ভ্রমণ:: বাঙালি এবং ভ্রমণ - অন্বয় গুপ্ত


বাঙালি এবং ভ্রমণ
অন্বয় গুপ্ত

স্কুলজীবনে আমাদের বেড়ে ওঠার সময় সাক্ষী ছিল রচনা লেখা। যখন যেটা হাতে গরম ইস্যু, যেমন মহাপুরুষদের সার্ধশতবর্ষ কিংবা বিশ্বকাপ, সে সব বাদ দিলে এমন কয়েকটা রচনা প্রত্যেকবার বাঁধা থাকত, যেগুলো সবাই পারবে, যেমন বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য কিংবা কোনো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। মুশকিলে পড়তাম আমরা, যাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তথৈবচ। আবার এটাও ঠিক যে যারা প্রচুর বেড়াতে যেত, যেমন আমার এক সহপাঠী একটা বিশেষ প্যাকেজের জন্য অর্ধেক ভারত অর্ধেক ইউরোপ ট্যুর করেছিল, সে যে খুব জাঁকিয়ে লিখত তা কিন্তু নয়। কারণ শরৎচন্দ্র মোক্ষম বলেছিলেন পা দুটো থাকলেই ভ্রমণ করা সম্ভব কিন্তু হাত দুটো থাকলেই তা নিয়ে লিখে ফেলা যায় না!
বাজারে প্রবন্ধের চলতি অনেক বই ছিল। সেখানে একটায় দেওঘর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ যত্ন করে লেখা ছিল। আজও তার অনেকটাই মনে আছে। ত্রিকূট পাহাড় দেখা থেকে অনেককিছুই গুছিয়ে লেখা ছিল তাতে। সফরসঙ্গী করে দেওয়া হয়েছিল শফিকচাচা নামক জনৈক টাঙ্গাওয়ালাকে। বাঁদরদের ছোলা খাওয়ানোর সরেস বিবরণও ছিল।
আঞ্চলিক লোকগাথার কিংবদন্তি অনুযায়ী কৈলাস থেকে শিবকে বহন করে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার পথে দেবতাদের কারসাজিতে এখানেই তাঁকে নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন রাবণ। শিবও অনড় হয়ে থেকে যান। আবার কথিত আছে যে বৈদ্যনাথধামে সতীর হৃদয় পড়েছিল - তাই একে ৫১ পীঠের মধ্যেও গণ্য করা হয়। দেওঘরশব্দ হিন্দি শব্দ যা দেবদেবীসূচক। বৈদ্যনাথ মন্দিরে এর নাম যুক্ত করে এই শহরকে বৈদ্যনাথ ধাম, বাবা ধাম বা দেওঘর বলা হয়। এই শহরটির উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থগুলিতে হরিতকী বা কেতকীবন নামে উল্লেখ রয়েছে।
তখন ক্লাস সিক্স, বাংলা কমপ্রিহেনসনের ক্লাসে ভ্রমণ বিষয়ক রচনা লেখানোর সময় একজন শিক্ষিকা বিপজ্জনক ট্রেকিং নিয়ে খুবই ছকভাঙা একটা ভ্রমণকাহিনি লিখিয়েছিলেন। সেই ক্লাস অনুযায়ী তা ছিল বেশ হাই ডোজের কিন্তু চমকপ্রদ।
এর অনেকদিন পর একজন প্রাইভেট টিউটর চোখ খুলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন লিখতে গেলে সবসময় যে প্রচুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এমনটা নয়। চারপাশের খড়কুটো বেঁধে তৈরি করে নিতে হবে বাগান। তাঁর সময় তিনি ভ্রমণের রচনা লেখার সময় ‘সোনার কেল্লা’-র ট্রেন, অ্যাডভেঞ্চার মিলিয়ে কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

“টিলা টিলা শিমুলতলায় ভিলা ভিলা” বাড়ি কথাটা পরিবারের বয়স্কদের মুখে একসময় খুব শোনা যেত। একসময় এই শিমুলতলা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বাঙালির প্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস। ১৮৭১ সালে এই অঞ্চলে প্রথম বাঙালি হিসেবে পা রাখেন হুগলি জেলার বিজয়নারায়ণ কুণ্ডু। মধুপুর-গিরিডি শাখার রেললাইন পাতার ঠিকাদারি নিয়ে আসেন এখানে। তাঁর সেই কাজের মেয়াদ একদিন ফুরোয়। কিন্তু বিজয়নারায়ণ আবিষ্কার করেন তাঁর পেটের দুরারোগ্য পুরোনো আমাশয় রোগ এখানকার জলের গুণে পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে। তাই তিনি এখানেই নিজের বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে বাঙালির এই অঞ্চলে আগমন শুরু। এটাকেই বলা হয় বাঙালির স্বাস্থ্য বদলের পশ্চিম।
আরও একটা নাম আছে এই অঞ্চলের, ‘ড্যাঞ্চিবাবুদের দেশ।তার পেছনের গল্পটাও চমকপ্রদ। স্বাস্থ্যবদল করতে আসা বাঙালিরা এই সব অঞ্চলের হাটে তাজা শাকসবজি, মাছ, মাংস এই সব কিনতে গিয়ে সে সবের দাম শুনে অবাক হয়ে যেতেন। কলকাতার অগ্নিমূল্যের তুলনায় এখানে দাম ছিল অনেক অনেক কম। সে কারণে বাজার করতে এসে ইংরেজিতে বলে উঠতেন ড্যাম চিপ।বাজারে এই সব বাঙালিবাবুর মুখে নিয়মিত ড্যাম চিপকথাটা শুনে শুনে সেখানকার আদিবাসী মানুষজন এদের নাম দিয়েছিল ড্যাঞ্চিবাবু। ড্যাঞ্চিকথাটা আদতে ওই ড্যাম চিপকথারই অপভ্রংশ।


সেই কবে থেকে বাংলা সাহিত্য এবং সিনেমা জুড়ে বাঙালির পশ্চিম ভ্রমণের কথা পাওয়া যায়। মধুপুর, গিরিডি, গয়া, জসিডি, শিমুলতলা, দেওঘর, দুমকা, মুঙ্গের, ভাগলপুর, ঘাটশিলা। মজার কথা হল বাঙালি এইসব জায়গায় বেড়াতে যায় না, বরং বাঙালি পশ্চিমে যায় চেঞ্জে। তাই মধুপুর কিংবা শিমুলতলায় পর্যটনের বদলে তারা যায় মূলত চেঞ্জে। হাওয়া বদলাতে গিয়ে এইসব জায়গার প্রেমে পড়ে এসব জায়গায় সুন্দর সুন্দর সব বাংলো বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন অনেক বাঙালিবাবু। জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চিত্তরঞ্জন দাস, লীলা মজুমদার, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ থেকে শুরু করে অসংখ্য বাঙালীর মননের ক্ষেত্র ছিল এসব এলাকা। এখানকার ইঁদারার জল খেলে পেটের রোগ সারে, এই যুক্তি মেনে বাঙালিরা এতদিন আসতেন। এমনকি বিদ্যাসাগরও তাঁর জীবনের শেষ সতেরো বছর এই সাঁওতাল পরগণার এক অজ পাঁড়া গা কর্মাটাঁড়ে কাটানতাঁর তৈরি বাড়ি আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। সত্যজিৎ রায়ের মহাপুরুষছবির মনোলোভন সূর্যাস্তের দৃশ্য আজও দর্শককে নিয়ে যায় সেই অতীতের পশ্চিমে। পাহাড়-অরণ্যের মাঝে মনোরম চলার পথে, টেলবা নদীর কিনারে সিকেটিয়া আশ্রম, ধীরহারা ঝোরা দেখেও বাঙালির মনে পড়ে যেতে পারে দাদার কীর্তিছবির কোনো দৃশ্যের কথাও। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী অনেকটাই ভাগলপুরের প্রেক্ষাপটে লেখা। একসময় বাঙালি ছাড়াও বহু ইংরেজ মধুপুরে আসতেন স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে। রেলের কাজের সূত্রে অনেকে থেকেও যেতেন। এখানে এসে বাঙালিরা ক্লাব কিংবা অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে আদান-প্রদানের একটা ক্ষেত্র তৈরি করতেন।
শিমুলতলায় ট্রেন থেকে নামলেই দেখা যাবে পাহাড়ি ম্যালের মতো ওখানকার রেল স্টেশন। আর রেল স্টেশনের মুখোমুখি মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে শিমুলতলার মূল আকর্ষণ লাট্টু পাহাড়। দুর্গের মতো পাটনা লজ, নলডাঙার রাজবাড়ি, সেন সাহেবদের লন টেনিস কোর্টকে পাশে রেখে মাঠ পেরিয়ে হাজার ফুট উঁচু লাট্টু পাহাড়। গাছগাছালিতে ছাওয়া লাট্টুর শীর্ষে চড়ে দেখে নেওয়া যায় আদিবাসী দেবতাদের স্থান। বাঁদিকে সে কালের হাউজ অফ লর্ডস আর ডানদিকে হাউজ অফ কমনস। চারপাশ ঘিরে প্রহরীর মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়শ্রেণি।
গিরিডি জায়গাটা শুনলে প্রথমেই মনে আসে সহজ পাঠের সেই লাইন - আজ উস্রি নদীর ঝরনা দেখতে যাব, দিনটা বড় বিশ্রী।সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নন্দলাল বসুর সেই আঁকা ছবির কথা।
গিরিডিবাসী বিরলকেশ সেই বৈজ্ঞানিক, সত্যজিৎ রায়ের লেখা-আঁকা দিয়েই চিনেছেন পড়ুয়ারা। জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়িও ছিল এই গিরিডিতে। উস্রির ঝরনা চমকে দেয় সেখানে বর্ষার পরে গেলে। পাথুরে ভূমিরূপের মাঝখান দিয়ে উচ্ছ্বল উস্রি বয়ে চলেছে। কখনও শান্ত, কখনও সে খরস্রোতা।


মধুপুরে একসময় ছিল বাঙালিদের রমরমা। অনেক অর্থশালীরা জমি কিনে নিজেদের দ্বিতীয় বাসস্থান তৈরি করেছিলেন মধুপুরে। বিদ্যাসাগরের স্নেহধন্য ভূগোলবিদ শশিভূষণ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, প্রদ্যুম্ন মল্লিকের মতো অনেকেই সে যুগে নিজের বাড়ি তৈরি করেন মধুপুরে। যদিও আজ আর সে সবের কোনো চিহ্ন নেই। যেমন চিহ্ন নেই বাবা গঙ্গাপ্রসাদের নামে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তৈরি বাড়ি গঙ্গাপ্রসাদ ভবন
শহরের একেবারে অন্য প্রান্ত কাঁঠালতলা। প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্র গোড়ায় নিজের থাকার জন্য কাঁঠালতলায় বিশাল বাড়ি তৈরি করেছিলেন। সামনে বিশাল এক ঝিল। জায়গাটা পছন্দ হওয়াতে পাথরোলের রাজাদের কাছ থেকে পাথরচাপাটি মৌজার বেশ অনেকটা জমি লিজ নিয়ে কাঁঠালতলা, বটতলা, পায়রাতলা নামের ছ’-সাতটা বাড়ি তৈরি করে কলকাতার বাঙালিদের আমন্ত্রণ করেন হাওয়া বদল করতে আসার জন্য। আজ গোটা তিনেক বাড়ি ছাড়া সবই কালের গর্ভে বিলীন। কাছেই রয়েছে রায়বাহাদুর অনাথনাথ সাধুর সাধুসঙ্গবাড়ি, ওই পরিবারেরই তৈরি সিদ্ধেশ্বরী দুর্গামন্দির। পাথরোল এস্টেটের বাঙালি ম্যানেজার মতিলাল মিত্র রাজবাড়িতে চাকরির সুবাদে অনেক বাঙালিকেই বাড়ির জমি পাওয়ায় সাহায্য করতেন। এডয়ার্ড জর্জ হাইস্কুল নামে এক স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর উদ্যোগে। সে স্কুল এখনও আছে। তবে নাম হয়েছে আশুতোষ-পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে।

বাঙালি এক কালে হোল্ড-অল নিয়ে চিঁড়ে-মুড়ি বেঁধে সদলবলে ট্রেনে উঠত। যে সে ভ্রমণ ছিল না। তাকে বলা হত চেঞ্জ’-এ যাওয়া। মাস খানেকের জন্য গোটা পরিবার চলে যেত অন্য কোথাও। হয় গ্রীষ্মের ছুটিতে, না হয় পুজোর পর। দক্ষিণে হাওয়া বদলের জন্য যেতে বলতেন চিকিৎসকেরা। না হলে কাশী যাত্রা হত মাঝেমধ্যে। আর পাহাড় দেখতে হলে শিলং। রবিঠাকুরের অমিত-লাবণ্যের প্রভাব তো বটেই, সত্যজিৎ রায়ের প্রভাবে দার্জিলিং আর পরে রাজস্থান যাওয়ার চল বাড়ে। পোশাকেও আসে বৈচিত্র্য। শাড়ির উপর লম্বা কার্ডিগান। সঙ্গে চাদর আর হনুমান টুপি।
মধ্যবিত্ত বাঙালির ভ্রমণের বাজেটেও হত কাটছাঁট। বড়ো হোটেলের বদলে প্রায়োরিটি ছিল হলিডে হোম কিংবা কোনো আশ্রম। আশ্রম মানে নিরামিষ। তাই অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে বিশেষ করে মেয়েদের প্রসাধনী জিনিসের সঙ্গে ঢুকত লুকিয়ে রাখা পেঁয়াজ। আশ্রমের ঘরে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে মুড়ি মাখা হত সেই পেঁয়াজ দিয়ে। সে খোসা উড়ে বাইরে গেলে চিত্তির। বহুবার খোসা উড়ে আশ্রমে বদনাম হয়েছে বাঙালির।
মোদ্দা কথা ভ্রমণের ব্যাপারে বাঙালির যে একটা খ্যাতি আছে, ভারতের অন্য যে কোনো রাজ্যের অধিবাসীদের বোধহয় সেটা নেই। বস্তুত এই ভ্রমণ জিনিসটা বাঙালির মজ্জায় মজ্জায় এমনই গেঁথে গেছে যে উঠল বাই তো কটক যাইনামক প্রবাদ সাধে তৈরি হয়নি। পায়ে চাকা লাগানো’ কথার উৎপত্তিও তার এই ভবঘুরে বৈশিষ্ট্যের জন্যই। বলা হয় বাঙালি মিশ্র জাতি, কারণ বর্ণসংকরের ফলেই বাঙালি জাতির উদ্ভব। তাই বাঙালির জীবন যাপনে কিছুটা যাযাবরবৃত্তি যেন দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটনপাগল জাতি হল বাঙালি। বাঙালির এই পর্যটনের উপর নানা প্রভাবকের প্রভাব রয়েছে। বাঙালিদের ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যায় যে এই ইতিহাস এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস। কখনও বহিশত্রুর আক্রমণের ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে, কখনও বাণিজ্যিক কারণে, আবার কখনও বা তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে পড়েছে। তৎকালীন তীর্থযাত্রা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সেই কষ্টকে অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের তীর্থ পর্যটন চলে আসছে। বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর দশম শতাব্দীতে তিব্বতে গেছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারে। উনিশ শতকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত ভ্রমণের দৃষ্টান্ত প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। রমেশচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক ভারতের আরও বহু মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের মতন পরিব্রাজকের কথাও ধরতে হবে। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে শিবনাথ শাস্ত্রী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙালিরা যাঁরাই ইউরোপে গেছেন, সতর্ক মন নিয়েই ভ্রমণ করেছেন এবং কী পাওয়ার আছে তা ভেবেছেন। তবে শিবনাথ শাস্ত্রী, ত্রৈলোক্যনাথদের ভ্রমণ ঠিক ভ্রমণ নয় এঁরা যখন যাচ্ছেন তখন এঁরা জানেন ইউরোপে ঠিক কী কী দেখতে হবে, কোনটার প্রশংসা করতে হবে আর কোনটার নিন্দে করতে হবে। এঁরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং তৎকালীন ঔপনিবেশিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। ফলত ইউরোপ সম্পর্কে কতকগুলো বাঁধাধরা ধারণা তাঁদের ছিল। ভ্রমণ বৃত্তান্তগুলো সেই স্টিরিওটাইপকে যথার্থতা দিয়েছে। সেই জন্যই দেশ-বিদেশ ভ্রমণকে বাদ দিলে দেখা যায় যে, বহু আগে থেকেই বাঙালিরা তীর্থযাত্রীকেই প্রথম পছন্দের মধ্যে বেছে নিয়েছে। বাঙালি তীর্থযাত্রীদের কাছে হিন্দুপুরাণের চার ধাম কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী; হিন্দুদের মোক্ষলাভের সপ্তপুরী বারাণসী, অযোধ্যা, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থভূমিগুলোর স্থান ছিল সর্বাগ্রে। বহুকাল ধরে অসংখ্য বাঙালি পুণ্যলাভের আশায় এইসব স্থানে ভ্রমণ করেছে। তাছাড়া হিন্দু তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে পুরী, তেনকাশী, প্রয়াগ, গয়া, বুদ্ধগয়া, দেওঘর, বৃন্দাবন প্রভৃতি স্থানগুলোয় একসময় প্রচুর তীর্থযাত্রী ভিড় করত। তবে বাঙালিরা যে শুধুমাত্র তীর্থযাত্রী ছিল তা নয়, এমন অনেক বাঙালি আছেন যাঁরা অভিজাত পর্যটকহিসাবে পরিচিত। এঁরা বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, বহু জায়গা কিংবা বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, অনেক দেখেছেন, অনেক জেনেছেনভ্রমণ এঁদের কাছে শুধু দেখা নয়, অনুভবও। এঁরা ছিলেন সংখ্যায় খুবই কম। ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে এমন অনেক ভ্রমণার্থীদের মধ্যে এঁদের সংখ্যাও খুবই কম ছিল। এঁরা সাধারণত আবিষ্কারক। নতুন পথ, নতুন জায়গা, নতুন পাহাড় ইত্যাদির খোঁজ মেলে এঁদের অভিযানে। ১৯৬০ সালে হিমালয়ের নন্দাঘুন্টি শিখর অভিযান করে বাঙালির অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের যাত্রা শুরু হয়। তার আগে বিক্ষিপ্তভাবে নানাজন হিমালয়ে পৌঁছেছেন তার দুর্গম আকর্ষণে, তীর্থযাত্রীরা গেছেন ধর্মের টানে। ঘটে গেছে বেশকিছু উচ্চমানের ট্রেকিং। স্বামী অখণ্ডানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, জলধর সেন, রামানন্দ ভারতীয় মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বর্ণনায় জানা গেছে হিমালয়ের গহন অঞ্চলের কথা। বলা যেতে পারে তাদের দেখানো পথ ধরেই এসেছিল বাঙালিদের পাহাড়ে যাওয়ার একান্ত নিজস্ব ট্র্যাডিসনপরে হিমালয়ের ট্রেকিংকে আরও সুপরিচিত করে তুলেছিলেন প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধ বসু, প্রবোধকুমার সান্যালের মতো পর্যটক।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment