মহাভারতের গল্প:: মহাভারতের এক তেজস্বিনী মেয়ের কথা - সুমনা সাহা


মহাভারতের এক তেজস্বিনী মেয়ের কথা
সুমনা সাহা

প্রথম পর্ব

দূরে, যত দূরে চোখ যায় অথৈ জল সুনীল জলরাশির উপর নাচছে ছোটো ছোটো তরঙ্গ উজ্জ্বল রৌদ্রকিরণে ঢেউয়ের মাথায় রূপোর মুকুটগুলো ঝিকমিক ঝিকমিক করে উঠছে পন্নগী দু’চোখ ভরে দেখছে সকলের অলক্ষে আবার সে নিঃশব্দে উঠে এসেছে জলের উপরিভাগে, বসেছে একটি আধোডোবা চ্যাপটা পাথরের উপর বাবা জানতে পারলে ভীষণ রাগ করবেন জলের উপর আসার বিপদ আছে পন্নগীও যে সেটা জানে না, তা নয় কিন্তু তবুও না এসে পারে না জলের উপরের জগৎটা তাকে ভীষণ টানে এই জলকল্লোলের শব্দ, এই মৃদুমন্দ পবন, দূরে সবুজ বনের আভাসএসবই তার বড়ো ভালো লাগে আনমনে দূর বনের দিকে চেয়ে থাকে পন্নগী বাতাসে ওড়ে তার ঘন কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশদাম, হলদে সবুজ জলপাই রঙের ত্বকে খেলা করে কমনীয় রোদ্দুর, কোমরের নিচের দুর্বল পা-দুটিকে ঢেকে রাখা শ্যাওলা সবুজ মেখলা ঢেউয়ের হিল্লোলে ভিজে উঠছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই পন্নগীর অপূর্ব এক ভালোলাগার আবেশে সকালের সোনালি আলো আর গঙ্গা-তীরের মিঠে বাতাস গায়ে মাথায় মেখে সে চুপ করে বসে থাকে মন যেন কীসের এক প্রতীক্ষায় অধীর কী যেন এক অজানা আজ ঘটবে তার জীবনে যেন এক অস্ফুট স্বপ্নের মতো সেই অধরা মাধুরী তাকে আনমনা করে রেখেছে
অবাক হচ্ছ বুঝি? হ্যাঁ, পন্নগী সত্যিই জলের নিচে থাকে অনেক অনেক কাল আগে, মানব সভ্যতা উন্নতির শিখর স্পর্শ করেছিল তাদের ছিল দ্রুত গতিসম্পন্ন বিমান, জানা ছিল নীরোগ শরীরে দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকবার বিদ্যা, অধিগত হয়েছিল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির জ্ঞান, আরও কত কী! একবিংশ শতাব্দীর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের যুগে মানুষ এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের নিচে বসতি স্থাপন করবার পরিকল্পনা করছে, অথচ বহুযুগ আগে নদীর তলদেশে সমুদ্রের নিচে উন্নত জাতি বাস করত তাদের পাতালবাসী কিম্বা নাগলোকের বাসিন্দা বলা হত, আর অনেক অনেক কাল পরে সে সমস্ত লোকের মুখে মুখে গল্পকথায় পরিণত হল জলের নিচে স্থলভাগের তুলনায় চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা কম ডাঙায় হাঁটতে গেলে মাটির সঙ্গে পায়ের ঘর্ষণের ফলে যে বাধার সৃষ্টি হয়, সেই বাধা কাটিয়ে দেহের ওজন অনুপাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে চলাফেরা করতে হয় জলে সে সব অসুবিধা নেই বললেই চলে তাই অনেক প্রজন্ম জলে বাস করার পর পাতালের বাসিন্দাদের কোমরের নিচের দিক থেকে পায়ের অংশ খানিকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল তবে তারা সাঁতারে অত্যন্ত পটু ডাঙার মানুষ জলে তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না কিন্তু জলের উপরে গেলে কেউ যদি আক্রমণ করে, তখন বিপদ তাই তো জলের উপরে একলা এলে বাবা রাগ করেন ওহো, ওর পরিচয় তো তোমাদের বলা হয়নি গঙ্গানদীর নিচে সেকালে ছিল এক বিরাট সাম্রাজ্য সেখানকার রাজা কৌরব্য- মেয়ে সে, আমাদের পন্নগী তবে তার কী কেবল একটা নাম? কেউ বলে কৌরবী, কেউ বলে ভূজগাত্মজা, পন্নগদুহিতা, ভূজগেন্দ্রকন্নকা এমনিই কত নাম তার, আরও একটি নাম আছে তার, উলূপী এই নামেই আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে, বিষ্ণুপুরাণে ভাগবত পুরাণেও তার উল্লেখ আছে তাকে কখনও-সখনও কেউ দেখে ফেলেছে পাথরের উপর বসে থাকতে মানুষ কাছেপিঠে দেখলেই সে চোখের পলকে জলের তলায় অদৃশ্য হয় তখন অবাক হয়ে লোকে বলাবলি করে, “অদ্ভুত একটা প্রাণী দেখেছি, দেহের উপরের ভাগ তার মানুষের মতো, কিন্তু নিচের অংশ সাপের মতো, নাকি মাছের মতো, জলের ভিতর তিরবেগে সাঁতরে সে নিমেষেই চোখের আড়াল হয়ে গেল!”
উলূপী সুন্দরী, যুদ্ধবিদ্যা জানে, আরও অনেক বিদ্যা শেখা হয়েছে তার, কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা হল, সে ভীষণ তেজি মেয়ে তেমনই সাহসী আর স্বাধীনচেতা কারও কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া তার ধাতে নেই সহসা জলের ঢেউয়ে ঝলসে ওঠে একটি শাণিত ফলার মতো পদার্থ সেদিকে দৃষ্টি পড়তে উলূপী লক্ষ করে একজন স্থলের মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে, হয়তো বা অচেতন, তার কাঁধে রাখা তূণীর মধ্যস্থ তিরের ফলা সূর্যের আলোয় ঝকমকিয়ে উঠে উলূপীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তিরের ফলা, রোদের প্রতিফলন এসবই তো বাহ্য, এরা সকলে মিলে কেবল ঘনিয়ে তুলেছে সেই যোগ, যে যোগ পরিচয় করাবে দুটি মানুষের, স্থলের মানুষের সঙ্গে জলের মানুষের, রচনা করবে অন্য এক ইতিহাস, উলূপীর আজকের এই অজানা অধীর অপেক্ষা এই পরিচয়ের ক্ষণটির জন্যেই হয়তো বা তৈরি হয়েছিল! এক সর্পিণীর মতোই তড়িৎ গতিতে উলূপী সাঁতরে পৌঁছে যায় আধোডোবা অচেতন মানুষটার কাছে, তারপর এক হাতে ওর হাত ধরে মারে এক হ্যাঁচকা টান আর যাত্রা করে নিজের রাজত্বের দিকে, জলের এক্কেবারে গভীরে
হ্যাঁচকা টানে চেতনা ফিরে আসে স্থলের মানুষটার কিন্তু সেও চট করে প্রতিক্রিয়া দেখানোর লোক নয় ধীর-স্থির-বুদ্ধিমান পুরুষ সে তাই কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, তা দেখবার জন্য শান্তভাবে সে ভেসে চলে শান্ত ছায়াময় এক মনোরম লতাপাতায় ঘেরা স্থানে পৌঁছে থামে সেই মেয়ে পুরুষের হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়ায় দু’চোখে ওর একরাশ মুগ্ধতা জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি?” পুরুষ দৃপ্ত স্বরে বলে, “আমি কুন্তীপুত্র অর্জুন! তুমি কে গো সাহসিনী কন্যা?”
অর্জুন? কী সুন্দর এই নাম! সাহস তো তোমারও কম কিছু নয়? এই যে অপরিচিত এক মেয়ে তোমাকে টেনে নিয়ে এল এক অজানা স্থানে, বিন্দুমাত্র ভয় নেই তোমার?”
অর্জুন হাসল ভুবনমোহন হাসিতে জয় করেছে সে কত নারী-পুরুষ-রাজা-ঋষি আচার্য হৃদয় নিতান্ত কিশোরী কন্যার আর কথা কী? হাসি মনের মুকুর সৎ, পবিত্র, সরল, অকপট নির্ভীক পুরুষেরই হাসি সাজে
স্নেহপূর্ণ স্বরে অর্জুন বলল, “ভয় কীসের কন্যা? এমন তো প্রথম নয় আগেও কতবার জীবন বিপন্ন হয়েছে আমার দৈব সর্বদাই আমার সহায় হয়েছে তুমি তো নেহাৎই বালিকা কে তুমি? পরিচয় দাও নিজের, আমাকে কোথায় এনেছ তাও বল
“আমি নাগলোকের অধিপতি কৌরব্য রাজার কন্যা পন্নগী তুমি আমাকে উলূপী নামেও ডাকতে পার এটি গঙ্গাগর্ভের নাগলোক এখানে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন আর তুমি আমাকে বালিকা বলছ কেন? আমি মোটেই বালিকা নই তোমাকে আমার ভালো লেগেছে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই
অর্জুন এবার আগের থেকে আরও জোরে হেসে উঠল হাসি আর থামতেই চায় না তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আচ্ছা বেশ, তোমাকে আর বালিকা বলব না তোমার নির্ভীক অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু উলূপী, আমি যে তোমার প্রস্তাবে সাড়া দিতে অক্ষম! আমি ইতিপূর্বেই বিবাহ করেছি এবং আমাদের স্থলের রাজাদের নিয়ম অনুসারে এক স্ত্রী জীবিত থাকতে তার অনুমতি না নিয়ে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারি না
উলূপী অর্জুনের কথায় একটুও দমে না গিয়ে বলে, “বেশ, তুমি বিবাহিত, তা না হয় মেনে নিলাম কিন্তু তুমি তো রাজা! একলা এই নদীতীরে এমন ভ্রাম্যমান পথিকের মতো কীভাবে এসে পড়েছ? তোমার অনুচর-সহচর কোথায়? যদি নদীতীরে কোনো যজ্ঞ করতে এসে থাকো, তোমার ধর্মপত্নী সঙ্গে নেই কেন?”
অর্জুন শান্তস্বরে বলে, “তুমি ঠিকই বলেছ, আমি নদীতীরে একটি যজ্ঞের প্রয়োজনেই এসেছি হঠাৎ স্রোতের টানে আমি ভেসে গিয়েছিলাম তারপর কখন জ্ঞান হারিয়েছি, মনে নেই আমার সঙ্গে কয়েকজন ব্রাহ্মণ ছিলেন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব তার আগে আমি আমার অসম্পূর্ণ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে চাই এই নাগলোকে কি যজ্ঞাহুতির জন্য অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা যেতে পারে?”
উলূপী কোনো কথা না বলে আবার এসে নিঃসঙ্কোচে অর্জুনের হাত ধরে তারপর তাকে টেনে নিয়ে চলে আরেক দিকে
কিছুক্ষণ পরে যেখানে পৌঁছায়, সেখানে অর্জুন দেখে এক বিরাট প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড সামনে প্রশস্ত যজ্ঞবেদি এখানে যে নিয়মিত যজ্ঞাদি কর্ম হয়ে থাকে, বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না অর্জুনের দৃষ্টিতে প্রসন্নতা দেখে খুশি হয় উলূপী, বলে, “নাও, এবার তোমার কাজ সম্পূর্ণ কর
হৃষ্ট চিত্তে অগ্নিতে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে অর্জুন অগ্নিদেবও যেন অর্জুনের প্রাত্যহিক ব্রত-অনুষ্ঠানের নিষ্ঠা দেখে তুষ্ট হয়ে পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠলেন তারপর দু’জনে কথা বলবার জন্য বসে অর্জুন বলে, “আমার স্ত্রী দ্রুপদ রাজার মেয়ে দ্রৌপদী যাজ্ঞসেনী সে, যজ্ঞের অগ্নি থেকে উদ্ভূতা পরমা সুন্দরী তাকে লাভ করবার জন্য দেশবিদেশের রাজকুমারদের মধ্যে লড়াই বেঁধে গিয়েছিল অবশেষে স্বয়ম্বর সভায় এক কঠিন প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে তার কাছ থেকে আমিই বরমাল্য লাভ করেছি
, তুমি পাঞ্চাল দেশের রাজকন্যা পাঞ্চালীর কথা বলছ! কিন্তু তিনি তো শুনেছি পঞ্চপতি গ্রহণ করেছেন
তিনি পঞ্চপতি গ্রহণ করেননি পরিস্থিতি তাকে দিয়ে তেমন করিয়েছে যাই হোক, তুমি এসব জানলে কোথা থেকে?”
আমার পিতার কাছে সব খবরই আসে আমি সেখান থেকেই জানতে পেরেছি তবে কি তুমিই সেই অর্জুন? সেই অসম্ভব শর্ত মেনে মাছের চোখে লক্ষ্যভেদ করে তুমিই জয় করেছ পাঞ্চালীকে? তবে তোমার রাজবেশ কোথায়? কেন তুমি এমন দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশে? তোমার তূণীরে তির দেখে আমার সংশয় হয়েছিল আমাকে বলো বীর অর্জুন, যাজ্ঞসেনী কি এখন তোমার সঙ্গে বাস করছেন না?”
অর্জুন, বীর অর্জুন, ক্ষত্রিয় যোদ্ধা অর্জুন, এই মুহূর্তে এক বিস্মিত কিশোরীর সরল প্রশ্নবাণে নতমস্তকে নীরব থাকে, বলতে পারে না, ‘ওহে বালিকা, ভাগ্য কতরকমে পরিহাস করে, তার তুমি কতটুকুই বা জানো?
অবশেষে ধীরে ধীরে আরক্ত নয়ন তুলে অর্জুন তাকায় উলূপীর দিকে তার প্রেমপ্রার্থী এই সুন্দরী কিশোরী ব্যাকুল আগ্রহে চেয়ে আছে তারই মুখের পানে, নিষ্পাপ সরল দুটি চোখে ভালোবাসা আর নিঃশর্ত সমর্পণ অর্জুন মৃদুস্বরে বলে চলে মাতা কুন্তীর অসতর্ক উক্তির কথা, তাদের পঞ্চভ্রাতার মধ্যে দ্রৌপদীর ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা এবং এক ভ্রাতার স্ত্রী থাকাকালীন অন্য কোনো ভ্রাতা তাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তে উপস্থিত হলে শাস্তিস্বরূপ এক বছরের জন্য অরণ্যে ব্রহ্মচারী হয়ে থেকে প্রায়শ্চিত্ত করার প্রতিজ্ঞার কথা, এবং বর্তমানে শর্তভঙ্গকারী অর্জুনের অরণ্যচারী হওয়ার কথা
নীরবে সব শোনে উলূপী তার দু’চোখ ছলছলিয়ে ওঠে অর্জুনের দুঃখে স্থলের মানুষদের জটিল নিয়মকানুন সে বুঝতে পারে না
উলূপী অর্জুনের হাতের উপর নিজের হাত রাখে তারপর দৃঢ় স্বরে বলে, “শোন বীর অর্জুন, সমস্ত ঘটনা শুনে আমি যা বুঝেছি, তাতে কোনোখানে তোমার কোনো অপরাধ হয়নি দ্রৌপদী ধর্মমতে তোমার স্ত্রী হলেও এখন তিনি যুধিষ্ঠিরের গৃহিণী তাই এখন তোমার অন্য স্ত্রী গ্রহণে বাধা থাকতে পারে না
তুমি বোঝনি কন্যা আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাই না কেন বার বার অসম্ভব কথা বলছ? আমি ভ্রাতাদের অনুমতি না নিয়ে অন্য স্ত্রী নিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে পারব না আমাকে দয়া করে নাগলোক থেকে বেরোবার পথ বলে দাও
এবার উলূপী খিলখিল করে হেসে ওঠেএই তোমার ভয় বীরপুরুষ? আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে সঙ্গে নিতে হলে পরিবারের সমর্থন দরকার? কে তোমার পরিবারে যেতে চায়? আমি? আমি এখানে মহানন্দে থাকি, আমার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করেন না, এমনকি আমার পিতাও নন আমি নাগলোকের রাজনন্দিনী আমি তোমাদের স্থলের জগতে বাস করতে পারবও না তোমাকে আমার ভালো লেগেছে তোমাকে ভালোবেসে আমি তোমার ভালোবাসা পেতে চাই এই নাগলোকে এমন কোনো নিয়ম নেই যে বিয়ে করবার পর নারী-পুরুষকে পরস্পরের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হবে এবং তাদেরকে একত্রে থাকতেই হবে তোমার যতদিন ইচ্ছা এই নাগলোকে থাকতে পার তারপর কর্তব্য পালনের জন্য প্রয়োজনে যেতে পার যেখানে ইচ্ছা, আমাদের এখানে কেউ তোমাকে বাধা দেবে না আমিও না কেবল আমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান কোরো না বীর অর্জুন! কথা দিচ্ছি, কোনোদিন, কোনো দাবি নিয়ে তোমাকে বিব্রত করতে উপস্থিত হব না বরং কোনোদিন তোমার কোনো দরকারে যদি কাজে লাগতে পারি, নিজেকে ধন্য মনে করব
দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে অর্জুনের মন বারংবার মনে পড়ছে সেদিনের সেই লক্ষ্যভেদ অনুষ্ঠান শেষে বিজিতা যাজ্ঞসেনীর লাজনম্র মুখের ছবিখানি! যাজ্ঞসেনীর আগে স্থান দিতে হবে অন্য কোনো নারীকে! নিয়তির এ কী অদ্ভুত পরিহাস! চিন্তাজাল ছিন্ন হয় কোমল দুটি করস্পর্শে দু’হাতে অর্জুনকে বেষ্টন করে দু’চোখের নীরব ভাষায় উলূপী যেন বলতে চায়, ‘যাজ্ঞসেনীর চেয়ে আমিও রূপে-গুণে কোনো অংশে কম নই! উলূপীর সহজ সরল স্পষ্ট বাক্যে অর্জুন মুগ্ধ হয়, মন থেকে সব দ্বিধা মুছে ফেলে জলজ শৈবালের মতো নরম অথচ দৃঢ় মনের সেই নাগলোকবাসিনী কন্যা উলূপীর বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি জানায় বহু রাজকন্যা যে বীর অর্জুনের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, সেই মধ্যমপাণ্ডব কৃষ্ণসখা অর্জুনের প্রথমা স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করেছিল সাহসিনী মেয়ে উলূপী
কোনো শর্ত নেই, নেই কোনো বন্ধন, কোনো মন্ত্র উচ্চারিত হয় না এই প্রেমের বিবাহে, কেবল দুটি পবিত্র হৃদয় হল যজ্ঞের অগ্নি, আর দু’জনের পবিত্র ভালোবাসা -বিয়ের মন্ত্র বেশ কিছুদিন সুখে অতিবাহিত হয় ভালোবেসে অর্জুনকে উপহারস্বরূপ এক বর দান করে উলূপী, বলে, “জলের নিচের সমস্ত প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধে তুমি হবে অপরাজেয়!” একসময় অর্জুন উলূপীকে স্মরণ করিয়ে দেয় নিজের অসমাপ্ত কর্তব্যের কথা নির্দ্বিধায় উলূপী বিদায় দেয় প্রিয়তম অর্জুনকে সঙ্গে করে দিয়ে আসে পাতাললোকের ঊর্ধ্বে, স্থলভাগে বিদায়কালে মনে করিয়ে দেয়, “আমার অনেক বিদ্যা জানা আছে, কোনোদিন বিপদে পড়লে স্মরণ কোরো, পাশে পাবে যে-ক’দিন একসঙ্গে কাটল, তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে থাকবে চির-অমলিন!”
চলে গেলেন অর্জুন মহাভারত মহাকাব্যে তাঁর বিরাট ভূমিকা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে তিনি সে সমস্ত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন উলূপীর কথা আর তাঁর মনে এল না নাকি মাঝেসাঝে মনে পড়ত, কে জানে?
কিছুদিন পরে নাগলোকে এল এক নতুন অতিথি উলূপীর গর্ভে জন্ম নিল অর্জুনের প্রথম সন্তান ইরাবান
রাজার ছেলের মতোই নাগলোকে ইরাবানকে বড়ো করে তুলছেন উলূপী ক্ষত্রিয় বীর অর্জুনের সন্তানকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে কোনো ত্রুটি রাখছেন না উলূপী ইতিমধ্যে গঙ্গায় বয়ে গেছে অনেক জল পিতা কৌরব্যের অবর্তমানে পাতাললোকের রাজ্য শাসন করছেন বীর নারী উলূপী হঠাৎই একদিন তাঁর কানে এল অর্জুনের সংবাদ তাঁর প্রিয় সখী, মণিপুর রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা খবর পাঠিয়েছেন, “অর্জুনের আর বাঁচার আশা নেই তুমি শিগগির এসো ভাই, কিছু একটা করউলূপীর যে অনেক বিদ্যা জানা আছে, সে কথাও জানে কেউ কেউ চিত্রাঙ্গদাও জানে কিন্তু অর্জুনের কী হল? যুদ্ধে হারিয়ে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে নাকি নেহাৎই এক বালক! বভ্রুবাহন নাম তার কী সর্বনাশ! সে- যে অর্জুনেরই ছেলে!
(ক্রমশ)
----------
[মহাভারত - আদিপর্ব, অধ্যায় - অর্জুন-বনবাস পর্ব, ২১৬ নং পরিচ্ছেদ]
ছবি - উইকিপিডিয়া
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment