প্রবন্ধ:: সুনামি ও ভূমিকম্প - দেবব্রত দাশ


সুনামি ভূমিকম্প
দেবব্রত দাশ

আমাদের মানে ভারতীয়দের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে সুনামি’-শব্দটি পরিচিতি লাভ করে ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪-এর পর থেকে ওই দিন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার কাছে ভারতমহাসাগরে উদ্ভূত সুনামি বিধ্বংসী আকার নিয়ে তছনছ করে দিয়েছিল থাইল্যান্ডের পাটায়া, ফুকেত থেকে শুরু করে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, চেন্নাইয়ের ম্যারিনা বিচ, শ্রীলঙ্কার গল, ভারতের সর্ব দক্ষিণের প্রান্তিক শহর কন্যাকুমারী এবং তারও পরের বহু দূরের আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলিও বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পায়নি
সুনামি আসলে কী এবং কেনই বা হয় এর উৎপত্তি? এটি জাপানি শব্দ সু (tsu) আর নামি (nami) - দু'টি শব্দের সংযোগে তৈরি - tsunami 'সু'- অর্থ হারবার বা বন্দর আর 'নামি'- মানে ঢেউ জাপানে যেহেতু সুনামি এক অতি পরিচিত ঘটনা, তাই শুধু জাপানিরাই এই শব্দটি ব্যবহার করত ১৯৬৩ সালে এক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-সম্মেলনে সুনামি’-শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহারের জন্যে স্বীকৃতি লাভ করে
এককথায়, সুনামি এক প্রবল জলোচ্ছ্বাস বিশেষ কতকগুলি কারণে অত্যন্ত দ্রুতগতির সমুদ্র-তরঙ্গ যখন উপকূলভাগে আছড়ে পড়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা মহাতরঙ্গে পর্যবসিত হয়, তখন তাকেই বলে সুনামি এর উৎপত্তির একাধিক কারণ রয়েছে যেমন - সমুদ্রের তলায় সৃষ্টি হওয়া ভূমিকম্প, নিমজ্জিত আগ্নেয়গিরির আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাত কিংবা বিশালাকার ভূমিধস অর্থাৎ, সমুদ্রের ধারে সৃষ্ট বড়োসড়ো ধস যদি সমুদ্রের জলে এসে পড়ে, তাহলেও সুনামির সৃষ্টি হতে পারে এছাড়া, আকাশ থেকে নেমে আসা বড়ো আকারের উল্কা, ধূমকেতু বা অ্যাস্টেরয়েড সমুদ্রের জলে আছড়ে পড়েও সুনামির জন্ম দিতে পারে
সবের মধ্যে প্রধান কারণ হল - সমুদ্রের তলদেশে উচ্চ মাত্রার প্রবল ভূমিকম্প আর বড়ো ধরনের ভূমিকম্পের পিছনে যে কারণ থাকে, তা হল ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটের চ্যুতি বিজ্ঞানী ওয়েগনারের প্লেট টেকটনিক’-তত্ত্ব অনুসারে গোটা পৃথিবীর উপরিস্তর, যা লিথোস্ফিয়ার বা ভূস্তর নামে অভিহিত এবং যার গভীরতা ৪০/৪৫ কিলোমিটার, সাত-আটটি বৃহৎ এবং অতিবৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত, সেই খণ্ডগুলিকেই বলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটস খণ্ডগুলির নিচে রয়েছে অর্ধগলিত তরল স্তর, যাকে বলা হয় mantle এই ম্যান্টল-এর উপরে অর্থাৎ, অর্ধগলিত তরলের সমুদ্রের উপর শামুকের গতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে সব মহাদেশ সাগর-মহাসাগরসহ ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলি ভাসতে ভাসতে তারা কখনও একে অন্যের গা ঘেঁষে চলে যায়, আবার কখনও বা দু'টি প্লেটের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটে, আবার কখনও কখনও একে অন্যের উপর বা নিচ দিয়ে পিছলে বেরিয়ে যায়
এখন থেকে ৬৫০ লক্ষ বছর আগে ভারতবর্ষের সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলজুড়ে ছিল সমুদ্র ইন্ডিয়ান প্লেটের ক্রমাগত উত্তরাভিমুখে সরণ ঘটতে থাকার ফলে তার সঙ্গে উত্তর দিকের চাইনিজ প্লেট আর পুব দিকের বার্মিজ (মায়ানমার) প্লেট-এর সংঘাতে যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবল বল উত্থিত হয়, তার ফলেই সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছিল হিমালয় পর্বতমালা ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪- মায়ানমার-প্লেটের নিচ দিয়ে ইন্ডিয়ান প্লেট পিছলে চলে যাওয়ায় সুমাত্রার কাছে সমুদ্রের তলায় যে . মাত্রার প্রবল  ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই কম্পন উল্লম্ব বা খাড়াভাবে সমুদ্রের জলকে ঠেলে উঁচুতে তুলে দেয় তখন অভিকর্ষের প্রভাবে ওই ফুলে ফেঁপে ওঠা জল ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি বেগে ছড়িয়ে পড়ে উপকূলের দিকে ধেয়ে গিয়েছিল মজার ব্যাপার হল এই যে, সমুদ্রের মাঝখানে এই জলপ্রবাহের গতি যত বেশিই হোক না কেন, তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বা উচ্চতা তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয় দু'টি তরঙ্গ-শীর্ষের দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে খানিক বেশি আর ঢেউয়ের উচ্চতা এক/দেড় মিটার মাত্র কিন্তু সেই তরঙ্গই যখন উপকূলের কাছাকাছি চলে এসেছিল, তখন তা হয়ে উঠেছিল অতি ভয়ঙ্কর
মূল ভূমিকম্পের প্রাবল্য অনুসারে সৃষ্ট সুনামির এক একটি ঢেউ মিটার থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠে উপকূলের দিকে যেতে যেতে সমুদ্রের গভীরতা যত কমতে থাকে, ততই সুনামির গতিবেগ প্রতিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তরঙ্গগুলি উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে তীরভূমি থেকে সেদিকে তাকালে মনে হয় - একটা পাহাড় হঠাৎ গজিয়ে উঠে ক্রমশ এগিয়ে আসছে এবং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরক শক্তিতে সেই জলস্তম্ভ তীর ছাপিয়ে দেড়-দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, যার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু জনপদ-লোকালয়, বলি হয় হাজার হাজার প্রাণ
এমনটাই ঘটেছিল ২০০৪-এর ২৬ ডিসেম্বরের ওই বিধ্বংসী সুনামিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারত মহাসাগরে সুনামির আবির্ভাব একেবারেই ব্যতিক্রান্ত ঘটনা ২০০৪-এর আগে পরে যে সব ভয়াবহ সুনামির উদ্ভব ঘটেছে, সেগুলোর প্রায় সব 'টাই প্রশান্ত মহাসাগরে
একটা কথা মনে রাখা দরকার, শুধুমাত্র উল্লম্ব অর্থাৎ উপর-নিচে আন্দোলিত ভূকম্পন থেকেই সুনামির সৃষ্টি হয়, আড়াআড়িভাবে মানে অনুভূমিক আন্দোলিত কম্পনে হয় না আগেই বলা হয়েছে যে, উল্লম্ব কম্পনের ফলে সমুদ্রের জল উপরের দিকে অপসারিত হওয়ার পরে পরেই অভিকর্ষ-বলের টানে তা নিচে এসে সাম্যাবস্থায় আসার চেষ্টা করে এবং তারই পরিণামে তৈরি হয় সুনামি
২০০৪-এর এই ইন্ডিয়ান ওশান সুনামি-কে আরও কয়েকটি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে যেমন – ‘সাউথ এশিয়ান সুনামি’, ‘ইন্দোনেশিয়ান সুনামিএবং বক্সিং ডে সুনামি
এই সুনামি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানিয়েছেন বিজ্ঞানীগণ ভূমিকম্প সুনামি মিলিয়ে ভূপৃষ্ঠে ২৬ মেগাটন টি.এন.টি পরিমাণ শক্তির নির্গমন ঘটেছিল ওই সময়, যা কিনা হিরোশিমায় পড়া অ্যাটম বোমার তুলনায় ১৫০০ গুণের চেয়েও বেশি শক্তিশালী ছিল মূল ভূমিকম্পের হাইপো সেন্টার ছিল গড় সমুদ্রতল থেকে ৩০ কিলোমিটার গভীরে
এই সুনামি ভূমিকম্পে ১৪টি দেশের দুলক্ষ তিরিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইন্দোনেশিয়ার পরে অন্য দেশগুলির মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির বিচারে তিনটি দেশ প্রথম সারিতে আসে শ্রীলঙ্কা, ভারত থাইল্যান্ড
২০০৪-এর সুনামি-সৃষ্টিকারী এই ভূমিকম্প এ যাবৎ তৃতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প, যা কিনা আমাদের পৃথিবীকে সেন্টিমিটার নাড়িয়ে দিয়েছে, তার মানে পৃথিবীর অক্ষরেখা ওই পরিমাণ ঘুরে গিয়েছে
২০০৪-এর পর ২০১১- ১১ মার্চ যে সুনামি জাপানের উত্তর পূর্ব উপকূলে তোহোকুর কাছে প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হয়ে সেন্ডাই ফুকুসিমা অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল, তা এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে, উপকূল অতিক্রম করে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্থলভূমিতে প্রবেশ করেছিল ওই সুনামির জন্যে দায়ী ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ., হাইপো সেন্টার ছিল সমুদ্রের নিচে ৩০ কিলোমিটার গভীরে এবং শক্তি নির্গত হয়েছিল পূর্বে বর্ণিত ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ভূমিকম্পের প্রায় দ্বিগুণ প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় দু'লক্ষ আশি হাজার মানুষ
১৯০০ সাল থেকে আধুনিক তথ্য-সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর জাপানের ২০১১ সালের ১১ মার্চের ভূমিকম্পটি এ যাবৎ সবচেয়ে শক্তিশালী সুনামির উচ্চতা ছিল ৪০. মিটার বা ১৩৩ ফুট সবচেয়ে ভয়ের কথা, এই ভূমিকম্পের প্রভাবে পৃথিবীর অক্ষরেখার চ্যুতি ঘটেছে ১০ সেন্টিমিটার বা ইঞ্চি থেকে ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির মধ্যবর্তী কোনো এক মান, যা কিনা এই গ্রহের কিছু ছোটোখাটো বিষয়ের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - দিনের সময়সীমার পরিবর্তন পৃথিবীর আহ্নিকগতি বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবী আগের তুলনায় . মাইক্রো সেকেন্ড কম সময়ে আবর্তিত হচ্ছে অর্থাৎ একটি দিন-রাত্তিরের দৈর্ঘ্য কমে গেছে . মাইক্রো সেকেন্ড
তবে রিখটার স্কেলে সবচেয়ে বেশি মানের ভূমিকম্প... এ যাবৎ যা সর্বোচ্চ... তা হল গিয়ে ১৯৬০ সালের গ্রেট চিলিয়ান আর্থকুয়েক ঘটেছিল মে মাসের ২২ তারিখে, মাত্রা ছিল . এই মনস্টার বা দৈত্যসদৃশ ভূমিকম্পের সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া সুনামি দক্ষিণ চিলিকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল পুরোপুরি ২২ মে ১৯৬০ ছিল new moon বা অমাবস্যার আগের দিন
১৯৬৪- ২৭ মার্চ শুক্রবার ঘটেছিল গ্রেট আলাস্কান আর্থকুয়েক’, যা গুড ফ্রাইডে আর্থকুয়েক নামেও পরিচিত রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল . হাইপো সেন্টার ছিল ২৫ কিলোমিটার গভীরে সমুদ্রতলের উল্লম্ব উত্তোলনের ফলে যে প্রবল সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল ৬৭ মিটার বা ২২০ ফুট ১৯৬৪- এই ভূমিকম্প উত্তর আমেরিকার ইতিহাসে বৃহত্তম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম আর ঘটনার দিনটি ছিল full moon বা পূর্ণিমার দিন
এর পর উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১০-এর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া . মাত্রার চিলি আর্থকুয়েক’-এর কথা সে দিনটা ছিল পূর্ণিমার আগের দিন আগেই বলা হয়েছে, ২০০৪-এর ২৬ ডিসেম্বর ভারতমহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া সুনামি ভূমিকম্পের দিনটিও ছিল পূর্ণিমার দিন
অতি সাম্প্রতিক কালে ২০১৬- ১৩ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডে . মাত্রার যে প্রবল ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, তার হাইপো সেন্টার ছিল প্রশান্তমহাসাগরের ২৩ কিলোমিটার নিচে এবং তা . মিটার উচ্চতার সুনামির জন্ম দিয়েছে দিনটা ছিল পূর্ণিমার আগের দিন

এবার তাহলে ভূমিকম্পের সঙ্গে চাঁদ সূর্যের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সে আলোচনায় আসা যাক পৃথিবীতে বড়োসড়ো ভূমিকম্প ঘটার পেছনে যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর চ্যুতিই দায়ী, সে কথাই বলা হয়েছে ওয়েগনারের তত্ত্বে কিন্তু ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর চ্যুতির পেছনে কি চাঁদ সূর্যের মহাকর্ষের মানে gravitation–এর প্রভাব আছে?
কিছুসংখ্যক বিজ্ঞানী মনে করেন যে, প্রভাব অবশ্যই আছে যুক্তি তথ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের মত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন
আসলে, চাঁদ সূর্যের সম্মিলিত মহাকর্ষ বল বা gravitational pull যেমন সাগর মহাসাগরের জলকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে টেনে তুলে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে, তেমনই ওই মহাকর্ষ বল পৃথিবীর অভ্যন্তরের অর্ধগলিত ম্যাগমার উপরে অতি ধীরগতিতে ভেসে বেড়ানো ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর গতিকে প্রভাবিত করে জোয়ার-ভাটা নিয়মিত দৈনন্দিন ঘটনা কিন্তু, ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর চ্যুতি নিত্য দিনের নয়
চাঁদ সূর্যের সম্মিলিত মহাকর্ষ বলের মান নির্ভর করে চাঁদ, সূর্য পৃথিবীর আপেক্ষিক অবস্থানের উপর যেমন, পূর্ণিমা অমাবস্যায় এই আকর্ষণ বল যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় ফলে, জোয়ার-ভাটার তীব্রতা ওই দুই সময় বেশি হয় এবং মানতে অসুবিধে নেই যে, একই কারণে ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর চ্যুতি বা সরণের ব্যাপারে পারস্পরিক রেষারেষিও পূর্ণিমা অমাবস্যায় বৃদ্ধি পায় কিন্তু, এই সম্মিলিত মহাকর্ষ বল আবার সব পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সমান থাকে না কেন থাকে না, সে ব্যাখ্যাও সহজ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে এই পরিক্রমণ-পথে চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখন সেই অবস্থানকে বলে অনুসুরবা ‘perigee’ এবং যখন সবচেয়ে দূরে থাকে, তখন সেই অবস্থানকে বলে অপসুরবা ‘apogee’
যেহেতু, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কমে-বাড়ে, তাই প্রতি পূর্ণিমায় অমাবস্যায় পৃথিবীর উপর চাঁদের আকর্ষণ বল সমান থাকে না উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, কোনো এক পূর্ণিমায় বা অমাবস্যায় চাঁদ অনুসুরঅবস্থানে আছে ওই অবস্থানে চাঁদকে ১২ থেকে ১৪% বড়ো দেখায়... অমাবস্যায় দেখা যায় না, পূর্ণিমা হলে দেখা যায় এবং সেই বড়ো আকারের চাঁদকে বলে সুপার মুন এই দু'টি ক্ষেত্রে আকর্ষণ বলের মান বেশি হওয়ায় এক বা একাধিক ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটের চ্যুতি বা সরণ ঘটার সম্ভাবনা বাড়ে আর যদি সত্যিই তা ঘটে, তবেই  ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘অপসুরঅবস্থানে চাঁদ থাকলে এই বলের মান কম হয়
এবার আসা যাক সূর্যের কথায় যে কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবী, সেটিও উপবৃত্তাকার হওয়ায় জানুয়ারি মাসে সূর্যের দূরত্ব ৫০ লক্ষ কিলোমিটার কমে যায় আর জুলাইতে সূর্য থাকে দূরতম অবস্থানে অতএব, এটা পরিষ্কার যে, যদি কোনো বছরের জানুয়ারিতে পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় চাঁদ রয়েছেঅনুসুরঅবস্থানে, তবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটের চ্যুতি বা সরণের পক্ষে ব্যাপারটা খুবই অনুকূল হয় আর যদি আরও একধাপ এগিয়ে এমন হয় যে, সেই পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ অথবা অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ ঘটছে, তাহলে চন্দ্র-সূর্যের সম্মিলিত আকর্ষণ-বলের প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয়৷ কারণ - গ্রহণের সময় চাঁদ, পৃথিবী সূর্য এক সরলরেখায় অবস্থান করে অর্থাৎ, যদি সময়টা জানুয়ারি... চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ চলছে আর চাঁদ আছেঅনুসুরঅবস্থানে, তবে চাঁদ সূর্যের সম্মিলিত আকর্ষণ-বল সর্বাধিক হয় এবং নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটের চ্যুতি ঘটে গিয়ে ভূমিকম্প হওয়ার সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেদিনপৃথিবীর বড়ো বড়ো ভূমিকম্পের সময়কাল যে পূর্ণিমা/ অমাবস্যা বা তার খুব কাছের কোনো দিন, তা আগেই উল্লেখ করেছি
যদি চাঁদ না থাকত, তবে সাগর-মহাসাগরে মৃদু জোয়ার-ভাটা হত সূর্যের স্বল্প মহাকর্ষ-বলের প্রভাবে এবং পৃথিবীর আহ্নিকগতির দরুন সূর্যের ভর চাঁদের ভরের তুলনায় অনেক গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বহু দূরে থাকার জন্যে সাগর-মহাসাগরের জলের এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটগুলোর উপর সূর্যের মহাকর্ষের প্রভাব অনেকটাই কম তাই, চাঁদের অনুপস্থিতিতে প্লেটগুলোর নিরন্তর অস্থিরতা থাকত না এবং পৃথিবীজুড়ে বড়োসড়ো ভূমিকম্প হতই না আর প্লেটের চ্যুতিই যদি না ঘটত তবে ভূমিকম্প-জনিত কারণে সুনামি উদ্ভূত হত না, অর্থাৎ, ভূমিকম্প সুনামির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পিছনে চাঁদই প্রধান প্রোটাগনিস্টের ভূমিকা পালন করছে

কিন্তু, লাখ টাকার প্রশ্ন হল - কখন এবং কোথায় বড়োসড়ো ভূমিকম্প হবে, তার পূর্বাভাস দেওয়া কি সম্ভব? টোকিওর ইলেকট্রো কম্যুনিকেশনস’-ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মাশাশি হায়াকাওয়া এবং তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের গবেষণা-পত্রে ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে একটি নতুন পদ্ধতির কথা বলেছেন মাশাশির মতে - যেহেতু, বড়ো বড়ো ভূমিকম্পের কারণ ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্লেটের চ্যুতি, তাই লিথোস্ফিয়ারবা ভূত্বক’-এর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটবেই এবং সে পরিবর্তন শুরু হবে ভূমিকম্পের কয়েকদিন আগেই স্পষ্টতই, পৃথিবীর চারপাশের তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণই ভূমিকম্পের আগাম সতর্ক-বার্তা দিতে পারবে অত্যন্ত নিম্ন কম্পাঙ্কের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই
জাপানের ভূ-পদার্থবিদ প্রফেসর সাতোশি ইদে টোকিওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে বহু বহু গবেষণা চালিয়ে নিশ্চিতভাবে বলেছেন অতীতের সব বড়ো ভূমিকম্পের পিছনে রয়েছে চাঁদ সূর্য, যারা ভূত্বকে মানে লিথোস্ফিয়ারে আলোড়ন (strain) সৃষ্টি করেছে এবং বলেছেন - তাঁদের গবেষণালব্ধ ফল বড়ো ভূমিকম্পের উন্নততর পূর্বাভাস-পদ্ধতির সন্ধান দিতে পারবে আমরা আশাবাদী হতেই পারি
এছাড়া দেখা গেছে যে, ভূমিকম্পের আগে কোনো কোনো প্রাণীর আচরণে কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা অন্য সময়ের বিচারে অস্বাভাবিক এক বিশেষ ধরনের মাছের চঞ্চলতা লক্ষ করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পেয়েছেন কোনো কোনো দেশের বিজ্ঞানীমহল
২০১৫- ২৫ এপ্রিলে নেপালের স্থানীয় সময় ১১টা ৫৬ মিনিটে নেপালে আঘাত হেনেছিল . মাত্রার ভূমিকম্প, যার প্রভাবে কেঁপে উঠেছিল উত্তর ভারত উত্তর পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ওই ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ আগে জলপাইগুড়িতে পোষা কয়েকটি হাতি শুঁড় তুলে এবং মাথা দুলিয়ে কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছিল প্রাণীদের এরকম আচরণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন আসলে, ওইসব প্রাণীদের হয়তো তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের পরিবর্তন বোঝার ক্ষমতা রয়েছে, যা কিনা উন্নত প্রাণী মানুষের নেই
-------
তথ্যসূত্র:
) Vol ৭৪, জুলাই-অগস্ট, ২০০৮-এর ‘Science And Culture'- প্রকাশিত দেবব্রত দাশের article ‘The Moon and Earthquake'
) Vol ৭৭, মে-জুন, ২০১১- ‘Science And Culture'- প্রকাশিত দেবব্রত দাশের article, ‘Earthquake and Its Prediction'
) Vol ৮২, নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০১৬- ‘Science And Culture'- প্রকাশিত দেবব্রত দাশের article ‘Moon - The Main Protagonist Behind Earthquakes'.
----------
ছবি - আন্তর্জাল
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment