক্ষণ ওখানে থাকা যায় - এই আর কী। গজলডোবায় দেখার মতন কিছুই নেই এই অফ সিজনে। তবু নৌকায় ঘোরা, ড‍্যামের পাশে বসে থাকা, মোহরকে ব‍্যারেজের কার্যপ্রণালী বোঝানো এইসবের মধ্যে সূর্যাস্ত হল গজলডোবার শরবনের ওপাশে। গাড়ি করে ফেরার পথে দেখি রাখাল ছেলে দলে দলে গরু মোষ চরিয়ে ঘরে ফিরছে আর তাদের খুরে খুরে আকাশ পর্যন্ত ধুলোয় ধূসর আক্ষরিক গোধূলি নেমেছে তখন।
মাল বাজারের টি জংশনে চা খেয়ে, স্যাক্সোফোন শুনে যখন ঘরে ফিরলুম তখন আকাশ জুড়ে অলৌকিক জ্যোৎস্না নেমেছে ফিনকি ছুটিয়ে। কাল আমরা চলে যাব। আবার হয়তো আসব বর্ষা উজিয়ে। ততদিন মনে থাকুক এবারের এই রুখা সিজনের ডুয়ার্স আর তার জীবজন্তুদের নিজস্ব গল্প।

----------
ফোটো - লেখক

No comments:

Post a Comment