![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjn7psUUIl2pSsoyoaNpgjxHNyK88iSjrhRsK35wxJjt96Sgw7QwFNw7msmSLRiVefPTtllelqDTKWxj8Y6HW9FkpAxeFIgEBg0RdEPXIHzNTkPQarK755116Btt_vo0dYQT3Dv0wW1gpLTPFgDj3F06BKPMY1D52gHsUceBwdzLN5bV3xmtWGQWAJojQ/w640-h532/banorendra.jpg)
বানরেন্দ্র পটকুচন্দ্রের কীর্তি
পল্লবী মালো
এ গল্প আজকের নয়... বহুকাল
আগের কথা!
সে সময়টা ছিল একেবারে অন্যরকম।
আজকের মতো তখন চারপাশে সারি-সারি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর ফ্যাক্টরি ছিল না। ছিল
দিগন্তবিস্তীর্ণ, সোনালি ধানখেত, শান্ত-সমাহিত তপোবন, ঘন সবুজ বনাঞ্চল
আর ছোটো-বড়ো অনেক গ্রাম। সোনা-রুপো-হিরে-জহরত দিয়ে বানানো
রাজার মহলও ছিল। সেই
মহলের ভিতর ছিল রং-বেরঙের ফুলের বাগান, রাজকীয় রান্নাঘর!
জন্তু-জানোয়ার বলতে তখন রাজমহলের
হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর বার্তাপ্রেরক
হিসেবে পায়রা। গ্রামে-গঞ্জে
কাক-পক্ষী, গরু-মোষ তো ছিলই।
কিন্তু বানর?
রাজপুত্তুর শিকারে গিয়েও
তখন খুঁজতেন পশুরাজ সিংহ, হিংস্র বাঘ নাহলে চিতা...
বানরদের কেই বা পাত্তা দিত?
বনে-জঙ্গলে বা পাহাড়ে দল বেঁধে
ছিল ওদের বাস। গাছের ডালে ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে ফল-মূল চিবোত, কখনও আবার উলটো হয়ে ডিগবাজি
খেত। গ্রামে-গঞ্জেও
আসত ওরা প্রায়ই। দলেবলে
এসে ফলের বাগান মুহূর্তে নিঃশেষিত করে দিয়ে চলে যেত। পথচলতি নিরীহ লোকের হাত থেকে কলা
ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ও দিত।
ওদের দৌরাত্ম্যের কি আর শেষ
আছে? বানরদের পছন্দ করা বা ভালোবাসা তো দূরের কথা, দূর থেকে বানর দেখতে পেলেই তেড়ে
আসত লোকে।
এত কথা বলছি ঠিকই, তবে এটাও
সত্যি যে তারা একেবারে অবাধ্য ছিল না! তাদের উপরও শাসন ছিল।
তা নয় তো কী? বানরদের বুঝি রাজ্য ছিল না? আলবাত
ছিল। সেই
রাজ্যে বানর-হনুমান সব্বাই মিলেমিশে থাকত। রাজাও ছিলেন।
এমনি করেই দিন কাটছিল
ওদের...
হঠাৎ একদিন একটা কাণ্ড হল।
এমন একটা কাণ্ড যা কেউ শোনেনি কোনোদিন।
একটা বাচ্চা বানর, নাম তার
পটকু। বয়স বড়োজোর দু-তিন বছর। মুখে কথা ফুটেছে সবে-সবে। সেই পটকু এসে একদিন এমন
কিছু কথা বলল, যা শুনে সবার চোখ কপালে উঠল। গায়ের উকুনগুলোও নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু
কারোর মাথায় ঢুকল না কিচ্ছুটি। তবে ওর কথাগুলোকে একেবারে ছেলেমানুষি কথাবার্তা
ভেবে ফেলে দেওয়াও সম্ভব না। এই বয়সেই ওর যা ক্ষুরধার বুদ্ধি!
গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ি
থেকেই খাবারের পরিবর্তে বানরদের কপালে জোটে গৃহস্থের হুঙ্কার আর লাঠি-ঝ্যাঁটা।
এরকমই এক বাড়িতে বানরেরা দাপুটে দলপতির নেতৃত্বে লুঠপাট চালানোর চেষ্টা চালিয়েও
যখন বার বার ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন এই পটকুই বুদ্ধি খাটিয়ে, সেই বাড়ির রান্নাঘর থেকে
চুপি চুপি খাবার চুরি করে এনেছিল সবার জন্য।
তাই হাঁটুর বয়সি হলে কী হবে, সেই ঘটনার পর থেকে সমাজে পটকুর বেশ নাম-ডাক হয়েছে।
তখন সূর্যের ঘুম ভেঙেছে।
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে।
এমন সময় আধো-আধোভাবে, জড়ানো
গলায় পটকু এসে বলল, কাল রাতে নাকি ওর স্বপ্নে এসেছিলেন স্বয়ং ভগবান! ভগবানকে আগে
কখনও দেখেনি পটকু। তবে মানুষের গ্রামে-গ্রামে যে মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বলে, পটকুর
স্বপ্নের জনকে ঠিক যেন সেই মূর্তির মতোই দেখতে। নির্ঘাত ভগবান!
সেই ভগবান পটকুকে বললেন, “তোমার
মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে। বাঁদুরে বুদ্ধি নয়, কাজের বুদ্ধি! তাই তোমাকেই বলতে এসেছি,
একটা গোপন কথা। শুধু গোপন নয়, গোপনতম কথা! যদিও বিশাল এই সৃষ্টির কোনো গোপন কথাই
আমার কাউকে বলা উচিত নয়। তবুও তোমাকে বলছি। কান
পাতো...”
সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল পটকু।
কানটা বাড়িয়ে দিল ভগবানের দিকে।
ভগবানের দিক থেকে সূর্যের
মতো উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।
ভগবান ফিসফিস করে বললেন, “জানো
কি? তোমার মতো বুদ্ধিমান বানরদের থেকেই একদিন মানুষ তৈরি হয়েছে!”
পটকু কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়েছিল শুধু।
গম্ভীর হয়ে ভগবান তারপর
বললেন, “এত কথা তোমাকে বললাম, তার একটা কারণ আছে। মনুষ্যনির্মিত সমাজে তোমাদের
করুণ অবস্থা দেখে আমি নিতান্তই দুঃখিত। তোমরাও আমার সন্তান! তোমরা, বানরেরা, নিজেদের
কখনও অবাঞ্ছিত বা অবহেলিত মনে কোরো না। মানুষের মতো জীবজগতের শ্রেষ্ঠতম জীবের পূর্বসূরি
তোমরা, বুঝলে তো! রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি বা গাছে-গাছে ঘুরে বেড়ানো নয়, বড়ো কিছু
কর... যাও স্বজাতিকে গিয়ে বোঝাও! দেরি কোরো না।”
পটকু তখনও মাথা চুলকাচ্ছিল।
দেখে ভগবান আবার বললেন,
“বিশ্বাস হচ্ছে না তো? স্বজাতির মহিমা সম্পর্কে তোমরা এতটাই উদাসীন! আশ্চর্য লাগে
আমার! এই মুহূর্তেই আমি দৈববাণী করছি, কয়েকযুগ পরে আসবে কলিকাল, সেই কলিকালে জন্ম
নেবে এক আপনভোলা ছেলে।”
সেই ছেলেটার নাম যে ভগবান
কী বলেছিলেন... পটকুর ঠিকঠাক মনে নেই।
ডারিন না ডারুন না ডারউইন,
কী যেন একটা...
হ্যাঁ, ডারউইন! ডারউইন।
প্রকৃতির মধ্যেই হেসে খেলে
ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই নাকি একদিন সে খুঁজে বের করবে সৃষ্টির গোপন রহস্য...
“তখনই সব্বাই জানতে পারবে,
বানর আর মানুষের মধ্যে আসলে রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। একজন পূর্বসূরি তো অন্যজন
উত্তরসূরি! বুঝলে?”
পটকু কিছু বলতে যাবে এমন
সময়েই ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। ভগবানের
কথা যে ও পুরোটা বুঝেছে তা নয়। তবে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করেছে। এবং এটাও বুঝেছে
যে ভগবান যা বলেছেন কাল, সক্কলের সেটা জানা দরকার।
পটকুর স্বপ্নের কথা শুনে
বানরেরা ওকে তক্ষুনি কাঁধে তুলে নিয়ে গেল কিস্কিন্ধ্যা পর্বতের রাজগুহায়।
বানররাজ চুপ করে পুরোটা
শুনলেন। মুখে
কিছু বললেন না। শুধু চোখে ইশারা করলেন মন্ত্রীমশাইকে। এর অর্থ পরামর্শ চাই।
মন্ত্রীমশাইয়ের বুদ্ধির
তারিফ আর কী করব! গেল বছর দাবানলে যখন এত্তবড়ো জঙ্গলটা পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল,
তখন মন্ত্রীমশাইয়ের একার বুদ্ধিতেই বানরেরা বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়। না হলে গাছের ফলমূল ছাড়া বানরদলের
বেঁচে থাকার কথা ভাবাও যায় না।
তিনি যে বাকিদের থেকে একটু
হলেও বেশি বোঝেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মন্ত্রীমশাই কপাল কুঁচকে বললেন,
“অসম্ভব কিছু না। হতেই পারে। শিশুদের মন পরিষ্কার হয়। তাই হয়তো ভগবান...”
তাঁর কথা সবাই মানল। মানে
পটকুর কথা সত্যি, সর্বৈব সত্যি!
তাহলে এখন করণীয় কী?
বড়ো কিছু করতে হবে... যাতে
মানুষ আর তাদের অবজ্ঞা করতে না পারে!
এমন বড়ো কাজ কী হতে পারে?
কী হতে পারে?
ভাবতে বসল সবাই।
ভাবতে-ভাবতে বেলা গড়িয়ে
রাত হল, রাত পেরিয়ে আবার দিন...
গাছের ডালে ল্যাজ পেঁচিয়ে
ডিগবাজি খাওয়া, ফল খাওয়া আর গৃহস্থের বাড়ি থেকে খাবার চুরি করা ছাড়া আর কাজ কী-ই
বা হতে পারে? মাথায় এল না কিছু কারও।
এমন সময় পটকুই প্রথম
চেঁচিয়ে উঠল। আনন্দে
আত্মহারা হয়ে এ গাছ থেকে ও গাছে লাফাতে লাগল।
সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আরে হলটা কী?”
পটকু বলল, “পেয়েছি কাজ; বড়োরকমের
কাজ! কিন্তু সেটা করতে হলে আগে আমাদের বুঝতে হবে সেটা করতে হয় কীভাবে?”
সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
তাকিয়ে থাকতে দেখে পটকু বলল, “চলো, তোমরা সবাই আমার সঙ্গে চলো! আমাদের যেতে হবে, মানুষের
গ্রামে, রাজমহলে, বাগানে, খেতে...!”
জঙ্গল থেকে বেরিয়েই বানরের
দল ভাগ হয়ে গেল অনেকগুলো। একদল গেল
গ্রামে, আরেক দল রাজপ্রাসাদে, অন্যদল খেতে।
শুরু হল এক অভিনব অভিযান...
শুরুতেই পটকু বলে রেখেছিল,
“বন্ধুগণ, আমাদের আজকের অভিযানের উদ্দেশ্য কোনো দৌরাত্ম্য, হামলা, বিশৃঙ্খলা
সৃষ্টি বা চুরি নয়! আজকে আমরা গিয়ে শুধু দেখব। যাকে বলে পর্যবেক্ষণ! সঠিকভাবে
পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো কিছু শেখা সম্ভব নয়।”
সবাই পটকুর বিচক্ষণতা আর
বুদ্ধি দেখে অভিভূত হল। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনল ওর কথা, অক্ষরে-অক্ষরে পালন করল
সবটা...
গ্রামে পৌঁছে বানরেরা বসে রইল
এক কোণায়। বউ-ঝিয়েরা ঝাঁটা হাতে দৌড়ে এল। কিন্তু বানরেরা কোনো অনিষ্ট করছে না দেখে
থতোমতো খেয়ে ফিরে গেল।
সারাদিন বসে-বসে বানরেরা
দেখল কীভাবে মেয়েরা ধান ঝেড়ে গোলায় ভরছে, সবজি কাটছে, উনুনে ভাত চাপাচ্ছে।
বাচ্চারা তপোবনের পাঠশালায় লেখা-পড়া করছে, আঁকছে, গান গাইছে... মায়েরা সুর করে করে
ঘুম পাড়াচ্ছে শিশুদের।
রাজমহলে বসে দেখল বাগানের
মালি কেমনভাবে ফুলগাছে জল দিচ্ছে।
বানরেরা বুঝল, কতরকমের বড়ো-বড়ো
কাজ রয়েছে করার মতো। এই
কাজগুলো করতে পারে বলেই ওরা মানুষ, আর পারে না বলেই এরা বানর! নাহলে আর তফাত কীসে?
স্বয়ং ভগবান বলেছেন, মানুষ আর বানর একে অপরের আত্মীয়!
পর্যবেক্ষণের পালা শেষ। এরপর
শুরু হল চেষ্টা...
একসময় গৃহস্থের বাড়িতে লুঠপাট
চালিয়ে বানরের দল তালপাতার খাতা, খাগের কলম, নূপুর-বাদ্য, হাঁড়ি-কলসিসহ মনুষ্যব্যবহৃত
বহু জিনিসপত্র এনেছে। কিন্তু
তখন ওগুলোর ব্যবহার ছিল অজানা।
এখন জেনেছে ওরা।
রাজকোষাগারে জমা দেওয়া
লুঠপাটের সেই সব সামগ্রী ফিরিয়ে এনে ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হল।
বড়ো কিছু, নতুন কিছু করে
দেখাতেই হবে। মানুষের পূর্বসূরি বলে কথা! সেই সম্মানটা তো আদায় করতেই হবে।
দেখা গেল, সবাই ভুলেই গেছে
কোনটার কী কাজ! কলম দিয়ে আঁক কাটতে হয় আর ছুরি দিয়ে ফল... এটুকুও মনে নেই ওদের।
গান গাওয়ার চেষ্টা করতে
গিয়েও ঘটল আরেক কাণ্ড।
রাজসভায় গান শেখাতেন যে
গুরুমশাই, তাঁর ফেলে দেওয়া পুরোনো একটা ভাঙাচোরা হারমোনিয়াম এককালে নিয়ে এসেছিল
ওরা।
সেই হারমোনিয়ামের রীডের
উপর দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে চারপায়ে দৌড়ে গেল দুটো বানর। অন্য দু’জন এসে হারমোনিয়ামের
বেলোটা ধরে দিল হ্যাঁচকা টান।
হারমোনিয়ামটা যেন
আর্তচিৎকার করে উঠল!
সঙ্গে তবলাও ছিল। তবলার
উপর বসে দুই বানর মিলে লাফাতে লাগল পুরোদমে। একসময়ে তবলার উপরের পর্দা গেল ছিঁড়ে।
সেইসঙ্গে গলা খুলে চেঁচাতে
শুরু করল ওরা। সেই গলায় সুর ছিল না। ছিল ক্যাঁই-কিচির, ক্যাঁই-কিচির শব্দ। ওটাই
ওদের গান!
গোধূলিবেলায় শুধু সূর্য
নয়, সূর্যের সঙ্গে ঘুমোতে যায় অনেক পশু-প্রাণী। সেইসময় এমন বিকট অর্কেস্ট্রা শুনে মেজাজ
সপ্তমে চড়ল বাঘ-সিংহ-গণ্ডার-হরিণ-ভালুক... সকলের। জঙ্গলে হই-হই-রই-রই রব উঠল। চমকে
গেল পাখিরা। সুরেলা কোকিল এসে বানরদের গান শেখার আড়ম্বর দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে উড়ে গেল
আকাশে। শেয়ালের দল ডাকতে শুরু করল হুক্কা-হুয়া।
খাতা-কলম নিয়ে বসেও সে এক
হুলুস্থুলু কাণ্ড!
খাগের কলমের মুখে কালি
লাগাতে গিয়ে নিজেরাই হাতে-মুখে-পায়ে কালি মেখে বসে রইল। তারপর একে অন্যকে দেখে
শুরু হল হাসাহাসি, এবং শেষমেশ মারামারি। কিছুতেই বাগে আনা যায় না কলমটাকে। খাতার
উপর চেপে ধরে যেই না একটা আঁক কাটতে যায়, অমনি হয় আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যায় কলম,
নয়তো খাতা ছিঁড়ে ফুটো-ফাটা হয়ে যায়। কেউ কেউ তো আবার গাছের ডালে ঘষে-ঘষে, পাথরের
গায়ে আছাড় মেরে আস্ত কলমটাকেই ভেঙে ফেলল।
বানরদের এই ল্যাজেগোবরে
অবস্থা দেখে পটকু মনমরা হয়ে বসে রইল কয়েকদিন।
মনে-মনে ভাবল, এদের দ্বারা
কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছুটি না! এদের না আছে বুদ্ধি, না চিন্তাশক্তি, না আছে ধৈর্য!
মানুষের পূর্বসুরি না ছাই! লজ্জা, লজ্জা!
পটকুর আত্মবিশ্বাস ভেঙে
পড়ার উপক্রম হল।
এমন সময়ে একটা সুবর্ণ সুযোগ
এল কিছু করে দেখানোর...
বেশ কিছুদিন হল দুই রাজকুমার
এসেছেন ওদের কিষ্কিন্ধ্যায়। সুঠাম দেহ, উজ্জ্বল গায়ের রং, চোখে-মুখে বুদ্ধি, সাহস
আর বীরত্বের ছাপ।
তবে দেখলেই বোঝা যায়, দু’জনেরই
মন খুব খারাপ।
ওঁরা দু’জন ভাই। অযোধ্যা
রাজ্যের রাজপুত্র। একজন ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ রামচন্দ্র, অন্যজন তাঁর প্রাণাধিক
প্রিয় ভাই লক্ষ্মণ। পিতার আদেশে বনবাসে এসেছিলেন ওঁরা চোদ্দ বছরের জন্য। সঙ্গে রামচন্দ্রের
স্ত্রী সীতাদেবী।
এরই মধ্যে লঙ্কার দুষ্ট রাক্ষসরাজা
রাবণ এসে সীতাদেবীকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে চলে যান। তারপর থেকেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে
সীতার খোঁজ করে চলেছেন দুই ভাই।
খুঁজতে খুঁজতে এসে
পৌঁছেছেন এখানে, বানরদের রাজ্য, কিষ্কিন্ধ্যায়।
পটকু এ পর্যন্ত সমস্তটাই
জানে। এও জানে যে, তাদের নতুন রাজামশাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজকুমারদের
দিকে।
কিন্তু ঠিক কী সাহায্য চাই
সেই রাজকুমারদ্বয়ের, কে জানে!
পটকুর প্রশ্নের ধোঁয়াশা
কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না।
শোনা গেল, সাগরপারের
লঙ্কায় নাকি সত্যিই বন্দিনী রয়েছেন সীতাদেবী! তাঁকে উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন
রামচন্দ্র। তাই
বানররাজ ঘোষণা করলেন নিজের সেনাবাহিনী দিয়ে রামচন্দ্রকে দুষ্ট রাবণরাজের বিরুদ্ধে
যুদ্ধে সাহায্য করবেন।
স্বর্ণলঙ্কার রাক্ষসদের
শক্তি, পরাক্রম আর তেজ সম্বন্ধে কে না জানে! তাদের অন্যায় আর অধর্মের বিরুদ্ধে
রামচন্দ্রের ন্যায় আর ধর্মের যুদ্ধ হতে চলেছে শীঘ্রই! বিশাল এক যুদ্ধ! আর সেই
যুদ্ধের শরিক হবে বানরেরা। নিজেদের যোগ্য সম্মান ফিরে পাওয়া, অধিকার বুঝে নেওয়ার
জন্য এর চেয়ে বড়ো সুযোগ আর কী হতে পারে?
সাধারণ বানরপ্রজা অতশত
বোঝে না। পটকু গাছে-গাছে গিয়ে বোঝাল সবাইকে।
বানরসেনাকে আরও শক্তিশালী
আর বড়ো করে তোলা হল। পটকু নিজেও যোগ দিল সেনায়। ওর দেখাদেখি কাঁচা বয়সের অনেক
বানরও এগিয়ে এল।
এবার যুদ্ধে যাওয়ার
প্রস্তুতি শুরু।
এক সমস্যার কূল পাওয়া যায়
তো অন্য আরেক সমস্যা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এতদিনে সবার খেয়াল হল,
সাগরপারের লঙ্কায় যুদ্ধ করতে যাওয়া তো মুখের কথা নয়! এই সুবিশাল সমুদ্র পেরোনো হবে
কীভাবে?
এখন উপায়?
বানর সেনাপতি, মন্ত্রী আর
রাজা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, সেতু তৈরি হবে পাথর দিয়ে সমুদ্রের উপর। সেই সেতুর উপর
পা ফেলে-ফেলে বানরেরা পৌঁছে যাবে সুদূর লঙ্কায়।
পটকুও সায় দিল এই
সিদ্ধান্তে। সামনে এগিয়ে এসে, একা হাতে উদ্যোগ নিয়ে একজোট করল সবাইকে। পটকুর কথা
সবাই চোখ-কান বুঝে বিশ্বাস করল। ভরসা করল ওকে।
সবাই বুঝল, “সত্যিই তো!
অকূল সমুদ্রের বুকে সেতু বানানোর মতো বড়ো কাজ আর কী হতে পারে? এরকম কাজ কেউ
কোনোদিন দেখেনি, শোনেওনি। এই কাজের পরে নিশ্চয়ই যোগ্য পূর্বসূরির সম্মান পাওয়া
যাবে!”
তারপর...
দিন-রাত এক করে লাখো-লাখো
বানরসৈন্য, ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বুড়ি সবাই একত্রিত হয়ে সমুদ্রের বুকে পাথরের পর পাথর
ফেলে বানাল লম্বা একখান সেতু; যে সেতু এই ভূখণ্ডের সঙ্গে ওই ভূখণ্ডের ব্যবধান
ঘুচিয়ে দিল। অজেয় সমুদ্রকেও জয় করা সম্ভব হল!
এরপর বহুদিন ধরে চলল
রাম-রাবণের যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে জয় হল রামচন্দ্র আর বানরদের।
পটকু বানরদলের পরবর্তী রাজা-মন্ত্রী
বা সেনাপতি হয়নি ঠিকই, তবে সবার ভালোবাসায় পেয়েছিল এক বিশেষ উপাধি...
“শ্রী শ্রী বানরেন্দ্র
পটকুচন্দ্র! বানরকুলের বুদ্ধি, বানরদলের গর্ব!”
কিন্তু ইতিহাস বেইমান! সব
কথা লিখে রেখেছে; শুধু ভুলে গিয়েছে সেই বানরেন্দ্রকে, যার বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাসের
জোরেই বানরের দল নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছিল, বড়ো কিছু করে দেখাতে পেরেছিল...
তবে সবকিছুই কি বদলে গেছে?
নিশ্চয়ই না!
আজই যদি দেখতে পান, আপনার
রান্নাঘরের তাক থেকে কলার কাঁদি নিয়ে পালাচ্ছে একদল বানর, অবাক হবেন না। বোঝেনই
তো, স্বভাব যায় না মলেও!
মৃদু ধমক দিয়ে, একটু
ক্ষমা-ঘেন্না করে দেবেন। আপনার-আমার আত্মীয় বলে কথা!
তবে বানরেন্দ্র
পটকুচন্দ্রের কসম, বড়ো কাজ কিছু নিশ্চয়ই করবে ওরা একদিন আবার... করবেই করবে!
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
ম্যাজিক ল্যাম্প ![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgIEREqXPaOaQJlg8GmMYXbYivW9sh_J3PADjiziyDs_qmGvdlg-bJi77x74RN8bHNarVzXDJfMOB0oTvMSxDUL_KQGpgHr3bC2zU2Ydif2hXBqCsMdFspBNzqtRz-kHYK0uuhyGm3Ymah7rznvLFvziyfOutjI8kPplZXXVnB4vjaPItG1K0z7bqmAcQ/s1600/animated-number2.gif)
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgiWqh6a-OD05y2k71Ry9KoXTtzKeydIZxnUjOnzDUKJ2JnIdTbTDKm9OpbwANBE3yPvUQz5p2y13pHWrEmwT_bI96QvNJlw93nVdaKnVTue0EQh5Nw4kh5Y8QQgITMQg2TcLm7APHo_6HNjPgfhwoqAK1EDHr_R6VzZrfAuoeG8KrLqaOeEdP79W7qDg/s1600/animated-number5.gif)
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgIEREqXPaOaQJlg8GmMYXbYivW9sh_J3PADjiziyDs_qmGvdlg-bJi77x74RN8bHNarVzXDJfMOB0oTvMSxDUL_KQGpgHr3bC2zU2Ydif2hXBqCsMdFspBNzqtRz-kHYK0uuhyGm3Ymah7rznvLFvziyfOutjI8kPplZXXVnB4vjaPItG1K0z7bqmAcQ/s1600/animated-number2.gif)
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgiWqh6a-OD05y2k71Ry9KoXTtzKeydIZxnUjOnzDUKJ2JnIdTbTDKm9OpbwANBE3yPvUQz5p2y13pHWrEmwT_bI96QvNJlw93nVdaKnVTue0EQh5Nw4kh5Y8QQgITMQg2TcLm7APHo_6HNjPgfhwoqAK1EDHr_R6VzZrfAuoeG8KrLqaOeEdP79W7qDg/s1600/animated-number5.gif)
No comments:
Post a Comment